logo ২০ এপ্রিল ২০২৫
রংপুরে নয় ‘নিখোঁজের’ ছয়জন প্রকাশ্যে, একজন কারাগারে
রফিকুল ইসলাম, রংপুর থেকে
২১ জুলাই, ২০১৬ ১৪:২০:৪৫
image




সাম্প্রতিককালে নিখোঁজদের র‌্যাবের তালিকায় রংপুরের অন্তত ৯ জনের নাম রয়েছে। কিন্তু এদের চার জন তাদের নিজেদের বাড়িতেই আছেন। বাকি পাঁচ জনের একজন গত আট মাস ধরে কারাগারে এবং একজন রংপুর সেনানিবাসে চাকরি করছেন।



র‌্যাবের নিখোঁজের তালিকায় নিজের বা পরিবারের সদস্যদের নাম দেখে অবাক হয়েছেন অন্য স্বজনরা। কেউ কেউ এ নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন। একজন বলেছেন, এই তালিকায় নাম আসার খবর ছড়ানোর পর থেকে তার কাছে বারবার পরিচিতজনরা জানতে চাইছেন কী হয়েছে। কেউ জঙ্গি তৎপরতায় জড়িয়েছে কি না। ওই ব্যক্তি ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘মানসম্মান নিয়ে বাস করি ভাই। এই তালিকার কারণে কত যে প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে, মানসম্মান তো আর রইলো না ভাই, হয়রানির তো শেষ নেই’।



তালিকা করা নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে অবহেলার অভিযোগ করেছেন একাধিক ‘নিখোঁজ’ ব্যক্তি এবং তাদের স্বজন। তালিকায় নাম থাকার খবর জেনে কেউ কেউ নিজেরাই পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। জানিয়েছেন, তারা কোথাও যাননি।



এই কথিত নিখোঁজদের খোঁজ না পেয়ে কারও কারও নামে সাধারণ ডায়েরি হয়েছিল স্থানীয় থানায়। পরে ফিরে আসা বা সন্ধান পাওয়ার পর পুলিশ কর্মকর্তাদেরকে মৌখিক বা লিখিতভাবে জানিয়েওছিলেন সব। কিন্তু পুলিশ কর্মকর্তারা তাদের নথিতে তথ্য হালনাগাত করেননি। আর এ কারণে তাদের নাম উঠে গেছে নিখোঁজের তালিকায়।



একাধিক ভুক্তভোগী বলেন, নিখোঁজের বিষয়ে সাধারণ ডায়েরি করা হলেও তখন পুলিশ এ বিষয়ে অনুসন্ধান করেনি। বুধবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রংপুরে কথিত নিখোঁজ হওয়া ৬ জনের বাড়িতে গিয়ে এসব তথ্য জানা গেছে। আর তিন জনের বিষয়ে গোয়েন্দা প্রতিবেদনও ঢাকাটাইমসের কাছে আছে, যাতে দেখা যায় দুই জন বাড়িতে থাকেন। একজনের ক্ষেত্রে র‌্যাব যে নাম বলেছে ওই নামে কাউকে এলাকাবাসী শনাক্ত করতে পারেনি।



নিখোঁজ নন তারা



র‌্যাবের দেয়া নিখোঁজের তালিকার ১৫৯ নম্বরে আছে রেজোয়ানুর রহমানের নাম। তার ডাক নাম রকিব। বাড়ি নগরীর কামালকাছনা বৈরাগী পাড়ায়। তার বাবা মজিবর রহমান চাকরি করেন রংপুর এলজিইডিতে। আর রেজোয়ানুর সোয়া তিন বছর ধরে কাজ করেন রংপুর প্রেসক্লাবের নিচ তলায় একটি কম্পিউটারের দোকানে।



