logo ৩০ এপ্রিল ২০২৫
ফোরাম থেকে অপসারিত হচ্ছেন এ কে খন্দকার

হাবিবুল্লাহ ফাহাদ
১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৪ ১৮:৪৯:১০
image


দেশে কোনো যুদ্ধাপরাধী বা স্বাধীনতাবিরোধী নেইÑ সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের এমন বক্তব্যের পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি নিয়ে একজোট হন মুক্তিযুদ্ধের সময়কার সেক্টর কামন্ডাররা। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে জনমত গঠনের উদ্দেশ্যে গড়ে তোলেন সংগঠন, যার নাম দেন সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম। মুক্তিযুদ্ধের উপ-প্রধান সেনাপতি এ কে খন্দকারকে শুরুতেই এই সংগঠনের চেয়ারম্যান করে একাত্তরের পাকিস্তানি বাহিনীর এ দেশীয় দোসরদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার হয় ফোরাম। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিকে আগে থেকেই ধারণ করা মানুষজন সাড়া দেয় ভীষণভাবে। একেবারে কোণঠাসা হয়ে যায় স্বাধীনতাবিরোধী দল জামায়াত। সেই সেক্টর কমান্ডারস ফোরামেই ঘটতে যাচ্ছে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা। ফোরামের চেয়ারম্যানের পদ থেকে এ কে খন্দকারকে অপসারণের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ সদস্যরা।

এ কে খন্দকারের নতুন বই ‘১৯৭১ : ভেতরে-বাইরে’-এর কিছু তথ্য ক্ষুব্ধ করে তুলেছে সেক্টর কমান্ডারদের। তারা বলছেন, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি অবমাননাকর কথা লিখেছেন যুদ্ধের উপ-প্রধান সেনাপতি। এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়ার সুযোগ নেই। ফোরাম এই লেখাগুলো সংশোধনের দাবি তুললেও দ্বিতীয় সংস্করণে তা না করে আগের বক্তব্যে এ কে খন্দকার অটল আছেন বলেই ধরে নিচ্ছেন ফোরামের নেতারা।  

‘মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর কথোপকথন’ নামে আরও একটি বইয়ে এ কে খন্দকারের উল্লেখ করা কিছু তথ্যও চলে এসেছে নতুন করে।



এ কে খন্দকারের ওপর ক্ষোভ যে কারণে...

‘১৯৭১ : ভেতরে-বাইরে’ বইয়ে বেশ কিছু বিভ্রান্তিকর তথ্য উল্লেখ করেছেন এ কে খন্দকার। তিনি দাবি করেছেন ১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ বঙ্গবন্ধু শেষ করেছেন জয় পাকিস্তান বলে। তিনি ওই সমাবেশে না থাকলেও সেনানিবাসে বসে সে কথা শোনার দাবি করেছেন।

৭ মার্চ ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বলে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার পরোক্ষ ঘোষণা দেন বলেই মনে করেন ইতিহাসবিদরা। ওই ভাষণে তিনি ‘তোমাদের যার যা আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো’Ñবঙ্গবন্ধুর এই বাক্যটিও স্পষ্ট ইঙ্গিত হিসেবে ভেবেছিলেন সে সময়ের বাঙালি সেনা কর্মকর্তারা। সেক্টর কমান্ডার আবু ওসমান চৌধুরী এই সময়কে বলেন, ভাষণের পরদিন রেডিওতে এই কথাগুলো শোনার পরই তারা অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার ও এস ফোর্সের কমান্ডার কে এম সফিউল্লাহ বলেন, ‘এভাবে একটি জাতিকে স্বাধীনতার সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হতে বলে সেই জাতির অবিসংবাদিত নেতা আবার ঔপনিবেশিক শক্তি পাকিস্তানের পক্ষে স্লোগান দেবেনÑএ কথা কোনো সুস্থ মানুষ বলতে পারেন না।’

আরেক সেক্টর কমান্ডার আবু ওসমান চৌধুরী মনে করেন এ কে খন্দকার কোনো স্বার্থের লোভ বা ফাঁদে পড়ে এই কাজটি করেছেন। এই তথ্যটি এ কে খন্দকার সংশোধন করে নেবেন ভেবেছিলেন ফোরাম নেতারা। কিন্তু দ্বিতীয় সংস্করণে তার বক্তব্য আরও ক্ষুব্ধ করে তুলেছে তাদের।

