ঢাকা: সভ্যতার শুরু থেকেই ধর্মীয় বিশ্বাস তাড়িত করছে মানুষকে। জীবনাচরণে এই বিশ্বাসের প্রভাব স্পষ্ট। কেবল ব্যক্তিগত নয়, সামাজিক, পারিবারিক এমনকি রাষ্ট্র পরিচালনায়ও ধর্মের প্রভাব অস্বীকার করার জো নেই। সৎ, শান্ত, নিষ্ঠাবান মানুষ হওয়ার কথা বলে ধর্ম। আবার এই ধর্মের ভেতর নানা গোত্র বা পথের মানুষদের মধ্যে দ্বন্দে¦র কারণেই কখনো কখনো ঘটে যায় প্রলয়ঙ্করী ঘটনা।
বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন দল ও সংগঠনের মধ্যেও আছে বিরোধ।এই বিরোধের জেরে সহিংসতার ঘটনা ঘটছে মাঝেমধ্যেই। এসব সহিংসতায় প্রায়ই নষ্ট হচ্ছে জনশৃঙ্খলা।
চারদলীয় জোট সরকারের আমলে জামা’আতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ-জেএমবি, তারও আগে থেকে তৎপর হুজি দেশে একের পর এক বোমা হামলা চালিয়ে উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি করেছিল। সে সময় আরেক সংগঠন হিযবুত তাহ্্রীর উগ্রবাদী বক্তব্য দিয়ে উত্তেজনা ছড়ানোর চেষ্টা করে। সংগঠনটি পরে নিষিদ্ধ হয়। এসব জঙ্গি ও উগ্র সংগঠনের কর্মীদের ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন দলে জড়ানোর তথ্য আছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে। সম্প্রতি আবার আনসারউল্লাহ বাংলা টিম নামে একটি জঙ্গি সংগঠন সহিংসতার চেষ্টা করে। ভিন্ন মতাবলম্বীদের তারা ধর্মদ্রোহী নামে হত্যার মতো ঘটনা ঘটিয়েছে একের পর এক। তাদের দাবি, ধর্মে অবিশ্বাসীদের হত্যা করা জায়েজ।
তবে কেবল ধর্মে অবিশ্বাসী নয়, ধর্মবিশ্বাসী অন্য সংগঠনের কর্মীরাও বাদ যায় না আক্রমণ থেকে। একেকটি দল ও সংগঠনের নেতা-কর্মীরা প্রায়ই একে অপরের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে নানা উত্তেজনা ছড়ায়। সবাই নিজেদের প্রকৃত ইসলামী দল দাবি করে অন্যদের ‘বাতেল’ (ভুল পথের অনুসারী) আখ্যা দেয়। বিরোধ মাঝেমধ্যে এত প্রকট হয় যে খুনোখুনিতে জড়ায় নেতা-কর্মীরা।
ধর্মভিত্তিক দল সম্মিলিত ইসলামী জোটের চেয়ারম্যান মাওলানা জিয়াউল হাসান ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘ধর্মের কথা বলে একটি গোষ্ঠী হিংসা ছড়াচ্ছে। তারা বা তাদের পূর্বসূরিরা নানা সময় একই কাজ করেছে। তারা কোরআন-হাদিসের অপব্যাখ্যা দিয়ে জঙ্গিবাদে জড়াতে চায় মানুষকে। অবস্থান নেয় নারীদের বিরুদ্ধে। তাদের বিরুদ্ধে বলতে গেলেই নানা হুমকি দেয়; আর হত্যায় মাতে।’
জিয়াউল হাসান বলেন, ‘কোরআনে বারবার বলা হয়েছে, ফেৎনা-ফ্যাসাদ না করতে। অথচ তারা সেটাই করে যাচ্ছে ইসলামের কথা বলে। মাওলানা ফারুকীকে হত্যার পর আমাকেও টেলিফোনে হুমকি দিয়ে বলে, এবার আমার সিরিয়াল। আমি বললাম, আপনার নিজেরটা কবে। জবাব না দিয়ে ফোন কেটে দিল।’
কারা এসব করছে জানতে চাইলে মাওলানা জিয়াউল হাসান বলেন, ‘আমরা যাদের বিরুদ্ধে কথা বলি, সেই জঙ্গিবাদী, স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিই এর পেছনে জড়িত, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এই শক্তি ইসলাম প্রতিষ্ঠার কথা বলে সারা দেশে বোমা হামলা চালিয়েছে, এদের পূর্বসূরিরাই আবার মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যা, ধর্ষণ, লুট করেছে ইসলামের কথা বলে। আসলে তারা ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে চায়।’
