logo ২০ এপ্রিল ২০২৫
‘নতুন জেএমবি’তে হিযবুত, শিবির, আনসারউল্লাহ একাকার
আশিক আহমেদ, ঢাকাটাইমস
১৭ আগস্ট, ২০১৬ ১১:৪৮:৪৬
image




দেশে জঙ্গি তৎপরতা শুরু দুই যুগেরও আগে। তবে বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড যতটা আতঙ্ক ও উদ্বেগ তৈরি করেছে, ততটা এর আগে কমই দেখা গেছে। বিশেষ করে বিদেশি, সংখ্যালঘুদেরকে টার্গেট করে আক্রমণ ভাবিয়ে তুলেছে গোটা রাষ্ট্রযন্ত্রকেই। আর এসব তৎপরতায় নাম আসছে ‘নতুন জেএমবি’ নামে সংগঠনের।



পুলিশের দাবি, হলি আর্টিজান হামলা বা সাম্প্রতিক টার্গেট কিলিং এই নতুন জেএমবিরই কাজ। যদিও এর আগে নানা ঘটনার পর জড়িত হিসেবে জামাআ’তুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ বা জেএমবি, হরকাতুল জিহাদ, আনসারউল্লাহ বাংলাটিম, আনসার আল ইসলাম, হিযবুত তাহরীর কখনও বা জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরের নাম। তবে হলি আর্টিজানকাণ্ডের পর পুলিশের তদন্তে বের হয়ে আসে, সবগুলো সংগঠনই নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করে সমন্বিতভাবে কাজ করছে।



২০০৪ সালের ১৭ আগস্ট সারাদেশে একযোগে বোমা হামলা চালিয়ে জেএমবির উত্থান হলেও পরে শীর্ষ ছয় নেতার ফাঁসি কার্যকরের পর কিছুটা দমে যায় কর্মীরা। তবে এরপর নিজেদেরকে নানাভাবে সংগঠিত করেছে তারা। সঙ্গে যোগ হয়েছে আরও নতুন নতুন সংগঠন। সবাই মিলে এখন একযোগে তৎপরতা শুরু করেছে-বলছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।



গোয়েন্দারা বলছেন, আর্টিজান হামলার পর বিভিন্ন এলাকা থেকে আটক জঙ্গিদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য যাচাই-বাছাই করে এই সিদ্ধান্তে এসেছেন তারা। পুলিশের বিশেষ শাখা কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম সংবাদ সম্মেলন করে এই বিষয়টি একাধিকবার নিশ্চিত করেছেন।



পুলিশ বলছে, গত কয়েক বছরের প্রবণতা দেখে এটা স্পষ্ট যে, জঙ্গিরা আগের চেয়ে নৃশংস হয়েছে। নাশকতা ছড়িয়ে তারা ভীতির সঞ্চার করতে চাইছে।



এই জেএমবির পুনরুত্থান বা নতুন জেএমবির জন্ম কি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারির অভাবে?- জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার আছাদুজ্জামান ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘পুলিশের নজরদারি সবসময়ই ছিল। না থাকলে একের পর এক আসামি গ্রেপ্তার হতো না।’



সবাইকে এক করার চেষ্টায় তামিম-জিয়া



আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানায়, সম্প্রতি সব কটি সংগঠনকে সমন্বয় করে কার্যক্রম চালানোর চেষ্টা করছে নতুন জেএমবি। এদেরকে এক করার চেষ্টায় রত ছিলেন অভ্যুত্থান চেষ্টার অভিযোগে সামরিক বাহিনী থেকে জিয়াউল হক ও বাংলাদেশে আইএসের কথিত প্রধান তামিম চৌধুরী। এই দুইজনকে ধরিয়ে দিতে ২০ লাখ টাকা পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়েছে।



আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, সবগুলো জঙ্গি সংগঠনের কর্মতৎপরতার ধরণ একই রকম। তারা মূলত উচ্চশিক্ষিত তরুণদের মগজ ধোলাই করে উগ্র তৎপরতায় নিয়ে আসে। সাবেক জেএমবি, হিযবুত তাহরীর, আনসার আল ইসলাম এবং শিবির কর্মীরা মিলেমিলেই উগ্র তৎপরতায় জড়িত। এই জঙ্গিরা আগের চেয়ে দক্ষ, নৃশংস। হলি আর্টিজান ও শোলাকিয়ায় হামলার পর তারা যে খুনে মনোভাব দেখিয়েছেন, এর আগে জঙ্গিরা তা দেখায়নি।



২০০৭ সালের জামায়াতুল মুজাহিদ বাংলাদেশ জেএমবির প্রধান শায়খ আবদুর রহমান সহ ছয় জঙ্গিও ফাঁসি কার্যকরের মধ্য দিয়ে জেএমবির সাংগঠনিক তৎপরতা বন্ধ হয়ে যায়নি। শায়খ আবদুর রহমানের স্ত্রী নুরজাহান বেগম রুপা ও তার মেয়ে আয়েশা রহমান জেল থেকে বেরিয়ে মাওলানা সাঈদুর রহমানের নেতৃত্বে জেএমবি পুন:গঠনে কাজ শুরু হয়। তাদের অবস্থান সম্পর্কে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাখে কোন তথ্য নেই।



ময়মনসিংহের ত্রিশালে পুলিশের ভ্যানে হামলা, আশুলিয়ায় ব্যাংক ডাকাতি, রাজধানীর গোপাবাগের সিক্স মার্ডার, শেরেবাংলানগরে টেলিভিশন উপস্থাপক মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকী, বাড্ডায় পিডিবির সাবেক চেয়ারম্যান মুহাম্মদ খিজির খান হত্যায় জেএমবিকেই সন্দেহ করছে পুলিশ।



কয়েক মাস আগেও ঢাকার একটি কওমি মাদ্রাসার শিক্ষক জসীমউদ্দীন রাহমানীর উগ্রপন্থি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের নানা তৎপরতার খবর আসে গণমাধ্যমে। ব্যাংক লুট, বেছে বেছে হত্যাসহ নানা ঘটনায় জড়ায় এই সংগঠনের নেতা-কর্মীরা।



এর মধ্যে তৎপরতা চালু রাখে ২০০৯ সালেই নিষিদ্ধ হিযবুত তাহরীর। বিশেষ করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে তৎপরতা চালানো এই সংগঠনের কর্মীদের একটি বড় অংশই পরে আনসারুল্লায় যোগ দেয় বলে তথ্য পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।



হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার দুই মূল হোতার একজন হাসনাত আর করিম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে হিযবুত তাহরীরের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। এই হামলায় জড়িত নিবরাস ইসলামও হিযবুত কর্মী ছিলেন।



আনসারুল্লাহর নেতা জসীমউদ্দীন রাহমানী আটক হলেও তার অনুসারীরা লোকবল সংগ্রহ ও জঙ্গি তৎপরতা চালু রাখে। এরপর একে একে নাম আসে আনসার আল ইসলামের নাম। চাকরিচ্যুত মেজর জিয়াউল হক এর নেতৃত্ব দেন।



পুলিশ জানায়, পথ ভিন্ন হলেও ইসলামী ছাত্রশিবিরের কর্মীদের একটি অংশও জঙ্গিবাদে জড়িয়েছে। আর্টিজান হামলায় মূল হোতাদের একজন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবি বিভাগের সাবেক ছাত্র নুরুল ইসলাম ফাহাদ ওরফে মারজান ছিলেন শিবিরের সাথী। ওই আস্তানা থেকে আটক বগুড়ার হাসান শিবির নিয়ন্ত্রিত কোচিং সেন্টার রেটিনায় ভর্তির পর পাল্টে যান বলে জানিয়েছেন তার মা।



