ঢাকা: ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। জীবন চলার পথে অর্থের প্রয়োজন অনস্বীকার্য। অর্থনৈতিক শোষণমুক্ত সমাজ গঠনে ইসলামের বিরাট অবদান রয়েছে। ইসলাম চায় সমাজ থেকে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে। ধনী গরীবের ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে একটি সুখী সমৃদ্ধ সমাজ গড়তে। সমাজে অর্থনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে সুদকে না বলেছে ইসলাম। কেননা সুদ সমাজের গরীব লোকদের আরও গরীব করে এবং ধনীদের করে তোলে আরও ধনী। এর ফলে সমাজে দেখা যায় অর্থনৈতিক বৈষম্য।
রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, আমি তোমাদের মধ্যে দুটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস রেখে যাচ্ছি, যতক্ষণ পর্যন্ত তোমরা তা আকড়ে ধরবে ততক্ষণ পর্যন্ত তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না। এদের মধ্যে একটি হলো আল্লাহর কালাম কোরআন, অপরটি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর অমূল্য বাণী হাদিস শরীফ। জীবনে সফলতা অর্জন করতে হলে কোরআন-হাদিসের পূর্ণাঙ্গ আমল করতে হবে। যেসব জিনিস পালনে আদেশ দেয়া হয়েছে তা সঠিকভাবে পালন করতে হবে আর যেসব জিনিস পালনে নিষেধাজ্ঞা করা হয়েছে তা বর্জন করতে হবে। তাহলেই ইহকালীন শান্তি ও পরকালীন মুক্তি সম্ভব।
কোরআন-হাদিসে যে সকল বিষয়াবলীর ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম একটি ‘রিবা’। ‘রিবা’ শব্দটি আরবি। এর বাংলা পরিভাষা সুদ। এর অর্থ- অতিরিক্ত, বেশি বা পরিবৃদ্ধি। অর্থাৎ মূলের অতিরিক্ত আদায় করা।
শরিয়তের পরিভাষায়, ‘রিবা’ বা সুদ ওই অতিরিক্ত সম্পদকে বলা হয়, যা কোনো প্রকার বিনিময় ব্যতীতই অর্জিত হয়। (হিদায়া, হাশিয়া- ৩/৭৭)। এতে ওই অতিরিক্ত সম্পদ অন্তর্ভুক্ত, যা ঋণ দিয়ে নেয়া হয়। কেননা ঋণের মধ্যে মূলধন ঠিকই থাকে। আর অতিরিক্ত সম্পদকে কোনো প্রকার বিনিময় ছাড়াই নেয়া হয়। অনুরূপ বাণিজ্যিক ওই সকল লেনদেনও অন্তর্ভূক্ত যা কোনো প্রকার বিনিময় ব্যতীতই অতিরিক্ত হিসাবে নেয়া হয়ে থাকে।
পবিত্র কোরআনে-হাদিসে সুদকে হারাম ঘোষণার পাশাপাশি এর ভয়াবহ পরিণাম বর্ণণা করা হয়েছে। সূরা আল বাকারার ২৭৫ নং আয়াতে আল্লাহ পাক সুদকে হারাম ঘোষণা করে বলেন, ‘যারা সুদ খায়, তারা কবর থেকে কিয়ামত দিবসে দণ্ডায়মান হবে, যেভাবে দণ্ডায়মান হয় ওই ব্যক্তি, যাকে শয়তান আছর করে মতিচ্ছন্ন করে দেয়। তাদের এ অবস্থার কারণ এই যে, তারা বলে, ক্রয়-বিক্রয়-সুদ নেয়ারই মতো। অথচ আল্লাহপাক ক্রয়-বিক্রয় বৈধ করেছেন এবং সুদকে হারাম করেছেন। অতঃপর যার কাছে তার পালনকর্তার পক্ষ থেকে উপদেশ এসেছে এবং যে বিরত হয়েছে, পূর্বে যা হয়ে গেছে, তা তার। তার ব্যাপারে আল্লাহর ওপর নির্ভরশীল। আর যারা পুনরায় সুদ নেয়, তাদের জন্য জাহান্নাম অবধারিত। তারা চিরকাল সেখানে অবস্থান করবে।’
ইসলামের পূর্বে বর্বরতার যুগে আরবরা সুদকে ক্রয়-বিক্রয়ের মতো মনে করতেন। কারণ তারা মনে করতেন, বেচাকেনা এবং সুদ উভয়ের মধ্যে লভ্যাংশ উদ্দেশ্য। তারা মনে করেন বেচাকেনা যেমন হালাল তেমনিভাবে সুদও হালাল। উক্ত আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহপাক তাদের ধারণকে ভুল সাব্যস্ত করে বলেন, ব্যবসা এবং সুদ এক নয়। এ দুটির মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। তাই সুদকে ব্যবসার মতো মনে করে উভয়কে বৈধ বলা শরীয়ত পরিপন্থী।
