ঢাকা: এ কে এম শামছুজ্জোহা ও আলী আহাম্মদ চুনকা। নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের অন্যতম দুই প্রতিষ্ঠাতা। দুজনই মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর দুজনই। এর মধ্যে শামছুজ্জোহা ’৭০-এর নির্বাচনে জয় পেয়ে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য হন। ’৭৩ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও জয়ী হন তিনি। অন্যদিকে আলী আহাম্মদ চুনকা ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার প্রথম নির্বাচিত চেয়ারম্যান। পরে ’৭৮ সালের নির্বাচনেও পৌর চেয়ারম্যান হয়েছিলেন তিনি।
প্রয়াত এই দুই নেতাই ছিলেন দলের জন্য নিবেদিতপ্রাণ। রাজনৈতিক আদর্শে দুজনের অমিল ছিল না। দুঃখ-দুর্দশায় একে অন্যের কা-ারি। আদর্শগত কিছু বিরোধ ছিল দুজনের মধ্যে। কিন্তু এ নিয়ে প্রকাশ্যে কোনো দ্বন্দ্বে জড়াননি কেউ। তবে সময় পাল্টেছে। নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের হাল এখনো ধরে আছে দুই পরিবার। একদিকে শামছুজ্জোহার উত্তরসূরি শামীম ওসমান; অন্যদিকে আলী আহাম্মদ চুনকার মেয়ে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী। একজন একাধিকবারের সংসদ সদস্য, অন্যজন সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচিত মেয়র, যিনি আবার হারিয়েছেন শামীম ওসমানকেই। ভোট শেষেও মেটেনি এই বিরোধ। দুজনের পূর্বপুরুষের আদর্শের দ্বন্দ্বের চেয়েও এই বিরোধ আরো বড়। প্রায় নিয়মিত বাগ্্বিত-া আর পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগের কারণে গণমাধ্যমে খবর হয়ে আসছেন দুজনই।
‘শামীম ও আইভী দুজনই মেতেছেন শত্রু শত্রু খেলায়। কেউ যেন কাউকে সহ্য করতে পারেন না। টিভি টক শো থেকে জনসমাবেশ, কোথাও ক্ষান্ত নেই।’ বলছিলেন নারায়ণগঞ্জের প্রবীণ একজন রাজনীতিক। তিনি বলেন, ‘দুজনের এই দ্বন্দ্বে নারায়ণগঞ্জ জেলার আওয়ামী লীগের রাজনীতি দুটি বিপরীত মেরুতে অবস্থান করছে। ভাগ হয়ে গেছে দলের নেতা-কর্মী-সমর্থকরাও। স্বস্তিতে নেই নারায়ণগঞ্জের সাধারণ মানুষ। হুমকির মুখে জননিরাপত্তা। প্রতিনিয়তই হচ্ছে খুন-খারাবি। দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি দোষারোপে অনেক ক্ষেত্রে প্রকৃত খুনি কারা সে রহস্যের জট খুলছে না।’
শামীম ওসমানের সঙ্গে আপনার লড়াইটা কিসের? জবাবে আইভীর বক্তব্য, ‘পারিবারিক কিংবা রাজনৈতিক নয়, দ্বন্দ্বটা আদর্শের। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সত্যের।’ এর কি কোনো সুরাহা নেই? ত্বরিত উত্তর। ‘সুরাহা তো যেকোনো সময় হতে পারে।’ কীভাবে সেটা? ‘শামীম ওসমান এ পর্যন্ত যত অপকর্ম করেছেন এর জন্য নারায়ণগঞ্জবাসীর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। খুন-খারাবি বন্ধ করতে হবে। টেন্ডারবাজি, ঝুট ব্যবসা, বালুমহালসহ সব কিছু নিজের নিয়ন্ত্রণে নেওয়া যাবে না। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন বন্ধ হলে এই শহরের মানুষ তার বিরুদ্ধে কথা বলবে না। তিনি সব কিছু বন্ধ করলেই তো আমরা শান্তিতে বসবাস করতে পারি।’
কিন্তু শামীম ওসমানের দাবি, তিনি ঠিক পথেই আছেন। তিনি এই সময়কে বলেন, নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের ঘাঁটি। বিএনপি-জামায়াত চাইছে এখানে নিজেদের অবস্থানকে জোরালো করতে। তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালাচ্ছেন তিনি। বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে তার শক্ত অবস্থানের কারণে আজ এসব ষড়যন্ত্রের শিকার হতে হচ্ছে। আইভী জামায়াত-বিএনপির ফাঁদে পা দিয়ে তার সঙ্গে গায়ে পড়ে ঝামেলা করছেন উল্লেখ করে শামীম বলেন, ‘আইভি বিশেষ মহলের ইন্ধনে ও ইশারায় আমার বিরুদ্ধে এসব ষড়যন্ত্র করে বেড়াচ্ছে। সে শুধু অভিযোগই করে গেল। কিন্তু একবারও কোনো একটি ঘটনার প্রমাণ দিতে পারেনি।’
জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জের সাবেক সংসদ সদস্য এস এম আকরাম ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘সাংগঠনিকভাবে নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগ কখনই ভাল ছিল না। তার মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে জেলা কমিটি নেই। এ অবস্থায় একটি সংগঠনের যে হাল হওয়ার কথা তাই হয়েছে।’
দল থেকে বেরিয়ে গেলেন কেন? ‘২০১১ সালে সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সময় দল শামীম ওসমানকে মেয়র প্রার্থী হিসেবে সমর্থন দেয়। কিন্তু আমি এটা মানতে পারিনি। কারণ, শামীম ওসমান ব্যাপারে নারায়ণগঞ্জের মানুষের ধারণা আগে থেকেই ভাল ছিল না। তাই নৈতিকতা বিবেচনা করে দল ছেড়েছি।’
অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় অপদস্থ হতে হয়েছে উল্লেখ করে নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক এই সভাপতি বলেন, ‘ভাল কিছু করতে গেলে বা বলতে গেলেই অপমান হতে হয়েছে।’
দলে ফিরতে চান? ‘ফিরতে তো চাই। কিন্তু নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের এই অবস্থা পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনাই দেখছি না। প্রধানমন্ত্রী (শেখ হাসিনা) তো বিতর্কিতদের প্রশ্রয় দিতে পছন্দ করেন।’
নারায়ণগঞ্জ নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেনের দাবি, নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের মধ্যে কোনো বিভেদ নেই। সবাই এক। তিনি ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘দ্বন্দ্ব থাকলে শামীম ও আইভীর মধ্যে থাকতে পারে। কিন্তু তারা তো দলের কেউ নন। নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের কোথাও তাদের কোনো পদ-পদবি নেই।’ তবে তিনি এও স্বীকার করেন যে, শামীম ও আইভীর মধ্যকার দ্বন্দ্বে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দল।
আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘কেউ চান না এভাবে প্রকাশ্যে একে অন্যকে গডফাদার বলে বেড়াক। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাও এতে ক্ষুব্ধ। কিন্তু আমাদের করার কিছু নেই। শামীম ও আইভীর এই দ্বন্দ্ব উত্তরাধিকার সূত্রে আমরা পেয়েছি। শামীমের বাবা শামছুজ্জোহা ও আইভীর বাবা আলী আহাম্মদ চুনকার মধ্যেও এ ধরনের দ্বন্দ্ব ছিল। আসলে এটা পারিবারিক সূত্রেই চলে এসেছে।’
শামীম ওসমান ও আইভীÑ নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের দুজনের কর্মকা-কে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন? জবাবে নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বলেন, ‘যে মাঠে-ময়দানে নেতা-কর্মীদের সঙ্গে থাকেন সবাই তার কথাই বলে। এদিক থেকে শামীম এগিয়ে। কোনো পদ-পদবিতে না থাকলেও তিনি নিজের উদ্যোগে নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেন। অন্যদিকে মেয়র আইভী আছেন সিটি করপোরেশন নিয়ে। নগরের উন্নয়ন নিয়ে ব্যস্ত। দলের কর্মকা-ে তিনি সক্রিয় নন। নেতা-কর্মীদের সঙ্গেও তার যোগাযোগ-সম্পর্ক নেই। কোনো সভা-সমাবেশে অতিথি হিসেবে ডাকলে আসেন। কিন্তু নিজে থেকে কোনো কর্মসূচি পালন করেন না। যে কারণে আওয়ামী লীগ থেকে পিছিয়ে পড়েছেন তিনি।’
শামীম ওসমানকে গডফাদার বলা হয়। আপনি এটিকে কীভাবে দেখেন? ‘আসলে আইভী এখন নতুন করে গডফাদার বলছে, তা নয়। এর আগেও শামীমের বিরুদ্ধে প্রচার-প্রচারণা ছিল। দলের একটি দায়িত্বশীল পদে থেকে এর বেশি কিছু বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’
দ্বন্দ্ব না মিটলে ক্ষতি আওয়ামী লীগেরই
