ঢাকা: ‘দুঃখের কথা কি আর কমু? রাস্তার এমন অবস্থা যাত্রী নেওয়া তো দূরের কথা, খালি রিকশাই টানা যায় না। আর লোক লইয়া তো শরীলের অবস্থা ডাইল হয়ে যায়। এটা খালি আজকের সমস্যা নয়, বহুদিন থেকে এই অবস্থা দেখতেছি। রাস্তার কোনো কামই হয় না। সরকার এগুলা চোকে দ্যাকে না। হামার দেকায় বহু লোক এ রাস্তায় দুর্ঘটনায় মরি গেল।’
এই কথাগুলো বলেছেন রাজধানীর শ্যামপুরের রিকশাচালক দেলোয়ার হোসেন। তার বাড়ি রংপুর বিভাগের নীলফামারী জেলায়। ১০ বছর ধরে তিনি রাজধানীর শ্যামপুর এলাকায় রিকশা চালান।
বুধবার দেলোয়ারের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের দেখা হয় শ্যামপুর বাজারে। তিনি বলেন, যাত্রাবাড়ী থেকে শ্যামপুরে যাওয়ার পুরো রাস্তাটিই খারাপ ছিল দীর্ঘদিন। কিন্তু ফ্লাইওভার হওয়ার পর জুরাইন থেকে পোস্তগোলা পর্যন্ত রাস্তাটি মেরামত করা হয়েছে। বাকি রাস্তা পুরোটাই খানাখন্দে ভরপুর।
রাজধানীর সড়কগুলোর একাংশ ঝকঝকে তকতকে হলেও বিভিন্ন অলিগলি আর মূল শহরের বাইরের সড়কগুলোর অবস্থা বেহাল। বর্ষায় বৃষ্টিতে পানি জমে বেশ কিছু এলাকার অবস্থা হয়েছে আরও খারাপ।
রাজধানীর সীমানা ঘেঁষা এলাকাগুলোর অবস্থা একেবারেই করুণ। সায়েদাবাদের রেললাইন থেকে যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত পুরো রাস্তাটি নদীর ঢেউয়ের মতো উঁচুনিচু। খানাখন্দ তো আছেই। রাস্তার বেহাল দশার কারণে এই রুটে সবসময় যানজট লেগেই থাকে। ফ্লাইওভার হওয়ার পরও কমেনি যানজট।
ইত্তেফাক মোড় থেকে শুরু করে যাত্রাবাড়ীর গোল চত্বর পার হতে কখনো কখনো সময় লাগে এক ঘণ্টা। যাত্রাবাড়ী গোলচত্বর থেকে শ্যামপুর যাওয়ার রাস্তাটির এতই খারাপ অবস্থা যে, সেখানে যানবাহন চলাচল করছে খুবই কম। মাঝে মধ্যে দু-একটি ট্রাক ও বাসের দেখা মেলে। তবে যেসব গাড়ি বা ট্রাক এই রাস্তা দিয়ে যায় সেসব গাড়ি নষ্ট হয় দ্রুত।
রাস্তায় ইটের খোয়া উঠে যাওয়ায় প্রায়ই গাড়ির চাকা ফুটো হয়ে যায়। ফলে বিড়ম্বনায় পড়তে হয় যাত্রী এবং গাড়িচালকদের। এ রকম ঘটনা যেন এই রুটে নিত্যদিনের।
শিখর পরিবহনের সহকারী ইব্রাহীম ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘কি আর কমু ভাই, ডেলি এই রাস্তা দেয়া গেলে জান বাইর হইয়া যায়। আমাগো তো বাসে দাঁড়ায়া থাকতে অয়। বাস আস্তে চালাইলেও সমস্যা। জোরে টান দিলে পেসেঞ্জাররা গালিগালাজ করে। এই রাস্তাডা যে শেষ কবে ঠিক করছিল তা মনেই নাই। ’
এই পরিবহনের যাত্রী আসমা বেগম ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘এই রাস্তা দিয়ে কোনো ভালো মানুষ গেলে তার শরীর ব্যথা হয়ে যায়। বাসায় গিয়ে ব্যথার ওষুধ খাওয়া লাগে।’
আনন্দ পরিবহনের একটি বাসের চালক মতিউর ঢাকাটাইমসকে জানান, ‘এই রাস্তায় একদিন গাড়ি চালাইলে দুইদিন বিশ্রাম নেওয়া লাগে। আর মাথায় সবসময় টেনশন থাকে কখন কি হয়। চাকা পাংচার হয়ে গেলে যাত্রী এবং আমাদের ভোগান্তির শেষ থাকে না।’