তাছাড়া তাদের দাবি যদি মেনে নেয়া হয়, তারপরও সুদ হারাম হওয়ার জন্য এতটুকু যথেষ্ট যে, এ ভূমণ্ডল ও নভোমণ্ডলের সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহপাক ব্যবসা-বাণিজ্যকে হালাল আর সুদকে হারাম করেছেন। যখন সকল জিনিসের ক্ষমতাধর মহান আল্লাহপাক কোনো বস্তুকে হারাম করেন তখন এ ব্যাপারে কারো দ্বিমত পোষণ করার অবকাশ থাকে না।
তাছাড়া ব্যবসা এবং সুদ এ দুটিকে এক বা অভিন্ন মনে করা নিতান্ত ভ্রান্তি। কারণ বেচাকেনা এবং ব্যবসার আসল উদ্দেশ্যর প্রতি লক্ষ্য করলে দেখা যায় ব্যবসা ও সুদের মধ্যে যে অনেক পার্থক্য রয়েছে, তা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য হলো, ব্যবসা-বাণিজ্যের মধ্যে যে লভ্যাংশ বা অতিরিক্ত সম্পদ অর্জিত হয়, তা পণ্যের বিনিময়ে, আর সুদের মধ্যে পণ্য ব্যতীতই অতিরিক্ত সম্পদ অর্জিত হয়।
তাছাড়া বেচাকেনা বৈধ হওয়ার জন্য অন্যতম শর্ত হলো, উভয়পক্ষের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্তি সম্মতি থাকা। কিন্তু তা সুদের মধ্যে বিদ্যমান থাকে না। তাই ব্যবসা এবং সুদকে এক মনে করে সুদকেই বৈধ বলা বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়। এছাড়া কোরআনের বেশ কয়েকটি আয়াতে সুদের ব্যাপারে কঠোরভাবে নিষেধাজ্ঞা করা হয়েছে, যেমন- সুরা আল ইমরানের ১৩০ নম্বর আয়াতে আল্লাহপাক বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ গ্রহণ করো না এবং আল্লাহকে ভয় করতে থাকো। তাতে তোমরা সফলকাম হবে।’
সুদকে হারাম ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে সুদের বকেয়া অর্থ সর্ম্পকেও পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সুদের যে সমস্ত বকেয়া আছে তা পরিত্যাগ করো, যদি তোমরা ঈমানদার হয়ে থাকো। অতঃপর যদি তোমরা পরিত্যাগ না করো, তবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সঙ্গে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত হও।’ (সূরা-বাকারা- ২৭৮-২৭৯)। এর দ্বারা সুস্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, সুদের গুনাহ অত্যন্ত মারাত্মক।
আল্লাহ কোরআনে আরও ইরশাদ করেন, আমি ইহুদিদের জন্য হারাম করে দিয়েছি বহু পূত-পবিত্র বস্তু, যা তাদের জন্য হালাল ছিলো। তাদের সীমালংঘনের কারণে এবং আল্লাহর পথে অধিক বাধা প্রদানের দরুণ। তার কারণ, তারা সুদ গ্রহণ করতো। অথচ এই ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞারোপ করা হয়েছিলো। (সূরা-নিসা-১৬০-১৬১)। উক্ত আয়াত থেকে বুঝা যায় যে, সুদ এতোই নিকৃষ্ট যে, তার কারণে হালাল বস্তু পর্যন্ত হারাম করা হয়েছে। ইমাম কুরতুবী (রহ.) উল্লেখ করেন, সুদ এমন নিকৃষ্ট হারাম যা প্রত্যেক শরীয়তে হারাম ছিলো। যেমন- আল্লাহপাক ইহুদি সম্প্রদায়ের ব্যাপারে বলেন, ইহুদিরা সুদ খায়, অথচ তাওরাতে তাদের জন্য সুদকে হারাম করা হয়েছিলো। (তাফসীরে কোরতুবী-৩/৩৬৬)।
অনুরুপভাবে অন্যান্য আসমানী কিতাবসূমহে সুদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিলো। যে বস্তুকে প্রত্যেক শরীয়তে হারাম করা হয়েছে, তা কি পরিমাণ অপছন্দনীয় ও জঘন্য হতে পারে তা বলাই বাহুল্য।
