ঢাকা: বরাবর সরকারি চিনিকলের চিনিতে আস্থা রাখেন আবুল খায়ের। ঈদের পর ঢাকায় ফিরে বাসার পাশের একটি সুপার শপে চিনি কিনতে গিয়ে দেখেন, এক কেজির দাম ৭৮ টাকা। চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের বাজারজাত করা এই চিনি পরে তিনি কারওয়ানবাজার পাইকারি দোকান থেকে কেনেন ৭০ টাকা করে।
মোড়কের গায়ে দাম লেখা ছিল ৫৫ টাকা। এই দাম অবশ্য করপোরেশনের নির্দিষ্ট নয়। অবৈধ হলেও আলাদা ছাপ দিয়ে ব্যবসায়ীরাই এই দাম বসিয়েছেন। এর চেয়েও ১৫ টাকা বেশি রাখার কারণ জানতে চাইলে ওই বিক্রেতা বলেন, ‘বাবারে, কিইন্যা আনছি ৬৮ টাকা কইরা। এই দামে বেচলেও পোষায় না’।
কারওয়ানাবাজারের দোতলায় পাইকারি পণ্য বিক্রির অন্য একটি দোকানে মোড়কবিহীন সরকারি খোলা চিনি চিক্রি করতে দেখা গেছে ৭২ টাকা কেজি দরে। আর আমদানি করা চিনি বিক্রি হয়েছে দুই টাকা কমে।
মূলত রোজার শুরু থেকেই অস্থির চিনির বাজার। পর্যাপ্ত আমদানির পরও বাড়তে থাকে চিনির বাজার। আশা ছিল রোজা শেষে চাহিদা কমলেও কমে দাম। কিন্তু হয়েছে উল্টোটা। রোজাতে যে চিনি বিক্রি হয়েছে সর্বোচ্চ ৬৫ টাকা কেজি দরে, সেই চিনি এখন খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকা পর্যন্ত।
দাম বেড়েছে, কিন্তু তাতে চিনি বিক্রি করে লোকসানে থাকা সরকারি প্রতিষ্ঠান কিছুটা স্বস্তিতে থাকবে- এটাই হয়ত স্বাভাবিক। কিন্তু আদতে লাভ হচ্ছে না সরকারের। সরকারি চিনিকলগুলো চিনি বিক্রি করছে আগের দামেই ৪৮ টাকা কেজি দরে। কিন্তু খুচরা পর্যায়ে ক্রেতারা আমদানি করা চিনির দামেই কিনছেন সরকারি এই চিনি। আর এই বাড়তি ৩০ থেকে ৩২ টাকা যাচ্ছে ব্যবসায়ীদের পকেটে।
তবে কোনও পর্যায়েই ব্যবসায়ীরা এই অতিরিক্ত লাভ করার কথা স্বীকার করছেন না। তারা কেবল বলছেন, বাড়তি দামে কিনতে হচ্ছে, তাদের কিছু করার নেই।
এক বছরে দাম প্রায় দ্বিগুণ
বাজার নিয়ন্ত্রণে পণ্য বিপণনকারী সরকারি প্রতিষ্ঠান টিসিবির দৈনিক বাজারদর বলছে, রাজধানীতে এখন চিনি বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৭৫ টাকা কেজি দরে (প্রকৃত মূল্য আরও বেশি)। আর এক মাসের ব্যবধানে চিনির দাম বেড়েছে ১৬ শতাংশেরও বেশি, আর এক বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ৮৫. ৯০ শতাংশ।
ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘এট স্পষ্ট যে চিনির বাজার স্বাভাবিক নয়। এ ক্ষেত্রে কারসারি হচ্ছে। নইলে এক বছরের ব্যবধানে দাম দ্বিগুণ হবে কেমনে?
