ঢাকা: জঙ্গি কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (এনএসইউ) প্রায় এক ডজন শিক্ষক চাকরি হারাচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) তদন্তে এসব শিক্ষকের বিরুদ্ধে জঙ্গি সম্পৃক্ততার প্রমাণ মিলেছে। ইউজিসি সূত্রে এসব তথা পাওয়া গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইউজিসির এক কর্মকর্তা ঢাকাটাইমসকে জানান, এনএসইউতে ইউজিসির তদন্ত দলের পরিদর্শনে ব্যাপক অনিয়ম ও এক ডজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে জঙ্গি তৎপরতায় অংশ নেয়ার তথ্য-প্রমাণ বেরিয়ে আসে। তারা শতাধিক শিক্ষার্থী নিখোঁজের তথ্যও চেয়েছে এনএসইউর কাছে।
গত ১৪ জুলাই নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় সরেজমিন তদন্তে যায় ইউজিসির প্রতিনিধিদল। ওই দলে ছিলেন কমিশনের সদস্য অধ্যাপক দিল আফরোজা বেগম, অধ্যাপক শাহনেওয়াজ আলী, কমিশনের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিটের উপপরিচালক জেসমিন পারভীন ও জ্যেষ্ঠ সহকারী পরিচালক বিষ্ণু মল্লিক।
পরিদর্শন শেষে অধ্যাপক দিল আফরোজা বলেন, “এটা আসলে আমাদের রুটিন ভিজিট ছিল। তবে সাম্প্রতিক সময়ের বিবেচনায় এবারের ভিজিটটাকে আমরা বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলাম।”
জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ডে শিক্ষার্থীদের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে প্রশ্ন করেছিলেন ইউজিসি প্রতিনিধিদলের সদস্যরা। তার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে এনএসইউ। যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ে সব স্থানে সিসি ক্যামেরা বসানো, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণের কথা বলেছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির কর্মকর্তারা।
তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে যেন কোনো নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড না ঘটে, তা দেখার প্রতিশ্রুতি ইউজিসিকে দিয়েছেন এনএসইউর কর্তৃপক্ষ।
গুলশানের আর্টিজানে উদ্ধার জিম্মিদের মধ্যে আবুল হাসনাত রেজা করিম ছিলেন নর্থ সাউথের সাবেক শিক্ষক, যাকে ওই ঘটনার এক ভিডিওর সূত্র ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সন্দেহ করা হচ্ছে। পুলিশ তাকে ছেড়ে দেওয়ার কথা বললেও পরিবার বলছে, তাকে তারা ফিরে পায়নি।
গত ১ জুলাই গুলশানে হামলাকারী যুবকদের সবাই বেশ কয়েক মাস ধরে নিখোঁজ ছিলেন, যাদের মধ্যে নিবরাস ইসলাম ছিলেন নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ছাত্র। এর এক সপ্তাহের মাথায় শোলাকিয়ায় হামলা চালাতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে নিহত আবীর রহমানও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন।
গুলশান ও শোলাকিয়ার ঘটনার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে নিখোঁজ যে ১০ যুবকের তালিকা দেওয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে জুন্নুন শিকদার ও বাসারুজ্জামানও নর্থ সাউথে পড়াশোনা করেছেন।
জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ডে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের জড়িত থাকার বিষয়টি প্রথম আলোচনায় আসে ২০১৩ সালে ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার হত্যার ঘটনায়। ওই ঘটনায় জড়িত থাকায় দণ্ডিত সাদমান ইয়াসির মাহমুদ, ফয়সাল বিন নাঈম দীপ, এহসান রেজা রুম্মান, মাকসুদুল হাসান অনিক, নাঈম ইরাদ ও নাফিজ ইমতিয়াজ সবাই ছিলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রনিক্স অ্যান্ড ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী।
১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের প্রথম দিককার এই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমান প্রায় ২২ হাজার শিক্ষার্থী রয়েছে।
জঙ্গিবাদী কার্যক্রম এবং আর্থিক অনিয়ম বিষয়ক তথ্যের সত্যতা যাচাইয়ে এর আগে গত ১৯ আগস্ট বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়টি পরিদর্শন করেছিল ইউজিসির একটি প্রতিনিধিদল।
সে দলের এক সদস্য বলেন, সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে বেশ কিছু নিষিদ্ধ জঙ্গিবাদী বই তারা পেয়েছিলেন এবং সে বিষয়ে কর্তৃপক্ষ সদুত্তর দিতে পারেনি।
তবে সম্প্রতি ইউজিসির তদন্ত দলের এনএসইউ পরিদর্শন এবং নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির (এনএসইউ) ভারপ্রাপ্ত উপ-উপাচার্যকে বরখাস্তের পর শিক্ষার্থীদের জঙ্গি কর্মকাণ্ডে উদ্বুদ্ধ করার অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিয়ান ড. মোস্তাফিজুর রহমানকেও সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
ইউজিসি সূত্রে জানা গেছে, এনএসইউর অন্তত একডজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ পেয়েছে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দেখভালের দায়িত্বে থাকা ইউজিসি। এর মধ্যে রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপ-উপাচার্য অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন আহসান, বাণিজ্য অনুষদের ডিন অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান, অধ্যাপক হান্নান মিয়া, ড. জসিম উদ্দিন আহমেদ ও ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষক ড. আবুল এল হক ও ড. আউয়াল, রেজিস্ট্রার শাহজাহান, একজন ডেপুটি রেজিস্ট্রার। এ তালিকায় আর কমপক্ষে তিনজন শিক্ষক রয়েছেন যাদের নাম জানা যায়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য আতিকুল ইসলাম বলেন, “এই মুহূর্তে আমি এ ব্যাপারে বিস্তারিত বলতে চাচ্ছি না। কারো নাম প্রকাশ করতে চাচ্ছি না। নাম প্রকাশ করলে সবাই সতর্ক হয়ে যাবে। তবে সময় হলে সব কিছুই জানা যাবে।
গত ১৭ জুলাই রাজধানীতে স্বরাষ্ট্র ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় আয়োজিত জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবিরোধী মতবিনিময় সভায় এনএসইউ উপাচার্য ঘোষণা দেন, ‘সার্জারি অপারেশনের মাধ্যমে নর্থ সাউথ থেকে জঙ্গিবাদ সমস্যা নির্মূল করা হবে। যেসব শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িত, তাদের প্রতি নর্থ সাউথের পক্ষ থেকে ঘৃণা জানাচ্ছি।’
গত ১ জুলাই গুলশানের আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলকারীদের আশ্রয় দেয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়ে রিমান্ডে থাকা এনএসইউর স্কুল অফ লাইফ সায়েন্স অনুষদের ডিন গিয়াস উদ্দিন আহসানকে (জিইউ আহসান) সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনএসইউ ট্রাস্টি বোর্ডের একজন সদস্য জানিয়েছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়টির জঙ্গি কর্মকাণ্ডে ও রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতায় লিপ্ত থাকার অভিযোগ খতিয়ে দেখা হচ্ছে। বেশ কয়েকজনকে সতর্ক পর্যেবেক্ষণে রাখা হয়েছে।’
(ঢাকাটাইমস/২২জুলাই/এমএম)