ঢাকা: স্বাধীনতাবিরোধী দল জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়ার পর থেকেই সমালোচনায় বিদ্ধ হচ্ছে বিএনপি। গত দেড় যুগ ধরেই নানা দুর্নাম গায়ে মেখেই একসঙ্গে চলেছে দুই দল।
দুই দফা আন্দোলনের নামে নজিরবিহীন নাশকতা, একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে শীর্ষ নেতাদের ফাঁসি আর জঙ্গি তৎপরতায় সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠার কারণে জামায়াত এখন আর বিএনপির সম্পদ নয়, বোঝা- এমন কথা বলছেন খোদ বিএনপিপন্থি বুদ্ধিজীবীরা।
আর জঙ্গিবিরোধী জাতীয় ঐক্যের ডাক দেয়ার পর ‘এবার জামায়াত ছাড়ার সময় এসেছে’- এ ধরনের বক্তব্য খোলামেলাভাবেই দিয়েছেন বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতারা। দলটির চেয়ারপারসনের জঙ্গিবিরোধী জাতীয় ঐক্যের ডাক, জামায়াত না ছাড়লে কোনো ঐক্য নয় বলে সরকারি দলের নেতাদের প্রতিক্রিয়া এবং এরপর ঐক্যের স্বার্থে বিএনপির জামায়াত ত্যাগের সম্ভাবনার কথা গণমাধ্যমে আসতে থাকে। এ কারণেই বিএনপির জামায়াত ছাড়ার প্রসঙ্গ বেশ গুরুত্ব পায় রাজনৈতিক অঙ্গনে।
তাহলে কি বিএনপি প্রায় দেড় যুগ পর জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করছে? করলে সেটা কবে?-এমন প্রশ্ন ঘুরে বেড়ালেও জবাব পাওয়ার সুযোগ নেই।
জামায়াত ছাড়ার প্রসঙ্গ আগেও এসেছিল
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর একবার বিএনপির জামায়াত ত্যাগের প্রসঙ্গ সামনে এসেছিল। বিদেশি একটি পত্রিকায় দেয়া সাক্ষাৎকারে জোট নেত্রী খালেদা জিয়া বলেছিলেন, জামায়াতের সঙ্গে তাদের জোট কৌশলগত, সময় আসলেই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তখন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা খালেদা জিয়ার এই বক্তব্যকে জামায়াত ছাড়ার ইঙ্গিত হিসেবেই দেখেছিলেন। এর পর উপজেলা নির্বাচন নিয়ে দুই দলের মধ্যে দূরত্ব, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে জামায়াতের দলীয়ভাবে অংশ নেয়ার অযোগ্যতা এবং আরও কিছু বিষয়ে মতবিরোধের পরও এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়নি বিএনপি।
এখনও কৌশলী বিএনপি
সম্প্রতি জামায়াত নিয়ে বিএনপিপন্থি বুদ্ধিজীবী এমাজউদ্দীন আহমেদের একটি বক্তব্য নিয়ে বেশ তোলপাড় হয়েছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। এই বুদ্ধিজীবী এক আলোচনা সভায় বলেছিলেন, জামায়াত বিএনপির জন্য আর সম্পদ নয়, বোঝা। আর খালেদা জিয়াও বুঝতে পেরেছেন এই দলকে ওইভাবে আর প্রয়োজন নেই।
গত এক বছর ধরে বিএনপির নীতি নির্ধারণে এই বুদ্ধিজীবীর ভূমিকার কারণে এমাজউদ্দীনের এই বক্তব্যকে বিএনপির জামায়াত ছাড়ার ইঙ্গিত হিসেবেই দেখছে গণমাধ্যম। কিন্তু পরদিন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বক্তব্য আবার ধোঁয়াশা তৈরি করে। ফখরুলের দাবি, এমাজউদ্দীনের বক্তব্য ব্যক্তিগত। এটা বিএনপির অবস্থান নয়। আর জামায়াতের প্রতিক্রিয়া ছিল আরও কড়া। এতদিন যে বুদ্ধিজীবীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিল দলটি সেই তাকেই আক্রমণ করে বিবৃতি দেয় মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে বিচারের মুখোমুখি দলটি।
জামায়াতের বিবৃতিতে বলা হয়, এমাজউদ্দিনের এমন বক্তব্য দেয়ার অধিকার নেই, তাকে ২০ দলীয় জোটে মুখপাত্র করা হয়নি। এমাজউদ্দীন বিশেষ কোনো গোষ্ঠীর এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছেন কি না, এমন সংশয়ের কথাও জানায় জামায়াত।