ব্যবসায়ীদের দাবি, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ায় বেড়ে যাচ্ছে চিনির দর। তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার আগেই বাংলাদেশে এসেছে চিনি। এমনকি এক বছরে দেশে যত চাহিদা, তার চেয়ে বেশি চিনি এসেছে চলতি বছরেই।
অভিযোগ আছে, বরাবর আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার সুযোগ নিয়ে ব্যবসায়ীরা বরাবরই মাত্রাতিরিক্ত লাভ করে। বিশ্বব্যাংকের গবেষণাতেও। গত অক্টোবরে সংস্থাটির প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলেও বাংলাদেশে সেভাবে কমে না। কিন্তু বাড়লে দেশে বেড়ে যায়। চিনির ক্ষেত্রেও এবার এমনটি হয়েছে।
বাড়তি দামের দায় নিতে চায় না কেউ
দেশের বাজারে সাধারণত সরকারি মিলের লালচে দানার চিনি ও বেসরকারি মিলের সাদা দানার চিনি পাওয়া যায়। সোমবার রাজধানীর পাইকারি বাজার মৌলভীবাজার ৫০ কেজির এক বস্তা চিনি বিক্রি হয়েছে তিন হাজার ৪৯০ টাকায়। আর খুচরা বাজারে প্রতি কেজি বিক্রি হতে দেখা গেছে ৭৫ থেকে ৮০ টাকায়।
চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তারা ৫০ কেজির একেকটি বস্তা চিনি বিক্রি করছে দুই হাজার ৪০০ টাকায়। অর্থাৎ প্রতি কেজির দাম পড়ে ৪৮ টাকা। কিন্তু খুচরা পর্যায়ে এই চিনির দামই গিয়ে ঠেকছে ৭৮ টাকা পর্যন্ত।
রাজধানীর আনন্দ বাজারের খুচরা বিক্রেতা আব্দুল করিম ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘চিনির দাম তো বাড়তি, কমার তো লক্ষণ দেহি না’।
একই বাজারের আরেক বিক্রেতা আহমেদ উদ্দীন বলেন, ‘দাম বাড়লেও আমাগো লাভ নাই বেশি। আগেও কেজিতে দুই-তিন টাকা থাকতো, এহন্ও তাই থাহে’।
তাহলে এই বাড়তি লাভ কার পকেটে যাচ্ছে? খুচরা বিক্রেতারা দায়ী করছেন পাইকারি ব্যবসায়ীদেরকে। কিন্তু পাইকারি ব্যবসায়ীরাও দায় নিতে নারাজ। মৌলভীবাজারের এক বড় ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সরকার দেশীয় চিনি কলগুলোকে প্রণোদনা দেয়ার জন্য চিনি আমদানির ওপর শুল্ক বাড়িয়েছে। এর সুযোগ নিয়েছে চিনি বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। করারাপের ফলে যত টাকা ব্যয় বেড়েছে, কোম্পানিগুলো দাম বাড়িয়েছে তার চেয়ে বেশি।
পাইকারি চিনি ব্যবসায়ী আব্দুস সোবাহান বলেন, ‘কয়েকটি বড় কোম্পানি সিন্ডিকেট করে পণ্যটির দাম বাড়াচ্ছে’।
মৌলভীবাজারের ব্যবসায়ী আসলাম মিয়া বলেন, বাজারের যে গতি প্রকৃতি তাতে দাম সহসা কমবে এমনটা তিনি মনে করেন না। তার ধারণা, আগামীতে চিনির দাম আরও বেড়ে যেতে পারে।
এ তো গেলো বেসরকারি কোম্পানির চিনির হিসাব। সরকারি চিনি কেন এত দামে বিক্রি হবে? –জানতে চাইলে চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশনের সচিব মোহাম্মদ সামছুল কবীর ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমাদের চিনি তো খুচরা বাজারে ৫০ বা কাছাকাছি দামে বিক্রি হওয়ার কথা। কেন এর চেয়ে বেশি দাম তার জবাব আমাদের কাছে নেই। কারণ বাজার তদারকি আমাদের দায়িত্ব নয়, এটা দেখবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়’।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুনের কাছে জানতে চাইলে তিনি ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘বাজারে যখন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায় তখন টিসিবি তা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। আর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় তা তদারকি করে’। চিনির বাজারে অস্থিরতার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ব্যাপারটা টিসিবিকে বলা হচ্ছে, তারা ব্যবস্থা নেবে’।