সম্প্রতি চ্যানেল আইয়ের ইসলামী অনুষ্ঠানের উপস্থাপক মাওলানা নূরুল ইসলাম ফারুকীকে হত্যার পর তার সমর্থকরা সরাসরিই অভিযোগ তুলেছেন ধর্মভিত্তিক অন্য সংগঠনের বিরুদ্ধে। তাদের অভিযোগ, মাওলানা ফারুকী জঙ্গিবাদ, যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে কথা বলতেন। তাই তাকে হত্যা করেছে।
বিশ্বাসের দ্বন্দে¦ খুন
গত বছরের আগস্টের কথা। ঈদুল ফিতরের আগের দিন সন্ধ্যা। খুলনার পূর্ব নগরীর খালিশপুর শিল্পাঞ্চলের উত্তর জোনের একটি বাড়িতে ঘটে ঘটনাটি। তৈয়বুর রহমানকে তার ছেলেসহ গলা কেটে খুন করা হয়। তৈয়ব ছিলেন বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। পুলিশের অনুসন্ধানে জানা গেছে, তৈয়ব ‘হিজবুল্লাহ’ নামে একটি সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
এর পরের ঘটনাটি একই বছরের ২৮ ডিসেম্বরের। ঘটনাটি ঘটেছিল রাজধানীর গোপীবাগে। বাবা-ছেলেসহ একসঙ্গে গলা কেটে খুন করা হয় ছয়জনকে। নিজ বাসায় খুন হওয়া লুৎফর রহমান স্থানীয় পর্যায়ে পীর হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি নিজেকে ইমাম গাজ্জালির প্রতিনিধি বলে দাবি করতেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ধারণা, মতাদর্শের দ্বন্দ্বের কারণে খুন হয়েছেন তিনি। অবশ্য পরবর্তী সময়ে এই ধারণার সত্যতাও মিলেছে তদন্তে।
পরের ঘটনার সঙ্গে ব্যবধান আট মাসের। ঠিক এই সময় আরেকটি হত্যার সাক্ষী হলো রাজধানীবাসী। গত ২৭ আগস্ট রাজধানীর রাজাবাজারে দুর্বৃত্তরা গলা কেটে খুন করে নূরুল ইসলাম ফারুকীকে। যিনি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আন্তর্জাতিক সম্পাদক ও ইসলামিক ফ্রন্টের সভাপতিম-লীর সদস্য ছিলেন। টেলিভিশনে ইসলামী অনুষ্ঠানে উপস্থাপক হিসেবেও বেশ নামডাক ছিল তার। হত্যার ধরন, প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা ও পারিপার্শ্বিক দিক আমলে এনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, খুনের কারণগুলোর মধ্যে ফারুকীর মতাদর্শ ও ধর্মীয় বিশ্বাসের দিকটি উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। এ নিয়ে ভিন্নমতাদর্শীদের সঙ্গে দ্বন্দ্বের বলি হতে পারেন তিনি।
ফারুকীর অনুসারীরা এ ঘটনায় কারো নাম উল্লেখ না করলেও ধর্মভিত্তিক অন্য গোষ্ঠীর অনুসারীদের দায়ী করেছেন। তাদের অভিযোগ, আহলে সুন্নাহের মতাদর্শ যারা মানতে পারে না, তারা নানা সময় তাদের আক্রমণ করেছে। ফারুকী হত্যাও এর অংশ।
ইসলামের মৌলিক আদর্শ ও বিশ্বাসের দ্বন্দ্ব নতুন নয়। বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রেক্ষিতে ব্যাপারটি গা-সওয়া হয়ে গেছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের মতো ইসলাম নিয়ে বহুমত, বহুপথের সহাবস্থান, যা পৃথিবীর অন্য দেশগুলোতে এমনটা খুব একটা দেখা যায় না। সময় সময় দ্বন্দ্বগুলো সামনে আসছে উদ্বেগজনকভাবে।
ধর্মীয় বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে খুনখারাবির শুরু থেকেই এ জন্য দায়ী করা হচ্ছে মওদুদী দর্শনে বিশ্বাসী জামায়াতে ইসলামী এবং কওমি মতাদর্শে বিশ্বাসী দলগুলোকে। কারণ জামায়াতের সঙ্গে আহলে সুন্নাতের ধর্র্মীয় আদর্শ, রূপরেখা ও বিশ্বাস নিয়ে মতভেদ আছে। আহলে সুন্নাতের নেতাদের অভিযোগ, জামায়াত-হেফাজতের উগ্রবাদের কারণেই ঘটছে হত্যার ঘটনা। তাদের সশস্ত্র গ্রুপ বিভিন্ন সময় ঝাঁপিয়ে পড়েছে ভিন্ন মতাদর্শে বিশ্বাসীদের ওপর।
