logo ৩০ এপ্রিল ২০২৫
সাবেক প্রতিমন্ত্রী শাহজাহানকে ঘিরে ছিল দুর্নীতির বলয়

হাবিবুল্লাহ ফাহাদ, ঢাকাটাইমস
১৬ আগস্ট, ২০১৪ ২০:০০:৩০
image


ঢাকা: রাজনীতিতে সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন তিনি। স্বচ্ছ ভাবমূর্তির মানুষ হওয়ায় গতবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে ধর্ম প্রতিমন্ত্রী বানিয়েছিল তাঁকে। কিন্তু মন্ত্রিত্ব পেয়ে এভাবে বিতর্কিত হয়ে পড়বেন তা হয়ত তিনি নিজেও ভাবেননি আগে। পরিস্থিতি এতটাই বেগতিক হয়েছিল যে, গত নির্বাচনে দলের মনোনয়ন বঞ্চিত হয়েছেন। তিনি মো. শাহজাহান মিয়া। পটুয়াখালীতে শাহজাহান উকিল নামে চেনে অনেকে। সরকারের গত মেয়াদে ধর্ম প্রতিমন্ত্রী থাকাকালে তাঁর বিরুদ্ধে সরাসরি দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ ছিল না। তবে নিজের ছেলেদের এবং সহকারী একান্ত সচিবের (এপিএস) বিরুদ্ধে আছে বৈধ-অবৈধভাবে টাকা আয়ের বিস্তর অভিযোগ। বিষয়টি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) নজরও এড়ায়নি। এপিএস সৌমেন্দ্র লাল চন্দ্র শৈলেনকে দাঁড়াতে হয়েছে দুদকের কাঠগড়ায়।

পটুয়াখালীর পথে প্রান্তরে অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে শাহজাহান মিয়ার ছেলেদের এবং এপিএস শৈলেনের নানা অনিয়ম-দুর্নীতির ও বিত্ত-বৈভবের অজানা তথ্য। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত পাঁচ বছরে পটুয়াখালীতে সরকারি বিভিন্ন খাতের ঠিকাদারি ব্যবসায় একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিল শাহজাহান মিয়ার দুই ছেলে তারিকুজ্জামান মনি এবং আরিফুজ্জামান রনি। এছাড়া ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক ব্যবসা, শপিংমলসহ নানা খাতে বিপুল বিনিয়োগ আছে তাদের। নামে-বেনামে জায়গাজমি কিনেছে প্রতিমন্ত্রীর পুত্ররা। একসময় মন্দিরে বসবাস করা প্রতিমন্ত্রীর এপিএস শহরের প্রাণ কেন্দ্রে তুলেছেন চারতলা পাকা দালান। ঢাকাতেও আছে প্রতিমন্ত্রীর বহুতল ভবন। এপিএস শৈলেনও পিছিয়ে নেই এ থেকে। দালান তুলতে না পারলেও রাজধানীতে আছে তাঁর একাধিক ফ্ল্যাট। শুধু অর্থকড়িই নয়, পটুয়াখালী আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোকে ঢেকে ফেলেছেন পরিবারতন্ত্রের চাদরে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পটুয়াখালী আওয়ামী লীগের এক প্রবীণ নেতা ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘শাহজাহান উকিল যেমন তেমন, গত পাঁচ বছরে তাঁর ছেলেদের ক্ষমতার দাপটেই টিকতে পারেনি কেউ। প্রতিমন্ত্রী নিজে সরাসরি কোনো অনিয়ম-দুর্নীতিতে না জড়ালেও এপিএস শৈলেনের হাত দিয়ে সবকিছু হতো। বড় বড় অর্থ লেনদেনের বিষয়গুলো প্রতিমন্ত্রীর স্ত্রী মমতাজ শাহজাহানের মধ্যস্থতায় ঠিক হতো। এছাড়া তাঁর মেয়ে শাম্মি এবং মেয়ের জামাতাও এসব কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।’   

