logo ৩০ এপ্রিল ২০২৫
নতুন কমিটিতে খোকার ছায়া দেখছেন আব্বাস
হাবিবুল্লাহ ফাহাদ, ঢাকাটাইমস
০২ আগস্ট, ২০১৪ ১০:৫৫:৫০
image


ঢাকা: নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবিতে আন্দোলনে নিষ্ক্রিয় ঢাকা মহানগর বিএনপিকে ঢেলে সাজানোর ঘোষণা দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া দিয়েছিলেন দশম সংসদ নির্বাচনের পর পর। নির্বাচনের ছয় মাসেরও পরে অবশেষে হয়েছে সে কমিটি। কিন্তু তাতে দ্বন্দ¦ মেটেনি।

ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মির্জা আব্বাসকে প্রধান করে মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করেছে বিএনপি। আগের কমিটির আহ্বায়ক সাদেক হোসেন খোকার সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব পুরনো। বিএনপির সূত্র বলছে, নতুন আহ্বায়ক কমিটি করার পর প্রকাশ্যে সম্প্রীতির কথা বললেও আবার মাথাচাড়া দিয়েছে পুরনো বিরোধ।

আবার কমিটির আহ্বায়ক মির্জা আব্বাস এবং সদস্য সচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেলের মধ্যেও আছে বিরোধ। ২৬ জুলাই রাজধানীর ভাসানী মিলনায়নে কক্ষ দখলকে কেন্দ্র করে দুই নেতার সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের বিষয়টি প্রকাশ্যে চলে আসে।

নতুন কমিটিতে স্থান পাওয়া না পাওয়া নিয়েও আছে ক্ষোভ। এ সব কারণে ঢাকা মহানগর বিএনপিকে ঢেলে সাজানোর বদলে দলাদলিতে মেতেছেন নতুন নেতৃত্ব। দলটির শীর্ষস্থানীয় একাধিক নেতা জানান, গত ১৮ জুলাই ঢাকা মহানগর বিএনপির নতুন আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণার পর থেকেই মির্জা আব্বাসের অনুসারীরা হাবিব-উন-নবী খান সোহেলকে মেনে নিতে পারছেন না। তারা চাচ্ছেন যে করেই হোক তাকে আহ্বায়ক কমিটি থেকে সরিয়ে দিতে। তাছাড়া মির্জা আব্বাস নিজেও মনে করেন, নতুন কমিটি করা হলেও এখানে আগের কমিটির আহ্বায়ক সাদেক হোসেন খোকার কর্তৃত্ব রয়েই গেছে। কারণ নতুন কমিটিতে তিনি উপদেষ্টা হিসেবে আছেন। সোহেলকে সদস্য সচিব বানানোর পেছনেও তার হাত থাকতে পারে বলে মনে করেন তিনি।

তবে এই কমিটি নিয়ে আশাবাদী বিএনপি। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, এবার তাদের আন্দোলনের কেন্দ্র হবে ঢাকা এবং নতুন কমিটি সে আন্দোলনকে জোরালো করবে বলে আশা করেন তারা।

শুরুতেই দ্বন্দ¦ আব্বাস-সোহেলের মধ্যে

মির্জা আব্বাসের ঘনিষ্ঠ সূত্র ঢাকাটাইমসকে বলেন, ঢাকা মহানগর বিএনপির থানা, ওয়ার্ড ও ইউনিট কমিটিগুলোতে খোকার অনুসারী, অনুগামীরাই বসে আছেন। তাই খোকা নতুন কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদে না থাকলেও খোকার ছায়া থেকে বের হয়ে আসা সহজ হবে না। সোহেলকে সদস্য সচিব বানানোয় এই কৌশলে খোকা সমর্থকরা আরও একধাপ এগিয়ে গেছে বলে মনে করেন তারা। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মতিঝিল (ঢাকা-৮) এলাকা থেকে দলের মনোনয়ন পেয়েছিলেন সোহেল। মতিঝিল এলাকা খোকার নিয়ন্ত্রণে। তার সঙ্গে সোহেলের ঘনিষ্ঠতার কথাও খোলামেলা।  

জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও ঢাকা মহানগর আহ্বায়ক কমিটির উপদেষ্টা আ স ম হান্নান শাহ ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘ঢাকায় আগে যারা নেতৃত্বে ছিলেন তাদের ওপর দলকে সুসংগঠিত করার যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তারা তা পালনে ব্যর্থ হয়েছে। তাই নতুন আহ্বায়ক কমিটি করা হয়েছে। এই কমিটি অতীতের সবকিছু পিছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যাবে বলে বিশ্বাস করি।’

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘ঢাকায় বিএনপির রাজনীতিতে শক্তিশালী করতে নতুন কমিটি করা হয়েছে। কিন্তু যদি অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব আগের মতোই থাকে তবে আর আশার আলো দেখা যাবে না।’  বিএনপির এই নেতা আরও বলেন, ‘মির্জা আব্বাস ও সোহেলের সমর্থকদের মধ্যে কদিন আগে যে ঘটনা ঘটলো তা লজ্জার ও হতাশার। কারণ যেখানে দলের চেয়ারপারসন শিগগির সরকার পতন আন্দোলনের ডাক দিতে যাচ্ছেন, ঠিক ওই মুহূর্তে এভাবে নিজেদের মধ্যে হানাহানি প্রকাশ্যে চলে এলে বিরোধীরা সুযোগ নেবে। এই কথাটা দুই পক্ষকেই বুঝতে হবে।’