মজিবর রহমান ঢাকাটাইমসকে জানান, গত বছরের ১৩ মার্চ বাড়ি থেকে অভিমান করে ঢাকায় চলে যান তার ছেলে। পর দিন রংপুর কোতয়ালী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন তিনি। পরদিনই রেজোয়ানুর বাড়িতে ফোন করে এবং তার অবস্থান সম্পর্কে জানান এবং দুই দিন পরেই তিনি বাড়িতে ফেরেন।



মজিবর রহমান বলেন, ‘এরপর আমি থানায় যাই এবং জিডি তুলে নিতে পুলিশকে বলি। পুলিশ আমাকে বলে, আপনি বাড়িতে যান, জিডি উইথড্র হয়ে গেছে। এরপর আমি বাড়িতে চলে আসি। কিন্তু কয়েকদিন থেকে আমার বাড়িতে প্রশাসনের লোকজন আসছে খোঁজ নিতে। আমি অবাক হই। কারণ আমাদের ছেলে বাড়িতে কিন্তু তাকে নিখোঁজের তালিকায় দেয়া হলো? বিষয়টি নিয়ে আমি পুলিশের সাথে কথা বলেছি’।



র‌্যাবের নিখোঁজের তালিকায় ১৫৮ নম্বরে আছে শায়েস্তা খাঁর নাম। তার বাবা আব্দুস সবুর খান রংপুর সেনানিবাসে মেস ওয়াটার হিসাবে কর্মরত। তিনি বলেন, ‘এইচএসসি পরীক্ষা শেষে আমার ছেলে তিন বন্ধু মিলে ঢাকায় ঘুরতে যায়। কিন্তু আমরা সেটা জানতাম না। এরপর আমি রংপুর কোতয়ালী থানায় সাধারণ ডায়েরি করি (নম্বর ৮৯২)। পরে জানতে পারি তারা সবাই ঢাকায় আছে এবং সেনাবাহিনীতে চাকরির জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছে। এ ঘটনা জানার পর তারা সবাই বাসায় ফেরে এবং আমি তিনদিন পর নিজে থানায় গিয়ে জিডি তুলে নেই। তখন ডিউটি অফিসার ছিলেন খায়রুন। তিনি লিখেও দেন। কিন্তু আমি অবাক হচ্ছি এখন এসব কী হচ্ছে?’।



সবুর খান বলেন, ‘সেই থেকে আমার ছেলে আমার কাছেই ছিল। পরে তাকে কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজে হিসাববিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি করে দেই। সে সেখানে পড়ালেখা করছে’। তিনি বলেন, ‘কয়েকদিন থেকে আমার বাসায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন আসছে। আমি বিষয়টি আমার সিনিয়র অফিসারকে জানিয়েছি’। তিনি বলেন, শুধু আমার ছেলে নয়, আমার আরেক সহকর্মী শফিউল ইসলাম রংপুর সেনানিবাসে মেস কুক হিসাবে কাজ করেন (১৫ এমপি ইউনিট)। তার ছেলে মো. সাঈদ রংপুর সেনানিবাসে নিরাপত্তারক্ষী হিসাবে কর্মরত। র‌্যাবের নিখোঁজের তালিকার ১৬০ নম্বরে তার নাম আছে।



কথা হয় শায়েস্তা খাঁ এর সঙ্গেও। তিনিও জানান ঢাকায় যাওয়া ও পরে ফিরে আসার বিষয়টি।



নিখোঁজের তালিকায় ১৬১ নম্বরে থাকা সাব্বির আহম্মেদও নিখোঁজ নন। রংপুরে ডিসির মোড় কেরানীপাড়ার কাজী আশরাফ ভবনে থাকতেন তিনি। এখন সেখানে ‘আলোর ভুবন’ নামের একটি বেসরকারি সংস্থা আছে। ওই সংস্থার পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান জানান, সাব্বিরের বাবা কাজী আশরাফ উদ্দিন রংপুর সরকারি বেগম রোকেয়া কলেজে অধ্যাপনা করতেন। তারা এখন চুয়াডাঙ্গায় থাকেন। সেখানে কাজী সাব্বিরসহ পরিবারের লোকজনও থাকেন। মাঝে মধ্যে তারা রংপুর আসেন।