বইটির দ্বিতীয় সংস্করণে এ কে খন্দকার লিখেছেন, বইয়ের ৩২ পৃষ্ঠার দ্বিতীয় স্তবকে আমি লিখেছিলামÑ ‘‘এই ভাষণের শেষ শব্দ ছিল ‘জয় পাকিস্তান’।’’ আসলে তা হবেÑ ‘‘এই ভাষণের শেষ শব্দগুলো ছিল ‘জয় বাংলা, জয় পাকিস্তান’।’’  

সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের মহাসচিব ও সাংবাদিক হারুন হাবীব বলেন, ‘আসলে তিনি (এ কে খন্দকার) আগের জায়গাতেই রয়ে গেছেন। তিনি ইতিহাসের  ‘জয় বাংলা’ স্লোগানকে অনেক হালকা করে ফেলেছেন। এটা তার নিজস্ব মানসিকতা, উপলব্ধি ও রাজনৈতিক সচেতনতার ব্যাপার। এ কে খন্দকারের কাছ থেকে এসব কথা শুনতে হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪৩ বছর পর,  তা সত্যিই বেদনাদায়ক।’

সংসদে তোলা বিতর্কে সেক্টর কমান্ডার রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ইচ্ছাকৃত ভুল হচ্ছে। এই বইয়ের বক্তব্য অসত্য ও ভুল। কোনো মহলের প্ররোচনা থাকতে পারে। কেউ না কেউ তাকে প্ররোচনা দিয়েছেন। অন্য কোনো ইচ্ছায় তিনি জাতির পিতাকে ছোট করার জন্য এটা করেছেন।’ তিনি বলেন, ‘এই বই লেখা নিয়ে তার সঙ্গে আমি দুই-তিন বার বসেছি। তখন তিনি কখনো এই কথা বলেননি।’

ফোরামের নেতারা বলছেন, তারা সংগঠনটি গড়ে তোলার পর দেশজুড়ে নানা কর্মসূচিতে বক্তব্য রেখেছেন এ কে খন্দকার। কোথাও তিনি একটিবারের জন্যও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব আর তাকে অবমাননাকর কোনো বাক্য উচ্চারণ করেননি। ৭ মার্চের ভাষণ নিয়েও অনেক কথা বলেছেন এ কে খন্দকার এর আগে। ঘুর্ণাক্ষরেও তিনি একটিবারের জন্যও লিখেননি যে, বঙ্গন্ধু ‘জয় পাকিস্তান’ দিয়ে সেই ভাষণ শেষ করেছিলেন।

এ কে খন্দকারের লেখায় আপত্তিকর আরও কথা আছে। তিনি দাবি করেছেন বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চ গ্রেপ্তারের আগে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যাননি। বঙ্গবন্ধু কেন এই ঘোষণা দিয়ে গেলেন নাÑএটা নিয়ে যুদ্ধ চলাকালে নানা সময় নানা কথা উঠেছে বলেও দাবি করেছেন এ কে খন্দকার।  

ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের (ইপিআর) বেতারযন্ত্রের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। আওয়ামী লীগের এ দাবিকে উড়িয়ে দিয়েছেন এ কে খন্দকার। তিনি লিখেছেন, ‘পরবর্তী সময়ে ঘটনার প্রায় এক বছর পর আরেকটি কথা প্রচার করা হয় যে, ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হওয়ার ঠিক আগে শেখ সাহেব ইপিআরের বেতারযন্ত্রের মাধ্যমে চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরীর কাছে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠিয়েছিলেন। এই তথ্যটি মোটেও বিশ্বাসযোগ্য নয়।’