সরবরাহে কোনও সংকট নেই
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে চিনির বাজার অস্থির হলেও এই মুহূর্তে দেশে পণ্যটির কোনও সংকট নেই। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (এপ্রিল পর্যন্ত) দেশে চিনি আমদানি হয়েছে সাড়ে ১৭ লাখ টন। এ ছাড়া সরকারি মিলগুলোয়ও রয়েছে এক লাখ টন চিনি। আর পুরো বছরে চিনির চাহিদা ১৫ লাখ টন।
বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ রোজার সময় বলেছিলেন, দেশীয় চিনিশিল্প রক্ষায় সরকার আমদানি শুল্ক বাড়িয়েছিল। তবে এর পরও চিনির কেজি ৬০ টাকার নিচে থাকার কথা। আকস্মিকভাবে কেউ কেউ কারসাজি করে দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। তারা ধরাও পড়ছে। কেউ কারসাজি করে দাম বাড়ালে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মন্ত্রী এই কথা বলার পর দাম আরও বেড়েছে। কিন্তু সেই ঘোষিত কঠোর ব্যবস্থা আর নেয়া হয়নি।
অভিযোগ আছে, দেশে পর্যাপ্ত মজুদ থাকলেও চিনির বাজারে কারসাজি করতে চিনি পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ইচ্ছা করে সরবরাহ কমিয়ে দেয়। রোজার সময় একটি বড় প্রতিষ্ঠান কারখানায় যন্ত্রপাতি মেরামতের নামে উৎপাদন বন্ধ রাখে। এটা্ও বাজারদর বৃদ্ধির একটি কারণ।
দাম বাড়ার সুফল পায়নি সরকারি চিনি কল
দেশের সরকারি চিনিকলগুলোতে প্রতি কেজি চিনি উৎপাদন করতে খরচ পড়ে প্রায় ৮৮ টাকা। সেই চিনি বিক্রি হচ্ছে মাত্র ৪৮ টাকায়। ফলে এক কেজি চিনিতে সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের (বিএসএফআইসি) কমপক্ষে ৪০ টাকা লোকসান হচ্ছে।
চিনির দাম বাড়ার পরও সরকারের এই লোকসান কমছে না। কারণ সরকার দাম বাড়ায়নি।
বিএসএফআইসির অধীনে বর্তমানে ১৫টি চিনিকল আছে। এগুলোর বার্ষিক মোট উৎপাদন ক্ষমতা ২ লাখ ১০ হাজার টন। তবে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে চিনি উৎপাদন করেছে মাত্র ৫৮ হাজার টন। আর এই চিনিও বিক্রি করতে পারে না সরকার। ফলে মজুদ বেড়ে লাখ টন ছাড়িয়েছে এরই মধ্যে।
বাজার পর্যবেক্ষকরা বলছেন, সরকারি চিনিকলগুলো বাড়তি দামে চিনি বিক্রি করে লোকসান কিছুটা কমাতে পারতো। আর সরকার সরবরাহ বাড়ালে বেসরকারি চিনিকলগুলোও চাপে পড়তো। সে ক্ষেত্রে দাম কমে আসতো বলে মনে করেন তারা।
তবে কেবল চিনি বিক্রি নয়, চিনিকলের লোকসান কমাতে সরকারকে পাঁচটি উদ্যোগ পরামর্শ দেয়া হয়েছে বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের এক সমীক্ষায়। এতে বলা হয়েছে, দেশে যে পরিমাণ আখ উৎপাদিত হয়, তার অর্ধেক ব্যবহার করা গেলেও চিনিকলগুলো তাদের উৎপাদন ক্ষমতার পুরোটা ব্যবহার করতে পারত। কিন্তু আখচাষিরা দাম কম হওয়ায় এবং বিক্রীত আখের দাম সময়মতো না পাওয়ায় গুড় উৎপাদকদের কাছে আখ বিক্রি করে দেন।
আর লোকসানের বৃত্তে থাকা চিনি কলগুলোর দায় বেড়েই চলেছে। কেবল গত অর্থবছরেই এই খাতে সরকারের লোকসান সাড়ে চারশ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। সব মিলিয়ে গত পাঁচ বছরে সংস্থাটির লোকসান দাঁড়িয়েছে দুই হাজার কোটি টাকা।
ট্যারিফ কমিশনের পাঁচ সুপারিশ
ট্যারিফ কমিশন মনে করে পরিপক্বতা অনুযায়ী যথাসময়ে আখ কেনা, মান অনুযায়ী আখের দাম নির্ধারণ, উন্নত জাতের আখ চাষ এবং বিদেশ থেকে অপরিশোধিত চিনি আমদানি করে পরিশোধন করতে পারলে সরকারি চিনি কলের লোকসান কমতো।
(ঢাকাটাইমস/১৯জুলাই/জিএম/ডব্লিউবি)