ফারুকী হত্যা সম্পর্কে জানতে চাইলে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের প্রধান সমন্বয়ক মাওলানা এম এ মতিন দায়ী করছেন মওদুদীবাদে বিশ্বাসী গোষ্ঠীকে। তিনি বলেন, ‘জামায়াত-হেফাজত জঙ্গি সংগঠন। এদের সঙ্গে আমাদের মতাদর্শগত বিরোধ পুরোনো। বিভিন্ন সময় তারা আমাদের নেতা-কর্মীদের ওপর প্রকাশ্যে হামলা করেছে। মাওলানা নূরুল ইসলাম ফারুকী তাদের শেষ শিকার।’
কী অপরাধে খুন করা হলো তাকে? জবাবে এম এ মতিন বলেন, ‘তার অপরাধ, তিনি ইসলামের সঠিক পথ ও মত আহলে সুন্নাত তথা ইসলামের সঠিক রূপরেখা তুলে ধরতেন। ইসলামের ছদ্মবেশী মোনাফেক জামায়াত-হেফাজত জঙ্গিগোষ্ঠীর ইসলামবিরোধী অপব্যাখ্যা তুলে ধরতেন। কোরআন-হাদিস দিয়ে তাদের ভুল আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতেন এবং সঠিক তথ্য তুলে ধরে প্রয়োজনে প্রকাশ্য বাহাসের চ্যালেঞ্জ করতেন। তাদের মিথ্যাচারের শুধু জবাবই দিতেন না টেলিভিশনে, কোরআন-হাদিসের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের ইসলামী নিদর্শন তুলে ধরতেন। আকিদাগতভাবে তাকে পরাজিত করা যাবে না এবং তাদের স্বরূপ উন্মোচন হয়ে যাচ্ছে আশঙ্কায় আহলে সুন্নাতের এ শীর্ষ আলেমকে খুন করা হয়।’
জানতে চাইলে হেফাজতে ইসলামের প্রচার সেলের প্রধান মাওলানা আহলুল্লাহ ওয়াসেল ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘ইসলামী দলগুলোর মধ্যে মতাদর্শের তফাত থাকতে পারে। তার মানে এই নয় যে আমরা একে অপরের শত্রু। ইসলাম শান্তির ধর্ম। আমরা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানেই বিশ্বাস করি। তাছাড়া ইসলামের সব মতাদর্শের প্রতিই আমরা শ্রদ্ধাশীল।’ তিনি বলেন, ‘মাওলানা ফারুকী হত্যার সঙ্গে আমাদের সম্পৃক্ত হওয়ার প্রশ্নই আসে না। আমরা কেন তাকে হত্যা করতে যাবো? খুন-রাহাজানি তো আমাদের কাজ না।’
হুমকি-আক্রমণের মধ্যে বসবাস
মতাদর্শের দ্বন্দ্বের কারণে এর আগেও ভিন্নমতালম্বীদের ওপর আঘাত এসেছে। কখনো প্রকাশ্যে, কখনো চোরাগোপ্তা হামলা হয়েছে। উগ্রবাদীদের আঘাতে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে। এগুলোর ব্যাপারে মামলা হয়েছে। কিন্তু বিচারে গতি নেই। যে কারণে একের পর এক এ ধরনের ঘটনা ঘটছে বলেও অভিযোগ করেন আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের নেতারা।
সংগঠনটির নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আহলে সুন্নাতের শীর্ষ আলেমদের সব সময়ই হুমকি-ধমকির মধ্যে থাকতে হয়। অতীতে সংগঠনটির শীর্ষ নেতা মাওলানা বাকী বিল্লাহ জালালী, মাওলানা আব্দুল হালিম, মাওলানা আবু সৈয়দ, জিতু মিয়া, মুহাম্মদ নঈমুদ্দিন, লিয়াকত হোসেন, সাইফুল ইসলামসহ আরো বেশ কিছু নেতা-কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। কাউকে গলা কেটে, কাউকে কুপিয়ে খুন নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে।
সংগঠনটির নেতা মাওলানা এম এ মতিন ফারুকী মনে করেন, অতীতের হত্যাগুলোর বিচার হলে খুনিরা কিছুটা হলেও ভয় পেত। তিনি বলেন, ‘একের পর এক খুন করে খুনিরা পার পেয়ে যাচ্ছে। এতে তাদের মধ্যে সাহস ঢুকে গেছে। জঙ্গিবাদী-জামায়াতিদের কারণে আহলে সুন্নাহর আলেমদের জীবন আজ বিপন্ন হতে বসেছে। এভাবে তো দীর্ঘদিন চলতে দেওয়া যায় না।’
গত বছরও চট্টগ্রামে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের দশ শীর্ষ আলেমকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছিল। জামায়াত-হেফাজত প্রকৃত ইসলাম মানছে না, তারা ধর্মের ব্যাপারে অপব্যাখ্যা দিয়ে বেড়াচ্ছে- এসব কথা বলায় তাদের ওপর এই হুমকি এসেছিল বলে দাবি করছেন সংগঠনটির নেতারা। তারা বলছেন, এ ঘটনার পর পর সংগঠনটির পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিবাদ জানানো হয়েছিল। যেখানে জামায়াত-হেফাজতকে ঘটনার জন্য দায়ী করা হয়েছিল। পরে পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। যেখানে দেখা গেছে, আলেমদের হত্যার জন্য একটি মহল ঠিকই তালিকা করেছিল।
