logo ২০ এপ্রিল ২০২৫
আইনের ফাঁক গলে জন্ম, এখনো ছিদ্র খুঁজছে পিস স্কুল
হাবিবুর রহমান, ঢাকাটাইমস
০৫ আগস্ট, ২০১৬ ০৮:১৬:২৪
image



ঢাকা: প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠায় সরকারি নীতিমালার ফাঁক-ফোকর গলে দেশের বিভিন্ন এলাকায় পিস স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিল জামায়াত-শিবিরের অনুসারীরা। ভারতীয় বিতর্কিত ইসলামি বক্তা ডা. জাকির নায়েকের পিস টিভির নামের একটি অংশ ব্যবহার করে মুনাফা করাই ছিলো এগুলোর প্রধান উদ্দেশ্যে।






রাষ্ট্রীয় নজরদারির ঘাটতি থাকায় এসব স্কুলে শিশু-কিশোরদের জঙ্গিবাদে উৎসাহিত করার সন্দেহ এখন জোরালো হচ্ছে। কারণ গুলশান হামলার একাধিক জঙ্গি ডা. জাকির নায়েককে অনুসরণ করতো- এর প্রমাণ মিলেছে। খোদ শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলছেন, ‘পিস স্কুল জঙ্গি তৈরির ক্ষেত্রকে উৎসাহিত করছিলো।’






এগুলো বন্ধে উদ্যোগও নিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী। ২ আগস্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্প্রতি এক অফিস আদেশে অনুমোদনহীন পিস স্কুলসমূহ অবিলম্বে বন্ধ করার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।’






অথচ এর আগেই ১৫টি জেলায় অন্তত ২৭টি স্কুল শিক্ষামন্ত্রীর ভাষায় জঙ্গি তৈরির ক্ষেত্রকে উৎসাহিত করেছে। সেটাও অন্তত তিন বছর ধরে।






এ ধরনের স্কুল কিভাবে চালু হলো- এখন এমন প্রশ্ন তুলছেন শিক্ষাবিদরা।  কোনো স্কুল প্রতিষ্ঠা, শিক্ষক নিয়োগ, পাঠ্যক্রম প্রনয়নে সরকারের কোনো নজরদারি না থাকার সমালোচনা করছেন তারা। এ প্রসঙ্গে নটরডেম কলেজের সাবেক অধ্যাপক এ এন রাশিদা বেগম বলেন, ‘এটা স্পষ্ট যে স্কুল অনুমোদন প্রক্রিয়া ও তদারকিতে ঘাটতি আছে।’






এসব বিষয়ে অভিভাবকদেরও সচেতন হওয়া জরুরি বলে মনে করেন এই শিক্ষক। তিনি বলেন, ‘বাবা-মা যদি সন্তানকে জাকির নায়েক বানাতে চান, তাহলে দেশে জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ কঠিন হয়ে যাবে।’






তবে শিক্ষা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার প্রসার উৎসাহিত করতে এতোদিন স্কুল প্রতিষ্ঠার নীতিমালা প্রয়োগে কঠোরতা ছিলো না। জঙ্গিবাদের প্রশ্ন আসার পর এখন থেকে আর কোনো ছাড় না দেয়ার কথা বলেন তারা।






নীতিমালা আছে শুধু কাগজেই






সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী বেসরকারি স্কুল প্রতিষ্ঠায় ১৩টি শর্ত পূরণ করতে হয়। এর অন্যতম হচ্ছে ‘নিবন্ধন’ নেয়া। কিন্তু শিক্ষা কর্মকর্তারা বলছেন, রাজধানী ঢাকায় লালমাটিয়া এলাকার পিস স্কুল এই নিবন্ধন নিয়েছে। তাহলে অনিবন্ধিত স্কুলগুলো কীভাবে এতদিন কার্যক্রম চালালো- এ প্রশ্নের জবাব নেই কারও কাছে।






নীতিমালায় বলা হয়েছে, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড অনুমোদিত এবং সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী নির্ধারিত পাঠ্যক্রম অনুসরণ করতে হবে।