শামীম ওসমান ও আইভীর মধ্যকার দ্বন্দ্ব না মিটলে নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগকে দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে বলে মনে করছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। তারা বলছেন, তাদের এই রেষারেষি সাধারণ মানুষের মধ্যে আওয়ামী লীগ-আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একের পর এক খুনের ঘটনায় নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে মানুষ। এসব হত্যার বিচার না হওয়ায় আওয়ামী লীগের ওপর থেকে আস্থাও কমে যাচ্ছে অনেকের।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় আওয়ামী লীগের প্রবীণ এক নেতা ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘দলের ভেতর-বাইরে দ্বন্দ্ব তো নতুন কিছু নয়। জেলা পর্যায়ে দলের মধ্য এ রকম দ্বন্দ্ব তো হরহামেশাই চোখে পড়ে। কিন্তু নারায়ণগঞ্জে শামীম ও আইভীর দ্বন্দ্ব এমন জায়গায় পৌঁছেছে তা আর নিয়ন্ত্রণে নেই। এতে আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তির ক্ষতি হচ্ছে। সাংগঠনিকভাবেও দল অনেক দুর্বল হয়ে পড়ছে। এভাবে তো দীর্ঘদিন চলতে পারে না। কেন্দ্রের উচিত যত দ্রুত সম্ভব বিষয়টি মীমাংসার মধ্যে নিয়ে আসা।’
অভিভাবকহীন নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগ
নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের রাজনীতি উত্তর-দক্ষিণে বিভক্ত। আইভী শহরের দক্ষিণাংশের এবং শামীম ওসমান উত্তরের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাই অতীতে দুই পক্ষের সমন্বয়ে কমিটি গঠনে ভালো ফল আসেনি। বরং প্রতিটি কমিটিই ছিল নিষ্ক্রিয়। শহর আওয়ামী লীগ, জেলা ও শহর যুবলীগ, কৃষক লীগে এর বেশি প্রভাব পড়েছিল। এ ছাড়া সাবেক জেলা ছাত্রলীগেও এ অবস্থা দেখা গেছে। এসব কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দুই মেরুর হওয়ায় কমিটিগুলো কোনো সাংগঠনিক তৎপরতা দেখাতে পারেনি। এ কারণে এবার নেতা-কর্মীদের অনেকের দাবি, যে কমিটির সভাপতি শামীম ওসমান হবেন সে কমিটিতে আইভী বলয়ের কেউ থাকবে না। আবার যে কমিটিতে আইভী বা তার অনুসারীরা থাকবেন সেখানে শামীমপন্থিদের কাউকে রাখা যাবে না।
নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সর্বশেষ আনুষ্ঠানিক কাউন্সিল হয়েছিল ১৯৯৭ সালের ২০ ডিসেম্বর। ওই সম্মেলনে নাজমা রহমান ১৩ ভোটের ব্যবধানে প্রবীণ রাজনীতিবিদ প্রয়াত আনসার আলীকে হারিয়ে সভাপতি নির্বাচিত হন। সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী থেকে মফিজুল ইসলাম সরে দাঁড়ালে তৎকালীন সংসদ সদস্য শামীম ওসমান বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সাধারণ সম্পাদক এবং আইনজীবী আনিসুর রহমান দীপু সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন।
২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ৪ দলীয় জোট সরকার গঠন করলে নাজমা রহমান দলবিমুখ হয়ে পড়েন। আর শামীম ওসমান বিদেশে পালিয়ে গেলে নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগ অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে। ওই সময় ২০০২ সালের ২৭ মার্চ পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির অধিকারী নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এস এম আকরামকে (বর্তমানে দলত্যাগী) আহ্বায়ক মনোনীত করে কেন্দ্র থেকে ৬৩ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়। ওই কমিটির ছয়জন ইতিমধ্যেই মারা গেছেন। ওই কমিটিও ইতিমধ্যে ১০ বছরের বেশি সময় পার করলেও সম্মেলন করতে পারেনি। দলের আহ্বায়ক এস এম আকরামসহ দুইজন (সাবেক ফুটবলার আশরাফ উদ্দিন চুন্নুু) দল ছেড়েছেন। আর যুগ্ম আহ্বায়ক মফিজুল ইসলাম বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন।
নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে জেলা আওয়ামী লীগের কমিটি নেই। তাই নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের অভিভাবক কে তা নিয়ে মতপার্থক্য বাড়ছে। যে যেভাবে পারছে দলের ক্ষমতাকে অপব্যবহার করছে। দোষারোপের রাজনীতির সংস্কৃতি মূলত এ কারণেই।’ তবে তিনি আশা ব্যক্ত করে বলেন, ‘শিগগির জেলায় কমিটি দেওয়া হবে বলে কেন্দ্র থেকে আশ্বাস পাওয়া গেছে। কমিটি হয়ে গেলে দল অনেকটা গোছানো অবস্থায় চলে আসবে।’
জানতে চাইলে সাবেক সংসদ সদস্য এস এম আকরাম বলেন, ‘এই মুহূর্তে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের কেউ জয়ী হবেন না।’
বিভিন্ন খুনের দায় নিয়ে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ
লাগাতার খুনোখুনির কারণে নারায়ণগঞ্জকে রক্তাক্ত জনপদ বলছেন অনেকে। বিশেষ করে রাজনৈতিক হানাহানির কারণে বাড়ছে খুন-খারাবি। তবে সব খুনই যে রাজনৈতিক তা ঠিক নয়। নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ার বাসিন্দা স্বপন কুমার দাস বলেন, ‘রাজনীতির বাইরেও ব্যক্তিগত রেষারেষিতে অনেক প্রাণ ঝরে যাচ্ছে। বড়দের ওপর প্রতিশোধ নিতে শিশু হত্যা বেছে নেওয়া হচ্ছে। এসব কারণে প্রতিনিয়তই আতঙ্ক বাড়ছে। জননিরাপত্তা দাঁড়িয়েছে হুমকির মুখে।’
তবে এখানে এ যাবৎকালে চাঞ্চল্যকর হত্যার জন্য পাল্টাপাল্টি দোষারোপের সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে রাজনীতিকদের মধ্যে। গত বছরের ৬ মার্চ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রাফিউর রাব্বীর ছেলে মেধাবী ছাত্র তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী নিখোঁজ হয়। দুদিন পর ৮ মার্চ সকালে শহরের চারারগোপ এলাকায় শীতলক্ষ্যা নদীর শাখা খাল থেকে ত্বকীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ওই দিন রাতেই থানায় একটি হত্যা মামলা করেন ত্বকীর বাবা। মামলায় আসামি করা হয় সংসদ সদস্য শামীম ওসমান, তাঁর ছেলে অয়ন ওসমানসহ জেলা যুবলীগ, ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের।
ঘটনার পর থেকেই ত্বকী হত্যার জন্য শামীম ওসমানের পরিবারকে শক্তভাবেই দোষারোপ করা হচ্ছিল। মেয়র আইভীও এই হত্যার জন্য প্রকাশ্যে শামীম ওসমান, তার ভাই নাসিম ওসমান (সদ্য প্রয়াত) এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের দায়ী করেন। এই হত্যার বিচারের দাবি তোলেন তিনি। কিন্তু শুরু থেকেই শামীম ওসমানের দাবি, রাজনৈতিকভাবে তাদের ঘায়েল করতে এসব ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে আঁতাত করে আইভী এসব করছেন। এই খুনের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা না থাকলেও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তাদের দোষারোপ করা হচ্ছে। ছেলের মরদেহ নিয়ে রাফিউর রাব্বী রাজনীতি করছেন বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
তবে মামলাটির তদন্ত সংস্থা র্যাব সূত্র জানায়, সদ্য প্রয়াত নাসিম ওসমানের ছেলে আজমেরী ওসমানসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে এই খুনের সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ মিলেছে। গ্রেপ্তারকৃতদের জবানবন্দি, সাক্ষীদের জবানবন্দি এবং আজমেরী ওসমানের কার্যালয় থেকে সংগৃহীত বিভিন্ন আলামতের ওপর ভর করে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র তৈরির প্রস্তুতি চলছে।
