logo ০৪ মে ২০২৫
বিতর্কিত সিমেন্সের রমরমা ব্যবসা
নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাটাইমস
০৬ মে, ২০১৪ ০০:৫৩:৫৭
image

ঢাকা: জার্মানিভিত্তিক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান সিমেন্স এজি। ঘুষের বিনিময়ে কার্যাদেশ হাতিয়ে নিয়ে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দুর্নাম কামিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি; কোনো কোনো দেশে নিষিদ্ধও। চট্টগ্রামের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল ও টেলিটকের মোবাইল নেটওয়ার্ক স্থাপনের কাজ ঘুষের বিনিময়ে পাওয়ার অভিযোগও তাদের বিরুদ্ধে প্রমাণিত। তবে কলঙ্কজনক এ অধ্যায়ের পরও এ দেশে ব্যবসা থেমে থাকেনি তাদের। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বরং গতি পেয়েছে বেশ।


বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে দেশের বেশ কয়েকটি প্রকল্প ঘুষের বিনিময়ে বাগিয়ে নেয় সিমেন্স। এ-সংক্রান্ত অভিযোগগুলো আলোচনায় আসে ২০০৭-০৮ সালের দিকে। যুক্তরাষ্ট্রে এ-বিষয়ক মামলা দায়েরের ভিত্তিতে সিমেন্সও ঘুষ প্রদানের বিষয়টি স্বীকার করে। ওই সময় বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসায় কিছুটা মন্দা গেলেও বিদ্যুৎ খাতে ভাড়া ও দ্রুত ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্র চালু তাদের ব্যবসা বাড়াতে ভূমিকা রেখেছে। এমনকি গত পাঁচ বছরে সরকারের নানা উন্নয়ন প্রকল্পে পরোক্ষভাবে বড় অঙ্কের ব্যবসা হাতিয়ে নিয়েছে সিমেন্স।


জানা গেছে, শুধু অক্টোবর ২০১২ থেকে সেপ্টেম্বর ২০১৩ পর্যন্ত এক বছরে প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশে প্রায় এক হাজার ৮০০ কোটি টাকার ব্যবসা করেছে। তাদের হাতে রয়েছে আরো প্রায় এক হাজার ৯০০ কোটি টাকার কার্যাদেশ। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্য, অবকাঠামো ও শিল্প খাতে কাজ করছে। কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুকেন্দ্রের জন্য টারবাইন যন্ত্রাংশ সরবরাহ করেছে সিমেন্স। স্বাস্থ্য খাতে আগে সরকারি হাসপাতালগুলোয় রোগ পরীক্ষার যন্ত্রপাতি সরবরাহ করলেও বর্তমানে বেসরকারি খাতে তা সরবরাহ করছে প্রতিষ্ঠানটি। পাশাপাশি বড় হোটেল বা হাসপাতালগুলোয় সাবস্টেশন স্থাপন ও বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা এবং বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে বিদ্যুত্সাশ্রয়ী যন্ত্রাংশ বিক্রি করছে সিমেন্স বাংলাদেশ।


সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসা বাড়ার বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করেছেন সিমেন্স বাংলাদেশের করপোরেট কমিউনিকেশন্সের দায়িত্বপ্রাপ্ত হুমায়ন কবির টিটু। বাংলাদেশে সিমেন্সের উপস্থিতি দীর্ঘদিনের উল্লেখ করে তিনি বলেন, কলঙ্কজনিত ওই অধ্যায়ের পরও বাংলাদেশে নিয়মিত ব্যবসা করে গেছে সিমেন্স। মাঝে গতি কিছুটা কমে এলেও গত কয়েক বছরে আবার তা চাঙ্গা হয়ে ওঠে। তবে সিমেন্স বাংলাদেশ সরাসরি কোনো দরপত্রে অংশগ্রহণ করে না। বাংলাদেশে বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগকৃত প্রতিষ্ঠানগুলোকে যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে সিমেন্স। এসব দরপত্রে অংশগ্রহণও জার্মানি থেকে হয়।


যদিও অনুসন্ধানে জানা যায়, সিমেন্সর বাংলাদেশে বৃহৎ কার্যালয় চালু আছে। সেখানে শতাধিক নিয়মিত কর্মী কাজ করছেন।


মূলত বিদ্যুৎ খাত ঘিরেই বাড়ছে সিমেন্সের ব্যবসা। আশুগঞ্জের ২২৫ মেগাওয়াট ও ৪৫০ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুেকন্দ্রের যন্ত্রপাতি সরবরাহের কাজ পেয়েছে সিমেন্স বাংলাদেশ। ২০১৫ সালের মধ্যে এ প্রকল্প থেকে ৬৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে। এছাড়া শিকলবাহায় ১৫০, সিরাজগঞ্জে ১৫০ ও ময়মনসিংহে ৭০ মেগাওয়াট বিদ্যুকেন্দ্র স্থাপনেও ব্যবহার হবে সিমেন্সের যন্ত্রপাতি। এদিকে কাজ শুরুর আগেই বেশি পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ রেখে অনুমোদন দেয়া হয়েছে শিকলবাহা দ্বৈত জ্বালানি প্রকল্প। এর ব্যয় ধরা হয়েছে ২ হাজার ২২ কোটি টাকা; যেটি তুলনামূলক আন্তর্জাতিক বিচারে এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) বিশেষজ্ঞদের হিসাবে কমপক্ষে ৩৫০ থেকে ৪৫০ কোটি টাকা অতিরিক্ত।


