ঢাকা: হারুন-অর রশীদ মজুমদার। ফেনী জেলা যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন তিনি। ওই পদ থেকে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়নি। তিনি নিজে পদত্যাগ করেছেন, এমন তথ্যও নেই কারো কাছে। দল ছেড়ে আওয়ামী লীগে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দিয়েছেন, তাও নয়। কিন্তু তিনি এখন ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের এক নম্বর সাংগঠনিক সম্পাদক। ফেনীর রাজনীতিতে এ রকম একাধিক ঘটনা আছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রায় হাফডজন নেতা আছেন যারা আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলের কমিটিতেই আছেন। একজন জামায়াত নেতাও আছেন এই দলে।
ফেনী আওয়ামী লীগের হর্তাকর্তা ফেনী-২ আসনের সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী। এখানে তাঁর কথাই শেষ কথা। তাঁর ছত্রছায়াতেই এক সময়ের নিবেদিতপ্রাণ বিএনপি নেতারা এখন আওয়ামী লীগের জেলা কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদ আঁকড়ে আছেন।
জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুর রহমান আছেন নামকাওয়াস্তে। এছাড়া কোনো পদ-পদবিতে নেই অথচ প্রভাবশালী এমন একজন নেতাও ফেনীর আওয়ামী লীগের কলকাঠি নাড়েন। এই অভিযোগ ফেনী আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের।
স্থানীয় সূত্র জানায়, নিজাম হাজারীর দাপটের মুখে ফেনীর অনেক প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতাই রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন। যথাযথ পদ-পদবি ও মূল্যায়ন না হওয়ায় হাল ছেড়ে দিয়েছেন তাঁরা।
আজিজ আহমেদ চৌধুরী, আকরাম হোসেন হুমায়ূন এবং আকরামুজ্জামানরা জেলার গুরুত্বপূর্ণ পদের জন্য বেশি যোগ্য হলেও সভাপতি হতে পারেননি। বরং নিজাম হাজারীর ঘনিষ্ঠজন বলে পরিচিত আবদুর রহমান বিকম-এর দখলে আছে পদটি। এসব কারণে ফেনী আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল দানা বেঁধেছে দীর্ঘদিন ধরে।
জানতে চাইলে ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুর রহমান ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব নেই। যারা দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে আছেন তারাই দল চালাচ্ছেন। বিএনপি নেতারা এখন আওয়ামী লীগের সব এ কথাটি ঠিক নয়।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছু দলের একজন প্রবীণ নেতা ঢাকাটাইমসকে বলেন, জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক হওয়ার আগে নিজাম হাজারী দলের কোনো পদ-পদবিতে ছিলেন না। এমনকি ফেনী আওয়ামী লীগের কোনো কার্মকাণ্ডে দেখা যায়নি তাকে। কিন্তু এমন একজন লোককে হঠাৎ করে জেলা কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়ে দেওয়ায় যা হওয়ার তাই হয়েছে। তিনি সাধারণ সম্পাদক হলেও ফেনী আওয়ামী লীগের অনেক জ্যেষ্ঠ নেতা কিংবা তৃণমূলের অনেককেই চিনতেন না। যে কারণে এখন পর্যন্ত তৃণমূলের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ-সম্পর্কের দূরত্ব রয়ে গেছে।
ফেনী সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, জেলার সাধারণ সম্পাদকের ঘনিষ্ঠজন ছাড়া ফেনী আওয়ামী লীগে সবাই কোণঠাসা। তাদের কোনো অব¯’ান নেই। তাছাড়া ক্ষমতার কারণে নিজাম হাজারীর বিরুদ্ধে কথা বলার সাহসও নেই কারো। এতে স্থানীয় আওয়ামী লীগের অবস্থানও অনেকটা জোর হারিয়েছে।
