logo ২০ এপ্রিল ২০২৫
‘স্বজনের ব্যস্ততায়’ পানিতে ডুবে মরছে শিশু
তানিম আহমেদ, ঢাকাটাইমস
২৩ জুলাই, ২০১৬ ০৮:১২:১১
image



ঢাকা: ছয় বছরের সানজিদা। থাকত মহাখালী বাসস্ট্যান্ডের পাশের বস্তিতে। বিকেল হলেই সমবয়সীদের সঙ্গে ছোটাছুটি, খেলাধুলা অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল তার। গত ১৩ জুলাই এমন খেলতে গিয়েই আর ফেরেনি ছোট্ট সানজিদা। নালায় পড়ে মৃত্যু হয়েছে তার। পরে ১৮ ঘণ্টার চেষ্টার পর তার মরদেহটি খুঁজে পেয়েছিল ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরিরা। 






মা রুবি আক্তারের বুকের মানিক হারিয়ে গেছে। কেঁদে চলেছেন তিনি। এই কান্না মুছতে না মুছতেই আবার খালি হয়েছে আরও এক মায়ের কোল। বৃহস্পতিবার রাতে মিরপুরে সানজিদার মতোই নালায় পড়ে মারা যায় চার বছরের সাব্বির। সেও খেলতে গিয়ে কমার্স কলেজের পেছনে পয়োনালায় পড়ে নিখোঁজ হয়। এবারও ১৮ ঘণ্টার চেষ্টায় তার মরদেহ উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল।






রাজধানীতে যেখানে পুকুর, ডোবা-নালা, খাল-বিলের সংখ্যা কম, সেখানেই প্রায়ই পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যুর খবর আসে। তাহলে মফস্বল শহর বা গ্রাম এলাকায় যেখানে জলাভূমির পরিমাণ বেশি সেখানে কী হয়? গণমাধ্যমে তেমন গুরুত্ব না পেলেও পরিসংখ্যানটা রীতিমতো ভয় জাগানো। এক গবেষণায় দেখা গেছে, বছরে কমপক্ষে ১৮ হাজার শিশুর মৃত্যু হয় পানিতে ডুবে, যাদের বেশির ভাগের বয়স ১০ মাস থেকে দুই বছরের মধ্যে।






গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ড্রোনিং রিসার্চ সেন্টারের এক জরিপে দেখা গেছে, অপুষ্টিতে ভুগে কিংবা রোগ-বালাইয়ে নয়, বাংলাদেশের বেশির ভাগ শিশুমৃত্যু হয় আসলে পানিতে ডুবে। পৃথিবীতে আর কোনো দেশে এভাবে এত শিশুর মৃত্যু হয় না। পানিতে ডুবে সবচেয়ে বেশি শিশু মারা যায় এমন পাঁচটি দেশে যত শিশু মারা যায়, তার ৬৬ শতাংশই হয় বাংলাদেশে।






এই সংস্থার গবেষণা বলছে, দেশে প্রতিদিন অন্তত ২২৮টি পানিতে ডোবার ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে প্রতিদিন গড়ে মৃত্যু হয় ৪৫টি শিশুর। নদ-নদী, খাল-বিল, পুকুর-ডোবা এমনকি পানি ভর্তি বালতিতেও মারা যায় শিশু। আবার এত শিশুর মৃত্যু হয়, কিন্তু এ বিষয়ে সচেতনতা গড়ে উঠছে না সেভাবে। শিশুদের ছোটবেলায় সাঁতার শেখানোর রীতিতেও ছেদ পড়েছে।






আরেক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশের (সিআইপিআবি) নির্বাহী পরিচালক এ কে এম ফজলুর রহমান ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর মধ্যে এক থেকে চার বছরের শিশুই বেশি। ঠিক সে সময়টিতে শিশুরা হাঁটতে শেখে এবং কৌতূহলবশত বা খেলতে গিয়ে পানিতে পড়ে যায়।” তিনি বলেন, সারা বছরই এই শিশুমৃত্যুর ঘটনা ঘটে। তবে সবচেয়ে বেশি হয় বর্ষা মৌসুমে।






অন্য এক জরিপে দেখা গেছে, ডুবে গেলেও মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পায় এমন শিশুর সংখ্যা ৬৬ হাজারের বেশি।






পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পরেই রয়েছে ভিয়েতনাম। সেখানে এমন শিশুমৃত্যুর সংখ্যা ১১ হাজার ৬৬৫; আর ডুবে গিয়ে উদ্ধার হওয়া শিশুর সংখ্যা ১১ হাজার ৭৯৫। তৃতীয় অবস্থানে থাকা চীনে ৪ হাজার ৫৪২, চতুর্থ থাইল্যান্ডে ২ হাজার ৬৪৫টি শিশুমৃত্যুর ঘটনা ঘটে পানিতে ডুবে। আর কম্বোডিয়ায় এ ধরনের মৃত্যু হয় বছরে ২০৯৪ শিশুর।






প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, শহরের চেয়ে গ্রামে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর হার অনেক বেশি। তবে ঢাকা মহানগরেও পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা কম নয়। ঢাকাকে ঘিরে রাখা বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ, ধলেশ্বরী নদীতে অনেক শিশু ডুবে যায়। রাজধানীতে নিচু এলাকা বা ঝিলের ওপর গড়ে ওঠা বস্তির শিশুরা নর্দমায় ডুবে মারা যায় বেশি।






কী উপায়?






বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বাংলাদেশ ডেমোক্রেটিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভের (বিডিএইচএস) তথ্যমতে, বেশির ভাগ শিশুই বাড়ি থেকে ২০ মিটার এবং ছোট বাচ্চারা ১০ মিটার দূরত্বের জলাশয়ে পড়ে মারা যায়।






আবার সকাল ১০টা থেকে দুপুরের পরপর পানিতে পড়ে যাওয়ার ঘটনা বেশি ঘটে। ঘর বা বাইরে কাজে থাকা অভিভাবকরা এই সময় শিশুদের প্রতি অতটা মনোযোগী থাকেন না বলে দেখা গেছে গবেষণায়।






প্রতিবেদন অনুযায়ী, পানিতে ডোবার ঘটনা বেশি ঘটে বাড়ির পাশের পুকুর-দিঘি-ডোবায়। খেলতে খেলতে কিংবা গ্রামাঞ্চলে হাত-মুখ ধুতে গিয়েও অনেক দুর্ঘটনা ঘটে। আবার ডুবে যাওয়া একটি শিশুকে বাঁচাতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয় আরেকটি শিশু। এমন ক্ষেত্রে অনেক সময় মারা যায় উভয় শিশুই।






তাহলে উপায়? গবেষকরা বলছেন, বিষয়টি সহজ নয়, তবে ছোট্ট শিশুদের চোখে চোখে রাখাই হবে এ ধরনের মৃত্যু রোধের প্রথম উপায়।






গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিআইপিআরবির নির্বাহী পরিচালক এ কে এম ফজলুর রহমান বলেন, শিশু হামাগুড়ি দিতে শেখার সময় থেকে পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত তার ওপর সার্বক্ষণিক নজরদারি রাখতে হবে। ডোবা ও পুকুরের চারপাশে বেড়া দেওয়ার পাশাপাশি শিশুকে পানিতে পড়ার ক্ষতিকর দিকও জানাতে হবে এবং ছয় বছরের আগেই তাকে সাঁতার শেখানোর চেষ্টা করতে হবে।






(ঢাকাটাইমস/টিএ/ডব্লিউবি/মোআ)