logo ১৯ মে ২০২৫
ইসলামে তাকওয়ার গুরুত্ব
ইসলাম ডেস্ক, ঢাকাটাইমস
০৯ জুন, ২০১৪ ০০:১৮:১৭
image

ঢাকা: মহান আল্লাহ মানুষ ও জিন জাতিকে সৃষ্টি করেছেন একমাত্র তাঁরই ইবাদত করার জন্য। ইবাদতের মাধ্যমে বান্দাহ শুধুমাত্র বাহ্যিক দৃষ্টিতে কয়েকটি আনুষ্ঠানিকতা পালন করে না বরং ইবাদত একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর নিমিত্তে হওয়ার জন্য চাই খালেস নিয়ত ও একাগ্রচিত্ততা, যা বান্দাহ ক্রমাগতভাবে করতে থাকলে অর্জন করে এক মহামূল্যবান নিয়ামত। যাকে ‘তাক্ওয়া’ নামে আখ্যায়িত করা হয়।ইসলামে তাকওয়ার গুরুত্ব অপরিসীম।নিচে তাকওয়ার সংজ্ঞা উল্লেখপূর্বক এর গুরুত্ব তুলে ধরা হলো।


তাকওয়া: তাকওয়া আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ বেঁচে থাকা, আত্মরক্ষা করা, নিষ্কৃতি লাভ করা ইত্যাদি। অর্থাৎ আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে তাঁর নির্দেশিত বিধান মোতাবেক জীবন পরিচালনা করে তাঁর দেয়া আদেশ পুরোপুরি মেনে চলা এবং নিষেধ করা কাজগুলো বর্জন করাই হলো তাকওয়া।


হযরত উবাই ইবনে কাব (রা.) কে ওমর (রা.) জিজ্ঞাসা করলেন তাকওয়া কী? তিনি বললেন, হে ওমর (রা)! পাহাড়ের দুই ধারে কাঁটাবন, মাঝখানে সরু পথ। এমতাবস্থায় কিভাবে চলতে হবে? তিনি বলেন, গায়ে যেন কাঁটা না লাগে, সেজন্য কাপড় গুটিয়ে সাবধানে পথ অতিক্রম করতে হবে। হযরত উবাই ইবনে কাব (রা) বললেন, এটাই তাকাওয়া। আজকের এই পাপ পঙ্কিলতাপৃর্ণ পৃথিবী, যার রন্ধ্রে রন্ধ্রে পাপাচার, অনাচার, শিরক, কুফর, বিদায়াত যেখানে অক্টোপাসের মত ছড়িয়ে আছে, দুর্নীতি, ঘুষ আর সুদের কাঁটা থেকে একজন মুমিনকে আত্মরক্ষা করে সাবধানে জীবনের পথ অতিক্রম করতে হবে। তাকওয়াই হচ্ছে যাবতীয় কল্যাণের মূল উৎস। সুতরাং ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে তাকওয়ার গুরুত্ব অপরিসীম।


ব্যক্তি জীবনে তাকওয়ার গুরুত্ব:


. ব্যক্তি চরিত্র গঠনে: মানুষের ব্যক্তি জীবনে তাকওয়ার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। ব্যক্তি চরিত্র গঠনে তাকওয়ার বিকল্প নেই। যে মুমিনের হৃদয়ে তাকওয়া আছে, সে কোন অবস্থাতেই প্রলোভনে পড়ে না এবং নির্জন থেকে নির্জনতর স্থানেও পাপ কাজে লিপ্ত হয় না। কারণ, সে জানে সবাইকে ফাঁকি দেয়া গেলেও আল্লাহকে ফাঁকি দেয়া যায় না। তাই চরিত্র গঠনে তাকওয়া একটি সুদৃঢ় দুর্গস্বরূপ।


. ইবাদতের মূল বস্তু: তাকওয়া হচ্ছে ইবাদত-বন্দেগীর মূল বস্তু। ইবাদতের আনুষ্ঠানিকতার কোন মূল্য নেই, যদি সেখানে তাকওয়া বা আল্লাহর ভয় না থাকে। যেমন আল্লাহর ঘোষণা ‘‘আল্লাহর নিকট তোমাদের কুরবানীর গোশত, রক্ত কিছুই পৌঁছে না, পৌঁছে শুধু এ থেকে অর্জিত শিক্ষা সংযমের অভ্যাস তাকওয়া।” (সূরা আলহাজ্জ : ৩৭)।


. ঈমানের পরিপূর্ণতা: আল্লাহ তায়ালাকে যথাযথভাবে ভয় না করলে, ঈমানের পরিপূর্ণতা আসে না। তাই আল্লাহ তাকওয়া অর্জনের নির্দেশ দিয়ে ঘোষণা করেন ‘‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে যথাযথভাবে ভয় কর এবং আল্লাহর কাছে পরিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ না করে মৃত্যু বরণ করো না। ’’ (সূরা-আল ইমরান-১০২)।


. আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ: আল্লাহর সান্নিধ্য, নৈকট্য ও সহায়তা লাভের জন্য তাকওয়া অবলম্বন করা অপরিহার্য। আল্লাহ বলেন : ‘‘তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। কেননা, জেনে রেখ আল্লাহ মুত্তাকীদের সঙ্গে আছেন।” (সূরা-আল বাকারাহ : ১৯৪)।


৫. মর্যাদার মাপকাঠি: আল্লাহর নিকট তাকওয়াই হচ্ছে শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা লাভের মাপকাঠি। আল্লাহ ঘোষণা করেন: ‘‘তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তিই বেশি মর্যাদাবান, যার মধ্যে বেশি তাকওয়া আছে।” (সূরা-আল হুজুরাত: ১৩)।


. জীবনের সাফল্য: তাকওয়ার গুণই মানুষের ইহ-পরকালীন জীবনে সামগ্রিক সাফল্য বয়ে আনবে। আল্লাহ বলেন: ‘‘নিশ্চয়ই তাকওয়াবানদের জন্য রয়েছে সফলতা।” (সূরা আন-নাবা: ৩১)।


. আত্মার পরিশুদ্ধি: মানুষের আত্মার পরিশুদ্ধি ও পরিশোধনের জন্য তাকওয়া একান্ত অপরিহার্য। হৃদয়ে তাকওয়া থাকলে সে মানুষ কোন অন্যায়-অশ্লীল কাজ করতে পারে না এবং কোন পাপ চিন্তা তার আত্মাকে কলুষিত করতে পারে না।


. নিষ্ঠায়: তাকওয়া ব্যক্তি মানুষের চরিত্রে, তার আকীদা-বিশ্বাসে, কাজ-কর্মে, আচার-আচরণে, ইবাদত-বন্দেগীতে এবং দায়িত্ব পালনে নিষ্ঠার সৃষ্টি করে। তাই সে হয় সকল কাজে অতীব আন্তরিক ও নিষ্ঠাবান।


. ঈমানের মজবুতি: তাকওয়া মানুষের ঈমানের মজবুতি ও পূর্ণতা এনে দেয়। যে ব্যক্তি যত তাকওয়া সম্পন্ন, তার ঈমান তত বেশি মজবুত। সে জীবনে-মরণে কখনো তাকওয়া থেকে এতটুকু বিচ্যুত হয় না। সে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহকে ভয় করে চলে এবং তাকওয়ার সঙ্গে জীবনযাপন করে।


১০. জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণ: তাকওয়া মানুষকে জাহান্নামের ভয়াবহ কঠিন শাস্তি হতে মুক্তি দান করে। মহানবী (সা.) এ বিষয়ে বলেন: ‘‘জ্ঞান-বিজ্ঞানের মূল হলো আল্লাহর ভয়।” তিনি আরো বলেন, ‘‘সে দু'টো চোখকে জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবে না: (ক) যে চোখ আল্লাহর ভয়ে অশ্রু ঝরায়, (খ) আর যে চোখ আল্লাহর রাস্তায় পাহারায় রত থেকে কাঁদে। (তিরমিযি)


১১. জান্নাতে দু'টি উদ্যান লাভ: মুত্তাকিরা নিশ্চিতভাবে জান্নাত লাভ করবে, তাকওয়ার মানদণ্ড অনুযায়ী কেউ কেউ দু'টি উদ্যান লাভে ধন্য হবে। আল্লাহ বলেন: ‘‘যে ব্যক্তি তার পালনকর্তার সামনে পেশ হওয়ার ভয় রাখে, তার জন্য দু'টি উদ্যান রয়েছে।” (সূরা-আল-রাহমান: ৪৬)।


১২. আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ: তাকওয়ার গুণ অর্জিত হলে মানবজীবনের সবচেয়ে বড় নিয়ামত আল্লাহর সন্তুষ্টি ও ভালোবাসা লাভ করা যায়। আল্লাহ তায়ালা বলেন: ‘‘আল্লাহ মুত্তাকীদের ভালোবাসেন।” (সূরা-আত-তাওবাহ: ৪)।


সামাজিক জীবনে তাকওয়ার গুরুত্ব:


. সুষ্ঠু সমাজ বিনির্মাণে: একটি সমাজকে সুন্দর, সুষ্ঠু, পুত-পবিত্র, পরিশুদ্ধ সর্বপরি সমৃদ্ধশালী করতে হলে ইসলামী আখলাকের প্রধান গুণ তাকওয়া একান্ত প্রয়োজন। একজন তাকওয়াবান মুমিনের জীবনে সুনাগরিকের সকল গুণ বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। অবশ্য তাকওয়াবান মানুষ না হলে, একটি সুন্দর, শান্তিময় সমাজ গড়ে তোলা যায় না। তাই সমাজের সকল সদস্যকে তাকওয়ার জীবন অবলম্বন করা অপরিহার্য।


