বিএনপির গত জাতীয় সম্মেলনে ‘এক নেতার এক পদ’ নীতি গৃহীত হওয়ার পর মহাসচিবসহ কেউ কেউ একটি পদ রেখে বাকি পদ থেকে সরেও দাঁড়িয়েছেন। তবে ভিন্ন যুক্তি দিয়ে ব্যতিক্রম রয়ে গেলেন একজন।। তিনি হলেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।
আগের কমিটির যুগ্ম মহাসচিব রিজভী নতুন কমিটিতে পদোন্নতি পেয়েও হলেন সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব। নির্বাহী কমিটিতে খালেদা জিয়া, তারেক রহমান ও মির্জা ফখরুলের পর গুরুত্বপূর্ণ সাংগঠনিক দায়িত্ব পাওয়ায় রিজভী দপ্তরের দায়িত্ব ছেড়ে দেবেন বলে ধারণা করেছিলেন নেতাকর্মীরা। ফলে বিএনপির একাধিক নেতা আগ্রহী ছিলেন দপ্তরের দায়িত্ব নিতে। কিন্তু রিজভীর আগ্রহের কাছে হতাশায় ডুবলেন তারা।
এ নিয়ে দলের মধ্যে বিরাজ করছে চাপা ক্ষোভ। নেতাকর্মীরা বলছেন, বিএনপির দপ্তর হলো লোভনীয় পদ। সে কারণেই দলের শীর্ষস্থানীয় পদে থাকার পরও দপ্তর দখলে রাখছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সাবেক ছাত্রনেতা।
তবে রিজভীর শিবির থেকে বরাবরই দাবি করা হচ্ছে, দপ্তরের দায়িত্ব আলাদা কোনো পদ নয়। চেয়ারপারসনের নির্দেশে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে তিনি এটা পালন করছেন।
এমন দায়িত্ব পালন অবশ্য রিজভীর জন্য নতুন নয়। ২০০৭ সালের এক-এগারোর পর তখনকার দপ্তর সম্পাদক মফিদুল হাসান তৃপ্তি সংস্কারপন্থী হিসেবে দল থেকে বহিষ্কার হলে কিছুদিন দপ্তরের দায়িত্ব পালন করেন বর্তমান স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান। এরপর থেকে রিজভী আহমেদ দপ্তরের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন।
নেতাকর্মীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছেন, বিএনপিতে কি একজন মানুষও নেই যিনি দপ্তর সম্পাদক হওয়ার যোগ্য। কেন্দ্র ঘোষিত কমিটিতে নতুন অনেক পদ সৃষ্টি করা হলেও দপ্তর সম্পাদকের আলাদা কোনো পদ দেখা যায়নি। রিজভী আহমেদের ‘সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব’ পদের পাশে ব্র্যাকেটে লেখা ‘দপ্তরের দায়িত্বে’।
শুধু তাই নয়, অভিযোগ আছে দপ্তরে ‘সহ’ হিসেবে যাদের রাখা হয়েছে, তারা রিজভী আহমেদের সমর্থক বলে পরিচিত।
নতুন কমিটিতে তাইফুল ইসলাম টিপুকে রাখার পাশাপাশি সহ-দপ্তর সম্পাদক পদে বেলাল হোসেন এবং মুনির হোসেনকে পদায়ন করা হয়েছে। তারা তিনজনই রিজভী আহমেদের ঘনিষ্ঠ। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের মনোনয়ন দেয়া নিয়ে টিপু ও বেলালের বিরুদ্ধে আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগ থাকলেও টিপুকে তিন নম্বর থেকে এক নম্বরে তুলে আনা হয়েছে। আর বেলালকে নির্বাহী কমিটি থেকে সহদপ্তর করা হয়েছে।
রিজভীর ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত নতুন নির্বাহী কমিটির সদস্য হয়েছেন এমন একজন ঢাকাটাইমসকে বলেন, “দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার কারণে রিজভী ভাই যেভাবে দপ্তরের দায়িত্ব পালন করতে পারবেন, অন্যরা সেভাবে পারবে না। এ কারণেই চেয়ারপারসন তাকে আবার এই অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়েছেন। এটা নিয়ে রাজনীতি করার কিছু নেই।”
জাতীয় কাউন্সিলের প্রায় পাঁচ মাস পর বিএনপির পূর্ণাঙ্গ জাতীয় নির্বাহী কমিটি ঘোষণা করা হয়। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সংবাদ সম্মেলনে কমিটির নামগুলো ঘোষণা করেন।
গত ১৯ মার্চ বিএনপির ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। ওই কাউন্সিলের মাধ্যমে বিএনপির গঠনতন্ত্রে ‘এক নেতার এক পদ’র বিধান সংযুক্ত করা হয়। তবে সাময়িক সময়ের জন্য কাউকে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয়ার ক্ষমতা দলীয় চেয়ারপারসনকে দেয়া হয়।