অভিযোগ আছে, হজ লাইসেন্স, ওয়াকফ এস্টেটের সম্পদের মোতোয়ালি পরিবর্তনের নামে কোটি কোটি টাকা ঘুষ লেনদেন হয়েছে। প্রতিমন্ত্রীর এপিএস শৈলেনের হাত দিয়েই এসব হয়েছে। এছাড়া হজে ওষুধ সরবরাহের কাজ পাইয়ে দেওয়ার নামে শাহজাহান মিয়ার বড় ছেলে আখতারুজ্জামান বাচ্চু আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন।

এপিএস শৈলেনকে জিজ্ঞাসাবাদ ও দুদকের অনুসন্ধানে মো. শাহজাহান মিয়া, তাঁর ছেলে মনি এবং রনি, মেয়ের জামাতা এবং স্ত্রীর বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের তথ্য মিলেছে। এ কারণে শাহজাহান মিয়া ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের আয়কর নথি তলব করেছে দুদক।

এ ব্যাপারে কথা বলার জন্য শাহজাহান মিয়ার মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি। পরে তার ছেলে তারিকুজ্জামান মনির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমার কোনো ক্লিনিক ব্যবসা নেই। ব্যক্তিগতভাবে আমি ঠিকাদারির সঙ্গেও জড়িত নই। এমনকি পটুয়াখালী শহরে আমার কেনা এক টুকরা জমি আছে এই প্রমাণ কেউ দিতে পারবে না। আমার বাপ-দাদারা অনেক সম্পদের মালিক। পটুয়াখালী সদরের তিন ভাগের দুই ভাগ জায়গা-জমিই আমাদের।’ স্ত্রীর নামে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও সম্পত্তির ব্যাপারে জানতে চাইলে মনি বলেন, ‘কারো নামে একটা-দুইটা দোকান থাকলে এটা তো দোষের কিছু নয়।’

সাবেক ধর্মপ্রতিমন্ত্রীর এপিএস শৈলেনের দুর্নীতি বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘শৈলেন কী করেছে না করেছে তা তো আমি বলতে পারব না। তার বিরুদ্ধে তদন্ত করলে সব জানা যাবে। তবে সে যদি দুর্নীতি করেও থাকে এর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক নেই।’

ঠিকাদারিতে একচ্ছত্র আধিপত্য

‘প্রতিমন্ত্রী বাবার পরিচয় খাটিয়ে এমন কোনো কাজ নেই তারা করেননি। পটুয়াখালীতে তাদের হুকুম ছাড়া কোনো ঠিকাদারি কাজ বণ্টন হতো না। নিজেদের প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দিতে সব ধরনের প্রভাব খাটাতেন প্রতিমন্ত্রীর ছেলেরা।’Ñসাবেক ধর্ম প্রতিমন্ত্রীর ছেলেদের ঠিকাদারি ব্যবসায় একচ্ছত্র আধিপত্যের বর্ণনা দিচ্ছিলেন স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতা।

স্থানীয় সূত্র জানায়, পটুয়াখালীর সড়ক ও জনপথ বিভাগ, এলজিইডি, গণপূর্ত বিভাগ, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন কর্মকা-ে নানা সময়ে অবৈধ প্রভাব বিস্তার করেছেন শাহজাহান মিয়ার দুই ছেলে রনি ও মনি। এছাড়া তাদের নিজস্ব ঠিকাদারদের কাজ পাইয়ে দিয়ে কোটি কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ আছে তাদের বিরুদ্ধে। নিজেদের পছন্দের লোকদের দিয়ে ঠিকাদারি ব্যবসা পরিচালনা করতেন রনি ও মনি। ঠিকাদারি ব্যবসায় সহযোগী সিন্ডিকেটে আছে পেপার নাসির, মহিউদ্দিন আজাদ, গিয়াস, রিয়াজ মৃধা, কালাম মৃধা, ওসি কামাল, হাফিজসহ বেশ কজন। মূলত এদের দিয়েই ঠিকাদারি ব্যবসা পরিচালনা করতেন সাবেক প্রতিমন্ত্রীর ছেলেরা। এছাড়া এসব কাজে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের সহযোগিতার বিষয়টিও লোকমুখে শোনা যায়। ঠিকাদারি কাজকে কেন্দ্র করে এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলীকে মারধরের অভিযোগ আছে রনির সহযোগীদের বিরুদ্ধে।