ত্বকী হত্যার বছর পেরোতে না পেরোতেই গত ২৭ এপ্রিল দুপুরে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র ও কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম এবং আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজনকে অপহরণ করা হয়। দুদিনের মাথায় তাদের মরদেহ শীতলক্ষ্যা নদীতে ভেসে ওঠে। এই খুনের অন্যতম অভিযুক্ত আসামি নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের আরেক কাউন্সিলর নূর হোসেন। শামীম ওসমানের সঙ্গে নূর হোসেনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা সবার মুখে মুখে। এছাড়া ২৭ এপ্রিল ঘটনার দিন নূর হোসেন শামীম ওসমানের সঙ্গে দেখাও করেছেন। কিন্তু এর পর থেকেই তিনি লাপাত্তা হয়ে যান। পরে অবশ্য তাকে কলকাতা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। এখন তিনি কলকাতাতেই আছেন।
আলোচিত এই সাত খুনের পেছনে শামীম ওসমানের সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে অভিযোগ করছেন মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী। গণমাধ্যমের সামনে একাধিকবার তিনি এ অভিযোগ করেছেন। হত্যার পর নূর হোসেনকে ভারতে পালিয়ে যেতে শামীম ওসমানের আশীর্বাদ ছিল বলেও দাবি আইভীর। অবশ্য ঘটনার পর প্রকাশ হওয়া একাধিক ফোনালাপেও বিষয়গুলো উঠে এসেছে।
কিন্তু শামীম ওসমান শুরু থেকেই এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন। বরং তিনি নিজেই গণমাধ্যমের কাছে বলেছেন, ঘটনার আগে নূর হোসেনের ফোনালাপ এবং তার পালিয়ে যাওয়ার ধরন দেখেই বোঝা যাচ্ছে এই খুন সেই করিয়েছে। ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বের কারণে নূর হোসেন এই হত্যা করেছে বলে ধারণা করেন তিনি।
অভিযোগ আছে, ৬ কোটি টাকার বিনিময়ে র্যাব-১১-এর কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এই হত্যাকা- ঘটিয়েছেন। র্যাব-১১-এর সাবেক অধিনায়ক তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, সাবেক মেজর আরিফ হোসেন এবং নারায়ণগঞ্জের সাবেক প্রধান এম এম রানাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। পরে তাদের গ্রেপ্তার করে বিচারের মুখোমুখি করা হয়। তারা তিনজনই জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন।
অন্যদিকে যুবলীগ নেতা জহিরুল ইসলাম পারভেজ গুমের ঘটনায় শুরু থেকেই আইভীকে দায়ী করছেন শামীম ওসমান। ওই ঘটনায় পারভেজের স্ত্রী খুরশিদ জাহান সোহানা প্রথমে গুলশান থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। ঘটনার দুই মাস পর গত বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর সোহানা বাদী হয়ে মেয়র আইভীর ঘনিষ্ঠ ঠিকাদার আবু সুফিয়ানকে প্রধান আসামি করে সাতজনের বিরুদ্ধে গুলশান থানায় একটি অপহরণ মামলা করেন। ওই মামলার অন্য আসামিদের মধ্যে রয়েছেন নাসিকের ১২নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর শওকত হাশেম শকু, বিএনপিপন্থি পরিবহন নেতা মাহাবুব উল্লাহ তপন, শহর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং আইভীর ছোট ভাই আহাম্মদ আলী রেজা উজ্জ্বল, জেলা যুবলীগ সভাপতি আবদুল কাদিরের একমাত্র ছেলে মিনহাজুল কাদির মিমন এবং মেয়র আইভীর মামাতো ভাই রেজাউল করিম রনি।
তবে আইভী বলেন, ‘পারভেজকে কে বা কারা গুম করেছে এটা আমরা জানি না। পারভেজের পারিবারিক ভাষ্য অনুযায়ী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে গুলশান থেকে তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু ঘটনার দুই মাস পর আমার ভাই-ভাগ্নেদের জড়িয়ে মামলা করা হয়েছে। এ আসামিদের প্রায় সবাই নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আমার হয়ে কাজ করেছে। তাই তাদের বিরুদ্ধে এই মামলা।’ তিনি অভিযোগ করেন, তাকে দলত্যাগে বাধ্য করতে শামীম ওসমান এসব কাজ করছেন। কিন্তু যত অত্যাচার-নির্যাতনই চালানো হোক, তিনি আওয়ামী লীগ ছেড়ে কোথাও যাবেন না।