এই অবস্থায় নতুন করে আবার প্রশ্ন এসেছে বিএনপি কবে সিদ্ধান্ত নেবে। নেতারা স্পষ্ট করে কিছু না বলে কৌশলী উত্তর দিচ্ছেন। দলটির নীতিনির্ধারকরা বলছেন, জামায়াতের সঙ্গে জোট সম্পূর্ণ রাজনৈতিক। নানা সময় এ নিয়ে কথা হয়েছে। এগুলো মেনে নিয়েই জোট টিকিয়ে রেখেছে বিএনপি। কোনো চাপে পড়ে তাদের দৃষ্টিতে ভোটের জন্য লাভজনক জোট ভাঙা উচিত হবে না বলে মনে করছেন বিএনপি নেতারা।
বিএনপি নেতাদের আশঙ্কা, জোট ভেঙে দিলে সরকারি দলের সঙ্গে জামায়াত আঁতাত করতে পারে। সে ক্ষেত্রে ভোটে তাদের চার থেকে পাঁচ শতাংশ সমর্থন বিএনপির বাক্সে যোগ হবে না। আর এতে আওয়ামী লীগকে মোকাবেলা করা কঠিন হবে।
বিএনপি নেতারা বলছেন, আদালত কর্তৃক জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ হলেও সুযোগ থাকার পর সরকার এটি করছে না। তার মানে সরকার দলটিকে নিয়ে খেলতে চাইছে। এ ক্ষেত্রে বিএনপির কৌশলী না হওয়ার সুযোগ নেই।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘বিএনপিকে তো জামায়াতকে বাদ দেওয়ার প্রয়োজন হয় না। সরকার চাইলেই নিষিদ্ধ করে দিতে পারে। কিন্তু করছেন না কেন?। আর বিএনপি জামায়াতকে বাদ দিলে তারা যে জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক করবেন না এই গ্যারান্টি কী?’
২০০১ সালে জাতীয় নির্বাচনের আগে ভোটের অংক সামনে রেখেই ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে কাছে টানে বিএনপি। নির্বাচনে জামায়াতের ভোটের প্রভাব লক্ষ্য করে এই দলটি থেকে জামায়াতের দুজনকে মন্ত্রী করা হয়। এরপর ২০০৮-এর নির্বাচনের পর চারদলীয় জোটের পরিধি বেড়ে দাঁড়ায় ২০-দলীয় জোটে।
‘অন্যদের’ পেলে ঝুঁকি নিতে পারেন খালেদা জিয়া
বিএনপি নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খালেদা জিয়া জঙ্গিবিরোধী যে জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছেন তাতে সরকার সাড়া না দিলেও এই প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে চায় দলটি। এ জন্য দুই জোটের বাইরে থাকা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলছেন।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, গণফোরাম, বিকল্প ধারা, জেএসডি, নাগরিক ঐক্য এবং কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের নেতাদের সঙ্গে বিএনপি নেতারা জাতীয় ঐক্যের বিষয় কথা বলেছেন। তবে প্রায় সবাই জামায়াত নিয়ে আপত্তি তুলেছেন।
ইতিমধ্যে এসব দলগুলোর এমন মনোভাবের কথা দলের প্রধানকে অবহিত করেছেন বলেও জানা গেছে। কিন্তু বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, জঙ্গিবাদ ইস্যুতে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের প্রশ্নে প্রগতিশীল দলগুলো শেষ পর্যন্ত কী করে তা দেখে জামায়াত নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার চিন্তা করছে বিএনপি। কারণ কোনো দলের সাড়া না মিললেও হঠাৎ করে দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক মিত্রকে ছেড়ে দেয়া বা সম্পর্ক নষ্ট করার কোনো যুক্তি দেখছেন না দলটির শীর্ষ নেতারা।
বিএনপির একজন ভাইস চেয়ারম্যান নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘সবার সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে। তারা কী করে তা দেখে সিদ্ধান্ত নেয়া যৌক্তিক হবে। কারণ শেষ পর্যন্ত কোনো দল জামায়াত থাকার দোহাই দিয়ে আসলো না। আমরাও জামায়াতকে ছেড়ে দিলাম, এটা তো ভুল সিদ্ধান্ত হবে।’
অন্য একটি সূত্র বলছে, জামায়াত নিয়ে নানা আলোচনার ফলে ঐক্য প্রক্রিয়া সামনে নিতে বিএনপিতে ভিন্ন চিন্তাভাবনা চলছে। সেক্ষেত্রে জোট নয়, বিএনপির নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্য হচ্ছে এমনটা ঘোষণা দিয়ে আপাতত ২০দলীয় জোটকে অকার্যকর করে রাখা। এতে জামায়াতসহ জোটের শরিকরাও মনক্ষুন্ন হবে না বলে ধারণা বিএনপির নীতি নির্ধারকদের।
