logo ০৩ জুলাই ২০২৫
আতঙ্কে ঝরে রক্তঘাম!
ঢাকাটাইমস ডেস্ক
০৮ ডিসেম্বর, ২০১৩ ১১:১৬:৫০
image

ঢাকা: শরীর চুঁইয়ে রক্ত ঝরে। ঘাম-রক্ত! যুদ্ধ শুরুর আগে মৃত্যুর আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন এক সৈনিকের গা-বেয়ে গড়িয়ে পড়ে ঘাম-রক্ত। লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চির আঁকা ছবিতে সেই দৃশ্য ধরা আছে।


তবে ভারতের পশ্চিবঙ্গের হাওড়া জেলায় চ্যাটার্জিহাটের ষষ্ঠ শ্রেণির মেয়েটির ঘটনাটা একেবারে বাস্তবের। কোনও কারণে তীব্র মানসিক উদ্বেগ হলে অথবা ভয় পেলেই কপাল, গাল, হাতের কনুই বেয়ে ঘামের সঙ্গে গড়িয়ে পড়ে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত। উদ্বেগ কেটে গেলে মেয়েটি আবার স্বাভাবিক।


চিকিৎসকদের কাছে অবশ্য এই রোগের বেশি নজির নেই। চিকিৎসকের ভাষায়, ১৯৫২ থেকে এ পর্যন্ত বিশ্বের নানা প্রান্তের ‘মেডিক্যাল লিটারেচার’থেকে এমন রোগীর সন্ধান মিলেছে ২০-২৫টি। যার মধ্যে ভারতে পাঁচটি।


পাকিস্তান থেকে প্রকাশিত ‘জার্নাল অব কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনস’-এর চলতি বছরের এপ্রিল সংখ্যায় কোয়েটা অঞ্চলের এক মহিলার এমন একটি রোগের কথা মেডিকেল রিপোর্টে তুলে ধরা হয়েছে।


সম্প্রতি ডোমিনিকান রিপাবলিকের এক তরুণী, বছর উনিশের ডেলফিনা সেডেনোরও একই লক্ষণ ধরা পড়ে। তারও প্রথম দিকে ঘামের সঙ্গে রক্ত গড়িয়ে পড়ত। তার পর ধীরে ধীরে নখ, নাভি এমনকী চোখ থেকেও বেরোতে শুরু করে রক্ত।


চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে, চরম মানসিক দুশ্চিন্তা থেকেই রক্তজালিকা ফেটে ঘামের সঙ্গে রক্ত ঝরে। চিকিৎসা পরিভাষায় যাকে বলে, ‘হেমাটোহাইড্রোসিস’ এবং এই রোগ জিনগত নয়।


ভারতের কিশোরীর ক্ষেত্রে বিষয়টি নজরে আসে গত বছর। কিশোরীর বাবা জানায়, দিনটা ছিল ২০১২ সাল, কী একটা কারণে একটু বকেছি মেয়েকে। দেখি, ও কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেল! ওর জুলফির পাশ দিয়ে ঘাম ঝরছে। সঙ্গে মিশে রয়েছে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত।


ঘামের সঙ্গে রক্ত পড়লেই কিশোরীর বাবা-মা বুঝতে পারেন মেয়ে কোনও কারণে উদ্বিগ্ন, অথবা ভীষণ ভয় পেয়েছে। এমন ঘটনা সপ্তাহে ২০-২৫ বারও হয়েছে বলে জানায় তার পরিবার।


মায়ের অভিযোগ, “জন্ম থেকে এমন ছিল না মেয়েটি। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ত অন্য এক স্কুলে। সেখানের এক দারোয়ান দিনের পর দিন ছুটির পরে ফাঁকা স্কুলে মেয়েটিকে যৌননিগ্রহ করত। এ কথা কাউকে জানালে মেরে ফেলার হুমকিও দিত। এই ভয়ে ও কোনও দিন আমাদের কিছু জানায়নি। অথচ দেখতাম, মেয়েটা কেমন চুপচাপ হয়ে যাচ্ছে, আচরণও বদলে যাচ্ছে। তার পর থেকেই ওই রক্ত পড়া শুরু।”