ওসমান পরিবারের অতীতগাথা
নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রাম ও রাজনৈতিক ইতিহাসে ওসমান পরিবার বিগত তিন পুরুষ ধরে অবদান রেখে আসছে। শামীম ওসমানের দাদা খানসাহেব ওসমান আলী ছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ-ভারতের প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব, এমএলএ এবং আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। ব্রিটিশ সরকার তার যোগ্যতার কারণে খানবাহাদুর ও খানসাহেব উপাধিতে ভূষিত করেন। শামীমের বাবা প্রয়াত এ কে এম শামছুজ্জোহা ভাষা আন্দোলনসহ ’৬৬-এর অসহযোগ আন্দোলন, ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান এবং ’৭১-এর স্বাধীনতা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর সহযোদ্ধা ছিলেন। ’৭০-এর নির্বাচনে তিনি প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য এবং ’৭৩ সালে আবার জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। স্বাধীনতা সংগ্রামে বিশেষ অবদানের জন্য স্বাধীনতা পদকে (মরণোত্তর) ভূষিত হন তিনি। শামীম ওসমানের বড় ভাই সদ্য প্রয়াত এ কে এম নাসিম ওসমান জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন। তিনি তিনবারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য ছিলেন। মেজো ভাই সংসদ সদস্য এ কে এম সেলিম ওসমান নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের সাবেক সভাপতি, বিকেএমইএ এবং নারায়ণগঞ্জ চেম্বারের বর্তমান সভাপতি।
শামীম ওসমান ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতি করেন। ১৯৮১ সালে সরকারি তোলারাম কলেজের ভিপি নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৯৬ সালে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে আওয়ামী লীগ থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। নারায়ণগঞ্জের টানবাজারের পতিতাপল্লী উচ্ছেদ এবং যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমকে নারায়ণগঞ্জে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন এবং তার প্রতীকী ফাঁসি দিয়ে ব্যাপক আলোচনায় চলে আসেন।
চুনকা পরিবারের কথা
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীর বাবা প্রয়াত আলী আহাম্মদ চুনকা ছিলেন ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার প্রথম নির্বাচিত চেয়ারম্যান। সাধারণ মানুষের নেতা হিসেবেই তিনি পরিচিত ছিলেন। পরবর্তী সময়ে ’৭৮ সালের নির্বাচনেও তিনি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তিনি শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। আইভীর বাবা যখন ১৯৮৪ সালে মারা যান আইভী তখন উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্রী ছিলেন এবং চুনকার পাঁচ সন্তানের মধ্যে তিনিই বড়। বাবার মৃত্যুর পর ১৯৮৬ সালে তিনি বৃত্তি নিয়ে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের ওদেসা নগরের পিরাগভ মেডিকেল ইনস্টিটিউটে পড়তে যান। পড়াশোনা শেষ করে ১৯৯২ সালে দেশে ফেরেন এবং ওই বছরই নারায়ণগঞ্জ শহর আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক হন। পরবর্তী সময়ে ২০০৩ সালে তিনি নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। নারায়ণগঞ্জ পৌরসভাকে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন ঘোষণার পর দলীয় সমর্থন না পেলেও ২০১১ সালের ৩০ অক্টোবর অনুষ্ঠিত মেয়র নির্বাচনে শামীম ওসমানকে বিপুল ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে আলোচনায় উঠে আসেন। নারায়ণগঞ্জ তো বটেই যেকোনো সিটি করপোরেশনে প্রথম নির্বাচিত নারী মেয়র এই সেলিনা হায়াৎ আইভী।
(ঢাকাটাইমস/ ২৪ আগস্ট /এইচএফ/ এআর/ ঘ.)