সুদ হারাম হওয়া সর্ম্পকে এ হাদিসটিই ছিলো সর্বশেষ ঘোষণা। হযরত ইবনে ওমর (রাযি.) উল্লেখ করেন, সুদ হারাম হওয়ার বিধানটি ইসলামের বিধান সূমহের মধ্যে সর্বশেষ বিধান। অন্য এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, হযরত জাবির বিন আবদুল্লাহ (রাযি.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসূলুল্লাহ (সা.) সুদ দাতা, সুদ গ্রহীতা, সুদের লেখক এবং সুদী লেনদেনের সাক্ষী সবার প্রতি অভিশাপ দিয়ে বলেন, গুনাহের ব্যাপারে তাঁরা সকলেই সমান অপরাধী।’ (মুসলিম শরীফ- ২/২৭)।
অন্য হাদীসে আবু হুরায়রার (রা.)বর্ণিত একটি হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘সুদের মধ্যে সত্তর প্রকার গুনাহ বিদ্যমান রয়েছে। এর সবচেয়ে নিম্নস্তরের গুনাহটি হলো, নিজের মায়ের সঙ্গে যিনা করা।’(ইবনে মাজাহ পৃ- ১৬৪)
এছাড়া রাসূলুল্লাহ (সা.) সুদ খাওয়াকে কবিরা গুনাহের অন্তভুর্ক্ত করে বলেছেন, ‘তোমরা সাতটি ধ্বাংসাত্মক জিনিস থেকে বেঁচে থাকো। সাহাবায়ে কিরাম জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ (সা.) সে সাতটি জিনিস কী? রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করলেন, আল্লাহ তা‘আল্লার সঙ্গে অন্য কাউকে অংশীদার করো না, যাদু বিদ্যা অর্জন করা, অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা, সুদ খাওয়া, ইয়াতীমের সম্পদ আত্মসাৎ করা, যুদ্ধের ময়দান থেকে পলায়ন করা, কোনো নিরঅপরাধী নারীকে অপবাদ দেয়া।’(মুসলিম শরীফ-১/৬৪)।
অন্য এক হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহপাক চার ব্যক্তিকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন না এবং তাদেরকে জান্নাতের নিয়ামতসমূহ থেকে বঞ্চিত করবেন। তারা হলেন, এক. মদপান কারী। দুই. সুদ ভক্ষণ কারী। তিন. অন্যায় ভাবে ইয়াতীমের সম্পদ আত্মসাতকারী। চার. পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান।’ (হাকিম) তাছাড়া সুদের একটি কুবৈশিষ্ট্য রয়েছে। যে ব্যক্তি সুদী লেনদেনে অভ্যস্ত, সম্পদের লোভ-লালসা তাকে এমন বিবেকহীন ও উদাসীন করে যে, সারাক্ষণ কিভাবে সম্পদ বৃদ্ধি পাবে, সে চিন্তায় মগ্ন থাকে। অথচ সুদের মাধ্যমে যে সম্পদ বৃদ্ধি পায়, তাতে বরকত থাকে না।
এ প্রসঙ্গে হাদিস শরীফে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাযি.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি সুদের মাধ্যমে সম্পদ বাড়ায়, তার সম্পদে অবশ্যই ঘাটতি দেখা দিবে।’ (ইবনে মাজাহ পৃ- ১৬৫)
বর্তমান যুগে সুদ মহামারীর আকার ধারণ করেছে। কোরআন-হাদিসের এর নিষেধাজ্ঞা ও এর ভয়াবহ শাস্তির দিকে অনেকেই কর্ণপাত করছেন না। অনেকেই আবার সুদকে অর্থনীতির প্রধান স্তম্ভ মনে করছেন এবং আবার অনেকেই সুদকে দারিদ্র্যতা বিমোচনের অন্যতম পন্থা হিসাবে আখ্যা দিচ্ছেন। অথচ ইতিহাস সাক্ষী, সুদ কখনো কোনো গরিবের দারিদ্র্যতা বিমোচন করতে সক্ষম হয়নি বরং সুদ গরীবকে আরো গরীব এবং ধনীকে আরো ধনী বানিয়েছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, বর্তমানে কিছু কিছু ব্যক্তি সুদের সাময়িক উপকার দেখে মুগ্ধ হয়ে যায়। অথচ সুদের জাগতিক ও পারলৌকিকের ভয়াভয় পরিণাম এ উপকারের তুলনায় যে অত্যন্ত জঘন্য, সে দিকে লক্ষ্য রাখেন না। তাই ইহকালীন শান্তি ও পরকালীন মুক্তি পেতে সকল ধরণের সুদী লেনদেন থেকে আমাদের বেঁচে থাকা উচিত।আল্লাহ পাক আমাদের সেই তৌফিক দান করুণ।
(ঢাকাটাইমস/৬জুন/প্রতিনিধি/ঘ.)