. সামাজিক শৃঙ্খলায় তাকওয়া: সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় তাকওয়া একান্ত অপরিহার্য। কেননা তাকওয়াবান মানুষ তার কাজ-কর্মে আন্তরিক ও নিষ্ঠাবান। আর আন্তরিক ও নিষ্ঠার সঙ্গে সমাজের সদস্যগণ যদি দায়িত্ব পালন করেন, তবে সে সমাজ অবশ্যই শান্তি ও শৃঙ্খলাময় হতে বাধ্য।


. সামাজিক মূল্যবোধ সৃষ্টিতে: সামাজিক জীবনে সামাজিক মূল্যবোধে তাকওয়া অপরিহার্য তাকওয়া সমাজের মানুষের মধ্যে সামাজিক মূল্যবোধ সৃষ্টি করে। তাই একজন তাকওয়াবান মানুষ কখনও অপরের অধিকার হরণ করে না, অপরকে কষ্ট দেয় না, অন্যায়-অনাচার থেকে নিজে বেঁচে থাকে, সমাজকে এ থেকে বাঁচায়। সমাজের অনিষ্ট ও অকল্যাণ হয় এমন কাজ তার দ্বারা হয় না।


. সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায়: সামাজিক ন্যায়বিচার ও ন্যায়-নীতি প্রতিষ্ঠার জন্য তাকওয়া একান্ত প্রয়োজনীয় গুণ। তাকওয়াবান মানুষ সমাজে কখনো ন্যায়নীতির বিপরীত কোন কাজ হতে দেয় না এবং সেও করে না। আল্লাহ বলেন: ‘‘তোমরা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা কর। কেননা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা তাকওয়ার খুব নিকটবর্তী।” (সূরা-আল মায়িদাহ: ৮)।


. সামাজিক নিরাপত্তায়: সামাজিক নিরাপত্তা, পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থা সৃষ্টির জন্য তাকওয়া অবলম্বন করা একান্ত প্রয়োজন। তাকওয়াবিহীন সমাজে সামাজিক আস্থা ও নিরাপত্তা গড়ে উঠে না।


. আত্ম-সামাজিক উন্নয়নে: আত্ম-সামাজিক উন্নয়নের জন্য তাকওয়া একটি বড় গুণ। যদি সমাজের লোকদের মধ্যে তাকওয়ার গুণ থাকে, তবে সমাজের সদস্যরা নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে সমাজের আত্ম-সামাজিক উন্নয়ন ও উৎকর্ষতার জন্য কাজ করে থাকে। আর দায়িত্ব পালনে নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার মূল উৎস হচ্ছে তাকওয়া ও আল্লাহভীতি। তাই আর্থ-সামাজিক সমৃদ্ধির জন্য তাকওয়াবান হওয়া অপরিহার্য।


. সুনাগরিকতার গুণ অর্জনে: সুনাগরিকতার প্রধান গুণ-বৈশিষ্ট্য হচ্ছে দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ। আর তাকওয়া থেকেই নাগরিকদের মধ্যে দায়িত্ববোধ সৃষ্টি হয়।


. সামাজিক সাম্য, সম্প্রীতি সংহতিতে: সামাজিক সাম্য, সম্প্রীতি ও সংহতি সৃষ্টিতে তাকওয়ার বিকল্প নেই। তাকওয়া বা আল্লাহভীতি মানুষের মনে অপর মানুষের প্রতি ভালোবাসা, মর্যাদা ও শ্রদ্ধা-স্নেহ সৃষ্টি করে। মানুষে মানুষে সাম্য, সম্প্রীতি ও সংহতি গড়ে তোলে। যাবতীয় ভেদ-বৈষম্য ও পার্থক্য দূরীভূত করে আল্লাহর বান্দা হিসেবে সকলে মিলেমিশে জীবনযাপন করে।


. সামাজিক মর্যাদায়: সমাজে সর্বোত্তম ব্যক্তিরা সমাদৃত হয় ও মর্যাদা পায়। আর সর্বোত্তম ব্যক্তিত্ব অর্জনের জন্য তাকওয়ার গুণ অর্জন করা একান্ত দরকার।


উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলতে পারি তাকওয়া বা আল্লাহ ভীতি মানুষের সবচেয়ে বড় গুণ। আর যে সমাজের মানুষের মধ্যে এ গুণ অর্জিত হয়, সে সমাজ হয় সুখী সমৃদ্ধশীল। তাকওয়াবান মানুষ কখনও ব্যক্তি ও সমাজকে ফাঁকি দেয় না। তাই মানুষ ব্যক্তি জীবনে যেমন হয় সৎ, তেমনি সমাজ জীবনে হয় কর্তব্যনিষ্ঠ। এজন্য সুষ্ঠু, সুন্দর ও সুশৃঙ্খল সমাজ প্রতিষ্ঠা একমাত্র তাকওয়া দ্বারাই সম্ভব।


(ঢাকাটাইমস/৯জুন/প্রতিনিধি/এমআর/ঘ.)