তবে নতুন আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেল মনে করেন, দলের সিদ্ধান্তের ওপর অবিচল থাকাই শৃঙ্খলা। যারা শৃঙ্খলা ভঙ্গ করবেন তাদের ব্যাপারে দল যে সিদ্ধান্ত নেবেÑতাই তিনি মেনে নেবেন। ঢাকাটাইমসকে তিনি বলেন, ‘আমাদের সবার লক্ষ্য জনগণকে সঙ্গে নিয়ে অগণতান্ত্রিক সরকারের পতন নিশ্চিত করা। পাশাপাশি নির্দলীয়, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। তাই কার মনে কী আছে তা না দেখে সবাই আন্দোলনের মাঠে সক্রিয় হবে বলে বিশ্বাস করি।’

কথা বলার জন্য মির্জা আব্বাসের মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। পরে মুঠোফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।

দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য রফিকুল ইসলাম মিয়া অবশ্য দোষ চাপাতে চাইছেন খোকা-সালামের নেতৃত্বাধীন সাবেক কমিটির ওপর। তিনি বলেন, ‘আগের কমিটির দায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। সাদেক হোসেন খোকা নিজেও সংবাদ সম্মেলন করে দল ছাড়ার কথা বলেছেন। তাদের ব্যর্থতার কারণেই নতুন কমিটি করতে হয়েছে। তারা যদি তাদের দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করতেন তবে ঢাকা মহানগর কমিটি আন্দোলন-সংগ্রামে ব্যর্থ হতো না।’

সোহেলকে সরিয়ে দিতে চান আব্বাস

বিএনপির একাধিক সূত্র ঢাকাটাইমসকে বলেন, ঢাকা মহানগর কমিটিতে সোহেলকে সদস্য সচিব করাকে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না মির্জা আব্বাসের সমর্থকরা। তারা মনে করছেন, সোহেল থাকলে আব্বাসের কর্মকা-ে ব্যাঘাত ঘটবে। কারণ ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি হওয়ায় তরুণ নেতা-কর্মীদের মধ্যে আব্বাসের চেয়ে সোহেলের অনুসারীর সংখ্যা বেশি। তাই সোহেল থাকলে আব্বাসপন্থিরা কোণঠাসা হয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র ঢাকাটাইমসকে জানান, গত ২৩ জুলাই মহানগরীর প্রথম সভা শেষে ভাসানী মিলনায়তনে সদস্য সচিবের কক্ষে বসেন সোহেল। তিনি চলে যাওয়ার পরপর সদস্য সচিবের নামফলক সরিয়ে কক্ষটি তালা লাগিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন আব্বাস। নির্দেশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আব্বাসপন্থি ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রশিদ হাবিব, ফিরোজ পাটোয়ারী, জব্বারসহ আরও কজন ওইদিন রাতেই সদস্য সচিবের নামফলক ভেঙে ফেলেন। সেখানে পল্টন থানা বিএনপির নামফলক ঝুলিয়ে কক্ষটিতে তালা লাগিয়ে দেওয়া হয়। সোহেল সমর্থকরা ওইদিনই তালা ভেঙে অফিস দখলের উদ্যোগে নিলে সোহেল তাতে বাধা দেন। বিষয়টি আব্বাসের কাছে জানতে চান সোহেল। উল্টো সোহেলকে ধমক দেন আব্বাস। সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি সিনিয়র নেতাদের জানান সোহেল।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গত ২৬ জুলাই বিকাল প্রায় সাড়ে তিনটার দিকে সোহেল সমর্থক স্বেচ্ছাসেবক দলের পরিবার পরিকল্পনা সম্পাদক তালুকদার অমিত হাসান হাফিজ এবং ছাত্রদলের নিয়াজ মাখদুম মাসুম বিল্লাহর নেতৃত্বে ২০ থেকে ২৫ জনের একটি দল ভাসানী ভবনে যান। খবর পেয়ে আব্বাস সমর্থকরা তাদের ওপর হামলা চালায়। এর আগেই সোহেল সমর্থকরা সদস্য সচিবের কক্ষে লাগানো তালা ভেঙে নতুন তালা লাগিয়ে দেন। দরজার ওপরে সদস্য সচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেলের নেমপ্লেট সেঁটে দেয় তারা। পরে আব্বাসের ক্যাডাররা সেখানে গিয়ে তালা ভেঙে ফেলে। সোহেলের নেমপ্লেট নামিয়ে ভেঙে টুকরো টুকরো করে নিচে ফেলে দেয়।