সূত্র আরও জানায়, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে হজে ওষুধ সরবরাহ করার কাজটি জাহাঙ্গীর উল্লাহ নামে একজনকে পাইয়ে দেন শাহজাহান মিয়ার বড় ছেলে আখতারুজ্জামান বাচ্চু। এছাড়া বাচ্চু ও রনির নামে একাধিক ঠিকাদারি লাইসেন্স আছে। গত পাঁচ বছরে ঠিকাদারি ব্যবসা করে বাচ্চু শতকোটি টাকা আয় করেছেন বলেও জানা গেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পটুয়াখালী সদর হাসপাতালে রোগীদের ডায়াট ও খাদ্য সরবরাহের কাজটিও নিয়ন্ত্রণ করেছেন শাহজাহান মিয়ার ছেলে মনি। শহীদ নামে এক ব্যক্তির মাধ্যমে কাজটি পাইয়ে দিতে মনি বছরে ৫০ লাখ টাকা উপঢৌকন নিয়েছেন বলে অভিযোগ আছে। এর সঙ্গে নজরুল ইসলাম ওরফে বেটে নজরুলের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে জানা গেছে।  

ওয়াকফ এস্টেটে কোটি কোটি টাকা লেনদেন

ওয়াকফ এস্টেটের মোতোয়ালি পরিবর্তন নিয়ে অনৈতিকভাবে কোটি কোটি টাকা লেনদেনের অভিযোগ আছে সাবেক ধর্ম প্রতিমন্ত্রীর বিরুদ্ধে। প্রতিমন্ত্রীর এপিএস শৈলেনের সরাসরি তত্ত্বাবধানে এসব অনিয়ম হয়েছে বলে সূত্রে জানা গেছে। সম্প্রতি দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানেও শৈলেনের এসব দুর্নীতির কথা উঠে এসেছে। সূত্র জানায়, চট্টগ্রামে ওয়াকফ এস্টেটের সম্পদের মোতোয়ালি পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে সর্বোচ্চ ৮০ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। এছাড়া সারা দেশেই ওয়াকফ এস্টেটের সম্পদ নিয়ে সরকারি দলের লোকজনদের বিরুদ্ধে ব্যাপক হরিলুটের অভিযোগ আছে।

শহরের বুকে দালান, তিনি থাকেন টিনশেডে

শহরের থানা পাড়া এলাকায় শাহজাহান মিয়ার একটি টিনশেড বাড়ি ছিল অনেক আগের। এই বাড়ির সামনেই তাঁর চেম্বার। এখানে বসেই আইন পেশা চর্চা করেন তিনি। পুরনো বাড়িটি আগের মতোই আছে। কিন্তু এই বাড়ির পশ্চিম পাশে উঠছে দালান। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভবনটি শাহজাহান মিয়ার বড় ছেলে বাচ্চুর। এর মধ্যে তিন তলার নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। তবে দুদক সাবেক প্রতিমন্ত্রীর এপিএসের সম্পদের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরুর পর এই ভবনটির নির্মাণ কাজ বন্ধ রাখা হয়েছে। এছাড়া পটুয়াখালী শহরের কালিকাপুরে আরও একটি তিন তলা ভবনের মালিক তিনি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় আওয়ামী লীগের এক নেতা ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পর শত শত কোটি টাকার মালিক হলেও যতটুকু সম্ভব সবকিছু গোপন রাখতে চাইছেন শাহজাহান মিয়া। এজন্য তিনি নিজে এখনো টিনশেড বাড়িতেই থাকছেন। পাকা দালানে উঠছেন না। এর সবকিছুই তাঁর লোক দেখানো। আসলেই তিনি  কৌঁসুলি (আইনজীবী)।’

