চট্টগ্রাম: দশ বছরে এক ফোঁটা বাড়েনি পানির উৎপাদন। পানির কষ্টের শেষ নেই বন্দরনগরী চট্টগ্রামের বাসিন্দাদের। তাকে উপলক্ষ করে এই সময়ে ভালো সুদিন যাচ্ছে চট্টগ্রাম ওয়াসার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। তাদের দক্ষতা বাড়ানোর নামে বিদেশ সফরের আড়ালে প্রমোদভ্রমণে আয়োজন চলছে ওয়াসার ৪৫ কর্মকর্তা-কর্মচারীর।
আগামী সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে চার দফায় নেদারল্যান্ড ও উগান্ডা সফরে যাবেন ওয়াসার এই বিশাল বহর। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ১৬০০ কোটি টাকার প্রকল্পের অধীনে প্রায় ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে এই সফর হলেও পরবর্তী সময়ে ওয়াসাকেই এ অর্থ পরিশোধ করতে হবে সুদে-আসলে।
বিদেশ সফরের সত্যতা স্বীকার করে চট্টগ্রাম ওয়াসার উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (প্রকৌশল) রতন কুমার সরকার ঢাকাটাইমসকে বলেন, “দক্ষতা বৃদ্ধির অংশ হিসেবে এই সফর হচ্ছে। বিশ্বব্যাংক প্রকল্পের অধীনে এটি হবে। এই সফরের মাধ্যমে নেদারল্যান্ড ও উগান্ডার বিভিন্ন প্রকল্প সরেজমিনে পরিদর্শন ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ওয়াসার নীতিনির্ধারণী ব্যক্তিরা যাচ্ছেন নেদারল্যান্ডে এবং মাঠপর্যায়ে বিভিন্ন পদে কর্মরতরা উগান্ডা যাচ্ছেন।
নেদারল্যান্ড সফরের তালিকায় রয়েছেন ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী এ কে এম ফজলুল্লাহ, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (অর্থ) মোহাম্মদ গোলাম মাওলা, উপব্যবস্থাাপনা পরিচালক (প্রকৌশল) রতন কুমার সরকার, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (প্রশাসন) গোলাম হোসেন, সচিব মোহাম্মদ সামসুদ্দোহা, কমার্শিয়াল ম্যানেজার বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য, প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ জহুরুল হক, কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্পের পরিচালক কাজী ইয়াকুব সিরাজুদ্দৌল্লা, বিশ্বব্যাংক প্রকল্পের পরিচালক নুরুল আবছার, বিশ্বব্যাংক প্রকল্পের উপপরিচালক মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এ কে এম নজরুল হক, প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা তৌহিদুল ইসলাম, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী গোলাম সরোয়ার ও মন্ত্রণালয়ের দুজন প্রতিনিধি।
অন্যদিকে উগান্ডায় সফরের তালিকায় আছেন সহকারী প্রকৌশলী, কেমিস্ট, রাজস্ব কর্মকর্তা, ক¤িপউটার প্রোগ্রামার, গবেষণা কর্মকর্তা, অ্যাকাউন্টস অফিসার, বাজেট অফিসার, এস্টেট অফিসার, উপসহকারী প্রকৌশলী, সহকারী সচিব পর্যায়ের ২৮ জন কর্মচারী ও মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী জহুরুল হক রাগত স্বরে বলেন, “প্রকল্পের স্বার্থেই এই সফর রাখা হয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে সঙ্গে এই সফরও হতে হবে, এটা বিশ্বব্যাংকের শর্ত।”
কিন্তু সহকারী সচিব, রাজস্ব কর্মকর্তা, হিসাবরক্ষণ কর্মচারীদের মতো ব্যক্তিদের কেন এই সফরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে- জানতে চাইলে জহুরুল হক বলেন, “এর আগে ওয়াসার ইউনিয়নের কর্মকর্তাদের একটি টিমও উগান্ডা সফর করে এসেছে। কই তখন তো কেউ প্রশ্ন করেনি!”
