logo ০১ মে ২০২৫
বিহারিদের বিভ্রান্ত রাষ্ট্র দর্শন, দুর্দশা
হাবিবুল্লাহ ফাহাদ, ঢাকাটাইমস
২০ জুন, ২০১৪ ১৯:১৯:০৮
image

ঢাকা: হাম লোগ বিহারি, ইয়ে সা”চা। লেকিন হামতো ইনসান হু। মেরি পাস বিবি-বা”চা থে। তুম লোগোকো ইয়ে সামাজ না আতে। লেকিন কিউ? (আমরা বিহারি ঠিক আছে, কিন্তু আমরা তো মানুষ। আমাদেরও বউ বা”চা আছে। তোমরা এটা বুঝতে চাও না। কিন্তু কেন?) বলতে বলতে কণ্ঠ জড়িয়ে আসছিল ষাটোর্ধ্ব আমির আলীর। তিনি একজন উর্দুভাষী। থাকেন রাজধানীর কুর্মিটোলা ক্যাম্পে। দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে এখানেই বসবাস। বাবা-চাচারা এখানেই ছিলেন। দেশ স্বাধীন হয়ে যাওয়ার পর পাকিস্তানে থাকা আত্মীয়রা সেদেশে ফিরে যাওয়ার জন্য বলেছেন। তাঁরা যাননি।


কিন্তু কেন? এ দেশ তুমারি ভি, হামারি ভি (এই দেশ তোমাদের, আমারও)। বললেন, বাংলাদেশকে তিনি ভালোবাসেন। তার বাবার কবর এই দেশেই। এখান থেকে কীভাবে যাবেন তিনি?


এই বৃদ্ধের দুই ছেলে, এক মেয়ে। মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। বড় ছেলেও বিয়ে করেছে, বিহারি নয়, বাঙালি মেয়ে। বড় ছেলে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন। স্ত্রী নিয়ে মিরপুর থাকেন। ছেলে বাবাকে ক্যাম্প ছাড়ার জন্য বলেন, কিš‘ আমির আলী এখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে চান।


বেসরকারি একটি হিসাব বলছে, বাংলাদেশে আটকেপড়া পাকিস্তানি অর্থাৎ বিহারির সংখ্যা প্রায় ৬ লাখ। যাদের মধ্যে সাড়ে তিন লাখ থাকেন দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে থাকা ১১৬টি শরণার্থী ক্যাম্পে। বাকিরা শিক্ষা ও ব্যবসা বাণিজ্যের মাধ্যমে বাঙালিদের পরিবেশে মিশে গেছেন।


১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর ভারতের বিহার থেকে এপার বাংলায় এসেছিলেন কয়েক লাখ মানুষ। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষে অস্ত্র ধরেছিল বিহারিরা। যুদ্ধ চলাকালে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপকহারে বাঙালি নিধনে অংশ নেয় বিহারিরা। যুদ্ধ শেষে তাই তাদের প্রতি ঘৃণা আর ক্ষোভ জন্মায় বাঙালিদের মধ্যে। আর মুক্তিযুদ্ধের পর বন্দি করা হয় শত শত খুনিকে। জাতিসংঘের শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় হয় এদের।


বাংলাদেশে যে বিহারিরা থাকেন তাদের রাষ্ট্র চিন্তা একটু অদ্ভুত ধাঁচের। নিজ দেশ ভারতকে ত্যাগ করে যে পাকিস্তান রাষ্ট্রে এসেছিল তারা, সেই রাষ্ট্র এখন আর নেই। যে রাষ্ট্রের পক্ষে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল তারা যুদ্ধে হারার পর এদেরকে আর স্বীকৃতি দেয়নি। বিহারিদের বেশিরভাগই এখনও পাকিস্তানে ফিরে যেতে চায়, কিন্তু সে দেশ তাদের নিতে চায় না। বাংলাদেশে বাস করে নিজেদের অন্য দেশের নাগরিক হিসেবে মনে করলেও সে দেশ তাদের নেবে নাÑসেটা জানা নেই কারও। 


শরণার্থী ক্যাম্পের উর্দুভাষী বাসিন্দাদের ফিরিয়ে নিতে পাকিস্তান সরকার প্রতিশ্রুতি দেয় এবং দুই দশক আগে নওয়াজ শরিফ প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় ফেরানোর একটি উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা আর এগোয়নি।


পাকিস্তানের আর কোনো সরকার তাদের নিতে আগ্রহ না দেখালেও এদের নেতা প্রয়াত নাসিম খান পাকিস্তানে যাওয়ার পক্ষেই অবস্থান নিয়ে ছিলেন, তাদের নবীন নেতারা এ নিয়ে ভিন্নমত পোষণ করছেন।


পরে ২০০৩ সালে হাইকোর্টের একটি রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে দেওয়া রায়ে বিহারিরা বাংলাদেশে ভোটাধিকার পান। তবে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব নিতে রাজি নন সবাই। ফলে ক্যাম্পের কঠিন জীবনকে আপন করেই থাকছেন তারা।