আহলে সুন্নাত ও হেফাজতের মধ্যে বিরোধ
গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীদের নাস্তিক আখ্যা দিয়ে যখন জামায়াত-হেফাজতের মাঠের আন্দোলনের সময় আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের সঙ্গে নতুন করে বিরোধী দেখা দেয়। আহলে সুন্নাতদের পক্ষ থেকে নাস্তিকদের বিচারের পাশাপাশি ধর্মের অপব্যাখ্যাদানের অভিযোগ জামায়াত-হেফাজতের শীর্ষ নেতাদের কঠোর শাস্তি দাবি করা হয়। এই দাবির স্বপক্ষে চট্টগ্রামে বড় ধরনের সমাবেশও করে আহলে সুন্নাত। সমাবেশ থেকে জামায়াত-হেফাজতকে নিজেদের দাবির পক্ষে সরাসরি তর্কের (বাহাস) আহ্বান জানানো হয়। কিন্তু আহ্বানে সাড়া না দিয়ে জামায়াত-হেফাজতের সশস্ত্র বাহিনী তাতে হামলা করেছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। একপর্যায়ে তারা আহলে সুন্নাতের ১০ জন আলেমকে হত্যার জন্য একটি হিটলিস্ট তৈরি করে। পরবর্তী সময়ে পুলিশ ওই তালিকাসহ এক জামায়াত কর্মীকেও আটক করে। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে একটি মামলা করেছিল। কিন্তু এখনো এর বিচার হয়নি।
কখনো পাল্টাপাল্টি সমাবেশে হামলা, কখনো প্রকাশ্যে গলা কেটে আবার গুম করে হত্যা করেছে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের নেতা-কর্মীদের। এসব ঘটনায় স্থানীয় পর্যায়ে মামলা হয়েছে। কিন্তু কোনোটাই সুরাহা হয়নি।
গত বছর ধর্মীয় অপপ্রচারের বিরুদ্ধে সমাবেশ করছিল আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত। অন্যদিকে পাল্টা সমাবেশ ঢেকেছিল হেফাজত। কাছাকাছি দূরত্বের ওই সমাবেশের একপর্যায়ে উভয় পক্ষের মধ্যে বাধে সংঘর্ষ। সশস্ত্র ওই হামলায় একপর্যায়ে প্রাণ হারান আহলে সুন্নাতের কর্মী মাদ্রাসার ছাত্র সাইফুল ইসলাম। এ ঘটনায় হেফাজতের শীর্ষ নেতাদের আসামি করে মামলা করা হয়।
আহলে সুন্নাতের একজন প্রাজ্ঞ আলেম ছিলেন নারায়ণগঞ্জের মাওলানা বাকী বিল্লাহ জালালী। সংগঠনটির এই প্রেসিডিয়াম সদস্যকেও প্রাণ দিতে হয়েছিল ধর্মীয় মতাদর্শের কারণে। একটি ধর্মীয় আলোচনার অনুষ্ঠান থেকে বাড়ি ফেরার পথে একদল দুর্বৃত্ত তুলে নিয়ে যায় তাকে। সেই থেকে তিনি নিখোঁজ।
উপজেলা নির্বাচনের পরেও ঘটেছে সহিংসতার ঘটনা। চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় প্রকাশ্যে গলা কেটে খুন করা হয় আহলে সুন্নাতের নেতা মাওলানা আবু সৈয়দকে। এ ঘটনায় জামায়াত-শিবিরকে দায়ী করেছে আহলে সুন্নাত। তাদের বিরুদ্ধে নিহতের পরিবার মামলাও করেছে। কিন্তু এখনো আলোর মুখ দেখেনি বিচার।
চট্টগ্রামের রাউজানে তিন বছর আগে হয়েছিল আরেক খুন। আহলে সুন্নাতের স্থানীয় কর্মী মুহাম্মদ নুঈমুদ্দিন নামের এক কিশোরকে প্রাণ হারাতে হয়েছিল শিবির ক্যাডারদের হাতে। এই অভিযোগ ওই কিশোরের পরিবারের সদস্যদের। তারা ওই ঘটনায় স্থানীয় শিবির নেতা-কর্মীদের আসামি করে মামলা করেছিল।
