কদিন আগের কথা। জাতীয় পত্রিকার একজন সাংবাদিক গেছেন বাসা ভাড়া করতে। মা মারা গেছেন। বাবাকে নিয়ে ঢাকায় থাকবেন। টু-লেট দেখে বাড়িওয়ালার কাছে গেলেন। সঙ্গে বাবাও। কথা হচ্ছে বাড়িওয়ালার সঙ্গে।
: আপনার বাড়ি তো পাঁচ তলা। টু-লেট দিয়েছেন। ভাড়া হবে কোন তলায়?
চতুর্থ তলায়।
: রুম কয়টা?
দুটো বেড, ডাইনিং, ড্রইং, কিচেন, দুটো ওয়াশরুম।
: ভাড়া কত দিতে হবে?
১৬ হাজার টাকা। গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ বিল ব্যবহারের ওপর। আচ্ছা এটা তো জানা হলো না আপনারা ফ্যামিলি মেম্বার কজন?
: দুজন। আমি আর বাবা।
আপনার মা নেই?
: না, তিনি মারা গেছেন।
মাফ করবেন, আমি ব্যাচেলর কারো কাছে বাসা ভাড়া দিতে পারব না।
ব্যাচেলরের সংজ্ঞা যাই হোক, ঢাকায় বাসা ভাড়া নেওয়ার আগে বাড়িওয়ালাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারের বাস্তবচিত্র এমনই। শুধু ছেলেদের কাছে বাসা ভাড়া দিতে চান না কেউ। খোঁজেন পরিবার। আগে থেকেই ব্যাচেলর বা অবিবাহিত ছেলেকে ‘উটকো ঝামেলা’ মনে করেন বাড়ির মালিকরা। মধ্যরাত পর্যন্ত বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, গভীর রাতে বাসায় ফেরা, অগোছালো জীবনাচরণের মতো অভিযোগের অন্ত নেই ব্যাচেলরদের বিরুদ্ধে। তার ওপর বর্তমানে ঢাকায় জঙ্গি তৎপরতা বাড়ার পর ভাড়া বাসা পাওয়া আকাশের চাঁদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যারা বসবাস করছেন তাদের অনেকেই পেয়েছেন নোটিশ, বাসা ছাড়ার।
সৃষ্ট এই পরিস্থিতি ভোগান্তিতে ফেলেছে লাখো মানুষকে। যাদের একটি বড় অংশ শিক্ষার্থী। চাকরিজীবীদের মধ্যেও এই সংখ্যা কম নয়। অনেকে আছেন, পড়াশোনা করছেন রাজধানীর কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কেউ আবার পাঠ চুকিয়ে অপেক্ষায় আছেন চাকরির। আবার বিবাহিত কিন্তু স্ত্রী থাকেন গ্রামের বাড়ি কিংবা কর্মক্ষেত্রে তার চাকরি ঢাকায়, এমন ব্যক্তিরাও বাসা ভাড়া পেতে ঘাম ঝরাচ্ছেন।
গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলা, শোলাকিয়া ঈদগাহে হামলার চেষ্টার পর থেকে সারা দেশে ব্যাচেলরদের বাসা ভাড়া দিতে হিসাব নিকাশ শুরু করে দিয়েছিলেন মালিকরা। সবশেষে কল্যাণপুরে একটি বাড়িতে অভিযানে ৯ জঙ্গি নিহত হওয়ার পর অবিবাহিত তরুণ, যুবকদের বাসা ভাড়া দেওয়া থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন বাড়ির মালিকরা। রাজধানীর কয়েকটি অঞ্চলের বাড়ি মালিকদের সমিতি থেকে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, প্রয়োজনে বাসা খালি থাকবে তাও আর একজন ব্যাচেলর ভাড়াটিয়া চান না তারা। মিরপুর-১০ এলাকার বাড়ির মালিক সোবহান মিয়া বলেন, ‘বাড়ি ভাড়া দিয়ে যদি গোয়েন্দার মতো নজরদারি করতে হয়, শান্তিতে ঘুমাতেও না পারি তবে এই টাকা দিয়ে কী হবে? এ ঝক্কি কে পোহাতে চায় বলুন?’
