ঢাকা: ১৯৯৮ সালের ২৩ এপ্রিল নিজ বাসায় খুন হন ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান লতিফুর রহমানের ১৫ বছরের মেয়ে শাজনীন তাসনিম রহমান। প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের অন্যতম মালিক এ শিল্পপতির মেয়ের হত্যাকাণ্ডের চূড়ান্ত রায় পেতে সময় লেগেছে দীর্ঘ ১৮ বছর। মঙ্গলবার এ মামলার রায় ঘোষণা করেন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ। হাইকোর্টে মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকা পাঁচ আসামির মধ্যে চারজনকে খালাস দিয়ে একজনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয় রায়ে। এ ঘটনায় চলমান অন্য একটি মামলাও বাতিল করে দেন আপিল বিভাগ।
তবে আলোচিত এ মামলার চূড়ান্ত রায় পেতে এত সময় লাগলো কেন এটা নিয়ে অনেকের মনে প্রশ্ন উঠেছে। এত বড় একজন শিল্পপতির মামলা নিষ্পত্তিতে ১৮ বছর লাগলে সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে অবস্থা কী হবে সেটা তাদের প্রশ্ন। আইন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, শুধু এই মামলাটিতে নয়, বাংলাদেশের বিচার বিভাগে এ ধরনের ঘটনা অহরহ ঘটে। এখানে ‘বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে’। প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা বিভিন্ন সময় এ ব্যাপারে বিচারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তিনি প্রতিটি মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের বারবার তাগিদও দিয়েছেন।
যে কারণে শাজনীনের মামলা নিষ্পত্তিতে বিলম্ব
শাজনীনের মামলা নিষ্পত্তিতে কেন বিলম্ব হয়েছে এ ব্যাপারে আসামিপক্ষের প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘এ মামলার প্রধান আসামি শহিদুল ইসলাম প্রথম থেকেই স্বীকার করে আসছেন যৌন আকর্ষণ থেকে তিনি একাই শাজনীনকে হত্যা করেন। এখানে পুলিশ চেষ্টা করে তাকে দিয়ে অন্য একটি স্ট্যাটমেন্ট দিয়েছিল। এরপর মামলার শেষ মুহূর্তে এসে শহিদুল আবার বিচারকের কাছে একই কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, আমিই শাজনীনকে হত্যা করেছি। এখানে অন্য কেউ সম্পৃক্ত ছিল না। কিন্তু দুর্ভাগ্য, আমাদের ট্রাইল কোর্ট, হাইকোর্ট এবং পুলিশ মিথ্যা সাক্ষী সাজিয়েছে এই নিরীহ লোকদের ওপরে। এরপর তাদেরকে ফাঁসির রায় দেয়া হয়েছে। সবশেষ আপিল বিভাগ আইনগতভাবে সবকিছু সূক্ষ্মভাবে পর্যালোচনা করে সঠিক ব্যক্তির সাজা বহাল রেখেছেন। যারা নির্দোষ তাদের ছেড়ে দিয়েছেন।’
মামলাটির চূড়ান্ত শুনানি শেষ করতে এতদিন সময় লাগার কারণ কী জানতে চাইলে এই আইনজীবী বলেন, ‘শাজনীন হত্যাকাণ্ড একটি আলোচিত ঘটনা। এটি দুঃখজনকও। শাজনীনের বাবা মিডিয়া ব্যক্তিত্ব। তিনি বিরাট একজন শিল্পপতি। তার মেয়ের হত্যাকাণ্ড। তাই স্বাভাবিকভাবেই কোর্ট একটা দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে ছিল। কেসটা আনতে আমরা আসামিপক্ষ থেকে বহুবার চেষ্টা করেছি। কিন্তু আমরা পারিনি।’
বাংলাদেশের বিচার বিভাগে বিলম্বিত প্রক্রিয়ার কথা স্মরণ করিয়ে খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘ফৌজদারি মামলায় এরকম হয়। অনেক দিন পরে এ মামলার রায় এসেছে। রায়ে আমরা খুশি। অবশ্য দুঃখিত যে, কিছু নিরীহ লোক এতদিন কারাবন্দী থাকলো।’
সম্প্রতি আলোচিত দুটি শিশু খুলনার রাকিব ও সিলেটের রাজন হত্যাকাণ্ডের বিচার দ্রুত শেষ করা হয়েছে এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে আসামিপক্ষের এ আইনজীবী বলেন, ‘কর্তার ইচ্ছাই কীর্তন হয়। সরকার পক্ষের আইনজীবীদের ইচ্ছা অনুযায়ী সব হয়। তারা ইচ্ছা করলে দেরি করতেও পারেন, ইচ্ছা করলে তাড়াতাড়িও করতে পারেন। এই মামলাটা সরকার পক্ষ থেকেই অযথা দেরি করা হয়েছে বারবার।’