২০০৫ সালের ২৯ মের ঘটনা। হবিগঞ্জের চুনারুঘাট এলাকায় চলছিল আহলে সুন্নাতের মাহফিল। একপর্যায়ে ওই মাহফিলে হামলা করা হয় সংগঠনটির তৎকালীন চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ আব্দুল জলিলের ওপর। মূলত তাকে হত্যার জন্য কওমিপন্থী ইসলামী দলগুলো সশস্ত্র হামলা চালিয়েছিল বলে অভিযোগ আহলে সুন্নাতের নেতাদের। ওই ঘটনায় আব্দুল জলিল এলাকাবাসীর প্রতিরোধের কারণে বেঁচে গেলেন প্রাণ যায় জিতু মিয়া নামে এক কর্মীর।
১৯৮৬ সালের ১০ এপ্রিল গলা কেটে খুন করা হয় ইসলামী ছাত্রসেনার এক নেতা লিয়াকত হোসেনকে। তিনি চট্টগ্রামের কুয়াইশ কলেজে সংগঠনটির সভাপতি ছিলেন। শিবিরের উশৃঙ্খল নেতা-কর্মীরা এ হামলা চালিয়েছিল বলে অভিযোগ আছে। মামলা হয়েছিল। কিন্তু নানা উপায়ে আসামি শিবির নেতা-কর্মীরা পার পেয়ে যায়।
১৯৮৪ সালের ১০ জুন চট্টগ্রামের অদুদিয়া তৈয়বীয়া মাদ্রাসায় আহলে সুন্নাতের নেতা মাওলানা আব্দুল হালিমকেও একই কায়দায় গলা কেটে খুন করা হয়। এ হত্যার অভিযোগে শিবির নেতা-কর্মীদের আসামি করা হয়।
মূলত বিরোধটা যেখানে
আহলে সুন্নাতের সঙ্গে জামায়াত, হেফাজত ও কওমিদের দ্বন্দ্বটা ধর্মের কিছু আচার অনুষ্ঠান নিয়ে। সঙ্গে আছে কিছু আপেক্ষিক বিশ্বাস ও দর্শনের মতভেদ। এই বিরোধ দীর্ঘদিনের। মূলত বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ধর্মীয় গোঁড়ামির কারণে এসব অপহত্যা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে বলে মনে করেন দেশের ইসলামি চিন্তাবিদরা।
আহলে সুন্নাত হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নূরের তৈরি, সাহাবায়ে কেরামকে সত্যের মাপকাঠি, অলি-আল্লাহ তথা সুফিবাদে বিশ্বাসী। মহানবী (সা.)-এর প্রতি দরুদ সালাম পাঠ করা ও তার সম্মানার্থে শরীয়তসম্মতভাবে মিলাদের মাঝখানে দাঁড়ানোতেও বিশ্বাসী। আহলে সুন্নাতের অনুসারীরা মনে করেন, আউলিয়াদের মাজার জিয়ারত, শ্রদ্ধা জানানো, মুসলমানদের কবর জিয়ারত ইসলামসম্মত। এগুলো ইসলামের মৌলিক আদর্শ ও বিশ্বাসের মধ্যে পড়ে বলেও তাদের ধারণা।
বিরোধটা মূলত এখানেই। কারণ জামায়াত ও হেফাজতপন্থী দলগুলো মনে করে এগুলো ইসলামের মৌলিক আদর্শ ও বিশ্বাসের অংশ হতে পারে। তারা এসবের বিরোধিতা করে বেড়ান। তাদের বক্তব্য, রাসুল (সা.) মাটির তৈরি। মাজারে পীরের দরবারে হাজির হয়ে কিছু চাওয়া শিরক। মিলাদ বেদায়াত। যে কারণে আহলে সুন্নাতপন্থীরা জামায়াত, হেফাজত ও কওমিদের বিভ্রান্ত মত-পথের অনুসারী বলে আখ্যা করে থাকে। সংগঠনটির নেতা-কর্মীদের দাবি, জামায়াত ও হেফাজত ধর্মের ব্যাপারে অপব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে মুসলমানদের বিভ্রান্ত করছে। রাসুল (সা.), সাহাবা, আউলিয়াদের নামে নানা ধরনের মনগড়া তথ্য দাঁড় করিয়ে ইসলামকে অবমাননা করছে। আহলে সুন্নাতের অনুসারীরা কোরআন, হাদিস, ইজমা ও কিয়াসের ভিত্তিতে এসবের জবাবও দিয়ে আসছেন বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিল ও টিভি অনুষ্ঠানে। মূলত এসব নিয়েই ভয়াবহ বিরোধে মেতেছে দুই পক্ষ।
জামায়াতকে নিয়ে অভিযোগ
কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক আলেমরা পাকিস্তানে মাওলানা আবুল আলা মওদুদীর প্রতিষ্ঠিত জামায়াতের মতাদর্শ ও বিশ্বাসের বিরোধিতা করে আসছেন ১৯৪০-এর দশকে জামায়াত প্রতিষ্ঠার পর থেকেই। তাদের অভিযোগ, ইসলামের ভ্রান্ত মতবাদ প্রচার করছে জামায়াত। তারা আসলে পশ্চিমা শক্তির চর হিসেবে ইসলামের ক্ষতি করে আসছে।