সাবেক এই মন্ত্রী আরও লিখেছেন, ‘...তার চেয়েও বড় প্রশ্ন, বঙ্গবন্ধু যাঁর মারফত এই ঘোষণা ইপিআরের বার্তাকেন্দ্রে পাঠিয়েছিলেন, সেই ব্যক্তি স্বাধীনতার ৪৩ বছরেও জনসমক্ষে এলেন না কেন? বঙ্গবন্ধুও তাঁর জীবদ্দশায় কখনো সেই ব্যক্তির নাম প্রকাশ করেননি কেন? একইভাবে চট্টগ্রামের ইপিআর বেতারকেন্দ্র থেকে কে, কীভাবে জহুর আহমেদকে বার্তাটি পাঠালেন, তা রহস্যাবৃতই থেকে গেছে। কাজেই ইপিআরের বার্তাকেন্দ্র ব্যবহার করে শেখ সাহেব স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠিয়েছিলেনÑ এটা সম্ভবত বাস্তব নয়। দ্বিতীয়ত, জহুর আহমেদ চৌধুরীর কাছে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠিয়েছিলেন, মুক্তিযুদ্ধকালে এমন কোনো সংবাদ আমরা শুনিনি।’

বই দুটিতে তিনি এ কে খন্দকার বিভিন্নজনের বরাত দিয়ে লিখেছেন, তাজউদ্দীন আহমদ বঙ্গবন্ধুকে দিয়ে একটি স্বাধীনতার ঘোষণা রেকর্ড করিয়ে রাখতে চাইলে তাতেও রাজি হননি বঙ্গবন্ধু।

ফোরামের নেতারা বলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর স্বাধীনতাবিরোধীরা জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক বলে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী যে অপতৎপরতা শুরু করেছিলেন, এমন দাবি করে এ কে খন্দকার তাদের সহায়তা করেছেন।

 সেক্টর কমান্ডার আবু ওসমান চৌধুরী বলেন, ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের ঘোষণাকেই অস্বীকার করেছেন এ কে খন্দকার। ওই ঘোষণায় স্পষ্ট বলা হয়েছে ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার কথা। ওই শপথ অনুষ্ঠানে নিজেও  শপথ নিয়ে এ কে খন্দকার কীভাবে এই কথা লিখেছেন তা পড়ে বিস্মিত আবু ওসমান চৌধুরী।

ফোরামের মহাসচিব হারুন হাবীব বলেন, এ কে খন্দকার সেদিনও সেনানিবাসে ছিলেন। আর সেই রেডিওবার্তা তো আর এখনকার মতো প্রচারের সুযোগ ছিল না। কিন্তু ওই বার্তার তথ্য যুক্তরাষ্ট্র সরকারের নথি, সে সময় ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশের পত্রপত্রিকা, রেডিও টেলিভিশনে প্রচার হয়েছে বারবার। পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তারাও তাদের বইয়ে বঙ্গবন্ধুর এই স্বাধীনতার ঘোষণার কথা লিখেছেন। বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়েছিল বিদ্রোহের অপরাধেই। এই বাস্তবতায় এ কে খন্দকার কেন এই কথা লিখলেন তা বুঝতে পারছেন না হারুন হাবীব।  

বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীনতার ঘোষক না বলেও জিয়াউর রহমানকেও স্বাধীনতার ঘোষক মানতে নারাজ এ কে খন্দকার। ‘মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর কথোপকথন’Ñ তিনি লিখেছেন, ‘মেজর জিয়া কালুরঘাট বেতারকেন্দ্রে প্রথম ঘোষণাটি ভুলভাবে দিলেন। তাতে তিনি নিজেকেই বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেছিলেন। এতে সবাই হতবাক হয়ে যায়। এমন ঘোষণা তো তার দেওয়ার কথা নয়! এরপর তা সংশোধন করা হয়। ঘোষণা আগে থেকেই যেটি তৈরি ছিল, সেটি আবার জিয়ার কণ্ঠে টেপে ধারণ করা হয় এবং সেটি জিয়া পড়েন ২৭ মার্চ সন্ধ্যার কিছু আগে।’

‘১৯৭১ : ভেতরে-বাইরে’ বইয়ে এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘মেজর জিয়ার ঘোষণাটিকে কোনোভাবেই স্বাধীনতার ঘোষণা বলা চলে না। মেজর জিয়া রাজনৈতিক নেতাও ছিলেন না বা স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার মতো উপযুক্ত ব্যক্তিও ছিলেন না।’

