ঢাকা: আড়াই বছরেও রাজধানীর বসুন্ধরা থেকে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া আট জন ঘরে ফেরেনি। থানায় সাধারণ ডায়েরি, র্যাবের কাছে লিখিত আবেদন এবং সবশেষে হাইকোর্টে রিট- সম্ভব সব কিছুই করেছে তাদের পরিবার। কিন্তু তাদের উদ্ধার বা সন্ধানলাভে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তেমন কোনো তৎপরতাই নেই।
বিএনপি-জামায়াত জোটের সরকারবিরোধী আন্দোলন চলাকালে ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর রাতে বসুন্ধরায় আড্ডা দিচ্ছিলেন এই আট জন। এরমধ্যে একটি গাড়িতে করে কালো পোশাকধারী একদল লোক এসে তাদেরকে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায় বলে জানিয়েছিলেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।
গুলশানের অভিজাত রেস্তোরাঁ হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার পরে সারাদেশে নিখোঁজ হওয়া যুবকদের বিষয়টি সামনে আসে। র্যাব পুলিশ নিখোঁজদের তালিকা প্রকাশের জন্য কাজ করছে। ইতোমধ্যে র্যাব দুটি তালিকা প্রকাশ করেছে। প্রথম তালিকায় ২৬২ জনের নাম আর সংশোধনের পরে ৬৮ জনের নামের তালিকায়। কিন্তু এই তালিকায় নেই ওই আট যুবকের নাম।
যারা নিখোঁজ
নিখোঁজরা হলেন- বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমন, জাহিদুল করিম তানভীর, আদনান চৌধুরী, কাওসার আহমেদ, মাজহারুল ইসলাম রাসেল, আল আমিন, আসাদুজ্জামান রানা ও আবদুল কাদের ভুঁইয়া।
এই আটজনের মধ্যে একজন ছিলেন রাজনৈতিক কর্মী। একজন একটি দলের সমর্থক। তিনজন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করেছেন। একজন ছিলেন অনার্স চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। বাকি দুজনের বিষয়ে বিস্তারিত পরিচয় জানা যায়নি।
এ ঘটনায় করা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ভাটারা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) বাবুল হোসেন ঢাকাটাইমসকে জানান, এখন পর্যন্ত তদন্তে এ ঘটনার কোনো অগ্রগতি নেই।
বিভিন্ন থানায় জিডিও করেছে নিখোঁজদের স্বজনরা। এর একটি হয়েছে তেজগাঁও থানায়। তেজগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাজহারুল ইসলাম ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘এটা অনেক পুরোনো ঘটনা। তাছাড়া আমি সে সময় এই থানায় ছিলামও না। তাই কী হয়েছে সে বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না।’
নিখোঁজদের মধ্যে সাজেদুল ইসলাম সুমন ছিলেন তেজগাঁও থানার ৩৮ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক। তার সঙ্গে ছিলেন তার খালাতো ভাই জাহিদুল করিম ওরফে তানভীরও। তাকেও ধরে নিয়ে যাওয়া হয়।
পশ্চিম নাখালপাড়ায় ভাড়া বাসায় থাকতেন মাজহারুল ইসলাম রাসেল। তিনি কখনও সরাসরি রাজনীতিতে জড়াননি। ২০১৩ সালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স শেষ করেছেন। পাশাপাশি পড়াশোনা করতেন আইন বিষয়ে। বিসিএস লিখিত পরীক্ষায় পাস করে অপেক্ষায় ছিলেন মৌখিক পরীক্ষার জন্য।
রাসেলের ছোট বোন নুসরাত জাহান লাবণী ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘ঘটনার দিন বিকালে আমার ভাই বের হয় সুমনের সঙ্গে। কিন্তু রাতেই শুনি কারা যেন বন্ধুদের সঙ্গে তাকেও ধরে নিয়ে গেছে। ওই ঘটনার পর থেকেই আমরা বিভিন্ন সময় র্যাব অফিসে যোগাযোগ করেছি। কিন্তু লাভ হয়নি।
২০১৩ সালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স পাসের পর বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন আসাদুজ্জামান রানা। তার বাড়ি রংপুরের বদরগঞ্জের মাথুরা গ্রামে।