এ মামলার শুনানিতে শাজনীনের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট এএম আমিনউদ্দিন। মামলা নিষ্পত্তিতে দেরির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কিছু বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
রাষ্ট্রপক্ষে এ মামলা শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল দিলারোজ্জামান। তিনি ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘মামলাটির পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হলে বিষয়টি বোঝা যাবে। রায়ে কোথায় কী ফাইন্ডিংস আছে সেটা পরে বলা যাবে।’
শাজনীন হত্যার বিচার প্রক্রিয়া
১৯৯৮ সালের ২৩ এপ্রিল হত্যাকাণ্ডের পরপরই শাজনীনের পরিবার থেকে মামলা করা হয়। মামলাটির বিচারিক কাজ শেষ করে ২০০৩ সালের ২ সেপ্টেম্বর ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক কাজী রহমতউল্লাহ রায় ঘোষণা করেন। বিচারিক আদালতে এ মামলার নিষ্পত্তির সময় লাগে প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর। ওই রায়ে শাজনীনকে ধর্ষণ ও খুনের পরিকল্পনা এবং সহযোগিতার জন্য তাদের বাড়ির সংস্কারকাজের দায়িত্ব পালনকারী ঠিকাদার সৈয়দ সাজ্জাদ মইনুদ্দিন হাসানসহ ছয়জনকে মৃত্যুদণ্ড দেন আদালত।
নিয়ম অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ডের প্রতিটি রায় কার্যকরে হাইকোর্টের অনুমোদন নিতে হয়। সেই অনুযায়ী রায় হওয়ার পরপরই এসব মামলার যাবতীয় নথিপত্র হাইকোর্টে চলে আসে। হাইকোর্টের প্রস্তুত করা হয় পেপারবুক। এরপর পর্যায়ক্রমে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত এসব মামলার শুনানি অনুষ্ঠিত হয়।
শাজনীন হত্যা মামলাটিও একই প্রক্রিয়া অনুযায়ী হাইকোর্টে শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। শুনানি শেষে ২০০৬ সালের ১০ জুলাই হাইকোর্ট রায় ঘোষণা করেন। রায়ে নিম্ন আদালতে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া মইনুদ্দিন হাসান, শহীদ, বাদল, মিনু ও পারভীনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রাখেন হাইকোর্ট। তবে একই দণ্ডপ্রাপ্ত শনিরামকে বেকসুর খালাস দেয় আদালত। ডেথ রেফারেন্সের শুনানি হতে সময় লাগে তিন বছর।
হাইকোর্টের এ রায়ের বিরুদ্ধে দণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচ আসামির মধ্যে গৃহকর্মী শহীদুল ইসলাম ছাড়া চার আসামি মইনুদ্দিন হাসান, বাদল, শহীদুল এবং গৃহপরিচারিকা মিনু ও পারভীনের পক্ষে আপিল বিভাগে আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন (লিভ টু আপিল) করেন। ২০০৯ সালের ২৬ এপ্রিল মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত চার আসামির লিভ টু আপিল মঞ্জুর করেন আপিল বিভাগ। এ পর্যায়ে সময় লাগে প্রায় তিন বছর।
২০০৯ সালে আপিল আবেদন মঞ্জুর হওয়ার পর চলতি বছরের ২৯ মার্চ এ মামলার আপিল শুনানি শুরু হয়। গত ১০ মে শুনানি শেষে মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ (সিভিএ) রাখেন আদালত। আড়াই মাসের বেশি সময় পরে মঙ্গলবার এ মামলায় রায় ঘোষণা করা হয়।
আসামিপক্ষের আইনজীবী এসএম শাহজাহান ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘মামলার রায় কার্যকর হতে আরও দুইটি ধাপ বাকি আছে। মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আসামি তাদের দণ্ডের বিরুদ্ধে রিভিউ করতে পারবেন। রিভিউতে রায় বহাল থাকলে রাষ্ট্রপতির কাছে তিনি প্রাণভিক্ষা চাইতে পারেন। রাষ্ট্রপতি ক্ষমা না করলে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে।’
(ঢাকাটাইমস/০২আগস্ট/এমএবি/জেবি)