আওয়ামী লীগের যুদ্ধের কোনো প্রস্তুতি ছিল না বলেও দাবি করেছেন এ কে খন্দকার। তার দাবি পাকিস্তান সামরিক বাহিনী যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার সময় বাঙালি সেনা কর্মকর্তাদের তাদের করণীয় সম্পর্কে কিছু জানানো হয়নি। এতে তিনি ধারণা করেন আওয়ামী লীগের দিক থেকে কোনো প্রকার যুদ্ধ প্রস্তুতি নেই। এমনকি এ সংক্রান্ত কোনো চিন্তা-ভাবনাও তাদের ছিল বলে মনে হয়নি।’

হারুন হাবীব বলেন, আওয়ামী লীগের সে সময়ের স্বাধীনতার প্রস্তুতি থাকবে কি থাকবে না তা সেনাবাহিনীর কোনো কর্মকর্তার জানার কথা নয়। এই প্রস্তুতি না থাকলে ২৬ মার্চের পর পর দেশ ছেড়ে প্রবাসী সরকার গঠন, অস্ত্র সংগ্রহ আর যুদ্ধ পরিচালনা করা আদৌ সম্ভব কি না সে প্রশ্ন তোলেন হারুন হাবীব। তিনি মনে করেন, এটা আওয়ামী লীগের প্রতি অবমাননা নয়, বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের প্রতি অশ্রদ্ধা। কারণ মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটা জনযুদ্ধ আর এই যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছে আওয়ামী  লীগ।



সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম থেকে অপসারণের সিদ্ধান্ত

পরিস্থিতি সামাল দিতে মুক্তিযুদ্ধের অস্তিত্ব মিশে থাকা সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের চেয়ারম্যান পদ থেকে বাদ পড়তে যাচ্ছেন মুক্তিযুদ্ধের উপ-প্রধান সেনাপতি এ কে খন্দকার। এমনটিই নিশ্চিত করেছেন ফোরামের একাধিক সভাপতিম-লীর সদস্য।

মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার আবু ওসমান চৌধুরী মনে করেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ইতিহাস নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য দেওয়ার অধিকার কেউ রাখেন না। এটা মুক্তিযুদ্ধের অস্তিত্বকে অপমান করার শামিল। জানতে চাইলে ফোরামের সভাপতিম-লীর এই সদস্য বলেন, ‘ফোরাম থেকে তাকে (এ কে খন্দকার) বহিষ্কার করা হবে। আমরা নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সাধারণ বৈঠক করে তাকে বহিষ্কার করব।’

কিন্তু ফোরামের সংবিধান তো বলছে তিনি আজীবন সেখানে থাকতে পারবেন। আবু ওসমান বলেন, ‘এ রকম পরিস্থিতি আসবে কেউ তো কল্পনাও করেনি। এখন সমস্যা দেখা দিয়েছে, সমাধানও সেভাবেই হবে। আমাদের আইনবিষয়ক উপদেষ্টা আছেন। তার পরামর্শ নিয়েই কাজ করব।’

তবে একটু রাখঢাক রেখেই কথা বললেন আরেক সেক্টর কমান্ডার কে এম সফিউল্লাহ। ‘আমরা আশা করছি খন্দকার সাহেব দ্রুতই তার ভুল সংশোধন করবেন। আর তা না করলে ইতিহাস বিকৃতির দায় তো সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম দীর্ঘদিন বয়ে বেড়াতে পারবে না।’  

এ কে খন্দকারের একজন ঘনিষ্ঠজন বলেন, ‘বইটি প্রকাশের কয়েকদিন আগে খন্দকার সাহেব আমাকে ফোন করেছিলেন। তিনি জানান তার একটি বই বেরোবে। আমি জানতে চাইলাম কোথা থেকে বেরুচ্ছে। তিনি জানান প্রথমা থেকে। এটা শুনে আমি তাকে সতর্ক করে বললাম, দেখবেন এ নিয়ে আবার নতুন কোনো বিতর্ক সৃষ্টি হবে নাতো? জবাবে খন্দকার সাহেব বলেন, ‘আমি যা লিখেছি তা তো জেনে বুঝেই লিখেছি। এখানে বিতর্কের কী আছে?’ বইটি প্রকাশের পর আমার সন্দেহই ঠিক  হলো। কারণ এর আগেও প্রথমা থেকে প্রকাশিত একটি বই নিয়ে বিতর্ক উঠেছিল।