কল্যাণপুর জঙ্গি আস্তানায় প্রাণ হারানো নোয়াখালীর যোবায়ের হোসেনও শিবিরের সক্রিয় কর্মী ছিলেন বলে জানিয়েছে পুলিশ। কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় পুলিশের ওপর  জঙ্গি হামলার পর আটক দিনাজপুরের সফিউল ইসলাম ওরফে শরিফুল ইসলামও জামায়াত পরিবারের সন্তান।



স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, গত কয়েক বছরে জঙ্গি তৎপরতায় জড়িত থাকার অভিযোগে যে চার হাজার জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের একটি বড় অংশই কোন না কোন সময় শিবির কর্মী ছিলেন।



আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে মানবতাবিরোধী অপরাধের আসামিদের ফাঁসির দাবিতে গড়ে উঠা গণজাগরণের পরই জঙ্গিদের এই নতুন রূপের আবির্ভাব। বিভিন্ন মত পথের জঙ্গিরা একত্র হয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করে তাদের স্বার্থ হাসিলের চেষ্টায় রত হয়। এ ক্ষেত্রে একেক গোষ্ঠীর স্বার্থ একেক হলেও এখন সরকারকে সাধারণ শত্রু হিসেবে ধরে নিয়ে উৎখাতের চেষ্টায় রত।



সাবেক পুলিশ প্রধান নুরুল হুদা ঢাকাটাইমসকে বলেন, সব জঙ্গিগোষ্ঠীরই মূল উদ্দেশ্য ইসলামি শরিয়া আইন প্রতিষ্ঠা। জঙ্গিরা মনে করে গণতান্ত্রিক সরকার ইসলামের দুশমন। তাই মত ও পথ ভিন্ন হলেও সরকারকে হটাতে তারা একজোট হয়েছে।



জামিনে বের হয়ে যাওয়া জঙ্গিদের নিয়ে উদ্বেগ



স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক নানা সময়ে এই বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন। মঙ্গলবারও রাজধানীতে এক আলোচনায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, পুলিশ অনেক কষ্ট করে জঙ্গিদের ধরলেও নানা ত্রুটির কারণে জামিনে ছাড়া পেয়ে লাপাত্তা হয়ে যায় তারা।



মঙ্গলবার রাজধানীতে এক আলোচনায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ‘অনেক সময় একটা আসামি ধরার জন্য এক বছরও লাগে। কিন্তু ধরা পড়ার পর তারা জামিনে ছাড়া পেয়ে যায়। আমি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে বলবো, এটা আমাদের দুর্ভাগ্য।



নানা সময় জঙ্গি আস্তানার সন্ধান



গত বছরের শেষ দিকে রাজধানীর মিরপুরের শাহআলী থানার চিলেড্রেন পার্কের কাছে একটি ছয় তলা বাড়িতে জঙ্গিদের আস্তানায় অভিযান জালিয়ে বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক দ্রব্যসহ সাত জনকে আটক করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। গোয়েন্দা পুলিশের ভাষ্য সেখান থেকে গ্রেনেড তৈরি করে দেশের বিভিন্নস্থানে সরবারাহ করা হতো।



ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মোহাম্মদ সানোয়ার হোসেন ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মিরপুরের ওই বাসায় যে সব গ্রেনেড উদ্ধার হয়েছে তা রাজধানীর কামরাঙ্গীচরে ও হোসনী দালানের বিস্ফোরণকৃত গ্রেনেডের সঙ্গে মিল পাওয়া যায়।



এরপর বগুড়ায় জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পায় পুলিশ। সেখান থেকেও উদ্ধার হয় গ্রেনেড ও গ্রেনেড তৈরির বিস্ফোরক।



সবশেষ গত ২৬ জুলাই কল্যাণপুরের জাহাজবাড়িতে জঙ্গি আস্তানায় পুলিশের অভিযানে নিহত হয় সন্দেভাজন ৯ জঙ্গি।



ঢাকাটাইমস/১৭আগস্ট/এএ/ডব্লিউবি