logo ০১ মে ২০২৫
এমন বিব্রত কখনও হয়নি র‌্যাব
মহিউদ্দিন মাহী ও আশিক আহমেদ, ঢাকাটাইমস
১০ জুন, ২০১৪ ১১:২৫:১৩
image


ঢাকা: নারায়ণগঞ্জের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামসহ সাতজনকে অপহরণের পর খুনের ঘটনায় চাকরি হারিয়েছেন র‌্যাবের তিন কর্মকর্তা। তাদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলাও হয়েছে। রিমান্ডেও নেওয়া হয়েছে তাদের।

ঘটনা এখানেই শেষ নয়। র‌্যাব বিলুপ্তির দাবি তুলেছে বিএনপি। সরকার এর পক্ষে না থাকলেও এ বাহিনীর কর্মকা- সীমিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে র‌্যাবের নিয়মিত টহল এবং তল্লাশি চৌকি বসানোর কাজ। র‌্যাব বলছে, এটা সাময়িক। তবে বাহিনীর সূত্র বলছে, চাপ এবং হতাশার মুখে এই কাজ করেছে তারা।

র‌্যাবের জন্য আরেকটি বিব্রতকর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ঢাকার কামরাঙ্গীরচরে র‌্যাব-১০’র কার্যালয়ের জন্য দেওয়া সাত একর জমির বরাদ্দ বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা জানিয়েছেন নৌ-পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। প্রকাশ্যে এই ঘোষণায় আরও হতাশ হয়েছেন এ বাহিনীর কর্মকর্তারা।

২০০৪ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় থাকতে প্রতিষ্ঠিত হয় র‌্যাব। জঙ্গি দমন, সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযানের কারণে শুরুতেই জনপ্রিয়তা পায় বাহিনীটি। তখন র‌্যাবের ক্রসফায়ারে বেশ কিছু সন্ত্রাসী মারা যাওয়ার পর মানবাধিকার সংগঠনগুলো এর সমালোচনা শুরু করলেও এসব বক্তব্যের তেমন কোনো প্রভাব দেখা যায়নি দেশে। বরং চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের দৌরাত্ম্য বন্ধ হওয়ায় ক্রসফায়ার ছিল জনপ্রিয়।

এর মধ্যে ক্রসফায়ার কমে এলেও উঠে গুমের অভিযোগ। খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে র‌্যাবের যাত্রা শুরু হলেও তিনিই এখন এ বাহিনীকে বিলুপ্ত করে দেওয়ার দাবি তুলছেন। তার অভিযোগ, জঙ্গি দমনে র‌্যাবের যাত্রা শুরু হলেও এখন বাহিনীটি গুম-খুনে জড়িয়েছে। তাদের কারণে সশস্ত্রবাহিনীর ভাবমূর্তিও নষ্ট হচ্ছে। কারণ,  সেনা, নৌ, বিমান বাহিনী থেকে এসেছে এই সদস্যরা।  

র‌্যাব অবশ্য বলছে, কেউ কোনো অন্যায় করলে গোটা বাহিনীকে দোষারোপ করা ঠিক নয়। গত দশ বছরে অনিয়ম, দুর্নীতি, শৃঙ্খলা ভঙের নানা অভিযোগে প্রায় দুই হাজার সদস্যকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। নারায়ণগঞ্জেও র‌্যাবের কোনো সদস্য কোনো অপকর্মে জড়িত থাকলে তাদের শাস্তি নিশ্চিত করতে চেষ্টা করবে বলে জানিয়েছে র‌্যাব।  

নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে র‌্যাব

২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জে সাতজনকে অপহরণ এবং তিনদিন পর শীতলক্ষ্যা নদীতে তাদের মরদেহ উদ্ধারের পর থেকে সারা দেশে র‌্যাবের তেমন কোনো তৎপরতার খবর পাওয়া যায়নি। এর মধ্যে গত ২৬ মে খবর আসে, এখন থেকে আর টহল ও তল্লাশি চৌকি বসাবে না র‌্যাব।

রাজধানীতে র‌্যাবের পাঁচটি ব্যাটালিয়ন প্রতিদিন ৪৫টি নিরাপত্তা চৌকি বসিয়ে তল্লাশি চালাত। আর থাকত ৭০টি টহল দল। কিন্তু এখন বন্ধ সব।