রাজধানীর বসুন্ধরা এলাকায় জঙ্গিদের ভাড়া দেওয়া বাড়ির মালিক নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সহকারী উপাচার্য অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহসানসহ তিনজন গ্রেপ্তার হয়েছেন। শেওড়াপাড়ায় জঙ্গিদের বাসা ভাড়া দেওয়া মালিক নুরুল ইসলামও গ্রেপ্তার হয়েছেন। ঝিনাইদহে জঙ্গিদের ভাড়া নেওয়া বাড়ির মালিকও গ্রেপ্তার হয়ে রিমান্ডে গেছেন। কল্যাণপুরে অভিযান চালানো বাড়ির মালিকের ছেলেকেও গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। বাসা ভাড়া দিয়ে এভাবে গ্রেপ্তার হওয়ার আতঙ্কে বাড়ির মালিকরা নিজেদের বাঁচিয়ে চলার পথ বেছে নিয়েছেন। আর বিপাকে পড়েছে ব্যাচেলররা।
যদিও পুলিশ বলছে, তারা ব্যাচেলরদের ভাড়া দিতে বারণ করেননি, বলেছেন ভাড়াটিয়ার তথ্য দিতে। বাড়ির মালিক ভাড়াটিয়া সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে তা পুলিশকে জানালে আর সমস্যা কোথায়? ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার শেখ মারুফ হাসান এই সময়কে বলেন, ‘ব্যাচেলরদের বাড়ি ভাড়া দিতে বাড়িওয়ালাদের ভীতি থাকা ঠিক নয়। পুলিশ তো ভাড়া দিতে নিষেধ করেনি। ব্যাচেলর বা ফ্যামিলি যাকেই ভাড়া দেন তার সম্পর্কে তথ্য সংশ্লিষ্ট থানায় জমা দিতে হবে। এ তো খুব কঠিন কিছু নয়। বাড়ির মালিক ও ভাড়াটিয়া উভয়ের নিরাপত্তার জন্য ভালো।’
ব্যাচেলর যেন আতঙ্ক
ব্যাচেলর পুরুষ এখন বাড়িওয়ালাদের কাছে রীতিমতো আতঙ্কের। যত দ্রুত দূর করা যায় ততই যেন মঙ্গল। এক জরিপে দেখা গেছে, রাজধানীতে প্রায় ৪৫ হাজার বাসা-বাড়িতে মেস আছে। এতে প্রায় সাড়ে ১০ লাখ ব্যাচেলর থাকেন। বৃহ¯পতিবার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে বাড়ির মালিক ও ব্যাচেলর ভাড়াটিয়াদের সঙ্গে কথা হয়। দুই পক্ষই তাদের ভোগান্তির কথা তুলে ধরেন। তবে বাড়ির মালিকদের চেয়ে ব্যাচেলরদের দুর্ভোগ নজরে এসেছে বেশি।
আরামবাগ ও ফকিরাপুলের আবাসিক এলাকায় বাসা ভাড়া ‘টু-লেটের’ অভাব নেই। কিন্তু ব্যাচেলরদের জন্য নেই একটিও। কয়েকটি টু-লেটে স্পষ্ট লেখা, ব্যাচেলর ভাড়া দেওয়া হয় না। তাহলে অবিবাহিত একা পুরুষ যাবে কোথায়? জবাবে আরামবাগ এলাকার বাড়ির মালিক মোখলেসুর রহমান বলেন, ‘মেসে অনেক সমস্যা। ভাড়া বেশি পাওয়া যায় সত্যি। তাই বলে জেনে শুনে ঝুঁকি তো নেওয়া যায় না।’
ফকিরাপুল এলাকায় বন্ধুদের নিয়ে মেস করে থাকেন কিশোর হাওলাদার। বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করেন। তিনি জানান, বাড়ির মালিক মাসের শুরুতে তাদের কাছ থেকে জাতীয় পরিচয়পত্র চেয়েছেন। তারা দিয়েছেনও। কিন্তু দুদিন আগে বাড়ির মালিক সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, আর তাদের এ বাড়িতে রাখতে পারবেন না তিনি। ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী ইলিয়াস আহমেদ এবং তার দুই সহপাঠী বন্ধুকেও বাসা ছাড়ার নোটিশ দেওয়া হয়েছে। অথচ মতিঝিলের আরামবাগের ওই বাড়িতে তারা থাকছেন প্রায় দেড় বছর হতে চললো। ইলিয়াস বলেন, ‘সন্ত্রাসী, জঙ্গিদের কারণে দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে আমাদের মতো সাধারণ মানুষকে। বাড়ি থেকে টাকা এনে চলি। ব্যয়ের ব্যাপারে সব সময়ই সজাগ থাকতে হয়। এই এলাকায় বাসা ভাড়া তুলনামূলক কম বলে থাকি। এখন কোথায় যাব চিন্তা করে কূল পাচ্ছি না।’
শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগের অন্ত নেই
কদিন আগে মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়েছেন নাজমুল ইসলাম। ফলাফল প্রকাশের অপেক্ষা। চাকরির পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। থাকেন কলাবাগানে। কিন্তু হঠাৎ করে বেকার জীবনে নতুন চিন্তার কারণ হয়েছে বাসা ভাড়া। বাড়িওয়ালা এক মাস সময় বেঁধে দিয়েছেন। বলেছেন, হয় পরিবার নিয়ে আসেন, নয় বাড়ি ছাড়তে হবে। তিন বছরের বেশি সময় ধরে এই বাড়িতে আছেন যে কারণে বাড়িওয়ালার প্রস্তাবটা কিছুটা নমনীয় তার ক্ষেত্রে। অন্যদের সোজাসুজি বলে দিয়েছেন, মেস ভাড়া আর নয়।
আনোয়ার হোসেন আরামবাগের ৭৯নং বাসায় একটি কক্ষ ভাড়া নিয়ে তিন জন নিয়ে থাকেন। বাসার পরিসর ছোট হওয়ায় আগামী মাস থেকে বাড়িওয়ালাকে না করে দিয়েছিলেন। এখন দেশের এই পরিস্থিতিতে ব্যাচেলরদের কোনো বাড়িওয়ালা ভাড়া দিতে চান না। বাড়ি ভাড়া না পাওয়ার বিড়ম্বনায় চরম বিরক্ত ও হতাশাগ্রস্ত অবস্থায় প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় তার। তিনি বলেন, দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে শুধু ব্যাচেলর কেন, সবারই তথ্য পুলিশের কাছে থাকা উচিত। অল্প কিছু সংখ্যক বিপদগামী জঙ্গি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর অপরাধের দায় লাখ লাখ ব্যাচেলরের ওপর বর্তানো উচিত নয়। রাজধানী থেকে মেস তুলে দেওয়া হলে লাখ লাখ ব্যাচেলর ভাড়াটিয়া বিপদে পড়বে।
রাজধানীতে সবচেয়ে বিপাকে পড়েছে উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্ররা। তাদের অধিকাংশের জাতীয় পরিচয়পত্র নেই। বগুড়ার সাঈদুল আনাম নটরডেম কলেজে ভর্তি হয়েছেন এবারই। ক্লাস শুরু হওয়ায় ঢাকার আরামবাগে তার অত্মীয়ের বাসায় উঠেছেন। গত কয়েকদিন যাবৎ বাড়ি ভাড়া খুঁজে বেড়াচ্ছেন কিন্তু জাতীয় পরিচয়পত্র না থাকায় কোনো বাড়িওয়ালা ভাড়া দিতে চান না। কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি বলেন, আমাদের ক্লাস শুরু হয়েছে। এখন পর্যন্ত কোনো বাড়ি ভাড়া পাইনি। পরিচিত এক আত্মীয়ের বাসায় উঠেছি। কিন্তু কয়দিন তার বাসায় থাকব। বাসা না পাওয়ায় পড়াশোনাও করতে পারছি না ঠিকমতো। তিনি বলেন, বাড়িওয়ালা জাতীয় পরিচয়পত্র চায় আমার কাছে। কিন্তু আমার তো জাতীয় পরিচয়পত্র হয়নি। তবে কলেজের আইডি কার্ড দিলেও বাড়ি ভাড়া দিতে নারাজ।