৫০-এর দশকে জামায়াতের প্রতিপত্তি এবং প্রতিষ্ঠার পর থেকে কওমি মাদ্রাসার আলেম-ওলামারা তাদের বিরুদ্ধে শত শত বই লিখে সতর্ক করেছেন অনুসারীদের। কওমি মাদ্রাসাগুলোতে মওদুদীবাদের বিরুদ্ধে এখনো পড়ানো হয় নানা বই। তবে সাংগঠনিক শক্তি এবং আর্থিক শক্তির জোরে এই প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও ধর্মভিত্তিক দলগুলোর মধ্যে জামায়াত এখন নিঃসন্দেহে সবচেয়ে শক্তিশালী।
জামায়াতের সঙ্গে আপনাদের মূল বিরোধিতা কোথায়, জানতে চাইলে কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক দল খেলাফত আন্দোলনের মহাসচিব মাওলানা জাফরুল্লাহ খান ঢাকাটাইমসকে বলন, ‘মওদুদী সাহেব বলেছেন সাহাবীরা সমালোচনার ঊর্ধ্বে নন। তিনি এও দাবি করেছেন নবীরা নিষ্পাপ নন। এটা কোনো মুসলমান বলতে পারে না। কারণ আল্লাহপাক নিজে বলেছেন, সাহাবীদের ওপর তিনি সন্তুষ্ট।’
আপনারা তো দীর্ঘদিন ধরেই জামায়াতের বিরোধিতা করে আসছেন, তারা এ বিষয়ে কী বলে, ‘জানতে চাইলে মাওলানা জাফরুল্লাহ খান বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত কথাবার্তায় কেউ কেউ বলেছেন যে, এসব কথা মওদুদী সাহেবের ব্যক্তিগত মতামত। তারা সেগুলো মেনে চলেন না। কিন্তু আমরা তাদের যখন বলেছি এগুলো প্রকাশ্যে বলতে বা পত্রিকায় বিবৃতি দিতে, তখন তারা রাজি হন না।’
চরমোনাইয়ের সাবেক পীর ও ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের সাবেক আমির মাওলানা ফজলুল করিম একাধিকবার ইসলামের নানা দিক নিয়ে জামায়াতকে বিতর্ক করার চ্যালেঞ্জ দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, জামায়াত যে আসলে ইসলামের শত্রু তা তিনি প্রমাণ করে দেবেন। আর বিতর্কে জামায়াত জিতে গেলে তিনি তাদের বিরুদ্ধে উঠা সব অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেবেন। কিন্তু জামায়াত কখনো সে চ্যালেঞ্জ নেয়নি।
জামায়াত নেতারা প্রকাশ্যে এই দ্বন্দ্ব নিয়ে কথা না বললেও নানা সময়ে ভেতরে ভেতরে কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক আলেমদের এই মনোভাব আর বিরোধিতা নিয়ে উদ্বিগ্ন। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে কওমি মাদ্রাসায় মওদুদীবাদের বিরুদ্ধে পড়ানো পাঠ্যবই বাতিলের চেষ্টাও করেছে জামায়াত। কিন্তু পারেনি তারা।
জামায়াতের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নেতা ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের সঙ্গে আমাদের শত্রুতা রাজনৈতিক বিষয়ে। কিন্তু এই দলগুলোর নেতারা বিভিন্ন মসজিদ মাদ্রাসায় আমাদের বিরুদ্ধে বলে যাচ্ছে। এটা মোকাবিলা করা আমাদের জন্য কঠিন।’
বিরোধের জেরে টুকরো টুকরো
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বরাবরই ধর্ম গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করলেও ধর্মভিত্তিক দলগুলোর প্রভাব একেবারেই নগণ্য। বিষয়টি অস্বীকার করে না দলগুলোর নেতারাও। একাধিক নেতা ঢাকাটাইমসকে এর কাছে বলেছেন, মানুষ ধর্মভীরু হলেও ইসলামপন্থি নেতাদের রাষ্ট্র পরিচালনায় যোগ্য মনে করে না। তা ছাড়া উগ্রবাদ নিয়ে ভীতিও আছে এখানে।
পাকিস্তান আমলের শুরুর দিকে জামায়াতের বাইরে কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক দল ছিল জমিয়তে উলামায়ে ইসলামী। মুফতি মাহমুদ, মাওলানা গোলাম গাউছ হজরাবি নামে দুজন ছিলেন দলটির প্রতিষ্ঠাতা। তাদের সঙ্গে বিরোধের জেরে ৫০ দশকের শুরুর দিকে মাওলানা আতাহার আলী খান ও সিদ্দিক আহমেদ খান প্রতিষ্ঠা করেন নেজামে ইসলাম পার্টি।
মুক্তিযুদ্ধের সময় মুসলিম লীগ, জামায়াত ও নেজামে ইসলাম পার্টির নেতা-কর্মীরা অস্ত্র ধরে পাকিস্তানের পক্ষে। মুক্তিযুদ্ধের পর পর আত্মগোপনে যায় সব সংগঠনের নেতারা। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করার পর দেশের বিভিন্ন এলাকায় নাশকতায় জড়ায় তারা।