ঢাকায় বহুতল ভবন

শাহজাহান মিয়ার বিত্ত-বৈভবের কথা প্রকাশ্যে আসতে শুরু হয় এপিএস শৈলেনের বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান শুরুর পর। দুদক সূত্র জানায়, দুদকের কাছে শৈলেন যে তথ্য দিয়েছেন, তাতে সাবেক প্রতিমন্ত্রীর সম্পদের ব্যাপারেও বলা হয়েছে। কোথায় কত টাকার সম্পদ ও নগদ টাকা জমা আছে এসব বিষয়েও দুদকের কাছে তথ্য দিয়েছেন শৈলেন।

সূত্র জানায়, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সাংসদের জন্য কম টাকায় কিস্তিতে উত্তরায় প্লট বরাদ্দ দিয়েছিল। শুরুর দিকে শাহজাহান মিয়ার পক্ষে ওই কিস্তির টাকা পরিশোধ করা কঠিন ছিল। কিন্তু ৯ নম্বর সেক্টরের ৬ নম্বর সড়কের ওই প্লটে এখন ছয়তলা ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। প্রায় ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ভবন নির্মাণের এ কাজ চলছে বলে জানা গেছে।

উত্তরার বাসিন্দা নাজমুল ইসলাম ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘শুনেছি এটি প্রতিমন্ত্রীর বাড়ি। দীর্ঘদিন জায়গাটি খালি ছিল। গত কয়েক বছর আগে এখানে ভবন নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে।’

মনির নামে পটুয়াখালীতে মার্কেট

পটুয়াখালী শহরে নামে-বেনামে সাবেক প্রতিমন্ত্রীর পরিবারের মার্কেট ও প্রসিদ্ধ মার্কেটে দোকান আছে। সূত্র জানায়, শাহজাহান মিয়ার ছেলে মনির নামে ৪ কোটি টাকা ব্যয়ে পটুয়াখালীতে মার্কেট নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া শহরের একটি অভিজাত সাগর কন্যা সুপার মার্কেটে মনির স্ত্রী শরমির একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে। মার্কেটের মধ্যে তার ওই প্রতিষ্ঠানটিই সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয়।

ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে শাহজাহান-পুত্রের বিনিয়োগ

পটুয়াখালী শহরটি খুব বেশি বড় না হলেও এখানে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে বেশকিছু ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। সেবার চেয়ে এগুলোর মূল লক্ষ্য ব্যবসা। এ রকম চারটি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে শাহজাহান মিয়ার মেজো ছেলে মনির প্রায় কোটি টাকা বিনিয়োগ আছে বলে জানা গেছে।

সূত্র জানায়, মালিকানায় মনির অংশীদারিত্ব আছে এমন প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছেÑসেতারা ক্লিনিক, আমেনা ডায়াগনস্টিক সেন্টার, পানামা ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং কিওর মেডিকেল সার্ভিসেস। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে কিওর মেডিকেল সার্ভিসেস প্রতিষ্ঠানে অর্ধেকের বেশি শেয়ার মনির নামে। বাকিগুলোরও প্রতিটিতে ১০ লাখের বেশি টাকা করে বিনিয়োগ আছে।

স্থানীয় আরেকটি ক্লিনিকের মালিক নাম প্রকাশ না করা শর্তে ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘শহরে গড়ে ওঠা ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সবকটিতেই মনির শেয়ার আছে। গত পাঁচ বছরে এসব ব্যবসা করে বিপুল অর্থ আয় করেছে সে।’ অথচ মনির নির্বাচনী হলফনামায় ক্লিনিক ও পত্রিকা ব্যবসায় ৯ লাখ টাকা বিনিয়োগ আছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসা তথ্যের সঙ্গে এর কোনো মিল নেই।  