নতুন মেস ভাড়ার ক্ষেত্রেই শুধু এই বিড়ম্বনা নয়, আগে থেকে যারা মেসে আছেন তাদের জন্যও কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। ফকিরাপুলের কমিশনার গলিতে ৩৩নং বাসায় প্রায় দুই বছর ধরে মেসে থাকেন আমান উল্লাহ ও ফয়সাল ইবনে শহীদ। একটি মাল্টিন্যাশনাল কো¤পানিতে কর্মরত এই ভাড়াটিয়া বলেন, গত সপ্তাহে মালিক ভাড়াটিয়া তথ্য ফরম পাঠিয়েছেন। জাতীয় পরিচয়পত্র ও ছবিসহ ফরম পূরণ করে দিতে হয়েছে। এ বিষয়ে এ বাড়ির মালিক বলেন, থানা থেকে মেস ও মেসের সদস্যের তথ্য চাওয়া হয়েছে, তাই এগুলো পূরণ করে দিতে হচ্ছে।
এ বিষয়ে কথা হয় মতিঝিল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (তদন্ত) গোলাম রব্বানীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘বাড়িওয়ালাদের বাড়ি ভাড়া সংক্রান্ত নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সেই নির্দেশনা অনুযায়ী বাড়িওয়ালাদের সব ভাড়াটিয়ার তথ্য ফরম দেওয়া হয়েছে, সেই তথ্য ফরম পূরণ করে বাড়ি ভাড়া দিতে পারবে। তথ্য ফরম পূরণ করে ব্যাচেলর কেন সব ভাড়াটিয়াকেই বাড়ি ভাড়া দেওয়া যাবে। এর বাইরে আর কোনো নির্দেশনা আমাদের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়নি। আমরা নিজেদের দায়িত্বটা ঠিকমতো পালন করি না কিন্তু চাই পুলিশ একাই দেশকে জঙ্গিমুক্ত করুক।’
তথ্য দিতে হচ্ছে সব ভাড়াটিয়াকেই
কাঁঠালবাগানের ফ্রি স্কুলের ২৫/২ নম্বর বাসায় প্রায় পাঁচ বছর ধরে মেস করে বাস করছেন শাকিল মো. খায়রুল আলম ও তার কয়েকজন বন্ধু। বেসরকারি একটি টেলিভিশনের এই কর্মকর্তা জানান, গত সপ্তাহে মালিক ভাড়াটিয়াদের কাছে তথ্য ফরম পাঠিয়েছেন। জাতীয় পরিচয়পত্র ও ছবিও দিতে হয়েছে। আগে এগুলো ছিল না। থানা থেকে শুধু মেসবাড়ির তথ্যই নেওয়া হচ্ছে। কোনো ফ্যামিলি বাসায় ফরম পাঠানো হয়নি। তার প্রশ্ন, শুধু মেসকেই কেন সন্দেহের চোখে দেখা হবে।
বাড়ির মালিক সিদ্দিকুর রহমান জানান, থানা থেকে মেস ও মেস সদস্যের তথ্য চাওয়া হয়েছে। যারা সপরিবারে বসবাস করেন, তাদের তথ্যও নেওয়া হচ্ছে কি না তা জানতে কলাবাগান থানায় যোগাযোগ করা হলেও দায়িত্বশীল কারও বক্তব্য পাওয়া যায়নি। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) উপকমিশনার (গণমাধ্যম ও জনসংযোগ) মাসুদুর রহমান বলেন, ‘শুধু মেস নয়, সব ভাড়াটিয়ার তথ্যই পুলিশ সংগ্রহ করছে। সবাইকে তথ্য দিতে হবে। এসব তথ্য যাচাই বাছাই করা হচ্ছে। কেউ মিথ্যা তথ্য দিলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মেস ভাড়া দিতে কোনো বাধা নেই। কিন্তু ভাড়াটিয়াদের তথ্য নিতে হবে।’ জানা যায়, ডিএমপি এরই মধ্যে ২২ লাখ ভাড়াটিয়ার তথ্য সংগ্রহ করছে। তাদের মধ্যে কতজন মেসের ভাড়াটিয়া, তা এখনও জানা যায়নি।
মেসবাসীর একটি সংগঠন ‘মেস সংঘ’। সংগঠনটির দাবি, তারা গোটা ঢাকার সব মেসবাসীর প্রতিনিধি। এর মহাসচিব আয়াতুল্লাহ আকতার বলেন, নিরাপত্তার স্বার্থে মেসের সদস্যের কেন, সবারই তথ্য পুলিশের কাছে থাকা উচিত। গুটিকয় জঙ্গির অপরাধের দায় লাখ লাখ মেস সদস্যের ওপর দেওয়া উচিত নয়। কারণ, জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে আমলা, পুলিশ তারাও একদিন মেসে থেকেই পড়াশোনা করেছেন। এটা ভুলে গেলে কীভাবে হবে?’