১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনের পর জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে রাজনীতিতে আসার সুযোগ করে দেন। ৭০ দশকের শেষ দিকে ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন সংগঠন এক হয়ে ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লিগ বা আইডিএলের যাত্রা শুরু করে। কিন্তু জামায়াতের নাম ব্যবহার নিয়ে বিরোধে ভেঙে যায় এই জোট।
১৯৮১ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে মাওলানা মোহাম্মদ উল্লাহ হাফেজ্জি হুজুর অংশ নেন। সারা দেশের আলেম-ওলামারা তাকে সমর্থন দেন। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভোট পেলেও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আসতে পারেননি। তিনি। ভোটের পর এক কর্মী সম্মেলন করে খেলাফত আন্দোলন নামে একটি দল করার ঘোষণা দেন হাফেজ্জি হুজুর।
বছর চারেক এক থাকতে পারেন এই দলের নেতারা। ১৯৮৫ সালে এই দল ভেঙে আলাদা হয়ে যান চরমোনাইয়ের পীর মাওলানা ফজলুল করীম, শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক ও মাওলানা আবদুল গাফফার। সেটি খেলাফত আন্দোলন (আ গা) নামে পরিচিত ছিল। এই দলেও ভাঙন ধরে পরের বছর। মাওলানা আবদুল গাফফার ও মাওলানা মোহাম্মদ ইসহাকের নেতৃত্বে গঠিত হয় খেলাফত আন্দোলন (গা ই)।
এই অংশে বেশ কয়েকজন নেতা যোগ দিলেও কর্মী ছিল না তেমন। সে সময় জামায়াতের ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের মধ্যে বিরোধের জেরে শিবির থেকে বের হয়ে যুব শিবির গঠন করেন বর্তমানে খেলাফত মজলিসের একাংশের মহাসচিব আহমাদ আবদুল কাদের। তারা যোগ দেন খেলাফত মজলিসের এই অংশে।
খেলাফত মজলিসের আরেক অংশে তখনো ছিলেন চরমোনাইয়ের পীর মাওলানা ফজলুল করীম। ফজলুল করীম, শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক, চট্টগ্রামের মাওলানা আবদুল আহাদ মাদানী, নওয়াপাড়ার পীরসাহেব সাইদ আহমদ, মাওলানা আবদুল গাফফার, বর্তমান জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ও মাওলানা নুরুল হুদা একজোট হয়ে ১৯৮৯ সালে গঠন করেন ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন।
পরের বছরই আবার ভাঙন ধরে এই জোটে। জোট থেকে বের হয়ে জামায়াতে যোগ দেন দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী।
১৯৯১ সালের নির্বাচনের আগে মাওলানা আশরাফ আলীর চিন্তা থেকে কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক সবগুলো দল এক হয়ে গঠন করে আরেকটি মোর্চা। এর নাম হয় ইসলামী ঐক্যজোট। ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনও যুক্ত হয় এই উদ্যোাগ। কিন্তু তারাও এক থাকতে পারেনি বেশি দিন। নির্বাচনের পরপরই জোটে ভাঙন ধরে। খেলাফত আন্দোলন, ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন বের হয়ে যায় জোট থেকে।
এই জোট কেন ভাঙল- জানতে চাইলে খেলাফত আন্দোলনের মহাসচিব মাওলানা জাফরুল্লাহ খান ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘নেতৃবৃন্দের গাদ্দারি এর জন্য দায়ী। আমাকে তারা দাঁড় করিয়েছিলেন (১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে) ঢাকার মিরপুর থেকে। কিন্তু ইসলামী দলের নেতারা আমার পক্ষে না খেটে তলে তলে কাজ করেছে বিএনপির হয়ে। একইভাবে আমাদের দলের আমির আহমদউল্লাহ আশরাফ দাঁড়িয়েছিলেন ঢাকার লালবাগ থেকে। তার বদলে নেতারা কাজ করেছেন বিএনপির প্রার্থী মীর শওকত আলীর হয়ে। তাই আমরা আর এই জোটে থাকা ঠিক মনে করিনি।’