এসব সেভাবে তদারকি করা হয় না বলে স্বীকার করেন ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের স্কুল পরির্দশক এটি এম মঈনুল। তিনি বলেন, স্কুলে কী পড়ানো হচ্ছে, কোন পাঠ্যক্রম অনুসরণ করা হচ্ছে, সরকারি নির্দেশনা মানা হচ্ছে কি না- এসব এখন পর্যন্ত যাচাই করা হয় না। তবে নীতিমালা সংশোধন করে এসব বিষয়ে জোর দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে বলে তিনি দাবি করেন।






বাণিজ্যিক ধারার স্কুল প্রতিষ্ঠার অনুমোদন কিভাবে দেয়া হয়- এমন প্রশ্নে এই স্কুল পরির্দশক জানান, ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের ক্ষেত্রে প্রথমে দেখা হয়, একটি বিদ্যালয়ে কতজন শিক্ষক-শিক্ষিকা থাকছে। এর কত জন বিদেশি শিক্ষক, কত জন বাংলাদেশি শিক্ষক রাখা হবে তা-ও বিবেচনা করা হয়। শিক্ষার্থী সংখ্যা, অবকাঠামো আর পরিবেশও যাচাই করা হয়। আশপাশের এলাকায় ইংরেজি মাধ্যম স্কুল আছে কিনা, থাকলে এর দূরত্ব কত, ব্যাংক জামানতের মতো বিষয়ও নিরীক্ষা্ করা হয়। এসব শর্ত না মানলে তাদের নিবন্ধন দেয়া হয় না বলে এটি এম মঈনুল দাবি করেন।






তাহলে নিবন্ধনহীন পিস স্কুলগুলো কিভাবে চলছিলো- জানতে চাইলে তিনি বলেন, এগুলোর সাময়িক নিবন্ধন ছিলো। এখন আর এগুলোর স্থায়ী অনুমোদন পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।






পিস স্কুলে মওদুদিবাদ






গোয়েন্দা প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, দেশের বেশিরভাগ পিস স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালকরা জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে যুক্ত। কেউ কেউ মুক্তিযুদ্ধবিরোধী দলটির অনুসারী। তাদের উদ্যোগে এসব স্কুলের পাঠ্যক্রমে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে জামায়াতের আধ্যাত্মিক নেতা আবুল আলা মওদুদীর দর্শন যোগ করা হয়েছে। ইংরেজি ও আরবি শিক্ষার পাশাপাশি মওদুদিবাদ শিক্ষা দেয়ায় শিশু-কিশোরদের মধ্যে উগ্রবাদী চিন্তাধারা প্রভাব বিস্তার করছে।






সরকারি একাধিক সূত্রের দাবি, পিস স্কুল নিয়ে গোয়েন্দাদের সন্দেহ-সংশয় নতুন নয়। গত মার্চে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়ে তদন্ত করার নির্দেশ দেয়া হয়। এরপরই তদন্তে নামে গোয়েন্দারা। এই প্রতিবেদন পাওয়ার পরই পিস স্কুল বন্ধের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় বলে জানিয়েছে সরকারের সংশ্লিষ্টরা।






পিস স্কুল বন্ধের নির্দেশ দিয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, ‘পিস স্কুলে যে লেখাপড়া হচ্ছে, যে পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে, এটি আমাদের দেশের জন্য কখনও মঙ্গলকর নয়। এগুলো যারা পরিচালনা করছেন তারা আমাদের স্বাধীনতার চেতনার বিরোধী শক্তি। তারা এখানে এমন পরিবেশ তৈরি করছেন যা শিশু-কিশোরদের জঙ্গিবাদে ধাবিত করতে পারে। যার জন্য এ ধরনের প্রতিষ্ঠান আমরা চালাতে দিতে পারি না।’






এ প্রসঙ্গে শিক্ষাবিদ এ এন রাশিদা বেগম বলেন, ‘কেবল পিস স্কুল কেন, কোনো প্রতিষ্ঠানে যদি সমাজ বা রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর কিছু পড়ানো হয়, তাহলে শুরুতেই তাদেরকে থামিয়ে দিতে হবে।’






রাতারাতি নামবদল!