তবে গত ২০ মে ফেনীর একাডেমি সড়কে ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুল হক একরামকে হত্যার পর আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের একটি অংশ গা-ঝাড়া দিয়ে উঠেছে। শুরু থেকেই এই অংশটি একরাম হত্যার জন্য নিজাম হাজারীকে দায়ী করে আসছে। এ নিয়ে প্রকাশ্যে সভা-সমাবেশও করেছে তারা।
তাদের অভিযোগ, একরাম হত্যায় এখন পর্যন্ত যারা ধরা পড়েছে তাদের সবাই নিজাম হাজারীর লোক। তাই বিষয়টি পরিষ্কার যে, সাংসদের ছত্রছায়াতেই এই খুন হয়েছে। যদিও এখনো নিজাম হাজারীর বিরুদ্ধে কোনো মামলা হয়নি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও এতে আগ্রহ দেখায়নি।
আরও যারা দুই দলেই আছেন
ফেনীর সদর উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান ফোরকান চৌধুরীর ভাই স্বপন চৌধুরী। যিনি বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কিন্তু সম্প্রতি রাজনীতির হাওয়া বদলে যাওয়ায় তলে তলে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আঁতাত রেখে চলছেন। জেলা আওয়ামী লীগের ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক ও কমিশনার আমির হোসেন বাহারকে নিয়েও নানা কথা চালু আছে ফেনীর রাজনীতিতে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের জেলা কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকার পর বিএনপির কমিটিতেও নাম আছে তাঁর।
জামায়াত নেতা আবদুল হাই সবুজ এখন পৌর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। তিনি বিএনপি নেতা ভিপি জয়নালের ঘনিষ্ঠ লোক বলেও ফেনীতে পরিচিত। এই জামায়াত নেতাকে নিয়ে ফেনী আওয়ামী লীগের রাজনীতিতেও ভেতরে-ভেতরে চরম অসন্তোষ রয়েছে। কিন্তু নিজাম হাজারীর ঘনিষ্ঠজন হওয়ায় জামায়াত নেতাও এখন বড় আওয়ামী লীগ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। জেলা আওয়ামী লীগের সহ-প্রচার সম্পাদক আবু সুফিয়ানও আছেন বিএনপির কমিটিতে। স্থানীয় আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, ‘জেলা কমিটিতে পদ পাওয়ার চুক্তিতেই বিএনপি ছেড়ে আওয়ামী লীগে এসেছেন আবু সুফিয়ান। দলীয় আদর্শের প্রতি উদ্বুদ্ধ হয়ে নয় বরং ক্ষমতার লোভে তিনি পদ পরিবর্তন করেছেন। আবার যখন বিএনপি ক্ষমতায় আসবে তখন যে তিনি ডিগবাজি দেবেন না এর নিশ্চয়তা কি?’
ফেনীর ১৮নং ওয়ার্ডের কমিশনার সাইফুর রহমান। যিনি বিএনপির জেলা কমিটিতেও আছেন। কিন্তু এখন তাঁর বড় পরিচয় তিনি আওয়ামী লীগ নেতা। হঠাৎ করে সাইফুরের আওয়ামী লীগ নেতা বনে যাওয়ায় হতবাক স্থানীয় রাজনীতিকরা। সূত্র জানায়, সাইফুর রহমান নিজাম হাজারীর সহপাঠী ছিলেন। এই পরিচয় খাটিয়ে তিনি বিভিন্ন জায়গায় নিজের অবস্থানকে শক্ত করার চেষ্টা করেন। একইভাবে সমবায় ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান পদটিও ভাগিয়ে নিয়েছেন তিনি।
চার নম্বর ওয়ার্ডের কমিশনার মুজিবুর রহমান মুজিবও এক সময় ফেনী বিএনপির তুখোড় নেতা ছিলেন। এখন তিনি আওয়ামী লীগ নেতা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক বিএনপি নেতা বলেন, ‘মামলা-হামলা থেকে রেহাই পেতে বিএনপি নেতাদের কেউ কেউ আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন। আবার জেলা বিএনপির অনেক নেতা ভেতরে-ভেতরে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আঁতাতের রাজনীতি করছেন। সাংসদ নিজাম হাজারীকে না জানিয়ে তারা কোনো কর্মসূচি পালন করেন না।’