মুক্তির মোড়ে প্লট

একাধিক বাড়িই নয়, পটুয়াখালী শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়কের পাশে আছে সাবেক প্রতিমন্ত্রীর ছেলের জায়গা এবং দোকানপাট। শহরের মুক্তির মোড়ে যে কাউকে বললে দেখিয়ে দেবে সীমানা দেয়ালে ঘেরা জায়গাটি। সূত্র জানায়, দুই বছর আগে দেড় কোটি টাকায় কেনা হয়েছে জায়গাটি। এর সামনে বেশকিছু দোকানপাটও আছে। নিজের নাম গোপন করতে জায়গা কেনাবেচায় মনির সহযোগী পেপার নাসিরকে সামনে আনা হয়েছে। তারিকুজ্জামান মনি পটুয়াখালী সদর উপজেলার সদ্য নির্বাচিত চেয়ারম্যান। তিনি নির্বাচনের আগে যে হলফনামা নির্বাচন কমিশনে জমা দিয়েছেন সেখানে নিজের কোনো স্থাবর সম্পদ অর্থাৎ জমিজমা নেই বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দা আক্কাস মিয়া ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘এই জায়গাটি শহরের একটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠানের মালিক কিনতে চেয়েছিলেন ৫০  হাজার টাকায়। কিন্তু তারা শেষ পর্যন্ত আর এটি কেনেননি। পরবর্তী সময়ে প্রতিমন্ত্রীর ছেলে দেড় কোটি টাকা দিয়ে জায়গাটি কিনেছেন বলে শুনেছি।’

শ্মশানের জমি দখল

পটুয়াখালী শহরের শেষ দিকে হিন্দুদের শ্মশানের জমি দখলের অভিযোগও আছে সাবেক প্রতিমন্ত্রীর পরিবারের বিরুদ্ধে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, শ্মশান ঘাটের পশ্চিম পাশে একটি জায়গায় ইট, বালু রাখা হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দা নিতাই চন্দ্র ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘হুনছি শাহজাহান উকিল সরকারের কাছ থাইক্যা জমিটা লিজ আনছে। হেয় এখন এইডা ভাড়া দেয়। অথচ আমরা জানতাম এইডা শ্মশানের জমি।’

সূত্রে জানা গেছে, এখানে ৩০ শতাংশের মতো জমি শাহজাহান মিয়া দীর্ঘদিন ধরে জবরদখল করে রেখেছেন। সরকারদলীয় লোক হওয়ায় তাঁর বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে সাহস পান না।  

বন তাপসী নিলাম

সব ধরনের ব্যবসাতেই মন দিয়েছেন সাবেক প্রতিমন্ত্রীর পরিবার। সম্প্রতি বন বিভাগের লঞ্চ বন তাপসী নিলামে ৫ লাখ টাকায় শাহজাহান মিয়ার ছেলে মনি কিনেছেন বলে সূত্রে জানা গেছে। এই নিলামে তারা অনৈতিকভাবে প্রভাব খাটিয়েছেন বলে অভিযোগ আছে।   

লঞ্চঘাট থেকে চাঁদা আদায়

অভিযোগ আছে, মনির সহযোগী বলে পরিচিত একটি চক্র প্রতিদিন লঞ্চ ঘাট থেকে ৬ হাজার টাকা করে চাঁদা আদায় করে আসছে। এসএম ফারুক মৃধা নামে এক ব্যক্তির কাছ থেকে এই টাকা আদায় করা হয়। তবে সরেজমিনে গেলে কেউ এ ব্যাপারে কথা বলতে রাজি হয়নি।  

মন্দির থেকে অট্টালিকায় শৈলেন

পটুয়াখালী শহরের স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একসময় শহরের হিন্দু মন্দিরের জায়গায় ঘর করে থাকতেন সাবেক ধর্ম প্রতিমন্ত্রীর এপিএস সৌমেন্দ্র লাল চন্দ্র শৈলেন। কিন্তু গত পাঁচ বছরে ভাগ্য বদলে গেছে শৈলেনের। এখন আর মন্দিরের জায়গায় থাকেন না। শহরের জুবলী স্কুল রোডে চারতলা দালান তুলেছেন তিনি। সূত্র জানায়, দশমিক ৪৪৩ একর জমির ওপর নির্মিত বাড়িটি শৈলেনের স্ত্রী শান্তা চন্দ্রের নামে। জমিটি তিনি কিনেছেন ১৯ লাখ টাকায়। বাড়ি বানাতে ব্যয় হয়েছে ১ কোটি ৪০ লাখ টাকা। শুধু তাই নয়, ঢাকায় শৈলেনের নামে-বেনামে আছে একাধিক ফ্ল্যাট। ৩০ লাখ টাকা দামের একটি জিপ গাড়িও হাঁকান শৈলেন।

