ঢাকা: সদ্য সমাপ্ত উপজেলা নির্বাচনের প্রথম দুই পর্বে বেশির ভাগ এলাকায় জয় পেয়েছিল বিএনপি। পরের তিন পর্ব মিলিয়ে আওয়ামী লীগ সমর্থিতরা এগিয়ে গেলেও এই তিন পর্বে উঠে কারচুপির অভিযোগ। সরকারি নানা চাপ সত্বেও এই নির্বাচনের ফলাফল পুরনো বিতর্ককে উস্কে দেয়, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে দলটি কি ভুল করেছে?
বিএনপির কর্মী-সমর্থকরাই এখন বলছেন, নির্বাচন ঠেকানোর ক্ষমতা না থাকলে ভোটে না দাঁড়ানোর মানে হয় না। আগের আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণেই নতুন নির্বাচনের দাবিতে কঠোর আন্দোলনের ঘোষণা গুরুত্ব পাচ্ছে না তেমন।
রোজার মাসে ঈদের পর কঠোর আন্দোলনের ঘোষণা এসেছিল দলটির সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে। কিন্তু বিএনপি যতটা গর্জে ছিল ততটা বর্ষেনি-এ মন্তব্য রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের। তারা বলছেন, দলটির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের গা বাঁচানো কৌশল এবং নিজেরদের মধ্যে নেতৃত্বের দ্বন্দ্বের কারণে আন্দোলনের পালে হাওয়া লাগেনি। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া নিজ হাতে ঢাকা মহানগর কমিটিকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছেন। কিন্তু সেখানেও নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে উঠে এসেছে। যে কারণে, কার্যত নিষ্ক্রিয় ঢাকা মহানগর বিএনপি আদৌ চাঙ্গা হবে কিনা, তা নিয়েও সন্দেহ আছে।
অন্যদিকে ২০-দলীয় জোটের নাম সর্বস্ব কৃত্রিম দলগুলোর ভেতরে ভেতরে অবিশ্বাস ও ভাঙন শুরু হয়েছে। নিজেদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি বহিষ্কারের ঘটনায় জোটের মধ্যে ভাঙনের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। ২০-দলীয় জোট টিকবে কিনা সেই প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। এখন আন্দোলন, নাকি দ্বন্দ্ব নিরসন? সবমিলিয়ে লেজেগোবরে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বিএনপিতে।
তবে এসব অভিযোগ মেনে নিতে নারাজ দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘বিএনপির আন্দোলন নিজস্ব গতিতে এগোচ্ছে। চলমান আন্দোলনের অংশ হিসেবে নতুন নতুন কর্মসূচি দেয়া হচ্ছে। কিন্তু অগণতান্ত্রিক সরকারের পতন ঘটিয়ে নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন চলছে।’
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী অবশ্য ব্যাপারগুলোকে সহজভাবেই দেখতে চাইছেন। তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক দলের ভেতরে ষড়যন্ত্র, বিবাদ, ভাঙন, পাল্টাপাল্টি বহিষ্কার নিয়মিত ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। এতে আন্দোলন কিংবা মূলধারার রাজনীতির কোনো ক্ষতি হবে না।’
২০-দলীয় জোট সূত্র ঢাকাটাইমসকে জানায়, আন্দোলনের ঘোষণা থাকলেও এর ধরন বা কৌশল কী হবে জোটের সঙ্গে এনিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। তাছাড়া এই মুহূর্তে হরতাল-অবরোধের মতো সহিংস আন্দোলনের যারাও কথাও চিন্তা করতে চান না জোট নেতারা। তারা বলছেন, আন্দোলনের নামে যদি এখনই মামলা-হামলায় জর্জরিত হতে হয় তবে সামনের দিনগুলোতে আন্দোলনের নেতাকর্মীদের পাওয়া যাবে না। তাই আন্দোলনের ব্যাপারে ‘ধীরে চলো’ নীতিতে এগোতে চাইছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট।
