পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডে সদ্য পরিত্যক্ত কেন্দ্রীয় কারাগার লাগোয়া অস্থায়ী এজলাসে ঢাকার এক নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে মামলা দুটির বিচার চলছে। বিচারক মো. শাহেদ নুর উদ্দিন এ মামলার কার্যক্রম পরিচালনা করছেন।
২০০৮ সালের ১১ জুন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, হরকাতুল জিহাদের শীর্ষ নেতা মুফতি হান্নানসহ ২২ জনের বিরুদ্ধে আদালতে প্রথম অভিযোগপত্র জমা দেয় সিআইডি। এরপর বিচারে ২০০৮ সালের ২৯ অক্টোবর থেকে ২০০৯ সালের ৯ জুন পর্যন্ত ৬১ জনের সাক্ষ্য নেয় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল।
২০০৯ সালের ৩ আগস্ট রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনে অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেয় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল। ২০১১ সালের ৩ জুলাই অধিকতর তদন্ত শেষে তারেক রহমানসহ আরও ৩০ জনের বিরুদ্ধে সম্পূরক অভিযোগপত্র জমা দেয় সিআইডি। ২০১২ সালের ১৮ মার্চ তারেক রহমানসহ সম্পূরক অভিযোগপত্রের ৩০ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে ফের বিচার শুরু হয়।
মামলাটিতে খালেদা জিয়ার ভাগ্নে সাইফুল ইসলাম ডিউক, সাবেক আইজিপি মো. আশরাফুল হুদা, শহিদুল হক ও খোদা বক্স চৌধুরী এবং মামলাটির তিন তদন্ত কর্মকর্তা সাবেক বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিন, সিআইডির সিনিয়র এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমান, এএসপি আবদুর রশীদ ও সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার আরিফুল ইসলাম জামিনে আছেন।
সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, হুজি নেতা মুফতি আবদুল হান্নানসহ ২৪ জন আসামি কারাগারে আছেন। অন্যদিকে তারেক রহমান, খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদসহ ১৯ জন আসামি পলাতক।
জোট সরকারের জজ মিয়া নাটক
চারদলীয় জোট ক্ষমতায় থাকতে ২০০৪ সালের ওই ঘটনার দিনই পুলিশ বাদী হয়ে মতিঝিল থানায় একটি মামলা করে। তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি)। শুরু থেকেই ঘটনাটি ভিন্নখাতে নেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। এই মামলার তদন্তে জোট সরকার যুক্তরাজ্যের গোয়েন্দা সংস্থা স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের একটি প্রতিনিধি দলকে আমন্ত্রণ জানালেও তারা দেশে এসে সরকারের কর্মকাণ্ডে বিরক্তি প্রকাশ করে। ওই সময় পুলিশ এই মামলার গুরুত্বপূর্ণ আলামত গায়েব করে দেয় বলে অভিযোগ ওঠে তখন।
আর তদন্তের এক পর্যায়ে সব উদঘাটনের দাবি করে কথিত জজ মিয়ার জবানবন্দি নিয়ে ‘আষাঢ়ে গল্প’ ফেঁদেছিলেন তৎকালীন তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির এএসপি আবদুর রশিদ ও সাবেক বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিন। সিআইডির এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমান তদন্তের ভার পাওয়ার পর তিনিও হেঁটেছেন সাজানো পথে। আর সে সময়ের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর সংবাদ সম্মেলন করে দাবি করেন, এক হকার জজ মিয়াই এই ঘটনার মূল হোতা।
ক্ষমতায় থাকতে বিএনপির অনেক নেতা এও বলেছিলেন যে, আওয়ামী লীগ নিজেরা নিজেরাই এ ঘটনা ঘটিয়ে সরকারের ওপর দোষ চাপাতে চাইছে। ঘটনার ১০ মাস পার হলে ২০০৫ সালের ৯ জুন নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার বীরকোট গ্রামের বাড়ি থেকে জজ মিয়া নামের এক যুবককে সিআইডি আটক করে।