সরেজমিনে ঢাকার বেশ কয়েকটি বিহারি ক্যাম্প ঘুরে দেখা গেছে, রাজধানীর এসব ক্যাম্পের পরিবেশ যাচ্ছেতাই। ছোট ছোট খুপরি ঘর। এসব এক একটি ঘরে দশ থেকে বারোজন বাস করে। গোসলখানা ও   শৌচাগারগুলোও খুবই নোংরা। যাও আছে তা পর্যাপ্ত নয়। কিš‘ উপায়  না থাকায় এখানেই মানবেতর জীবন কাটছে তাদের।


যেভাবে কাটছে বিহারিদের জীবন


স্থানীয়দের তথ্যমতে, মোহাম্মদপুর বিহারি ক্যাম্পে বসবাস করছে প্রায় দেড় লাখ মানুষ। কিš‘ বিপুলসংখ্যক এই মানুষের বাসের জন্য যে সুযোগ-সুবিধা আছে তা ১০ হাজার জনের জন্যও পর্যান্ত কি না সন্দেহ আছে।


নাম প্রকাশে অনি”ছুক ক্যাম্পের এক বাসিন্দা ঢাকাটাইমসকে  বলেন, লজ্জার শেষ নেই, ছেলে বিয়ে করেছে। বউ বা”চা নিয়ে আমরা এক ঘরেই থাকি। এক ঘরেই খাওয়া, দাওয়া আসবাবপত্র সব। এভাবে কী মানুষ থাকতে পারে?


ক্যাম্পের আরেক নারী বাসিন্দা নূরানী বেগম বলেন, সময় সময় বিদ্যুৎ, পানি কিছুই থাকে না। দিনের পর দিন দূর থেকে পানি টেনে এনে কাজ করতে হয়, খেতে হয়। কিš‘ তারপরও এই ক্যাম্প ছাড়া অন্য জায়গায় যাওয়ার উপায় নেই।


তিনি জানান, চার থেকে পাঁচটি গলির লোকের জন্য সাতটি শৌচাগার। নারীদের জন্য তিনটি আর পুরুষদের জন্য সাতটি। সকালে কিংবা রাতে যখন লোকজনের মাঝে তাড়াহুড়ো থাকে তখন শৌচাগারের সামনে লম্বা লাইন পড়ে যায়।


একটু আক্ষেপ করে কুর্মিটোলা ক্যাম্পের বাসিন্দা জাবের আলী বলেন, আমরাও তো এদেশের ভোটার। আমাদেরও জাতীয় পরিচয়পত্র আছে। কিš‘ তারপরও কেন আমরা বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত? বাপ-দাদাদের জন্ম পাকিস্তানে তাতে কী? আমাদের জন্ম তো এখানেই।


এখান থেকে বের হতে মন চায় না? জবাবে মোহাম্মদপুর বিহারি ক্যাম্পের এক তরুণী ইসমত আরা বেগম ঢাকাটাইমসকে বলেন, উপায় নেই। সবাই আমাদের সমানভাবে মেনে নিতে পারে না। অনেক প্রতিকূলতা আছে।


মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় কলেজে সম্মান প্রথম বর্ষে পড়া এই তরুণী বলেন, লেখাপড়া শিখে যদি অবস্থার উন্নতি ঘটানো যায়, এই চিন্তা থেকে সামনের দিনগুলোর জন্য অপেক্ষা করছি। আসলে আমাদের ব্যাপারে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলালে তখন হয়ত বাঙালি সমাজের সাথে মিশে যেতে সমস্যা হবে না।


তবে এই তরুণী জানান, সমাজে তাঁর অবস্থান যেমনই হোক, বিহারি বলে নিজের সহপাঠীদের মধ্যে কোনো ধরনের বৈষম্যমূলক আচরণ পাননি তিনি।


মোহাম্মদপুরের বিহারি ক্যাম্পের লাগোয়া এলাকার বাসিন্দা আশিকুজ্জামান বলেন, আজ থেকে প্রায় ২০ বছর আগে যখন এই এলাকায় আসি তখন বিহারিদের সঙ্গে চলাফেরায় কেমন দূরত্ব মনে হতো। কিš‘ এখন ঠিক হয়ে গেছে। আমরা একে অপরের প্রতিবেশী বন্ধুর মতো। একসঙ্গে বাজার করি, বসবাস করছি। মনেই হয় না তাঁরা বিহারি।  


দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাচ্ছে উর্দুভাষীদের


বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পে থাকা উর্দুভাষীদের অনেকে কসাইখানা, সেলুন, খাবারের দোকান কিংবা শ্রমিকের কাজ করেন। তবে তাদের মধ্যেও শিক্ষার হার বাড়ছে। এখন একটু সচেতন বাবা-মা নিজের সন্তানকে পড়াশোনা করানোর প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছেন। কারণ তাঁরা মনে করেন শিক্ষাই তাদের এই দৈন্যদশা থেকে মুক্তি দিতে পারবে।