সোহেল সমর্থকদের অভিযোগ, শুরু থেকেই সোহেলকে কোণঠাসা করে রাখার লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছেন আব্বাসপন্থিরা। নতুন কমিটি ঘোষণার পর দিন আব্বাসের বাসায় দেখা করতে গিয়েছিলেন সোহেল। পরদিন গয়েশ্বর চন্দ্র রায়সহ নতুন কমিটির কজন নেতা আব্বাসের বাসায় একান্তে বৈঠক করেন। কিন্তু সেখানে সোহেলকে ডাকা হয়নি। তাছাড়া মহানগর বিএনপির প্রথম যৌথসভায়ও সোহেলকে খাটো করার চেষ্টা করা হয়। নিয়ম অনুযায়ী সংগঠনের সদস্য সচিব সভা পরিচালনা করার কথা। কিন্তু ওইদিন সোহেলকে সেই দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। আব্বাস অনুসারীরা পরিকল্পিতভাবে এই কাজটি করেন। সোহেলের পরিবর্তে সভা পরিচালনা করেন স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। বৈঠকে উপস্থিত অনেকেই এটা ভালোভাবে নেননি।

ঢাকা মহানগর বিএনপির নতুন আহ্বায়ক কমিটির এক সদস্য ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘মহানগরীর কোনো থানা বা ওয়ার্ড কমিটির তালিকা সোহেলকে দেওয়া হচ্ছে না। দাপ্তরিক কোনো সুযোগ-সুবিধা সোহেল যাতে না পান সে বিষয়টিও কঠোরভাবে দেখছেন আব্বাস। বৃহস্পতিবার জিয়ার মাজারে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়েও বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হন সোহেল। নিয়ম অনুযায়ী আহ্বায়কের পাশেই সদস্য সচিবের থাকার কথা। কিন্তু সামনে দাঁড়ানোর কোনো সুযোগই পাননি সোহেল। তার জায়গায় সামনের সারি দখলে নেন আব্বাসের অনুগামীরা। সোহেল অনেক চেষ্টা করে সামনে যেতে চাইলে তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেওয়া হয়। পরে কিছুটা হট্টগোল দেখা দিলে দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয়।

খোকার অপেক্ষায় সোহেল!

একের পর এক ঘটনার পরও সোহেল কিংবা তার সমর্থকরা ওই অর্থে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন না। সব কিছুই খুব কৌশলে মোকাবিলা করছেন সোহেল। সোহেলের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানিয়েছে, এখনই এসব বিষয় নিয়ে উত্তেজিত হতে চাইছেন না সোহেল। তিনি তাকিয়ে আছেন দলের চেয়ারপারসনের দিকে। এসবের চেয়ে সামনের আন্দোলন নিয়ে ছক কষছেন তিনি। তবে সোহেলের অপেক্ষার আরেকটি কারণ খোকার অনুপস্থিতি। ক্যান্সারে আক্রান্ত খোকা এখন যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসাধীন আছেন। পূর্বাপর সব ঘটনাই সোহেল খোকাকে জানিয়েছেন। তিনি সবাইকে ধৈর্য ধরার পরামর্শ দিয়েছেন। আগামী ১৭ আগস্ট খোকা দেশে ফিরবেন। সোহেল তার অপেক্ষায় আছেন বলে দলের কজন নেতা জানিয়েছেন।

ঢাকা মহানগর বিএনপি নিয়ে ফখরুলের আশা

বিগত সময়ে বিএনপি কঠোর আন্দোলন গড়ে তুলতে যে সফল নয়, এটা দলের শীর্ষ নেতারাও ইতিপূর্বে প্রকাশ্যে স্বীকার করেছেন। এমনকি ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ কর্মসূচিতে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার পাশে বিএনপির কেন্দ্রীয় কোনো নেতাকে  দেখা যায়নি। ছিলেন না ঢাকা মহানগর বিএনপির শীর্ষ নেতারাও। যে কারণে ওইদিন গুলশানের বাসা থেকে বেরোতে পারেননি খালেদা জিয়া। আন্দোলনের এই ব্যর্থতার জন্য দলের নিষ্ক্রিয় কমিটিকে দায়ী করেছেন অনেকে। অভিযোগ করেছেন, বিএনপিকে দমনে সরকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহার করেছে। গ্রেপ্তার, গুমের আতঙ্কে তাই আন্দোলনের মাঠে সক্রিয় হতে পারেনি বিএনপি।

ঢাকা মহানগর বিএনপি নতুন আহ্বায়ক কমিটি পেয়েছে। কিন্তু এই কমিটি ঘোষণার পর থেকেই আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের বিষয় আলোচনা উঠে আসছিল। কদিন আগে উভয় পক্ষের সমর্থকদের সংঘর্ষের পর বিষয়টি প্রকাশ্যে চলে আসে। এই পরিস্থিতিতেও নতুন কমিটিকে নিয়ে আশাবাদী বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, ‘আন্দোলনে ঢাকার গুরুত্ব বরাবরই বেশি। তাই ঢাকায় কঠোর আন্দোলন গড়ে তোলার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। নেতা-কর্মীদের সেভাবেই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’

(ঢাকাটাইমস/০২ আগস্ট /এইচএফ/ এআর/ ঘ.)