ঢাকা: বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির পর এবার মেডিকেল ভর্তি কোটিং রেটিনার বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীর জঙ্গি তৎপরতায় জড়ানোর তথ্য পাওয়া গেছে। এদের একজন কল্যাণপুর অভিযানে আটক রাকিবুল হাসান ওরফে রিগ্যান বগুড়ায় রেটিনা কোচিং সেন্টারে ভর্তির পর পাল্টে গেছেন- জানিয়েছেন স্বয়ং তার মা।
ওই অভিযানে নিহতদের একজন চট্টগ্রামের মাজারভক্ত আজিজুল হক চৌধুরীর ছেলে সাব্বিরুল হক কণিক বলে জানিয়েছিল পুলিশ। পরে অবশ্য মরদেহ দেখার পর আজিজ জানান, এটা তার ছেলে নন। তবে আজিজের ছেলেও নিখোঁজ আছেন এবং তিনিও বাড়ি ছাড়ার আগে উগ্রবাদে দীক্ষিত হয়েছিল। এ কারণে রাগে-ক্ষেভে তার নিখোঁজের বিষয়ে পুলিশকেও জানাননি বাবা আজিজুল হক চৌধুরী।
গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারি ও কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া ময়দানের অদূরে জঙ্গি হামলায় জড়িতদের দুইজন ছিলেন নর্থ সাউথের বর্তমান বা সাবেক শিক্ষার্থী। কল্যাণপুরে নিহতদের মধ্যে অন্তত দুই জনও (সাজাদ রউফ অর্ক ও আকিফুজ্জামান খান) এই বিশ্ববিদ্যালয়টিতে পড়তেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীরা কেন উগ্রবাদে জড়াচ্ছেন, সে বিষয়ে সরকারি বিভিন্ন সংস্থা এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় এরই মধ্যে তদন্তে নেমেছে।
তবে শিবির নিয়ন্ত্রিত কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়ে শিক্ষার্থীরা কেন পাল্টে যাচ্ছে সে বিষয়ে এখন পর্যন্ত সরকার তদন্ত শুরু করেনি। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমি অন্তত ১০ বছর ধরে বলে আসছি শিবির নিয়ন্ত্রিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে নজরদারিতে আনা উচিত। তারা কিশোর বয়সে শিক্ষার্থীদের মগজ ধোলাই করে উগ্রবাদে দীক্ষিত করে। এর প্রমাণ নানা সময় পাওয়া গেছে। আর সাম্প্রতিক জঙ্গি তৎপরতায় অবশ্যই জামায়াত-শিবিরের ভূমিকা আছে। নইলে রেটিনার শিক্ষার্থীরা কেন উগ্রবাদে দীক্ষিত হবে?’
শিবির নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে কোচিং সেন্টারে শিক্ষার্থীদের মগজ ধোলাইয়ের অভিযোগ পুরনো। নানা সময় এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িতরা আটকও হয়েছেন। তবে এগুলোর বিরুদ্ধে সমন্বিত ব্যবস্থা কখনও নেয়া হয়নি।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম শাখার অতিরিক্ত উপ কমিশনার মুহাম্মদ ইউসূফ আলী ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘রেটিনার বিষয়টি গুরুত্ব পেতেই পারে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা যদি মনে করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ঘটনার সঙ্গে জড়িত তাহলে সে ওই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে আইনের আওতায় আনতে পারবেন।’
রেটিনায় কোচিং ভর্তির কয়েক মাস পর নিখোঁজ হন কল্যাণপুরে আটক হাসান
কল্যাণপুরে আটক হাসান ২০১৫ সালে বগুড়ার শাহ সুলতান কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নেন। তার পরীক্ষা ভালো হয়নি মোটেও। এরপরও বগুড়ায় রেটিনায় ভর্তি হওয়ার কথা মা রোকেয়া রহমানকে জানান হাসান।
হাসানের কলেজ শাহ সুলতান কলেজের অধ্যক্ষ এজাজুল হক ঢাকাটাইমসকে জানান, হাসান এইচএসসিতে কেবল বাংলায় সি গ্রেড আর তথ্য প্রযুক্তিতে বি গ্রেড পেয়েছিলেন। বাকি সব বিষয়ে ফেল করেছেন হাসান।