যাত্রাবাড়ীতে একটি কোচিং সেন্টারে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং করেন ডালিয়া আক্তার। প্রতিদিন শ্যামপুর থেকে যাত্রাবাড়ীতে আসেন তিনি। ক্ষোভ প্রকাশ করে ডালিয়া বলেন, ‘প্রতিদিন অনেক কষ্ট করে যাত্রাবাড়ীতে আসি। তারপর আবার জীবনের ঝুঁকি। কখন কি হয়। এছাড়া ভাড়াও বাড়তি। যানজট তো আছেই। সব মিলিয়ে এই রাস্তা পারাপারে জীবনের নাভিশ্বাস অবস্থা।’
মালিবাগ থেকে কাকরাইলগামী সড়কেও আছে বড় বড় গর্ত। বিশেষ করে শান্তিনগর থেকে কাকরাইলগামী পূর্ব দিকের সড়কটির বেহাল দশা। শান্তিনগর কাঁচাবাজারের সামনের সড়কে বৃষ্টি হলেই পানি জমে যাওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এ সড়ক দিয়ে যাতায়াতে বাস, সিএনজি, রিকশাসহ সব ধরনের যানবাহন দুর্ঘটনায় পড়ছে। গর্তে গাড়ির চাকা আটকে যাচ্ছে। গর্তের কারণে সাবধানে চলছে যানবাহনগুলো। এ কারণে সৃষ্টি হচ্ছে দীর্ঘ যানজট।
শান্তিনগর হাবীবুল্লাহ বাহার বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ মোড় থেকে মালিবাগ মোড় পর্যন্তও একই অবস্থা। পুরো সড়ক খানাখন্দ ও গর্তে ভরা। দীর্ঘদিন থেকে সড়কের কার্পেটিং, পাথরকুচি ও খোয়া উঠে গিয়ে বেহাল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়া গত কয়েকদিনের বৃষ্টিতে কাদাপানিতে একাকার।
একই অবস্থা মৌচাক থেকে মালিবাগগামী সড়কের। এ সড়কটির পশ্চিম লেনে সবসময় পানি জমে থাকে। ঈদের আগে ইট দিয়ে কিছু বড় গর্তের সংস্কার করলেও এখনো অনেক গর্ত রয়েছে। অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে চলছে গণপরিবহনগুলো।
ঢাকা-গাজীপুর রুটে চলাচলকারী একটি বাসের চালক কফিল উদ্দিন বলেন, ‘গাড়িতে বইলে ভয়ে থাকি। রাস্তায় জমে থাকা পানির নিচে গর্ত আছে কি নেই আগেভাগে বোঝার উপায় নেই। ভাঙা রাস্তার লাইগ্যা ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে বইয়া থাকতে হয়।’
এ ছাড়া মৌচাক থেকে মগবাজার, সেখান থেকে বাংলামোটর এবং মগবাজার থেকে হাতিরঝিল মোড় হয়ে সাতরাস্তা পর্যন্ত সড়কে ফ্লাইওভার নির্মাণের কারণে অসংখ্য ছোট-বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে হাতিরঝিল মোড়ের দুই দিকের অংশের অবস্থা খুবই খারাপ। এখানে প্রায়ই গাড়ি-রিকশা দুর্ঘটনায় পড়ছে। চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন যাত্রী ও পথচারীরা।
আলতাফ হোসেন নামে আজমেরী পরিবহনের এক যাত্রী ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘মহাখালী থেকে মালিবাগ আসতে সময় লেগেছে আড়াই ঘণ্টা।’ সকাল ১০টায় রওয়ানা দিয়ে সাড়ে ১২টায় মালিবাগে পৌঁছেছেন তিনি। শুধু সময়ই নষ্ট হয়নি, রাস্তার বেহাল দশায় ঝাঁকুনিতে পুরো শরীর ব্যথা হয়ে গেছে।’ একইভাবে বিভিন্ন সড়ক ঘুরে দেখা যায়, সড়কে বড় গর্ত সৃষ্টি হওয়ায় লাঠির মাথায় লাল কাপড় বেঁধে গাড়ির চালকদের সতর্ক করা হচ্ছে।