তবে এ প্রকল্পগুলোর কাজেও অভিযোগ রয়েছে সিমেন্সের বিরুদ্ধে। পরিকল্পনা কমিশনসংশ্লিষ্টরা বলছেন, সিমেন্স যেসব প্রকল্পে পরোক্ষভাবে যন্ত্রপাতি সরবরাহের কাজ পেয়েছে, সেসব প্রকল্পের ব্যয়ে নানা ধরনের অসঙ্গতি পাওয়া গেছে। অনেক ক্ষেত্রে অনুমোদন ছাড়াই অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় হচ্ছে, পরে যার অনুমোদন করিয়ে নেয়া হচ্ছে; যা উন্নয়ন পরিকল্পনার রীতিবহির্ভূত।


পরিকল্পনা কমিশনের তথ্যানুযায়ী, ২০১০ সালে ভারত থেকে বাংলাদেশে ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির জন্য সঞ্চালন লাইন নির্মাণের মূল কাজটি পায় সিমেন্স। এক বছরের মাথায় প্রকল্পটির মূল ব্যয় বেড়ে যায়। ট্রান্সমিশন লাইন ও সাবস্টেশন যন্ত্রপাতি ক্রয়ের ব্যয় ৪৭৮ কোটি থেকে বাড়িয়ে ৭৪৮ কোটি টাকার প্রস্তাব করা হয়। ২৭০ কোটি টাকা অতিরিক্ত এ ব্যয়ের ডিপিপি সংশোধন না করে এরই মধ্যে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান সিমেন্স জার্মানির সঙ্গে চুক্তি সই করেছে বাস্তবায়নকারী সংস্থা পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি বাংলাদেশ (পিজিসিবি)। অবৈধভাবে করা এ চুক্তি পরে বৈধতা পায় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক)।


উল্লেখ্য, সিমেন্সের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ, রাশিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশে ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে কাজ পাওয়ায় প্রমাণ রয়েছে। মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (এফবিআই) তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে চট্টগ্রামের নিউমুরিংয়ে কনটেইনার টার্মিনাল স্থাপন ও টেলিটকের মোবাইল নেটওয়ার্ক স্থাপনের কাজ পাওয়ার জন্য ঘুষ দেয় সিমেন্স। এ সময় সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোসহ ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকা বাংলাদেশ সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের প্রায় ৫৩ লাখ মার্কিন ডলার (বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ৩৯ কোটি টাকা) ঘুষ দিয়েছিল জার্মানির এ প্রতিষ্ঠানসহ চীনের চায়না হারবার। এরই মধ্যে আরাফাত রহমান কোকোর পাচার করা ২০ কোটি ৭৮ লাখ টাকা তিন ধাপে ফিরিয়ে এনেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।


বাংলাদেশে ঘুষ-দুর্নীতির কারণে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিস’ ২০০৯ সালের ৮ জানুয়ারি কলাম্বিয়ার জেলা আদালতে বিদেশে কাজ পেতে ঘুষ দেয়ার অভিযোগে ‘ফরেন করাপ্ট প্র্যাকটিস’ আইনের ধারায় সিমেন্সের বিরুদ্ধে মামলা করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে কাজ পাইয়ে দেয়ার জন্য আরাফাত রহমান কোকো ও সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুষ দেয়ার বিষয়টি স্বীকার করে নেয় সিমেন্স। এ কারণেই প্রতিষ্ঠানটির যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাংক হিসাব ব্যবহার করে প্রদত্ত ৩০ লাখ মার্কিন ডলার বাজেয়াপ্ত করার আবেদন করা হয় ওই মামলায়। এর আগেও ঘুষ দেয়ার জন্য সিমেন্সকে মার্কিন আদালতের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৬০ কোটি ডলার জরিমানা দিতে হয়।


সিমেন্সের দেয়া স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে মোট ৩৩টি ভাগে ৫৩ লাখ ৩৫ হাজার ৮৩৯ ডলার ঘুষ দেয় সিমেন্স বাংলাদেশ।


তবে বিশ্বে ঘুষ-দুর্নীতির কলঙ্ক ঘুচিয়ে সুনাম ফিরিয়ে আনতে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছেছে সিমেন্স এজি। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটি ঘুষ-দুর্নীতির কারণে বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতিবিরোধী তহবিলে ১০ কোটি ডলার প্রদান করবে।


(ঢাকাটাইমস/ ৬ মে/ এইচএফ/ ১২.৪৩ঘ.)