নারী ব্যাচেলরদের বিড়ম্বনা আরও বেশি
ঢাকায় প্রতিদিন বাড়ছে জনসংখ্যা। শুধু যে পুরুষরাই আসছেন তা নয়, নারীরাও আসছেন সমান তালে। কিন্তু নারীদের নিরাপদ বাসস্থানের ব্যবস্থা একেবারে হাতেগোনা। যে কারণে ইচ্ছে থাকলেও শিক্ষা কিংবা কর্মের তাগিদে ঢাকার পথে পা বাড়াচ্ছেন না মেয়েরা।
নীলক্ষেতের একটি বেসরকারি হোস্টেলে থাকেন মুন্নি ইসলাম। তিনি জানান, মাসে সাড়ে চার হাজার টাকা সিট ভাড়া দিতে হয়। পড়েন রাজধানীর ইডেন সরকারি মহিলা কলেজে। হোস্টেলের খরচ মেটাতে বাড়ি থেকে টাকা আনার পরও নিজেকে প্রাইভেট পড়িয়ে জোগাড় করতে হয় বাড়তি টাকা। মুন্নি বলেন, ‘হোস্টেলে ওঠার পর থেকেই এই বিল সেই বিল গুনতে গুনতে দফারফা। পানি থাকে না। মাঝেমধ্যে গোসল না করেই ক্লাসে যেতে হয়। এক বছর ধরে চেষ্টা করছি সরকারি হোস্টেলে উঠতে। কিন্তু সেখানে সিট যেন সোনার হরিণ।’
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত নুসরাত জাহান জানান, এ কারণে কিছুদিন আগেই বাসায় ওঠার এক মাসের মধ্যে তাকে বাসা ছাড়তে হয়েছিল। তিনি বলেন, ‘বাড়ির মালিক আমাদের হুট করেই বাসা ছাড়তে বলেন। আর ভাড়া নিতে গেলে তো শুনতে হয় অনেক অযাচিত প্রশ্ন। বেশির ভাগ মালিকই ভাড়া দিতে চান না। আর ভাড়া পেলে মানতে হয় হাজারটা নিয়মকানুন। অবস্থা দেখে মনে হয়, আমাদের বিনা মূল্যে থাকতে দেওয়া হচ্ছে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও তথ্য অধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান সাদেকা হালিম বলেন, ‘নাগরিকের মৌলিক অধিকারের একটি নিরাপদ বাসস্থান। এই অধিকার নিশ্চিতের দায়িত্ব অবশ্যই সরকারের। কিন্তু ঢাকায় কর্মজীবী নারীদের জন্য দু-চারটি নিবাস প্রতিষ্ঠা করে দিলেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। চাহিদার তুলনায় আবাসনে সিট যে অপ্রতুল এ দিকটিও গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে। যত দ্রুত সম্ভব মেয়েদের জন্য পর্যাপ্ত নিবাসের ব্যবস্থা করতে হবে।’
বেসরকারি সংস্থায় চাকরিরত সাদিয়া মোবাশ্বেরা জান্নাত বলেন, বাড়ির মালিকেরা বাসা ভাড়া দিতেই চান না। আর বন্ধুদের নিয়ে থাকতে গেলে আরও সমস্যা হয়। কেন ঢাকায় আত্মীয় নেই, এমন প্রশ্নও শুনতে হয়। অনেক চেষ্টার পর মিরপুরে একটি বাসা পেয়েছেন বলে জানালেন সাদিয়া। কিন্তু সেখানেও মানতে হচ্ছে অনেক শর্ত, শুনতে হয় অহেতুক অনুযোগ।
মেয়েদের ব্যাপারে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের প্রতি জোর দিয়ে সাদেক হালিম বলেন, ‘ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা এই সমাজে অনেক সুবিধা বঞ্চিত। তাদের অসহায় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। একটা ছেলেকে বাসা ভাড়া দিতে যতটা নিরাপদ মনে করা হয়, মেয়েদের ক্ষেত্রে ততটাই ঝামেলা বলে মনে করেন বাড়ির মালিকরা। মনে করেন মেয়েদের ভাড়া দিলে তাদের বাসায় ছেলেরা আসবে, সমাজের চোখে এটা ভালো দেখায় না। অথচ একই কাজ কোনো ছেলে করলে সেটা নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই। সমাজের মানুষকে মেয়েদের ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গির এই সীমাবদ্ধতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।’