ঢাকা মহানগর বিএনপি আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সচিব হাবিব-উন নবী খান সোহেল মনে করেন, জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সামনের দিনগুলোতে কঠোর আন্দোলন গড়ে তুলতে পারবেন তারা। তিনি এই ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘জনগণ শুধু বিএনপির ডাকের অপেক্ষায় আছে। সরকার পতনের আন্দোলনের ডাক এলে জনগণ তাতে অংশ নেবে বলে আমি বিশ্বাস করি। কারণ, অতীতে যত আন্দোলনই সফল হয়েছে তার মূলে ছিল জনগণের সম্পৃক্ততা।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকায় বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যেও একটা হতাশা তৈরি হয়েছে। এক টানা প্রায় আট বছর ক্ষমতার বাইরের থাকায় অনেক জায়গায় দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল বেড়েছে। তাছাড়া বিএনপি ও এর সহযোগী প্রায় সব সংগঠনের কমিটিগুলো মেয়াদ পার করেছে অনেকদিন হল। নতুন কমিটি না হওয়ায় নতুন নেতৃত্ব উঠে আসছে না। এসব কারণেও সংগঠন প্রায় নিষ্ক্রিয় হতে বসেছে।’
কঠোর আন্দোলনের ‘নরম’ কর্মসূচি:
এত টানাপোড়েনের মাঝেও আন্দোলনের ডাক দিয়েছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট। যদিও এটিকে মুখ রক্ষার কর্মসূচি হিসেবে দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা মনে করেন, গত ১২ আগস্ট বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব যে কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছেন, তা কোনোভাবেই সরকার পতনের আন্দোলনের অংশ বলে ধরে নেয়া যায় না। কারণ, গাজায় ইসরাইলি হামলার ইস্যুটি কখনই এদেশের রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত নয়। অন্যদিকে সম্প্রচার নীতিমালার প্রতিবাদও একটি রাজনৈতিক দলের মূল ইস্যু হতে পারে না। তাছাড়া বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট নেতারাও এটিকে ‘নরম’ কর্মসূচি বলে উল্লেখ করেছেন।
জানতে চাইলে বিএনপি চেয়াপারসনের উপদেষ্টা আব্দুল আউয়াল মিন্টু ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘এই কর্মসূচি সরকার পতনে চলমান আন্দোলনেরই অংশ। ধীরে ধীরে কর্মসূচি আরও কঠোর হবে। তবে জনগণের ভোগান্তি বাড়ে এ ধরনের কর্মসূচির কথা এখনও চিন্তা করছে না বিএনপি।’
খোকার অপেক্ষায় মহানগর বিএনপি
ঢাকা মহানগর বিএনপি আহ্বায়ক কমিটি করার পর থেকেই এনিয়ে বিভিন্ন মহলে কানাঘুষা শুরু হয়। কমিটির নেতাদের কেন্দ্র করে উপ দলে ভাগ হয়ে যায় কর্মীরা। একটি পক্ষ সরাসরি আহ্বায়কের এবং অন্য পক্ষ সদস্য সচিবের পাশে রয়েছে। এরই মধ্যে সদস্য সচিবের বসার কক্ষ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। যে কারণে, ঢাকা মহানগর বিএনপি আহ্বায়ক মির্জা আব্বাসের সঙ্গে সদস্য সচিব হাবিব উন নবী খান সোহেলের ভেতরগত দ্বন্দ্ব আরও চরমে পৌঁছেছে বলে জানা গেছে।
দলীয় সূত্র জানায়, দলের তরুণ নেতৃত্বের একটি বড় অংশ সোহেলের সঙ্গে আছে। তারা চাইছে নতুন কমিটিতে সোহেল দায়িত্বশীল পদ পান। অপর দিকে আব্বাস শিবিরের সমর্থকরা কোনোভাবেই সোহেলকে কমিটিতে মেনে নিতে পারছেন না। নতুন কমিটিতেও সোহেলের উপস্থিতি তারা কল্পনা করতে পারছেন না। তারা মনে করছেন সাদেক হোসেন খোকা মহানগর কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদে না থাকলেও তার হয়ে কাজ করছেন সোহেল। মির্জা আব্বাসের ওপর ক্ষোভ ঢালতে গিয়ে খোকার আশীর্বাদ পাচ্ছেন সোহেল। খোকার কারণেই আহ্বায়ক কমিটিতে ঠাঁই হয়েছে সোহেলের। আব্বাসের ওপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠান করতে খোকা এই কৌশল নিয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে।
অপর একটি সূত্র জানায়, সোহেল শিবির এখন খোকার জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনছে। যে কারণে আব্বাসের অনুসারী-অনুগামীরা সোহেলের লোকজনদের ওপর হামলা করলেও তারা কঠিন জবাব দেয়নি। খোকাকে তারা বিষয়টি মুঠোফোনে জানিয়েছে। তার নির্দেশেই এখনও মুখ বুজে আছেন সোহেলপন্থীরা।
অবিশ্বাসে ঘেরাটোপে ২০-দলীয় জোট