রানার বোন মিনারা বেগম ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘রানা, মাসুম, আল-আমিন ও রাসেল চার বন্ধু ছিল। একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করত। ঘটনার দিন চার বন্ধু একসঙ্গে আড্ডা দেওয়ার জন্য ঘর থেকে বের হয়। এর পর থেকে রানার কোনো খোঁজ নেই।’
আরেক নিখোঁজ আল-আমিনের ছোট ভাই মোহাম্মদ রুহুল আমিন বলেন, ‘ঘটনার দিন বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার কথা বলে ঘর থেকে সে বের হয়। এর পর থেকে তার কোনো খবর আমাদের কাছে নেই। ঘটনার পরদিন বাড্ডা থানায় একটি জিডি করি। পরের দিন ভাটারা থানায় মামলা করেন আমার বাবা আহমদউল্লাহ। কিন্তু আজ পর্যন্ত মামলাটির কোনো সুরাহা করতে পারেনি পুলিশ।’
৩৩৭/বি নম্বর বাড়িতে থাকতেন আবদুল কাদের ভুঁইয়া মাসুম। তিনি মহাখালীর সরকারি তিতুমীর কলেজের ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের অনার্স শেষ বর্ষের ছাত্র ছিলেন। স্বপ্ন ছিল বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করবেন। প্রায়ই স্বজন আর বন্ধুদের বলতেন সে স্বপ্নের কথা। পড়াশোনার পাশাপাশি চাকরির জন্য প্রস্তুতি এরই মধ্যে শুরু করেছিলেন মাসুম।
উচ্ছ্বল ছেলেটি গুম হবে তা বিশ্বাসই হয় না বড় ভাই রফিকুল আসান ভুঁইয়া আরজুর। ঢাকাটাইমসকে তিনি বলেন, ‘আমরা তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোট মাসুম। কতই না আদরের ভাইটি ছিল আমাদের। সারাক্ষণ মজা করত। আড্ডা দিতে ভীষণ পছন্দ করত সে। সেদিনও বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার কথা বলেই বের হয়। বলেছিল ফিরবে তাড়াতাড়িই। কিন্তু আমাদের অপেক্ষা আর শেষ হয় না। কোথায় গেলে পাব তাকে?’
নিখোঁজদের মধ্যে কাওসার আহমেদ ও এ এম আদনান চৌধুরী শাহীনবাগের বাসিন্দা। তাদের নাম ছাড়া বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়নি।
জানতে চাইলে র্যাব-১ এর অধিনায়ক লে কর্নেল তুহিন মাসুদ ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘তাদের পরিবারের সদস্যরা এখনও আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। আমরাও তাদের খুঁজছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত তাদের সন্ধান পাইনি।’
মামলা নিতে পুলিশের অনীহা
এতগুলো মানুষ এক জায়গা থেকে উধাও কিন্তু পুলিশ, র্যাব বা সরকারি কোনো সংস্থার কোনো তৎপরতা নেই। কারা নিয়েছে এদের? স্বজনদের অভিযোগের তীর র্যাবের দিকে। রাজধানীর ভাটারা থানায় এ নিয়ে মামলাও হয়েছে একটি।
এ মামলাটি হয়েছে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে। করেছেন নিখোঁজ আল-আমিনের বাবা আহমদউল্লাহ। সুমনের পরিবার মামলা করতে গিয়েছিল তেজগাঁও থানায়। কিন্তু র্যাবের বিরুদ্ধে করতে যাওয়া সে মামলা নেয়নি পুলিশ। আবার বেশ কয়েকটি ঘটনায় থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করলেও পুলিশ তাতে গুরুত্ব দেয়নি। এর তদন্ত এগোয়নি বললেই চলে।
এখনও ফেরার প্রত্যাশায় স্বজনরা
সাজেদুল ইসলাম সুমনের বৃদ্ধা হাজেরা খাতুন আড়াই বছর ধরে অপক্ষো করছেন কবে তা ছেলে ফিরবে। ছেলেকে ফিরে পেতে র্যাবের কাছে ধর্ণা দেওয়ার পাশাপাশি তিনি চলতি বছরের ৯ মার্চ হাইকোর্টে একটি রিটও করেন।
জানতে চাইলে সুমনের বড় বোন আফরোজা ইসলাম ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘ভাই ফিরে আসবে এমন প্রতীক্ষায় রয়েছি। আমরাও বিশ্বাস করি যে সুমন বেচেঁ আছে সে ফিরবে।’
(ঢাকাটাইমস/ ১আগস্ট/এএ/ডব্লিউবি)