ওয়াসার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিশ্বব্যাংক প্রকল্পের আওতায় চট্টগ্রাম নগরীতে পাইপলাইন নেটওয়ার্ক, মদুনাঘাট পানি সরবরাহ প্রকল্প নির্মাণ ও ওয়াসার অবকাঠামো নির্মাণ করা হবে। আর এই প্রকল্পের পরামর্শক হিসেবে রয়েছে উগান্ডার একটি টিম।
পানি প্রকল্পে উগান্ডার কিছু সাফল্য রয়েছে, আর তা দেখাতেই নাকি এই ভ্রমণ। অন্যদিকে পানি প্রকৌশলে একটি উন্নত নাম নেদারল্যান্ড। পানি শাসন ও পানি ব্যবস্থাপনা দেখাতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে নেদারল্যান্ডে। দুই দেশে এই সফরে খরচ হবে প্রায় ৫ কোটি টাকা।
এদিকে বিদেশ সফরে মনোনীত হওয়া একাধিক কর্মকর্তা জানান, বিশাল বহর নিয়ে এই বিদেশ সফর প্রকৃতপক্ষে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী এ কে এম ফজলুল্লাহর একটি ‘পলিসি’। ওয়াসার উচ্চপর্যায় থেকে নি¤œপর্যায় পর্যন্ত যাতে সবাই তার অনুগত থাকে, সে জন্য ওয়াসার ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি লোককে বিদেশ সফরের সুযোগ দেয়া হয়েছে।
এবারই প্রথমবারের মতো বিশাল বহর প্রমোদভ্রমণে যাচ্ছে জানিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওয়াসার কয়েকজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, নগরীতে গত ১০ বছর ধরে পানির উৎপাদন না বাড়লেও চলমান তিন প্রকল্পের অধীনে কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরের কমতি নেই। শুধু তাই নয়, এমপি থেকে শুরু করে আরও অনেকের মুখ বন্ধ রাখতে তাদের নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে যাচ্ছেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে এম ফজলুল্লাহ।
কর্মকর্তাদের মতে, চট্টগ্রাম ওয়াসা কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্পের অধীনে গত জুন মাসের মধ্যে নগরবাসীকে দৈনিক অতিরিক্ত ১৪ কোটি লিটার পানি সরবরাহ করার কথা থাকলেও এখনো প্রকল্পের কাজই শেষ করতে পারেনি। অথচ ২০১০ সালে শেষ হওয়ার কথা ছিল প্রকল্পের কাজ। অন্যদিকে কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের পাশাপাশি দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজও শুরু করেছে সংস্থাটি।
কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্প ছাড়াও বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে শুরু হয়েছে মদুনাঘাট পানি সরবরাহ প্রকল্পের কাজ। এটি বাস্তবায়িত হলে নগরবাসী দৈনিক ৯ কোটি লিটার পানি পাওয়ার কথা। এত সব প্রকল্প চট্টগ্রামবাসীর সামনে থাকলেও কমছে না তাদের পানির দুর্ভোগ।
বর্তমানে চট্টগ্রাম ওয়াসার সবেধন নীলমণি হচ্ছে মোহরা পানি সরবরাহ প্রকল্প। এ প্রকল্প থেকে দৈনিক ৯ কোটি লিটার ও ৯৭টি গভীর নলকূপ থেকে দৈনিক ৭-৮ কোটি লিটার পানি নগরীতে সরবরাহ করা হচ্ছে। ১০ বছর আগেও এই পরিমাণ অর্থাৎ দৈনিক ১৬-১৭ কোটি লিটার পানি উৎপাদন করত ওয়াসা। কিন্তু নগরীতে প্রতিবছর প্রায় ৭৫ হাজার জনসংখ্যা বাড়ছে। ১০ বছর আগের ৩৬ হাজার সংযোগের জায়গায় এখন তা ৬২ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু ওয়াসার পানি উৎপাদন বাড়েনি ন্যূনতম পরিমাণ।
(ঢাকাটাইমস/২৬জুলাই/মোআ)