যৌননিগ্রহের কথা মেয়েটি প্রথম জানায় ভারতের পশ্চিমবঙ্গের এসএসকেএম হাসপাতালের চিকিৎসকদের। কয়েকমাস ধরে এমন হচ্ছে দেখে গত ফেব্রুয়ারিতে এই হাসপাতালের ত্বক বিভাগে মেয়েকে নিয়ে আসেন বাবা-মা।


এক সপ্তাহ ‘নজরদারি’-তে রেখে যাবতীয় পরীক্ষার পর মেয়েটিকে পাঠানো হয় ‘ইনস্টিটিউট অব সাইকিয়াট্রি’ (আইওপি) বিভাগে। সেখানেই ‘সাইকোলজিক্যাল ইভ্যালুয়েশন’ বা মনোবৈজ্ঞানিক পরীক্ষা করে মেয়েটির রক্তক্ষরণের আসল কারণ ধরা পড়ে।


চিকিৎসকেরা জানান, মাত্রাতিরিক্ত মানসিক উত্তেজনা ও ভয়ে কোনও কোনও মানুষের দেহের সূক্ষ্ম রক্তজালিকা (ক্যাপিলারি ব্লাড ভেসেলস) ছিঁড়ে যায়। সেখান থেকে নির্গত রক্ত ঘামের সঙ্গে মিশে চামড়ার উপরে থাকা ছিদ্র দিয়ে চলে আসে বাইরে।


হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মেয়েটির কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করেন। সেখানেই উঠে আসে তার উপর যৌননিগ্রহের তথ্য এবং তার থেকে উদ্বেগ ও ভয় পাওয়ার ছবিটা। কিন্তু শুধুমাত্র দুর্নামের ভয়ে ওই দারোয়ানের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি মেয়েটির পরিবার।


এসএসকেএমের ত্বক বিভাগের প্রধান গোবিন্দ চট্টোপাধ্যায় বলেন,  “আমার দীর্ঘ পঁচিশ বছরের চিকিৎসক জীবনে এই রকম দুটি ঘটনা দেখলাম। এমন একটি ঘটনা চার বছর আগে দেখেছি আরজি কর হাসপাতালে। রোগটা মূলত অত্যধিক মানসিক চাপ থেকে হয়।”


মানুষের ত্বকের নিচের অংশটিকে ‘ডারমিস’ এবং উপরের অংশটাকে ‘এপিডারমিস’ বলে। কোনও কারণে ভয় পেলে এপিডারমিসের রক্তজালিকাগুলো সঙ্কুচিত হয়ে যায়। পরমুহূর্তে জালিকাগুলি আবার যখন প্রসারিত হয়, তখন কিছু ক্ষেত্রে তা ফেটে রক্ত বেরিয়ে আসতে পারে। সেই রক্তই ঘামের সঙ্গে বেরিয়ে আসে। কারণ, ঘর্মগ্রন্থি আর রক্তজালিকা পাশাপাশি থাকে।


ইনস্টিটিউট অব সাইকিয়াট্রি (আইওপি)-তে এখন চিকিৎসা চলছে মেয়েটির।


চিকিৎসকদের দাবি, অনেকটাই সুস্থ হয়েছে মেয়েটি। মাসে এখন হয়তো একবার ঘামের সঙ্গে রক্ত বের হয়, তাও সামান্য। সম্ভবত যৌন হেনস্থা থেকেই মেয়েটির মনের ভিতর এত মারাত্মক ভয় জমেছিল যে সে সেই চাপ নিতে পারছিল না।


মনোবিজ্ঞানের পরিভাষায় এসব উপসর্গকে ‘ট্রান্স অ্যান্ড পজেশন ডিসঅর্ডার’ নামে অভিহিত করা হচ্ছে। চিকিৎসকদের মতে, এই মানসিক সমস্যা কিংবা শরীর থেকে রক্তঘাম বেরোনো, দুই-ই আসলে দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা ভয়, উদ্বেগের বহিঃপ্রকাশ। তবে এই রোগে সাধারণ কারণে ঘাম হলে কোনও রক্তক্ষরণ হয় না।


(ঢাকাটাইমস/৮ডিসেম্বর/জেএস)