নিখোঁজের তালিকায় ১৫৭ নম্বরে থাকা শামিম মিয়া এবং ১৬৪ নম্বরে থাকা সাদ্দাম হোসেনের বিষয়ে খোঁজ নিতে গত সপ্তাহেই রংপুরে তাদের বাড়িতে যায় একটি রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। তাদেরকে বাড়িতেই পায় তারা এবং তাদের বিষয়ে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে প্রতিবেদনও দেয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন ওই গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা।



তালিকার ১৬৩ নম্বরে নাম থাকা মো ইকবাল হোসেন নারী নির্যাতন মামলায় গত আট মাস ধরেই রংপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী। জেল সুপার আবদুল কুদ্দুস ও রংপুর কোতয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এ বি এম জাহিদুল ইসলাম বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। পুলিশ জানায়, স্থানীয় এক মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে বিয়ে করার পর ইকবালের বিরুদ্ধে মামলা করে মেয়েটির পরিবার। পরে তার স্বজনরা ধরে ইকবালকে পুলিশে দেয় এবং আদালত তাকে কারাগারে পাঠায়। কিন্তু এর কিছুই জানতে পারেনি তার স্বজনরা। পরে গত এপ্রিলে ইকবালের বিষয়ে একটি সাধারণ ডায়েরি করেন তার বাবা মো. মাহবুবুর রহমান। পরে পুলিশ সব জানতে পারে।



একজন ‘মানসিকভাবে অসুস্থ’’’, ‘একজনের পরিচিতি অজানা’



নিখোঁজের তালিকার ১৬২ নম্বরে থাকা মো. রেজাউল করিম (বয়স ২৮) মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে। রংপুর কোতয়ালী থানার কলাবাড়ী মাহিগঞ্জ এলাকায় তারা থাকতেন। এখন সেই বাড়িতে কেউ থাকেন না। স্থানীয় বাসিন্দা ইউসুফ আলী জানান, ‘রেজাউলের মানসিক রোগ ছিল। সে মাটিসহ যা পেত তাই খেত। কিছুদিন আগে গাইবান্ধায় একটি বাড়িতে ডাকাতি হয়। ওই বাড়ির বারান্দায় শুয়ে ছিল রেজাউল। পরে পুলিশ তাকে ধরে নেয়। এরপর মা রোজিনা বেগম তাকে ছাড়িয়ে আনে। এরপর তারা জমি বিক্রি করে চলে গেছে’।



আর র‌্যাবের তালিকায় ১৬৫ নম্বরে থাকা মো নজরুল ইসলামের বাবার নাম বলা হয়েছে আল আমিন। রংপুর কোতয়ালী থানার পার্বতীপুর এলাকায় তার বাড়ি বলা হয়েছে। তবে স্থানীয় বাসিন্দারা এই নামে ওই এলাকায় কখনও কেউ থাকতো- এমন কথাই বলতে পারছেন না। সরকারি একটি গোয়েন্দা সংস্থার অনুসন্ধানেও একই বিষয় উঠে এসেছে।



রংপুর কোতয়ালী থানার ওসি এবিএম জাহিদুল ইসলাম জানান, ‘তারা যখন নিখোঁজ হয়েছিল আমাদের কাছে ডায়েরি করেছে আমরা তা গ্রহণ করেছি। এরপর ফিরে আসার তথ্য আছে। কীভাবে তারা নিখোঁজের তালিকায় গেল সে বিষয়ে র‌্যাব ভালো জানবে’।



এসব বিষয়ে জানতে চাইলে র‌্যাব-১৩ এর অপারেশন অফিসার দোলন মিয়া ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘তালিকাটি যাচাই বাছাই করা হচ্ছে’।   



ঢাকাটাইমস/২১জুলাই/ডব্লিউবি