কাউন্সিলের পর গত ২১ মার্চ সংবাদ সম্মেলনে মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, “চেয়ারপারসন যদি মনে করেন, কোনো একটি সুনির্দিষ্ট জেলায় অথবা মহানগরে অথবা অঙ্গসংগঠনে কোনো বিশেষ ব্যক্তিকে সাময়িকভাবে অতিরিক্ত পদে রাখা প্রয়োজন, তাহলে তিনি তা করতে পারবেন। কাউন্সিল তাকে সেই ক্ষমতা দিয়েছে।”
এ ধরনের সিদ্ধান্ত শুধু রিজভী আহমেদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য কি না এমন প্রশ্ন উঠছে নেতাকর্মীদের মধ্যে।
এদিকে অভিযোগ উঠছে, রিজভীর বিরাগভাজন বলে অনেকে তাদের কাঙ্ক্ষিত পদ পাননি নতুন কমিটিতে। এমনই একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকাটাইমসকে বলেন, “শুধু যে আমি তা নয়, রিজভী আহমেদের বিরাগভাজন হওয়ায় অনেক প্রভাবশালী নেতা কাঙ্ক্ষিত পদ পাননি। অনেক যোগ্য নেতা দপ্তর সম্পাদক হতে আগ্রহী ছিলেন, কিন্তু রিজভী সেই সুযোগ দেননি।”
ওই নেতা অভিযোগ করে আরও বলেন, “সিনিয়র নেতারা কমিটি গঠন প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করতে না পারলেও চেয়ারপারসনের কার্যালয়ের প্রভাবশালী এক কর্মকর্তা ও রিজভী আহমেদ সেই সুযোগ পেয়েছেন। ফলে এমনটা হয়েছে। দেখবেন আরও অনেকে পদ ছেড়ে দিতে পারেন।”
জানা গেছে, দপ্তর সম্পাদক পদে ড. আসাদুজ্জামান রিপন, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, এ বি এম মোশাররফ হোসেন আগ্রহী ছিলেন। তারা নিজেদের বলয়ে লবিং-তদবিরও চালিয়েছিলেন। কিন্তু সেসব কোনো কাজে আসেনি রিজভীর প্রভাবের কারণে।
নতুন কমিটিতে রিপনকে বিশেষ সম্পাদক, এ্যানীকে প্রচার সম্পাদক ও মোশাররফকে প্রশিক্ষণ সম্পাদক করা হয়।
এ ছাড়া আরও অনেকে দপ্তরের দায়িত্ব পাওয়ার জন্য আগ্রহী ছিলেন। গত কমিটির দুজন সহ-দপ্তর সম্পাদকও এদের মধ্যে ছিলেন বলে জানা গেছে।
অভিযোগ আছে, রিজভী আহমেদের বিরাগভাজন হওয়ায় সহ-দপ্তর সম্পাদক আব্দুল লতিফ জনি ও কৃষিবিদ শামীমুর রহমান শামীমের অবনমন হয়েছে। জনিকে নির্বাহী কমিটির সদস্য করা হয়েছে। আর শামীমকে সহ-প্রচার সম্পাদক করা হয়েছে। তার অভিযোগ, দলের জন্য কাজ করলেও একই মানের অন্য পদে জুনিয়রদের পরে পদ দেয়া হয়েছে তাকে।
এরই মধ্যে শামীম দলের মহাসচিবের কাছে সহ-প্রচার সম্পাদকের পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন।
শুধু তাই নয়, বিদায়ী কমিটির সহ-দপ্তর সম্পাদক আসাদুল করিম শাহীনকে নতুন কমিটিতে সহ-প্রচার সম্পাদক করা হয়েছে। তিনি আগের পদে বহাল থাকা কিংবা কোনো সম্পাদকীয় পদের প্রত্যাশী ছিলেন বলে তার ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা যায়।
গ্রেপ্তার আতঙ্কে আত্মগোপনে থাকা রিজভী আহমেদের সঙ্গে এসব বিষয় কথা বলতে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে তার ব্যক্তিগত মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়।
তবে আংশিক কমিটি ঘোষণার পর তিনি দপ্তরের দায়িত্ব ছেড়ে দেবেন কি না এমন প্রশ্নে রিজভীর বক্তব্য ছিল, “সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে একাধিক পদে কেউই থাকবে না। পদত্যাগ করার পর যে পদগুলো খালি হবে ওই সব পদে কাকে দায়িত্ব দেয়া হবে এ সিদ্ধান্তের কারণেই সময় লাগছে।”
অতিরিক্ত পদ কবে ছাড়বেন এমন প্রশ্নে রিজভীর বক্তব্য ছিল, “এটা আমার পদ না। আমি দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব। পদত্যাগ করারও কিছু নেই। এই পদে বা দায়িত্ব অন্য একজনকে দিলেই আমি সরে যাব। কাকে দায়িত্ব দেবেন সেটা চেয়ারপারসন জানেন।”
(ঢাকাটাইমস/০৯আগস্ট/মোআ)