১৭ দিন রিমান্ডে রেখে জজ মিয়া ১৬৪ ধারায় ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জবানবন্দি দেয়। যাতে জজ মিয়া বলেন, ‘তিনি আগে কখনো গ্রেনেড দেখেননি; গ্রেনেড ও বোমার মধ্যে পার্থক্য তিনি জানেন না। পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে বড় ভাইদের নির্দেশে তিনি অন্যদের সঙ্গে গ্রেনেড মারতে এসেছেন। কারা এই বড় ভাই? জবাবে তিনি বলেন, শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন, জয়, মোল্লা মাসুদ, মুকুল প্রমুখ। এর প্রায় দুই বছর পর ২০০৬ সালে জজ মিয়া নাটকের সব ভণ্ডুল করে দেন তার মা জোবেদা খাতুন। একটি পত্রিকাকে তিনি বলেন, জজ মিয়া গ্রেপ্তারের পর থেকে সিআইডি তার পরিবারকে মাসে মাসে খোরপোষের টাকা দিয়ে আসত। জজ মিয়াকে রাজসাক্ষী করতে সিআইডির প্রস্তাবের কথাও বলেন জোবেদা।
ঘটনা তদন্তে ২০০৪ সালের ২৪ আগস্ট বিচারপতি মো. জয়নুল আবেদীনকে চেয়ারম্যান করে এক সদস্যের একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশনও করেছিল চারদলীয় জোট সরকার। সেই কমিশন ১০ দিনের মাথায় সরকারের কাছে ১৬২ পাতার প্রতিবেদন দেয়। যেখানে
২১ আগস্টের ঘটনার পেছনে বিদেশি শক্তির হাত আছে বলা হয়। কিন্তু কোনটি সেই দেশ তা নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি। বলা হয়, প্রতিবেশী একটি দেশে এই হামলার মহড়া হয়েছে। সে সময় তার এই প্রতিবেদন রীতিমতো হাসির খোরাক হয়। পরে সেটি অবশ্য আর প্রকাশ করা হয়নি।
জজ মিয়া নাটকের যবনিকাপাত
২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় মামলাটির পুনরায় তদন্ত হলে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। বেরিয়ে পড়ে থলের বিড়াল। তদন্তে দেখা যায়, বিএনপি নেতা আবদুস সালাম পিন্টুর সহযোগিতায় জঙ্গিগোষ্ঠী হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশের (হুজি-বি) জঙ্গিরা শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে ওই হামলা চালিয়েছিল। মূলত তাদের লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতে। চারদলীয় জোট সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের সরাসরি মদদে তদন্তের নামে জজ মিয়া নাটক সাজানো হয়েছিল বলেও জানা যায়।
২০০৮ সালের ১১ জুন হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে আদালতে দুটি অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়। সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার ফজলুল কবিরের জমা দেওয়া অভিযোগপত্রে হরকাতুল জিহাদের নেতা মুফতি হান্নান, পিন্টু ও তার ভাই তাজউদ্দিনসহ ২২ জনকে আসামি করা হয়। সেই সঙ্গে জজ মিয়াসহ ২০ জনকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
পরে ২০০৯ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এলে মামলাটির অধিকতর তদন্ত করা হয়। ওই হামলার সঙ্গে সরাসরি জড়িত থাকা জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি হান্নান জবানবন্দি দেন। যেখানে তিনি তারেক রহমান, বাবর, পিন্টু এবং হারিছ চৌধুরীর নামসহ তৎকালীন সিআইডি ও একটি গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নাম ফাঁস করে দেন।
পুনরায় তদন্তের ভিত্তিতে সিআইডি ২০১১ সালের ৩ জুলাই সম্পূরক অভিযোগপত্র দেয়। তাতে তারেক রহমান, বাবর, হারিছ চৌধুরী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদসহ আরও ৩০ জনকে আসামি করা হয়। দুই অভিযোগপত্র মিলে আসামির সংখ্যা দাঁড়ায় ৫২ জনে। ২০১২ সালের ১৮ মার্চ হত্যা মামলায় ৫২ জনের বিরুদ্ধে এবং বিস্ফোরক মামলায় ৪১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। এর মধ্যে আদালত বিস্ফোরক মামলায় সশস্ত্র বাহিনী ও পুলিশের সাবেক ১১ কর্মকর্তাকে অব্যাহতি দেন।
ঢাকাটাইমস/২১আগস্ট/এইচএফ/ডব্লিউবি
আরো পড়ুন