পিস স্কুল বন্ধ করে দিতে সরকারের নির্দেশনা জারির আগেই রাজশাহীতে স্কুল কর্তৃপক্ষ নাম পাল্টে ‘লিজেন্ড একাডেমি’ করে ফেলে।






মহানগরের তেরখাদিয়ার গাজী ভবনের পিস স্কুল অ্যান্ড কলেজের মূল সাইনবোর্ডের উপর এখন ‘লিজেন্ড একাডেমি’ নামে ডিজিটাল ব্যানার জুড়ে দেয়া হয়েছে। এছাড়া শিশু শিক্ষার্থী বহনের রিকশাভ্যানে লেখা ‘পিস স্কুল অ্যন্ড কলেজ’ নামও মুছে ফেলা হয়েছে। তবে শিক্ষার্থীদের পরিচয়পত্র, ব্যাগ, ক্যালেন্ডার, খাতাপত্র এবং স্কুল ড্রেসের উপর এখনও রয়েছে পিস স্কুলের নাম।






এদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশের পর পরই লালমাটিয়ার বি-ব্লকের ৫/৭ বাড়ির পিস ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের সাময়িক নিবন্ধন বাতিল করে আদেশ জারি করেছে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড।






এতে বলা হয়েছে, “বিতর্কিত কার্যক্রমে লিপ্ত থাকায় ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয় পীস ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, লালমাটিয়া, ঢাকা এর বোর্ডের ২০১৪ সালের ১৩ নভেম্বর তারিখের ২৯৫৬ নং পত্রে প্রাপ্ত সাময়িক নিবন্ধন এতদ্বারা বাতিল করা হল।”






তবে নতুন নামে আবার চালুর বিষয়ে অভিভাবকদেরকে ভাবনা দূর করার চেষ্টা করছে কর্তৃপক্ষ। ‘সাউথ শোর’ নামে স্কুলটি আবার নিবন্ধিত হয়েছে বলেও অভিভাবকদেরকে এসএমএসে জানিয়ে দেয়া হয়।






মালিবাগে পিস স্কুল শাখায় অভিভাবক পরিচয় দিয়ে ফোন করার পর প্রয়োজনে নাম পাল্টে আবারও তা চালু করার আশ্বাস দেয়া হয়।






শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার পর ফেনী শহরের ট্রাংক রোডের পিস স্কুলটি আপাতত বন্ধ হয়ে গেলেও এটি নতুন নামে আসবে বলে জানিয়েছেন এর পরিচালকরা।






দিনাজপুরেও তিনটি স্কুল কর্তৃপক্ষ তাদের প্রতিষ্ঠানের নাম পাল্টে দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন গণমাধ্যম কর্মীদের। সরকারি নির্দেশনা আসার পর বন্ধ হয়ে যাওয়া স্কুলের নামফলক খুলে নেয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীদের আনা নেয়ার কাজে ব্যবহার করা স্কুলবাসে পিস স্কুলের নামও মুখে ফেলা হয়েছে।






তবে পিস স্কুল বন্ধের বিষয়ে সরকারি নির্দেশনা আসার পর এই স্কুলগুলোর উদ্যোক্তারা যেন নতুন কোনো কৌশলে কার্যক্রম শুরু করতে না পারে, সেদিকে নজর রাখার কথা জানিয়েছেন শিক্ষা প্রশাসনের কর্মকর্তারা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব চৌধুরী মুফাদ আহমেদ ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘নাম পাল্টে যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম চালু রেখেছে, সেগুলোও বন্ধ করে দেয়া হবে। নতুন করে কাউকে নাম পাল্টানোর সুযোগ দেয়া হবে না। এ বিষয় প্রতিটি শিক্ষাবোর্ডের কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।’






শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, বিভিন্ন এলাকায় পিস স্কুলের কর্তৃপক্ষ অভিভাবকদেরকে যেভাবে নাম পাল্টে দেয়ার কথা বলছে, প্রক্রিয়া এত সহজ নয়। এ জন্য অনেক কিছুই করতে হয় আর চাইলেই রাতারাতি কিছু করে ফেলা সম্ভব নয়। অভিভাবকদের আস্থায় নিতেই স্কুল কর্তৃপক্ষ তাদের সঙ্গে প্রতারণা করছে বলেও মনে করছেন একাধিক কর্মকর্তা।






(ঢাকাটাইমস/৫আগস্ট/এইচআর/এমএইচ/এমআর)