সরেজমিনে দেখা যায়, খুব বেশিদিন হয় বাড়িটিতে রঙ করা হয়নি। ওই এলাকার বাসিন্দা সুমন ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘পয়সা হলে কী আর কিছু বাকি থাকে। টাকা-পয়সার মধ্যে পড়ে আর নিজেকে সামলে রাখতে পারেননি শৈলেন। গত পাঁচ বছরে এত টাকার মালিকই তিনি হয়েছেন যে, মন্দির থেকে অট্টালিকায় উঠে এসেছেন।’

শৈলেনের বাড়ির পাশে জগদীশ কর্মকারের বাড়ি। অভিযোগ আছে, জগদীশ কর্মকারের জায়গাতেও হানা দিয়েছেন শৈলেন। অন্যায়ভাবে দখল করে নিয়েছেন তাদের জায়গা।

মেয়াদ শেষ হওয়ার পর থেকেই শৈলেনের ফুলে ফেঁপে ওঠা সম্পদের বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা শুরু হয়। একপর্যায়ে তার সম্পদের ব্যাপারে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হন শৈলেন। দুদকের অনুসন্ধানে শৈলেনের নামে-বেনামে ৫০ কোটি টাকার সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। প্রতিমন্ত্রীর এপিএস থাকাকালে পাঁচ শতাধিক হজ লাইসেন্স, ওয়াকফ এস্টেটের সম্পদ বেহাতের মতো রাষ্ট্রীয় দুর্নীতির মাধ্যমে এসব অর্থ অর্জন করেছেন বলে দুদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে। প্রতিটি হজ এজেন্টের কাছ থেকে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ নেওয়া হয়েছে। প্রতিমন্ত্রীর হয়ে শৈলেন এসব টাকা সংগ্রহ করেছেন বলে দুদকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। সূত্র জানায়, শৈলেনের বোনের জামাতা একজন চিকিৎসক। তারা ঢাকাতেই থাকেন। তাদের মাধ্যমেই ভারতের বিভিন্ন ব্যাংকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করেছেন শৈলেন। দুদকের কাছে এ ব্যাপারে তথ্য আছে বলে জানা গেছে।  

বাদশা মামার’ বাদশা বনে যাওয়া

প্রতিমন্ত্রী দুলাভাইয়ের কারণে কোটিপতি বনে গেছেন বাদশা। লোকে যাকে ‘বাদশা মামা’ বলেই বেশি চেনে। আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের এক নেতা ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, গত পাঁচ বছরে হজ লাইসেন্সের মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা কামিয়েছেন তিনি। বাদশা মামা এখন কোটি কোটি টাকার মালিক। এই নেতা আরও জানান, সাবেক প্রতিমন্ত্রীর ভায়রার ছোট ভাই জেলার সাব-রেজিস্ট্রার। তার সহযোগিতায় দলিল জাল-জালিয়াতি করে জায়গাজমি দখলের অভিযোগও আছে বাদশা মামার বিরুদ্ধে। এছাড়া সাবেক প্রতিমন্ত্রীর আত্মীয়দের মধ্যে প্রায় ৭০ জনের বাড়িতে পাকা দালান উঠেছে গত পাঁচ বছরে। একেকটি বাড়ি দুই থেকে ছয় তলা পর্যন্ত।

