logo ২৪ মে ২০২৫
কেবল ফুটপাত থেকেই শত কোটি টাকার চাঁদা
মহিউদ্দিন মাহী ও আশিক আহমেদ
১৯ জুলাই, ২০১৪ ০০:১৪:১০
image


ঢাকা: গুলিস্তানে গোলাপ শাহ মাজারের পাশে ফুটপাতে দোকান করেন জাফর আহমদ। শার্ট বিক্রি করছেন তিনি। কেনাকাটায় জমে উঠেনি এখনও। বেচাকেনা হোক বা না হোক প্রতিনিদনই দিতে হয় চাঁদা।

‘কত টাকা দিতে হয়?’

জবাব আসলো, ‘দিনে ১০০ টেকা’।

গুলিস্তানের ফুটপাতে যত দোকানই আছে সবাইকেই গুনতে হয় এই চাঁদা। তবে টাকার পরিমাণে ভিন্নতা আছে। যারা শরবত বিক্রি করেন তাদের দিতে হয় ৭০ টাকা থেকে ৮০ টাকা পর্যন্ত। আর যারা ডিম বিক্রি করেন তাদের দিতে হয় ৬০ থেকে ৭০ টাকা। যারা একটু বড় করে জামা-কাপড় বিক্রির দোকান দেন তাদের দিতে হয় ২০০ থেকে ৩০০ টাকা।   

‘কারা এই চাঁদা নেয়?’

‘পুলিশে’-জবাব দিলেন একজন হকার।

‘দেন কেনো?’

‘না দিলে বইতে দেয় না’।

‘লোকসান হয় না?’

‘কি করুম ভাই, গরিব মানুষ, বইতে অইবো, নাইলে পেডে ভাত থাকবে না’।

কেবল গুলিস্তান না, এভাবে চাঁদা নেয়ার অভিযোগ আছে ঢাকার সব ফুটপাতেই। সিটি করপোরেশনের ১৬৩ কিলোমিটার ফুটপাতে দোকানের সংখ্যা কয়েক হাজার। এগুলো থেকে ঈদে ও রমজানে শত কোটি টাকার বেশি চাঁদা আদায় হয় বলে অভিযোগ করেছেন হকারদের নেতারা। হকাররা জানায়, কেবল এক পক্ষ নয়, চাঁদা দিতে হয় নানা পক্ষকেই। একই হকারকে চাঁদা দিতে হয় পুলিশকে, দিতে হয় ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাদের, দিতে হয় মাস্তানদের। এভাবে চাঁদার কারণে প্রভাব পড়ে পণ্যমূল্যে।

একজন হকার বলেন, ‘চান্দা দিতে না অইলে আরও কম দামে জিনিস বেচতে পারতাম’।

হকার নেতারা জানান, পুলিশ, স্থানীয় মাস্তান, ক্ষমতাসীন দলের কর্মী, সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা এমনকি সরকার সমর্থক হকার সমিতিও জড়িত এই চাঁদাবাজিতে।

সূত্র জানায়, ফুটপাতের চাঁদা আদায়ে সাড়ে চার থেকে পাঁচশ লাইনম্যান কাজ করে। স্বাভাবিক সময়ে ফুটপাতে আড়াই লাখের মতো হকার থাকে। কিন্তু রমজানে ও ঈদ মৌসুমি হকার আরও বেড়ে যায়। এরা বিভিন্নভাবে প্রতিদিনই বিভিন্ন অংকের চাঁদা দিতে বাধ্য হয়। স্বাভাবিক সময়ে যে হারে চাঁদা দিতে হয়, রোজার সময় দিতে হয় আরও বেশি পরিমাণে। ঈদের আগে কাপড়ের দোকানিদের চাঁদা বাড়ে দুই থেকে তিনশ টাকা।

হকার্স ফেডারেশনের সভাপতি এম এ কাশেম ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘ফুটপাতে চাঁদাবাজি নিয়মিত ঘটনা। তবে রমজানে চাঁদার পরিমাণ দ্বিগুণ হয়ে যায়’। তার মতে, বছরে ছয়শ কোটি টাকা ফুটপাত থেকে চাঁদাবাজি হচ্ছে। তিনি বলেন, পুনর্বাসন ছাড়া হকার উচ্ছেদ সম্ভব নয়। তবে সরকার অবৈধ এই চাঁদাবাজি বন্ধ করে হকারদের কাছ থেকে ফুটপাতের খাজনা আদায় করতে পারে। হকাররা সরকারকে রাজস্ব দিতে আগ্রহী বলে জানান তিনি।

দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সম্পত্তি কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান মিয়া ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ফুটপাত থেকে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের উচ্ছেদ অভিযান চলমান রয়েছে। কিন্তু আমরা অভিযান চালিয়ে চলে আসার পর আবার বেদখল হয়ে যাচ্ছে। ফুটপাত থেকে পুলিশের চাঁদাবাজি সম্পর্কে জানতে চাইলে পুলিশের মতিঝিল বিভাগের উপ-কমিশনার আশরাফুজ্জামান বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনা আমার জানা নেই’।

হকার সমিতির হিসাবে রোজায় রাজধানীর ফুটপাত ও মার্কেটগুলোতে প্রতিদিন সাড়ে চার কোটি টাকার চাঁদাবাজি হয়। কোনো ব্যবসায়ী টাকা না দিতে পারলে পরদিন তার ব্যবসার স্থানটি মৌসুমি হকারদের কছে অধিক মূল্যে ভাড়া দেয়া হয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে পুলিশের কাছে অভিযোগ দিয়েও কোনো লাভ হয় না বলে ফুটপাতের হকারদের অভিযোগ।

হকাররা জানান, পুলিশের কাছে ফুটপাতের কোনো অভিযোগ নিয়ে গেলে তারা এ ব্যাপারে কোনো সহযোগিতা করে না, কারণ পুলিশ নিজেই জড়িত এর সঙ্গে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন হকার জানান, তিনি অভিযোগ নিয়ে যাওয়ার পর নেতাদের সঙ্গে আপস করে ব্যবসা করতে পরামর্শ দেন এক কর্মকর্তা।

সরেজমিনে রাজধানীর ফার্মগেট, নিউমার্কেট, সায়েন্সল্যাবরেটরি, এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা কলেজ, কলাবাগান, গ্রিন রোড, মিরপুর, পল্লবী, গুলিস্তান, ফুলবাড়িয়া, কাপ্তান বাজার, সদরঘাট, মহাখালী, উত্তর দক্ষিণখান মালিবাগ, মগবাজার, যাত্রাবাড়ীসহ বিভিন্ন এলাকায় টানা সাতদিন ঘুরে দেখা গেছে ফুটপাতে এবং মার্কেটে চাঁদাবাজির চিত্র।

ফার্মগেটের পশ্চিম পাশ রাজাবাজার গলি থেকে শুরু করে এমার গলি পর্যন্ত প্রায় সাড়ে চার শতাধিক হকার ফুটপাতে এবং রাস্তার পাশে বিভিন্ন রকমের পসরা নিয়ে বসেছে। ফার্মভিউ সুপার মার্কেটের সামনে বেল্ট মানি ব্যাগ বিক্রি করছিলেন হানিফ। রাত সাড়ে নয়টার দিকে এক লাইনম্যান এসে হানিফের কাছ থেকে ২৫০ টাকা নিয়ে সিগারেটের একটি খালি ছেড়া প্যাকেটের গায়ে তারিখ লিখে একটি টিক চিহ্ন দিয়ে তার সই করে গেলেন। হানিফ জানান, ওই লোকটির নাম মতিন। তিনি এই মার্কেট এলাকার ‘লাইনম্যান’। প্রতিদিন মতিন এখান থেকে ৯০ হাজার টাকা চাঁদা তোলেন। এই টাকা যায় ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের পকেটে।

কিছুক্ষণ পরে মোটাসোটা এক লোক আসলেন এবং ৭০ টাকা নিয়ে চলে গেলেন। তার পরিচয় জানতে চাইলে তিনি হানিফকে দেখিয়ে চলে গেলেন। হানিফ জানান, এই লোকের নাম মোক্তার। তিনি পুলিশের সোর্স।

