logo ০৮ জুন ২০২৫
জামায়াত ছাড়ার পরামর্শ
এবার গুরুত্ব দিয়েই ভাবছেন খালেদা জিয়া
বোরহানউদ্দিন, ঢাকাটাইমস
১৬ জুলাই, ২০১৬ ১১:৩৬:৫৪
image



ঢাকা: স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতের সঙ্গ ছাড়তে বিএনপির প্রতি সহানুভূতিশীল বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীদের পরামর্শের পর বিষয়টি নিয়ে গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে শুরু করেছেন জোট নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। বিএনপি চেয়ারপারসনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ একাধিক নেতা ঢাকাটাইমসকে জানিয়েছেন, এ বিষয়টি নিয়ে বিএনপির প্রতি সহানুভূতিশীল অন্য দল, রাজনীতিবিদ ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা করবেন জোট নেত্রী। আর দীর্ঘদিন ধরে ঝুলিয়ে রাখা সম্পর্কটি নিয়ে দ্রুতই একটি সিদ্ধান্তে আসতে চান খালেদা জিয়া।






দেশে সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলার পর আওয়ামী লীগের প্রতি জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছে বিএনপি। তবে জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধ থাকা অবস্থায় বিএনপির সঙ্গে আলোচনায় বসতে আগ্রহী নয় সরকারি দল। কেবল এবার নয়, ২০০৬ সালে শুরু হওয়া রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার সময়ও এই একই ইস্যুতে আওয়ামী লীগ-বিএনপির মধ্যে প্রত্যাশিত আলোচনা বারবার পিছিয়েছে বা হয়ইনি। জামায়াতের চার থেকে পাঁচ শতাংশ ভোটের কথা বা আন্দোলনে জামায়াত-শিবির কর্মীদের সক্রিয়তার কথা বিবেচনা করে বিএনপি বিষয়টি কখনও বিবেচনায় নেয়নি।






২০০১ সালে জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়ার পর ওই বছরের জাতীয় নির্বাচনে ব্যাপক সাফল্য পায় বিএনপি। ওই নির্বাচনে দুই দলের ভোট সমান হলেও মূলত শরিকদের ভোট যোগ হওয়ায় ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ধরাশায়ী করে বিএনপি। তবে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনে এই জোট আর কার্যকর প্রমাণ হয়নি।






তবে ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আন্দোলনে নজিরবিহীন সহিংসতায় সাধারণ মানুষের ব্যাপক প্রাণহানির পর বিদেশি গণমাধ্যমে দেয়া সাক্ষাৎকারে জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্বিবেচনার কথা জানান। এরপর থেকে দুই দল আগের মত ঘনিষ্ঠ না হলেও জোট ছাড়ার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা আর আগায়নি।






খালেদার জাতীয় ঐক্যের ডাক ও জামায়াত প্রতিবন্ধকতা






তবে জঙ্গিবিরোধী জাতীয় ঐক্যের ডাককে সরকার যেন এবার কোনও শর্ত দিয়ে অগ্রাহ্য করার সুযোগ না পায়, সে বিষয়ে সচেতন বিএনপি। আর বিএনপিপন্থি বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীদের কাছ থেকেও জামায়াত ছাড়ার পরামর্শ আসার পর বিষয়টি নিয়ে গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হচ্ছে খালেদা জিয়াকে।






বিএনপি নেতারা বলছেন, জঙ্গিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্যের উদ্যোগ থেকে খালেদা জিয়া পিছপা হবেন না। এ জন্য সব শ্রেণি পেশার নেতাদের সঙ্গে আরও বিস্তারিত আলোচনা করে রূপরেখা তৈরি করবেন বিএনপি চেয়ারপারসন। ইতিমধ্যে জোটের বাইরে আছে এমন রাজননৈতিক দল ও ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে কয়েকজন নেতাকে তিনি নির্দেশনাও দিয়েছেন। সে অনুযায়ী কাজও শুরু হয়েছে।