গুলশান ১ নম্বর এলাকায় উদয় টাওয়ারের পেছনে সড়কগুলোর বেহাল অবস্থায় ক্ষোভ প্রকাশ করে মুদি দোকানি আফছার উদ্দিন বলেন, এই এলাকা ভিআইপি হিসেবে পরিচিত। অথচ এখানকার রাস্তার অবস্থা দেখলে মনে হয় এটা কোনো গ্রাম এলাকা।’ স্থানীয় বাসিন্দারা জানালেন অনেকবার ডিসিসির সঙ্গে যোগাযোগ করে রাস্তা মেরামতের অনুরোধ করা হলেও কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
গাবতলী থেকে নিউমার্কেট হয়ে গুলিস্তান সড়কে নিয়মিত গাড়ি চালান আফাজ উদ্দিন। তিনি জানান, ‘ভাই কি কমু। রাস্তার কারণে প্রতি মাসে অতিরিক্ত ওষুধ খেতে হয়। আর গাড়ির সমস্যা তো আছেই।’ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে প্রায় প্রতিটি এলাকায়ই এ ধরনের সমস্যা দেখা গেছে। প্রধান সড়কের বাইরে বিশেষ করে মহল্লার সড়কগুলোর অবস্থা অনেকটাই নাজুক। এ বিষয়ে সাধারণ মানুষের ক্ষোভের শেষ নেই। তাদের মতে, জনপ্রতিনিধি না থাকায় এ ধরনের উন্নয়ন কাজের দিকে কারও কোনো নজর নেই।
যাত্রাবাড়ীর ধোলাইরপাড় এলাকার বাসিন্দা কবির হোসেন জানান, ‘আমাদের এখানে যে কমিশনার ছিলেন, তিনি এখন নেই। তার মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০১১ সালে। এ জন্য এখানকার সমস্যা দেখার কোনো লোক নেই। যারা আছেন তাদের সবসময় পাওয়া যায় না।’ ডিসিসির প্রশাসকরা মাত্র ৬ মাসের জন্য দায়িত্ব পান বলে রুটিন কাজের বাইরে তেমন কোনো উন্নয়ন কাজে হাত দেন না বলে ধারণা কবির হোসেনের।
ডিসিসি দক্ষিণের প্রধান প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আমরা যাত্রাবাড়ী থেকে শ্যামপুর রাস্তার দায়িত্ব একটি প্রতিষ্ঠানকে দিয়েছিলাম। তারা কাজ করেনি। তাই তাদের বাদ দিয়ে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় রাস্তাটির সংস্কার কাজ করব। আগামী ৪-৫ দিনের মধ্যেই আমাদের লোকজন কাজে নেমে যাবে। আশা করছি ওই রুটের কাজ কোরবানির ঈদের আগেই শেষ হয়ে যাবে।’
এক প্রশ্নের জবাবে জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘এবার যেভাবে পানি আটকে আছে সে জন্য রাস্তাগুলোতে খানাখন্দ ও গর্ত তৈরি হয়েছে। এর জন্য দায় ওয়াসার। তাদের আমরা অনেক বার বলেছি। কিন্তু তারা পানি সরানোর কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না।’ তিনি বলেন, ‘আর্থিক সংকটের কারণে ঠিকাদারদের বিল দেওয়া যাচ্ছে না। যে রাজস্ব আদায় হচ্ছে সেটা বেতন-ভাতাসহ অগ্রাধিকার খাতে ব্যয় হচ্ছে। আর বাজেট সংকটের কারণে সব রাস্তার সংস্কারও করা সম্ভব হয় না।’