বিএনপির শীর্ষ নেতারা বলছেন, দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে আলাপের পর দুই জোটের বাইরে থাকা নেতাদের সঙ্গে চা চক্রে মিলিত হবেন খালেদা জিয়া। এরই মধ্যে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ নেতা আবদুল কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে খালেদা জিয়ার আনুষ্ঠানিক বৈঠক হয়েছে। তবে কাদের সিদ্দিকী স্পষ্টই বলেছেন, জামায়াতের সঙ্গে বেহেশতেও যেতে চান না তিনি।
অনানুষ্ঠানিকভাবে বিকল্প ধারার নেতারাও খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেছেন বলে শোনা যাচ্ছে। তবে জেএসডি নেতা আ স ম আদুর রবসহ বামপন্থি দলগুলো বিএনপি চেয়ারপারসনের এই চা চক্রে অংশ নেবে কি না তা এখনো অনিশ্চিত রয়ে গেছে।
জাতীয় ঐক্য এবং জামায়াত প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য জমিরউদ্দিন সরকার ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘জাতীয় ঐক্যের ব্যাপারে জামায়াত কোনো বিষয়ই না। মূল কথা হলো শেখ হাসিনা জামায়াতকে লাইক (পছন্দ) করে না বহুকাল ধরে। কিন্তু শেখ হাসিনা বলুক না, জাতীয় ঐক্যে আমি রাজি আছি, জামায়াত থাকলে আমি বসব না। বলবে না। কোনোদিনই বলবে না।’
দুই দলে মান অভিমানও আছে
এই দীর্ঘ সময়ে কখনও কখনও দুই দলের মধ্যে মান অভিমানও হয়েছে। বিশেষ করে মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে রায় আসার পর বিএনপির পক্ষ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখানো, কর্মসূচিতে একাত্মতা প্রকাশ না করে গা এড়িয়ে চলার কারণে জোটের প্রধান দলের প্রতি ক্ষুব্ধ হয় জামায়াত। কখনো কখনো দলটির শীর্ষ মহল থেকে বিএনপির এমন অবস্থানের জন্য কড়া সমালোচনাও করা হয়েছে। ওই সময় গুঞ্জন উঠে বিএনপি ছেড়ে যাচ্ছে জামায়াত। অবশ্য এমন গুঞ্জন আর আলোর মুখ দেখেনি।
বিএনপির জন্য জামায়াতের সুফল-কুফল
২০০১ সালের নির্বাচনে জামায়াতকে জোটে পেয়ে অভাবনীয় ফল করে বিএনপি। প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ভোট প্রায় সমান হলেও ওই সময়ের ক্ষমতাসীন দলের তিন গুণেরও বেশি আসন পায় বিএনপি। ওই নির্বাচনে ফল পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, ৮৫টিরও বেশি আসনে আওয়ামী লীগ পাঁচ থেকে ১০ হাজার ভোটের ব্যবধানে জিতেছে। এসব আসনে জামায়াতের ভোট বিএনপির বাক্সে যোগ হওয়ায় এই ফল হয়েছে বলেই মনে করেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা।
কিন্তু ওই নির্বাচনে জিতে চারদলীয় জোট ক্ষমতায় আসার পর বিএনপি দুই চিহ্নিত আলবদর নেতা মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদকে মন্ত্রিত্ব দিয়ে সমালোচনায় পড়ে। আবার জোট সরকারের আমলে জঙ্গি সংগঠন জেএমবির উত্থান, এই গোষ্ঠীর সঙ্গে জামায়াত-শিবিরের কর্মীদের একাংশের যোগাযোগ, বাংলাভাই মিডিয়ার সৃষ্টি বলে জাতীয় সংসদে নিজামীর বক্তব্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয় দেশে। আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে ‘দেশে স্বাধীনতাবিরোধী বা যুদ্ধাপরাধী বলে কেউ নেই’- বলে মুজাহিদের বক্তব্যের পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলন আবার তীব্র হয়।
আর ২০০৮ সালের নির্বাচনে জামায়াতের ভোটও বিএনপির জন্য যথেষ্ট প্রমাণ হয়নি। আবার আওয়ামী লীগ সরকারবিরোধী আন্দোলনে নজিরবিহীন নাশকতায় দেশ বিদেশে সমালোচিত হয় জামায়াত-শিবির। এরপর জামায়াত ছাড়তে বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে পরিচিত বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সংস্থাও বিএনপিতে পরামর্শ দিতে থাকে।
(ঢাকাটাইমস/৪এপ্রিল/বিইউ/ডব্লিউবি)