তবে বেশ কিছু দল বের হয়ে এলেও থেকে যায় ইসলামী ঐক্যজোট। মোর্চার নেতারা বারবার নারী নেতৃত্বের বিরোধিতা করলেও ২০০১ সালে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে নেত্রী মেনেই যোগ দেন চারদলীয় জোটে। খালেদা জিয়াকে নেত্রী মানার চেয়ে বড় বিরোধ তখন তৈরি হয় মওদুদীবাদী জামায়াতের সঙ্গে কাজ করা নিয়ে। এ নিয়ে তীব্র বাদানুবাদের পরও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কার্যকর কিছু করতেই হবে- এই চিন্তা থেকে জোটে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ইসলামী ঐক্যজোট।
২০০১ সালে চারদলীয় জোট ক্ষমতায় আসার পর আবার ভাঙন ধরে নানা বিষয়ে মতপার্থক্যের কারণে। ইসলামী ঐক্যজোট থেকে আলাদা হয়ে যান শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক। এরপর তার পরিচয় হয় খেলাফত মজলিসের আমির হিসেবে। তবে চারদলীয় জোটে থেকে যান তিনি।
২০০৬ সালে বিএনপির সঙ্গে বিরোধিতার কারণে চারদলীয় জোট থেকে বের হয়ে যায় খেলাফত মজলিস। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত মানতে না পেরে মাওলানা মোহাম্মদ ইসহাক ও আহমাদ আবদুল কাদের দল ভেঙে খেলাফত মজলিস নামেই থেকে যান চারদলীয় জোটে।
এরপর নানা বিরোধিতায় মুফতি ফজলুল হক আমিনীর নেতৃত্বে ইসলামী ঐক্যজোট থেকে বের হয়ে আলাদা ইসলামী ঐক্যজোট করেন চট্টগ্রামে মাদ্রাসায় গ্রেনেড বিস্ফোরণ মামলার প্রধান আসামি মুফতি ইজাহারুল ইসলাম চৌধুরী। একই ভাবে জোট থেকে বের হয়ে যান মিছবাহুর রহমান চৌধুরী।
বর্তমানে বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক কতটি দল আছে আর সেগুলো কয়টি ভাগে বিভক্ত সে বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা নেই এই দলগুলোর নেতাদেরও।
তবে আলোচিত দলগুলোর মধ্যে ইসলামী ঐক্যজোটের অন্তত তিনটি অংশ। একসময়ের শক্তিশালী দল নেজামে ইসলাম পার্টিতে দুই দফা ঐক্য প্রক্রিয়া চলার পরও দুই অংশে বিভক্ত। জমিয়তে ওলাকায়ে ইসলাম, খেলাফত মজলিস, ইসলামিক ফ্রন্ট, মুসলিম লীগ- সবগুলো দলই ভাগ হয়েছে বিরোধের কারণে।
এই দলগুলো নিজেদের মধ্যে যখন বিরোধে জড়ায় তখন অন্যদের ইসলামের শত্রু এবং ইসলামবিরোধীদের চর আখ্যা দেয়। আবার কখনো কখনো এক হওয়ার চেষ্টা করলেও সন্দেহ-অবিশ্বাসের দোলাচলে কখনো এগোয়নি ঐক্য প্রক্রিয়া।
একটি দলের একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমাদের কাছে আমাদের নেতা যা বলেন, তাই ইসলাম। অন্য দলেও একই কথা প্রযোজ্য। এখন যে যার মতো বিশ্বাস নিয়ে চলে। বলার কিছু নেই।’
আপনারা কখনো একজোট থাকতে পারেননি, বারবার নানা দ্বন্দে¦ ভেঙেছেন। এতে দল হিসেবে নিজেদের গুরুত্ব হারিয়েছেন, কেন এমন হয়েছে- জানতে চাইলে খেলাফত আন্দোলনের মহাসচিব জাফরুল্লাহ খান বলেন, ‘এটা সত্য, কিন্তু কেন হয়েছে, তা কিছু বলার নেই।’
এসব বিরোধ আর ভাগাভাগি নিয়ে আক্ষেপও আছে ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন দল ও সংগঠনের নেতাদের মধ্যে। ইসলামী আন্দোলনের এক নেতা ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমি সবাইকেই বন্ধু মনে করি। আমি মনে করি সবাই ইসলামের অনুসারী। ছোটখাটো বিরোধে এই ভাগাভাগি আমার পছন্দ নয়।’
(ঢাকাটাইমস/ ০৭সেপ্টেম্ব/এইচএফ/এআর/ ঘ.)