পুরুষশূন্য ছোট বিঘাই

পটুয়াখালী সদর উপজেলার একটি ইউনিয়নের নাম ছোট বিঘাই। এই ইউনিয়নের মাটিভাঙা গ্রামে উপজেলা নির্বাচনের পর ব্যাপক সহিংসতা চালানো হয়েছে। অভিযোগ আছে, নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী গোলাম সরোয়ারকে সমর্থন করায় গ্রামবাসীর ওপর পৈশাচিক নির্যাতন চালিয়েছে সাবেক প্রতিমন্ত্রীর ছেলে ও নির্বাচিত চেয়ারম্যান তারিকুজ্জামান মনির লোকজন। নির্বাচনের পর থেকে এ এলাকার মানুষের রাত ভোর হচ্ছে আতঙ্কে। পুরো গ্রাম খুঁজে প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষের দেখা মিলছে না। সরেজমিনে গিয়ে এ চিত্র চোখে পড়েছে।

কথা হয় বিউটি বেগম নামে মধ্যবয়সী এক নারীর সঙ্গে। তার স্বামী সুলতান প্যাদা। ছেলে নাজমুল, নেয়ামুল ও মহিবুল প্যাদা। প্রতিপক্ষের হামলার ঘটনায় স্বামী এবং তিন ছেলেই গুরুতর আহত হয়েছে। বিউটি বেগম জানান, উপজেলা নির্বাচনের পর দিন ২৪ মার্চ সকালে স্থানীয় অফিসের হাট-বাজারের পশ্চিম পাশের রাস্তায় ছোট বিঘাই ইউনিয়ন যুবলীগের সম্পাদক বাচ্চু মৃধা, যুবলীগ কর্মী জাফর মৃধাসহ ১৫ থেকে ২০ জন তার স্বামী ও তিন সন্তানের ওপর ধারালো অস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়। এতে তাদের মাথা, হাত, পা মারাত্মক জখম হয়। পরে ধাপে ধাপে বাধা পেরিয়ে তাদের চিকিৎসার জন্য ঢাকায় আনা হয় বলে জানান তিনি।

চোখ মুছতে মুছতে বিউটি বেগম বলেন, ‘আমাগো কী দোষ? আমরা তো আর নির্বাচন করি নাই। কারো পক্ষ সমর্থন করলে এইভাবে মাইর খাইতে হইবে, এইডা কোন আইনে আছে?’

একই গ্রামের ফোরকান প্যাদার বাড়িতে নেই কোনো পুরুষ মানুষ। উঠানের মাঝে ঘরে আগুনে পোড়ার চিহ্ন। ঘরের পাশে খড়ের পালা পুড়ে ছাই হয়ে আছে। ২৪ মার্চ দুপুরে ওই বাড়িতে পেট্রল ছিটিয়ে আগুন দিয়েছে মনির সমর্থকরা। সেই থেকে বাড়ি ছাড়া ফোরকান প্যাদা, হারুন প্যাদা ও দুলাল প্যাদা। এই প্রতিবেদককে দেখে অঝোরে কেঁদে ওঠেন বৃদ্ধা রহিমা বেগম। ফোরকান প্যাদার মা। চোখে ভালো করে দেখতে পান না। প্রতিবেদকের গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে বলেন, ‘বাবো মোর তিন পোলায় আইজ ২০ দিন ধইর‌্যা ঘর ছাড়া। কই আছে জানি না। বাড়ি আইলে হেগো মাইর‌্যা হালাইবে...।’

জানতে চাইলে সব অভিযোগ অস্বীকার করেন ইউনিয়ন যুবলীগ সাধারণ সম্পাদক বাচ্চু মৃধা। তিনি ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘নির্বাচনের সময় আমার মামা সুলতান প্যাদার সঙ্গে মারামারি হয়েছে। তারা আমাদের লোকজন কুপিয়েছে। আমরা মামলাও করেছি।’



দ্বীপবাংলা বাস সার্ভিস

ঢাকার মিরপুর রুটে চলাচলকারী দ্বীপবাংলা যাত্রীবাস সার্ভিসে সাবেক প্রতিমন্ত্রী শাহজাহান মিয়ার পরিবারের শেয়ার আছে বলে জানা গেছে। প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পর বাস ব্যবসায় নাম লেখান শাহজাহান মিয়া।  