ওয়াসার দায় সম্পর্কে জানতে চাইলে সংস্থাটির ড্রেনেজ ও তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী জাকি মোস্তফা চৌধুরী ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘বৃষ্টির পানিতে যখন রাস্তা ডুবে যায়, তখন ওই পানি গর্তে ঢুকে যায়। ওই পানি সরানোর কোনো ব্যবস্থা আমাদের নেই। খানাখন্দ ও গর্তটা যদি ডিসিসি ভরাট করে দেয় তাহলে আর পানি জমবে না। কিন্তু ডিসিসি সেটা না করে উল্টো ওয়াসার ওপর দায় চাপিয়ে দিচ্ছে। ডিসিসি যদি তাদের দায়িত্ব ভালোভাবে পালন করে তাহলে তো আর এই সমস্যা থাকে না।’
এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বিএম এনামুল হকের মুঠোফোনে বার বার চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। তার মুঠোফোনটি বন্ধ পাওয়া গেছে।
জলাবদ্ধতায় নাকাল কিছু এলাকার মানুষ
পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ভরাট হয়ে যাওয়ায় রাজধানীর বেশ কয়েকটি এলাকায় জলাবদ্ধতা স্থায়ী রূপ ধারণ করেছে। এতে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে এলাকাবাসীর। রাজধানীর খিলগাঁওয়ের মৌলভীরটেক এলাকার সড়কগুলো নোংরা পানিতে ডুবে আছে দীর্ঘদিন ধরে। সড়ক ধরে হেঁটে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। রিকশা আর অন্য যানবাহনের ভাড়া বেড়ে গেছে এ কারণে।
একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করেন আবুল হাসান। মতিঝিলে তার অফিস। এই সড়ক ধরে যেতে হয়, তাই মাঝেমধ্যে থাকেন মালিবাগে বন্ধুর বাড়িতে। ওই এলাকায়ও খানাখন্দে ভরপুর। তবু নিজের এলাকার চেয়ে এখানে থাকাকেই ভালো মনে করেন তিনি।
ঢাকাটাইমসকে আবুল হাসান বলেন, ‘থাকি চার তলায়। নিচে নামলেই নোংরা পানির উৎকট গন্ধে বমি চলে আসে। এভাবে কি থাকা যায়?’ মৌলভীরটেকের পাশের সবুজবাগ ও নতুনবাগ এলাকায়ও দেখা গেল একই দৃশ্য। চার মাসেরও বেশি সময় ধরে এই দশা বলে জানিয়েছেন এলাকাবাসী। পানি সরাতে সিটি করপোরেশন ও ওয়াসার কাছে বারবার আবেদন করেও সমাধান মেলেনি।
এলাকার বাসিন্দা আবদুল মোমেন বলেন, ‘আমরা এলাকার মানুষ কতবার যে গেলাম ওয়াসা আর সিটি করপোরেশনের কাছে! তারা কেউ দায়িত্ব নেয় না। একজন পাঠায় অন্যজনের কাছে। এখন আমরা কী করব বলেন।’
বাসাবোর নন্দীগ্রামের মূল সড়কটি পানিবদ্ধ গত এক মাস ধরে। দীর্ঘদিন ধরে জলাবদ্ধ হয়ে আছে কামরাঙ্গীরচরের কোম্পানিঘাট থেকে ঝাউচর, যাত্রাবাড়ীর শ্যামপুর ও ডেমরার অধিকাংশ এলাকাও।
এই দুর্দশার কথা অস্বীকার করে না ঢাকা ওয়াসাও। জানতে চাইলে সরকারি সংস্থাটির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ঢাকাটাইমসকে বলেন, পানি প্রবাহ সচল রাখা ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে তারা ২৫টিরও বেশি প্রকল্প হাতে নিয়েছেন। তবে জনবল ও অর্থ সংকটের কারণে সব কাজ শেষ হয়নি।
(ঢাকাটাইমস/ ৬ সেপ্টেম্বর/ এমএম/ জেডএ.)