বৃহস্পতিবার রাতে দুই ঘণ্টার বৈঠকে প্রবীণ আইনজীবী রফিকুল হক ও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা জাফরুল্লাহ চৌধুরী খালেদা জিয়াকে জামায়াত ছাড়ার পরামর্শ দেন। বৈঠকে আগতরা জাতীয় ঐক্যের পথে জামায়াত বাধা বলে উল্লেখ করেছেন। বৈঠক শেষে রফিকুল হক সাংবাদিকদের বলেন, ‘উনাকে (খালেদা জিয়া) বলেছি জামায়াত ছাড়তে। এর বেশি কিছু আমি বলব না।’






জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘জামায়াতের বিষয়টা বৈঠকে উঠেছে। আমি বলেছি, জামায়াতকে তাদের পিতৃপুরুষেরা যে অন্যায় করেছে, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে, তার জন্য তাদেরকে আবার ক্ষমা চাইতে হবে।’






গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা বলেন, ‘বর্তমানে যারা আছে জামায়াতে, আমার পরামর্শ হলো-তাদের দলীয়ভাবে জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। তারা যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শ বিশ্বাস করে সেটা পুনরায় উল্লেখ করবে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের কবর জিয়ারত করবে’।






বিএনপি চেয়ারপারসনের মনোভাব কী বুঝলেন এমন প্রশ্নে জাফরুল্লাহ বলেন, ‘আমার মনে হয়েছে, উনিও মনে করেন এটি (জামায়াতে ইসলামী ক্ষমা চাওয়া) যুক্তিসঙ্গত।’






বৈঠকে উপস্থিত বুদ্ধিজীবীরা জানান, তাদেরকে খালেদা জিয়া বলেন, তিনি উগ্রবাদ ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্যের যে আহ্বান জানিয়েছি, সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ঐক্যের এই প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।






খালেদা জিয়া যাদেরকে উদ্দেশ্য করে জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছেন সেই আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও একই ধরনের ঐক্যের কথা বলেছেন। তবে দলের নেতারা বলছেন, দেশে জঙ্গি তৎপরতায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জামায়াত জড়িত। এই দলকে সঙ্গে নিয়ে জাতীয় ঐক্যের ডাককে তামাশা বলেছেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টাপরিষদের সদস্য বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ।






দলীয় সূত্রে জানা গেছে, জাতীয় ঐক্য গড়ার ক্ষেত্রে জামায়াত নিয়ে যেসব আলোচনা সামনে চলে আসছে তা নিয়ে গভীরভাবে পর‌্যালোচনা করছেন বিএনপি প্রধান। ঐক্যের আহ্বান নিয়ে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলার জন্য নেতাদের নির্দেশ দিয়েছেন। সে অনুযায়ী একাধিক টিম হয়ে সবার সঙ্গে আলোচনা করা করে জাতীয় ঐক্য নিয়ে প্রতিবন্ধকতা, জামায়াতের ব্যাপারে বক্তব্য সংগ্রহ করে পরবর্তী করণীয় ঠিক করা হবে।






শুরু থেকেই বিতর্কিত বিএনপি-জামায়াতের জোট






আওয়ামী লীগবিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে ১৯৯৯ সালে গোলাম আযমের জামায়াতে ইসলামী, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টি আর শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হকের ইসলামী ঐক্যজোটের কাছাকাছি আসে বিএনপি। এরপর ২০০১ সালে একজোট হয়ে নির্বাচনের পর ক্ষমতায় আসে চারদলীয় জোট। আর একাত্তরের আলবদর নেতা মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ মন্ত্রী হন।






দুই চিহ্নিত স্বাধীনতাবিরোধীকে মন্ত্রিত্ব দিয়ে সমালোচনায় পড়ে বিএনপি। আর ওই সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে জামায়াত নেতাদের ‘ঔদ্ধত্যপূর্ণ’ আচরণ ও বক্তব্যের পর বিএনপিকে জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগের দাবি উঠে নানা মহল থেকে। বিশেষ করে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরুর পর স্বাধীনতাবিরোধী দলের সঙ্গে জোট ত্যাগের দাবি জোরাল হয়। বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও একাধিক নেতা এ বিষয়ে খালেদা জিয়াকে পরামর্শ দেন বলে জানিয়েছেন বিএনপির নেতারা। কিন্তু বিএনপি বরাবরই দাবি করে আসছে, জামায়াতের সঙ্গে জোট শুধুই রাজনৈতিক।