সব সংগঠনের কমিটি নিজের ঘরে

‘পটুয়াখালীতে আওয়ামী লীগ আর আওয়ামী লীগ নেই, এটি এখন শাহজাহান মিয়া অ্যান্ড ফ্যামিলি কোম্পানি লিমিটেড হয়ে গেছে। দলের শীর্ষ পদগুলোতে নিজের ছেলে, স্ত্রী, বোন জামাই, ভাজিতাকে বসিয়ে সংগঠনকে এভাবে পরিবারতন্ত্রে রূপ দিয়েছে।’ বলছিলেন পটুয়াখালী শহর আওয়ামী লীগের এক নেতা। অভিযোগ আছে, পটুয়াখালীর রাজনীতিতে নিজের পরিবার-পরিজনদের প্রতিষ্ঠিত করতে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের প্রায় সব কমিটি ভেঙে দিয়ে আহ্বায়ক কমিটি করা হয়েছে। এখন প্রায় প্রতিটি সংগঠনের দুটি করে কমিটি হয়েছে। একটি কেন্দ্রের, অন্যটি শাহজাহান মিয়ার মনগড়া। এসব কারণে পটুয়াখালী আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কার্যক্রমেই নেমে এসেছে স্থবিরতা। জেলার শীর্ষ নেতাদের ওপর তৃণমূল নেতা-কর্মীদের ক্ষোভও চরমে পৌঁছেছে।

জানা গেছে, জেলার যুবলীগের কমিটি ভেঙে দিয়ে শাহজাহান মিয়ার ছোট ছেলে আরিফুজ্জামান রনিকে আহ্বায়ক করা হয়। গতবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসা এবং শাহজাহান মিয়া প্রতিমন্ত্রী হওয়ার আগ পর্যন্ত রনি ইতালি প্রবাসী ছিলেন। পরে দেশে ফিরে নানা সন্ত্রাসী কর্মকা-ে জড়িয়ে যাওয়ায় তার বিরুদ্ধে থানায় সাধারণ ডায়েরিও করা হয়।

জানতে চাইলে সাবেক কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সোহরাব সরদার ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘দলকে লিমিটেড কোম্পানি করে পারিবারিক সম্পত্তি বানিয়েছেন সাবেক ধর্ম প্রতিমন্ত্রী। তিনি চান না আর কেউ নেতৃত্বে আসুক।’

এক সময় বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগ আছে শাহজাহান মিয়ার স্ত্রী মমতাজ শাহজাহানের বিরুদ্ধে। অথচ প্রায় এক যুগের বেশি সময় ধরে তাকে জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী করে রাখা হয়েছে। তিনি নিজেও ১৮ বছর ধরে আছেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে একবারও সম্মেলনের উদ্যোগ নেননি তিনি। পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি করা হয়েছে মন্ত্রীর মেজো ছেলে তারিকুজ্জামান মনিকে। প্রতিমন্ত্রীর প্রতিবেশী জালাল খানকে করা হয়েছে ওই কমিটির সাধারণ সম্পাদক। শ্রমিক লীগের সভাপতি হচ্ছেন প্রতিমন্ত্রীর ভাতিজা কালাম মৃধা। সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতিও তিনি। সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফোরকান সিকদার মন্ত্রীর দূরসম্পর্কের ভায়রার ছেলে।

জানতে চাইলে পটুয়াখালী শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গাজী হাফিজুর রহমান (সবির) ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে পটুয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন হচ্ছে না। যে কারণে নতুন নেতৃত্ব বিকশিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না। এতে সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীর মধ্যে কিছুটা অসন্তোষ রয়েছে। এটি দূর করে সাংগঠনিক ভিত্তি মজবুত করতে দ্রুত সম্মেলন দেওয়া প্রয়োজন।’

(ঢাকাটাইমস/১৬আগস্ট/এমএম)