হাসান তার ফল প্রকাশের আগেই রেটিনা কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু শিক্ষক এজাজুল হক মনে করেন, যে ছাত্র প্রায় সব বিষয়ে ফেল করেছ, সে অবশ্যই তার ফলাফল কেমন হবে সে বিষয়ে আগে থেকেই কিছুটা হলেও ধারণা রাখবে। তার মত একজন ছাত্রের মেডিকেল কোচিংয়ে ভর্তি হওয়াটা মোটেও স্বাভাবিক নয়।
হাসানের মা রোকেয়া রহমান ঢাকাটাইমসকে জানান, রেটিনায় ক্লাস করার কথা বলে হাসান প্রতিদিন বাড়ির বাইরে যেতেন। সেখানে ছেলে কী করেছে তা জানেন না মা। বলেন, ওই কোচিংয়ে ক্লাস করার কিছুদিন পর ওই বছরের জুলাইয়ে নিখোঁজ হয়ে যান হাসান। এরপর বগুড়া সদর থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন তার মা। আর এক বছর পর গত মঙ্গলবার কল্যাণপুরে হাসানের আটক হওয়ার তথ্য পান রোকেয়া রহমান।
রেটিনায় কোচিং করার পর হাসানের উগ্রবাদে ধাবিত হওয়ার খবর প্রকাশের পর ওই সন্ধ্যাতেই বগুড়ায় শিবির নিয়ন্ত্রিত এই কোচিং সেন্টারটিতে আগুন দেয় স্থানীয়রা। এর আগেই এর সঙ্গে জড়িতরা পালিয়ে যান।
রেটিনা ‘পাল্টে দিয়েছে’ সাব্বিরুলকেও
কল্যাণপুরে নিহতদের মধ্যে চট্টগ্রামের সাব্বিরুল হক কণিক আছেন- এমন খবর প্রকাশের পর তার বিষয়ে খোঁজ খবর নিতে শুরু করে চট্টগ্রামের সাংবাদিকরা। জানা যায়, আওয়ামী লীগ পরিবারের সন্তান সাব্বিরের উগ্রপথে ধাবিত হওয়ার শুরু রেটিনায় কোচিং থেকে।
বাবা আজিজুল হক জানান, ২০১২ সালে চট্টগ্রামের একটি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করার পর শিবির নিয়ন্ত্রিত কোচিং সেন্টার রেটিনায় ভর্তি হয় সাব্বির। এরপর তার মন মানসিকতায় বিরাট পরিবর্তন আসে। হঠাৎ করে তার কথাবার্তা, চালচলনে পরিবর্তন দেখা দেয়। এরপর চট্টগ্রাম নগরীর বাকলিয়া থানাধীন রাহাত্তার পুলে মাইকবিহীন মসজিদে নিয়মিত নামাজ পড়া শুরু করেন সাব্বির। বলতে থাকেন, তিনি ছাড়া স্বজন-শুভার্থী কারো ধর্মকর্ম শুদ্ধ নয়। অনৈতিক, অনৈসলামিক বলেও কাছের জনদের গালমন্দ করতেন থাকেন।
আজিজুল হক জানান, রোটিনায় কোচিং শেষে তার ছেলে চট্টগ্রামের জামায়াতপন্থি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইন্টারন্যাশনার ইসলামি ইউনির্ভার্সিটি অব চিটাগাংয়ে ইকনোমিক অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগে ভর্তি হন। সেখানে তবলিগের কথা বলে মাঝে মাঝে সপ্তাহ-দশ দিনের জন্য উধাও হয়ে যেতেন সাব্বির। বছর খানেক আগে একবার তিনমাসের জন্য নিরুদ্দেশ থাকার পর বাসায় ফিরে আসেন। সর্বশেষ গত চার মাস আগে রাউজানে এক বিয়েতে যাবার কথা বলে বাবার কাছ থেকে পাঁচশ টাকা নিয়ে বের হন। সেই থেকে নিখোঁজ সাব্বির।
কল্যাণপুরে নিহত জোবায়ের ছিলেন শিবির কর্মী
কল্যাণপুরে জঙ্গি আস্তানায় নিহত জোবায়ের হোসেন শিবিরের রাজনীতি করতেন বলে জানিয়েছেন তার বাবা আবদুল কাইয়ুম। তার জোবায়েরের বাড়ি ছিল নোয়াখালীর পশ্চিম মাইজদি গ্রামে। নোয়াখালী কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী জোবায়ের নিখোঁজ জন গত ২৫ মে থেকে নিখোঁজ হয়। আর ১২ জুলাই তার বিষয়ে সুধারাম থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন বাবা আবদুল কাইয়ুম।
তার বাবা আবদুল কাইয়ুম ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমার পরিবারের কেউ জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে জড়িত না। কিন্তু চাচাতো ভাই বাহাদুর আমার ছেলেটিকে শিবিরে ঢুকিয়েছে, তার জন্যই আজ এই পরিণতি হলো।’
(ঢাকাটাইমস/৩০জুলাই/এমএম/ডব্লিউবি)