ক্ষমতাসীন জোটকে টেক্কা দিতে নিজেদের জোটের পরিধি বাড়িয়েছে বিএনপি। এ কথা বিএনপির একাধিক নেতার। কিন্তু জোটের পরিধি বাড়াতে গিয়ে নতুন সংকটের মুখে পড়েছে দলটি। কারণ, জোটের শরিক দলগুলোর মধ্যে দিন দিন অসন্তোষ বাড়ছে। হাতে গোনা কয়েকজন নেতা ছাড়া বেশিভাগ দলেরই কোনো কর্মী-সমর্থক নেই। অনেক দলের নামও জানেন না কেউ। ২০-দলীয় জোটে আছেন এরকম ১২টি ছাড়া বাকি দলগুলোর নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন নেই।
জোট সূত্র জানায়, বেশকিছু দলে ভেতরে নেতৃত্ব নিয়ে লড়াই চলছে। সরকার বিরোধী লড়াইয়ের চেয়ে নিজেদের মধ্যে লড়াইকে গুরুত্ব দিচ্ছেন তারা। পাল্টাপাল্টি বহিষ্কার করছেন। একই নামে একাধিক দল নিয়ে জোটে আছেন। আবার জোটের শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠকেও যোগ দিচ্ছেন। এসব নিয়ে অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়েছে বিএনপি।
এ পরিস্থিতিতে জোটের নীতিনির্ধারক শ্রেণির দলগুলোকে নিয়ে আলাদা একটি কোর কমিটি করার দাবি তুলেছেন জোটের অন্যতম শরিক এলডিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম। তিনি বলেন, জোটে এমন শরিক দলও আছে, যার শীর্ষ নেতা অন্য দলের কর্মীর মানের। এদের কারণে জোটের বৈঠকের গোপন খবরও বাইরে চলে যাচ্ছে। তাই সময় এসেছে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার। বিশেষ করে আন্দোলনের সফলতা এবং গোপনীয়তা রাখতে হলে জোট নেত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে একটি কোর কমিটি গঠন করা প্রয়োজন।
অবিশ্বাসের দোলাচলে বিএনপি
কোনো পরিকল্পনাই কাজে আসছে না। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে নির্বাচন ঠেকাতে আন্দোলনে মাঠে নেমেছিল বিএনপি। কিন্তু ফল তাদের প্রতিকূলেই গেছে। এতে দলীয় নেতাকর্মীদের মনোভাবে চির ধরেছিল। কিন্তু উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেয়ায় আবার কিছুটা আত্মবিশ্বাস ফিরেছে দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটির। উপজেলা নির্বাচনে আশাতীত ফল করেছে দলটি। যদিও সরকার দলের হস্তক্ষেপ না থাকলে তারা আরও ভাল করতো বলে দাবি দলটির শীর্ষ নেতাদের।
দলীয় একটি সূত্র জানায়, বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের একটি অংশ ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষে ছিল। তাদের বিশ্বাস ছিল নির্বাচনে অংশ নিলে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট ভাল করবে। যারা অবশ্য উপজেলা নির্বাচনের পর বিএনপি নীতিনির্ধারকদের বলেছেন, উপজেলা নির্বাচনে আমরা যতটুকু জনসমর্থন পেয়েছি জাতীয় নির্বাচনে এর চেয়ে বেশি পেতাম। সেক্ষেত্রে নির্বাচনে অংশ নেওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হতো। কিন্তু যে অংশটি নির্বাচনে যাওয়ার বিপক্ষে ছিল তাদের যুক্তি উপজেলা নির্বাচনে সরকার যেভাবে নগ্ন হস্তক্ষেপ করেছে, জাতীয় নির্বাচনে যে এর চেয়ে বেশি হতো না, তার নিশ্চয়তা কী ছিল? এসব পাল্টাপাল্টি অভিযোগে নিজেদের মধ্যে বিশ্বাসের সংকট তৈরি হয়েছে। বিএনপি কেন্দ্রীয় নেতাদের কেউ কেউ সরকারের সঙ্গে গোপন আঁতাত রেখে চলছেন বলেও প্রচার আছে। মামলা, গ্রেপ্তারের হাত থেকে নিজেদের বাঁচাতে এই কৌশল রপ্ত করেছেন কেউ কেউ। বিশেষ করে এদের মধ্যে ব্যবসায়ী গোছের নেতাদের সংখ্যাই বেশি। তারা মনে করেন, আন্দোলনে নেমে কারাগারে গেলে ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতিতে পরবেন। এর চেয়ে ধরি মাছ না ছুই পানি-তত্ত্ব মেনে চলা ভাল।
কিন্তু নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপি কেন্দ্রীয় এক নেতা ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘যারা আজ নিজেদের বড় বড় ব্যবসায়ী বলে জাহির করছেন, তাদের ভুলে গেলে চলবে না যে এই বিএনপি বদৌলতেই তারা এত অর্থকড়ির মালিক হয়েছে। এখন দলের দুঃসময়ে যদি তাদের পাশে পাওয়া না যায়, সেটা হবে সবচেয়ে দুঃখজনক। তবে এর প্রতিদানও তারা পাবে।’
(ঢাকাটাইমস/ ১৩ আগস্ট / এইচএফ/ এআর/ ঘ.)