পল্লবীর কালসিতে কথা হয় ক্যাম্পের এক নারী বাসিন্দার সঙ্গে।  ছেলেকে স্কুল থেকে নিয়ে আসছিলেন তিনি। এই নারী বলেন, নিজেরা খুব বেশিদূর পড়তে পারিনি। বা”চাকে পড়াচ্ছি। ওই হাত ধরে যদি আমাদের মুক্তি মেলে এই আশায়।


১৯৭১ সালের পর যাদের এই দেশে জন্ম তাদের মধ্যে বাংলাদেশ সম্পর্কেও দৃষ্টিভঙ্গি ইতিবাচক। তারা এই দেশকেই নিজের দেশ মনে করেন। এই দেশ ছেড়ে যাওয়ার কোনো ই”ছা তাদের নেই বলে কয়েকজন তরুণের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।


নাজিম উদ্দিন নামে এক তরুণ এই সময়কে বলেন, আমরা বিহারি নই, বাংলাদেশি। আমাদের বিহারি বলা ঠিক নয়। কারণ আমাদেরও বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র আছে।’ গত বছর তিনি নতুন ভোটার হয়েছেন বলে জানান।


বাঙালিদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব যেখানে


বিহারিদের দাবি, ¯’ানীয়দের সঙ্গে তাদের দ্বন্দ্ব ক্যাম্পের জায়গা নিয়ে। কারণ, ১৯৯৫ সালের দিকে তৎকালীন সরকার এই জায়গা বাঙালিদের মধ্যে বরাদ্দ দেয়। এর থেকে জায়গা দখলকে কেন্দ্র করে বিহারিদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব শুরু হয়।


বিহারিদের সংগঠন উর্দু স্পিকিং পিপলস ইয়ুথ রিহ্যাবিলিটেশন মুভমেন্টের সভাপতি সাদাকাত খান বলেন,  স্থানীয় বাঙালিদের সঙ্গে আমাদের সুসম্পর্ক রয়েছে। তবে ১৯৯৫ সালে তাদের ক্যাম্পের জমির ওপর স্থানীয় বাঙালিদের জন্য তৎকালীন সরকারের দেওয়া প্লট বরাদ্দের কারণেই তার ভাষায় বহিরাগতদের সঙ্গে তাদের এই সমস্যাগুলো শুরু হয়। তিনি বলেন, আমাদের বাড়িঘর যেখানে ছিল সেখানে সরকার ক্যাম্প করে। কিš‘ ১৯৯৫ সালে এই জমির ওপর স্থানীয় বাঙালিদের প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়। তারপর থেকেই দেশের বিভিন্ন জেলার লোকজন এসে এখানে স্থানীয় মাস্তানদের ভাড়া করে আমাদের ওপর হামলা চালায়। এ অবস্থা দূর করার জন্য সরকারকে জমি সংক্রান্ত ঝামেলা দূর করতে হবে।


কালসির ঘটনায় আতঙ্কিত বিহারিরা


গত ১৪ জুন ঢাকার মিরপুরে কালসি ক্যাম্পের উর্দুভাষীদের সঙ্গে স্থানীয় বাঙালিদের সংঘর্ষ হয়। এক পর্যায়ে ঘরে দেওয়া আগুনে পুড়ে নয়জন এবং গুলিতে একজন মারা যায়। এ নিয়ে মিরপুর ও মোহাম্মদপুর অঞ্চলের বিহারিদের মধ্যে চরম অসন্তোষ দেখা দেয়। পরবর্তী সময়ে গত ১৭ জুন রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ দেখানোর সময় পরিবহন শ্রমিকদের সঙ্গেও বিহারিদের দ্বিতীয় দফা সংঘর্ষ হয়।


শ্রমিকদের অভিযোগ, বিহারিরা গাড়ি ভাঙচুর করছিলেন বলে তাদের প্রতিহত করা হয়। এদিকে গত ১৪ জুনের ঘটনায় ছয়টি মামলা হয়েছে। তবে বিহারিদের অভিযোগ, পুলিশ অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো তাদের বিভিন্নভাবে হয়রানি করছে। এ নিয়ে আতঙ্কে আছেন তাঁরা। আবার তাদের ওপর হামলা হতে পারে, এই শঙ্কা তাদের পিছু ছাড়ছে না। 


কালসি ক্যাম্পের বিহারিদের অভিযোগ, ক্যাম্পের জমি নিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে তাদের বিরোধ দীর্ঘদিনের। এর সঙ্গে স্থানীয় সংসদ সদস্য ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লার মদদ আছে। তবে সাংসদের দাবি, জমি দখল বা সংঘর্ষের ঘটনার সঙ্গে তাঁর কোনো সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ দিতে পারলে সব শাস্তি তিনি মাথা পেতে নেবেন।


(ঢাকাটাইমস/২০জুন/এইচএফ/এএসএ)