ফোরামের নেতারা বলেন, এ কে খন্দকারের এই বইটি স্বাধীনতাবিরোধীরা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন। তার বিষয়ে ফোরাম জোরাল কোনো পদক্ষেপ না নিলে জনগণের মধ্যে এই ধারণা হতে পারে যে, এসব বক্তব্যের সঙ্গে ফোরামও একমত। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে তৈরি এই সংগঠন এটা করতে পারে না।

এর আগেও বিতর্ক উঠেছিল

এর আগেও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে ছোট আকারে বিতর্কের জন্ম দিয়েছিলেন এ কে খন্দকার। ‘মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর কথোপকথন’ বইটিতে তিনি দাবি করেছেন, যুদ্ধের জন্য আওয়ামী লীগ ছিল অপ্রস্তুত। আর বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি। বইটি বেরিয়েছিল যখন তিনি তখন মন্ত্রী ছিলেন। ওই সময় অবশ্য একবার মন্ত্রিসভার বৈঠকেও বিষয়টি আলোচনা হয়েছিল। কিন্তু তার পর আর সামনে আসেনি বিষয়টি। ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত ওই বইটি ছিল এ কে খন্দকার, প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী মঈদুল হাসান ও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য গঠিত যুব শিবিরের মহাপরিচালক এস আর মীর্জার মধ্যকার মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আলাপন। বইটির প্রকাশ করেছিল প্রথমা। ওই বইটি নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা না হলেও এবার ‘১৯৭১ : ভেতরে-বাইরে’ বই লিখে সংসদের ভেতরে ও বাইরে তুলেছেন তুমুল ঝড়। ‘কুলাঙ্গার’, ‘ খোন্দকার মুশতাকের প্রেতাত্মা’, ‘অকৃতজ্ঞ’ এমন কঠোর বাক্যও বলা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের এই উপ-প্রধান সেনাপতিকে। তার সঙ্গের সহযোদ্ধাদের কেউ কেউ সংসদে দাঁড়িয়ে তীব্র ভাষায় প্রতিবাদ জানিয়েছেন। দাবি উঠেছে বইটি বাজেয়াপ্ত করার। এ কে খন্দকারকে ভুল স্বীকার করে জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বানও জানানো হয়েছে সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে। প্রতিবাদ ছড়িয়েছে সংসদের বাইরেও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ছাত্রলীগ কর্তৃক পোড়ানো হয়েছে এ কে খন্দকারের বইটি। প্রথমার প্রকাশিত এই বইটি পুড়িয়েছেন যোগাযোগ ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলকও।   

সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের যাত্রা

মহান মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডারদের নেতৃত্বে ২০০৭ সাল থেকে যাত্রা শুরু করে ‘সেক্টর কমান্ডারস ফোরামÑ মুক্তিযুদ্ধ ৭১।’ জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিকাশ, একাত্তরের অবিকৃত ইতিহাস পুনরুদ্ধার,  বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের ঘাতক, ধর্ষক, যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী ঘৃণ্য অভিযুক্তদের বিচারের দাবিতে ফোরাম অব্যাহত  জাতীয় আন্দোলন পরিচালনা করে আসছে। সেক্টর  কমান্ডারস ফোরাম মনে করে, হানাদার পাকিস্তান বাহিনীর দোসর হিসেবে যে সব ব্যক্তি পবিত্র ধর্মের নামে নিরস্ত্র-নিরপরাধ মানুষ হত্যা করেছে, নির্বিচারে গণহত্যা ও নারী ধর্ষণ করেছে, ব্যাপক  লুণ্ঠন এবং  অপহরণ চালিয়েছে, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও  মানবতাকে সমুন্নত করার স্বার্থে এবং জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের অর্জনকে পূর্ণতাদান করার লক্ষ্যে  এই  মানবতাবিরোধীদের আইনের হাতে সোপর্দ করা একটি জরুরি জাতীয় দায়বদ্ধতা।-এই সময়ের সৌজন্যে