একটু পেছনে ফিরে তাকালে জানা যায়, বিএনপির সামনে দীর্ঘদিন ধরেই প্রভাবশালী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার প্রতিবন্ধক হয়ে আছে দুইটি বিষয়। জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ও ভবিষ্যতে সুশাসনের ব্যাপারে আশ্বস্ত করতে না পারা। দশম সংসদ নির্বাচনের আগে প্রভাবশালী দেশগুলোর কূটনীতিকদের আলোচনায়ও এ দুটি বিষয় উঠে আসে। শুধু তাই নয়, গত বছর জানুয়ারিতে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে পাস হওয়া এক প্রস্তাবে বিএনপিকে জামায়াত ছাড়ার কথা বলা হয়।






দেশি-বিদেশি শুভাকাঙক্ষীদের পক্ষ থেকে পরামর্শ আসছে জামায়াত ছেড়ে নিজস্ব শক্তিতে পথ চলার। অন্যদিকে প্রকাশ্যে না বললেও বিএনপিরই অনেক শীর্ষ নেতা ভেতরে ভেতরে জামায়াত ছাড়ার পক্ষে কথা বলেছেন।






গত বুধবার রাতে জোটের বৈঠকেও জামায়াত নিয়ে আলোচনা হয়। বৈঠকে উপস্থিত জামায়াত নেতা আব্দুল হালিমকে উদ্দেশ্য করে খালেদা জিয়া বলেন, ‘আপনাদেরকে নিয়ে বিএনপির অনেক সমস্যা। অথচ আওয়ামী লীগকে নিয়ে আপনারা যখন বিএনপির বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন তখন সমস্যা হয়নি। এখন জামায়াত-বিএনপি জোট নিয়ে সরকারি দল নানা কথা বলছে। এর জবাব আপনাদেরই দেওয়া উচিত’।






ছোট ছোট রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে এমন দাবি ওঠা নিয়েও কথা হয়। তবে বৈঠকে জামায়াত এমন দাবি খণ্ডন করে কথা বলেন এবং যারা বিএনপিকে জামায়াত ছাড়ার কথা বলছেন তাদের জনপ্রিয়তা নিয়েও কথা বলেন। পরে অবশ্য খালেদা জিয়া খালেদা জিয়া কয়েকজন জ্যেষ্ঠ রাজনীতিবীদের নাম উল্লেখ করে বলেন, ভোটের মাঠে তাদের অবদান কম থাকলেও তাদের গ্রহণযোগ্যতা আছে।






জোটের ওই বৈঠক সূত্রে জানা যায়, জামায়াত নিয়ে খালেদা জিয়া চূড়ান্ত কোনো কথা না বললেও তার মনোভাব দেখে মনে হয়েছে সরকারের জামায়াত ছাড়ার দাবি অনেকটা কূটকৈাশল হতে পারে। বিএনপি জামায়াত ছাড়লে হয়তো সরকার তাদের সঙ্গে গোপনে আঁতাত করতে পারে। আবার জামায়াত ছাড়ার পর তারা জাতীয় ঐক্যের ডাকে সাড়া নাও দিতে পারে। যে কারণে হয়তো তিনি এ বিষয়ে করণীয় ঠিক করতে আরো সময় নিবেন।






ওই বৈঠকে জামায়াত নেতা দাবি করেন, গুলশান ও শোলাকিয়া হামলার পর জনগণের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে এসব ঘটনায় জামায়াতের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। সুতরাং জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে জনগণের এই আস্থা আরও জোরালো করা হবে।






(ঢাকাটাইমস/১৬জুলাই/বিইউ)