ফার্মগেট পূর্বপাশ। তেজগাঁও রেলগেট থেকে ফার্মগেট ফুটওভার ব্রিজ পর্যন্ত তিন শতাধিক হকার রয়েছে। এখান থেকে প্রতিদিন হকার প্রতি ২৪০ টাকা চাঁদা তোলেন লাইনম্যান শফিক। তেজতুরীবাজার স্বেচ্ছাসেবক লীগের এক নেতার নামেই এই টাকা তোলা হয় বলে জানিয়েছেন হকাররা।

নিউমার্কেটের পূর্বপাশ নীলক্ষেত মোড় থেকে নিউ এলিফ্যান্ট রোড় ট্রাফিক সিগন্যাল পর্যন্ত ফুটপাতের হকারদের কাছ থেকে চাঁদা তুলেন চারজন লাইনম্যান এবং একজন সোর্স। এদেরে মধ্যে আমজাদ এবং মিলন নামে দুইজন টাকা তোলেন হকার সমিতির নামে। তারা নেন হকার প্রতি ৩০০ টাকা। নিউমার্কেট থানার সোর্স পরিচয়ধারী মহসিন একই হকারের কাছ থেকে নেন ৬০টাকা করে।

নিউমার্কেট এলাকার পশ্চিম পাশের ফুটপাতের চাঁদা চার ভাগে ভাগ হয় বলে স্থানীয় সূত্রে জানা যায়। এর মধ্যে স্থানীয় কলেজ ছাত্রলীগ, মার্কেট সমিতির নেতা, পুলিশ এবং হকার সমিতির নেতারা এর ভাগ পায় বলে জানা গেছে।

মিরপুর এক নম্বরের মুক্তিযোদ্ধা মার্কেট এলাকার হকারে চাঁদা তোলেন কবির নামে এক লাইনম্যান। তিনি মাঝে মধ্যে পুলিশের হয়েও চাঁদা তোলেন। অন্যদিকে শাহআলী মার্কেটের হকারের চাঁদা কালেকশন করে আবুল হোসেন কাল্লু। তিনি পুলিশের সোর্স হিসেবে সবার পরিচিত। পল্লবী মোল্লা সুপার মার্কেটের হকারদের কাছ থেকে প্রতিদিন সরোয়ার নামে স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধির সহযোগী চাঁদা আদায় করেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। পূরবী সুপার মার্কেটের সামনে থেকে স্থানীয় সরকারদলীয় নেতা হাজি রজ্জবের নামে প্রতিদিন হকার প্রতি ২৮০ টাকা আদায়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এ বিষয়ে পুলিশের মিরপুর বিভাগের উপ-কমিশনার ইমতিয়াজ আহমেদ ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘হকার ফুটপাত থেকে উচ্ছেদের কাজ সিটি করপোরেশনের। এটি পুলিশের কাজ নয়। তবে তারা পুলিশের সহযোগিতা নিতে পারেন। তাছাড়া হকার উচ্ছেদের বিষয়টি নিয়ে নাড়াচাড়া করেলই আসেন নানা রকম তদবির। তাই কেউ যদি হকারদের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হয় এবং সেখান থেকে কোনো আদেশ আসলে আমরা হকারদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে পারি। তবে পুলিশের চাঁদাবাজির ঘটনার কোনো অভিযোগ আমি পাইনি। এমন কোনো অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়া হবে’।

এ দিকে ডিসিসি উত্তরের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা আমিরুল ইসলাম ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ফুটপাত থেকে অবৈধ হকার ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের উচ্ছেদ অভিযান চলমান রয়েছে। আমরা একদিকে উচ্ছেদ করে এলেও তারা আবার বসে পড়ে। এক্ষেত্রে স্থানীয় কিছু সন্ত্রসীরা তাদের বসতে সহযোগিতা করছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।

হকার সমিতির সভাপতি বলেন, ‘ফুটপাতে চাঁদাবাজি এটি কোনো নতুন ঘটনা নয়। যে দল ক্ষমতায় আসে সে দলের কিছু নেতাকর্মীরা এগুলো মেনটেইন করেন। তাছাড়া হকারদের পুনর্বাসন না করে হকার উচ্ছেদ করা সম্ভব নয়। হকারদের কাছ থেকে যে চাঁদা তুলে করা হয় তা তাদের পুনর্বাসনের কাজে খরচ করা হবে’।

(ঢাকাটাইমস/১৯জুলাই/এমএম)