জাপা নেতা আলাউদ্দিন পৌর মেয়র হলেন যেভাবে
নিজাম হাজারী সংসদ সদস্য হওয়ার আগে ফেনী পৌরসভার মেয়র ছিলেন। সাংসদ হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পরও কয়েকদিন ওই পদটি আঁকড়ে ছিলেন তিনি। পরে তাঁর ছেড়ে দেওয়া পদে নির্বাচিত হয়েছেন জাতীয় পার্টির নেতা ও ব্যবসায়ী হাজী আলাউদ্দিন।
স্থানীয় সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট প্রার্থীদের টপকে জাপা নেতার মেয়র হওয়ার পেছনে আছেন নিজাম হাজারী। তাঁর ‘আশীর্বাদেই’ ফেনীর মেয়র বনে গেছেন ব্যবসায়ী আলাউদ্দিন। অভিযোগ আছে, এর বিনিময়ে সাংসদকে তিন কোটি টাকা দিতে হয়েছে আলাউদ্দিনকে।
নিজাম হাজারীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার পরিচয় পাওয়া গেছে আলাউদ্দিনের ছবি দেওয়া বিভিন্ন ব্যানার, ফেস্টুনেও। ফেনী শহরের বিভিন্ন জায়গায় টাঙানো এসব প্রচারণায় লেখা আছে, ‘ফেনী পৌরসভার সফল মেয়র নিজাম হাজারীর উন্নয়নের পথেই এগিয়ে যাব। তাঁর অসমাপ্ত কাজ শেষ করতে চাই।’ এছাড়া মেয়রের দায়িত্ব নেওয়া উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে আলাউদ্দিন বলেন, ‘ইতিমধ্যেই ফেনী পৌরসভাকে সারা দেশের মধ্যে একটি মডেল পৌরসভায় রূপান্তরিত করেছেন সাবেক পৌর মেয়র নিজাম উদ্দিন হাজারী। আমি এবং আমার কাউন্সিলররা সবাই মিলে সেই ধারাবাহিকতা বজায় রাখব।’ প্রতিপক্ষের সঙ্গে এমন রাজনৈতিক মেলবন্ধন অবশ্য খুব একটা দেখা যায় না বলে মন্তব্য করেছেন স্থানীয় রাজনীতিকরা।
ফেনী আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, ‘আলাউদ্দিন হচ্ছেন নিজাম হাজারীর অন্যতম একজন দাতা। তাঁর টাকায় নিজাম হাজারীর অনেক কাজ হয়। নিজাম হাজারীকে সংসদ সদস্য হওয়ার জন্য আলাউদ্দিন অনেক সহযোগিতা করেছেন। তাঁর প্রতিদান হিসেবে মেয়র পদটি উপহার পেয়েছেন তিনি।’
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য হাজী আলাউদ্দিনের মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে জানা যায় তিনি দেশের বাইরে আছেন।
আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ
ফেনীর এক সময়ের দুর্ধর্ষ আওয়ামী লীগ নেতা ছিলেন সাবেক সংসদ সদস্য জয়নাল হাজারী। তখন আওয়ামী লীগ চলতো তাঁর কথায়। দীর্ঘদিন হলো ফেনীর রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে জয়নাল হাজারীর হাত থেকে। তিনি এখন ফেনীতেও যেতে সাহস পান না দলে তাঁর প্রতিপক্ষের হামলার ভয়ে। জয়নাল হাজারী না থাকলেও ফেনী আওয়ামী লীগে তাঁর সমর্থকরা আছেন ঠিকই। কিন্তু তাদের কোনো অবস্থান নেই আওয়ামী লীগে। এক ধরনের কোণঠাসা হয়ে আছেন। এমনকি দল ক্ষমতায় থাকলেও নিজ দলের প্রতিপক্ষের মামলা-হামলায় ফেরারি জীবন যাপন করতে হচ্ছে অনেককে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাবেক এক যুবলীগ নেতা বলেন, ‘এখানে আওয়ামী লীগের রাজনীতি বলতে কিছু নেই। যা আছে তা নিয়ম রক্ষা। নিজাম হাজারী তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গদের নিয়ে কেন্দ্রীয় কিছু কর্মসূচিতে ভাড়া করা লোক দিয়ে সমাবেশ করে। এত অত্যাচার নির্যাতন চললে মানুষ রাজনীতি করবে কীভাবে? এখানে বিএনপি নয়, আওয়ামী লীগই আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ।’
(ঢাকাটাইমস/৪জুলাই/এএসএ)