র‌্যাবের সদর দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, সন্ত্রাসী জঙ্গি গোষ্ঠী গ্রেপ্তার, গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহসহ সাতটি সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব আছে বাহিনীটির ওপর। এগুলোতে মনোযোগ দিতেই টহল, তল্লাশি, সমাবেশের নিরাপত্তাসহ বাড়তি কাজ বন্ধ করা হয়েছে।

জানতে চাইলে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক হাবিবুর রহমান বলেন, ‘কয়েকদিন আগে ডিজি (মহাপরিচালক) মহোদয় র‌্যাবের প্রতিটি ব্যাটালিয়নকে জানিয়ে দিয়েছেন, সুনির্দিষ্ট সাতটি কাজের বাইরে র‌্যাবকে বাড়তি কোনো কাজে অংশ নিতে হবে না। তবে প্রশিক্ষণের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হবে।’ যানবাহন নিয়ন্ত্রণ, টেন্ডার বাক্স পাহারা, জমিজমা ও টানা লেনদেন সংক্রান্ত সমস্যা এবং পারিবারিক বিরোধ নিয়েও র‌্যাব কোনো কর্মকা- চালাবে না বলেও জানান হাবিবুর রহমান।

জানতে চাইলে র‌্যাবের মহাপরিচালক মোখলেছুর রহমান ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘মৌলিক সাত কাজের বাইরেও র‌্যাব সদস্যরা বাড়তি কিছু দায়িত্ব পালন করত। এতে মৌলিক কাজে গতি কমে আসছিল। এসব বিবেচনা করেই এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।  প্রতিষ্ঠার পর থেকে র‌্যাব সাতটি দায়িত্ব পালন করবে বলেই ঠিক হয়েছিল।’

অন্য এক প্রশ্নের জবাবে মোখলেছুর রহমান বলেন, ‘র‌্যাব নিয়ে অনেক আলোচনা সমালোচনা আছে। সেদিকে আমরা তাকাচ্ছি না। আমরা আমাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি।’

স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল অবশ্য বলেছেন, র‌্যাবের এই সিদ্ধান্ত সাময়িক এবং কৌশলগত। প্রয়োজনে আবার শুরু হবে তা।  

আরও যেসব নির্দেশনা

দেশের বিভিন্ন এলাকায় র‌্যাব বা অন্যান্য বাহিনীর পরিচয়ে বা সাদা পোশাকে বাড়ি থেকে মানুষকে ধরে আনার অভিযোগ পাওয়া গেছে। কোনো বাহিনী এভাবে ধরে আনার বিষয়টি স্বীকার না করলেও সম্প্রতি ময়মনসিংহের ভালুকা থেকে ছয়জনকে তুলে আনার কদিন পর র‌্যাব সংবাদ সম্মেলনে জানায়, এদেরকে অপহরণ নয়, জঙ্গি তৎপরতার অভিযোগে আটক করেছে তারা।

কিন্তু এই অভিযান নিয়ে উঠে গুরুতর আইনি প্রশ্ন। প্রথমত, স্থানীয় থানাকে না জানিয়ে এই অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে; দ্বিতীয়ত, আটককৃতদের বিরুদ্ধে কি কি অভিযোগ তা তাদের এবং স্বজনদের জানানো হয়নি; তৃতীয়ত, তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ মোকাবিলায় আইনজীবী নিয়োগের সুযোগ দেওয়া হয়নি এবং চতুর্থত, আটকের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে তোলা হয়নি তাদের।

এরপর থেকে সরকার এ ধরনের অভিযান বন্ধে নির্দেশনা দেয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এখন থেকে র‌্যাবের পোশাকে কোথাও কোনো অভিযান চালাতে গেলে আগেই সংশ্লিষ্ট থানাকে অবহিত করতে হবে। সাদা পোশাকে অভিযান চালানো যাবে না। বিশেষ ক্ষেত্রে সাদা পোশাকে অভিযান চালালেও পরিচয়পত্র ব্যবহার করতে হবে। কাউকে আটক করে নিয়ে যেতে হলে অবশ্যই স্থানীয় দুই ব্যক্তিকে সাক্ষী রাখতে হবে।  

র‌্যাব বিলোপ নাকি সংস্কার

বিএনপির দাবি, র‌্যাবকে বিলোপ করতে হবে। প্রায় প্রতিটি আলোচনা সভা-সমাবেশে এই দাবি তুলছেন দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। দলের প্রধান এই দাবি তোলার পর অন্য নেতারাও জোরেশোরে তুলছেন তা।

যাদের হাত ধরে এ বাহিনীর জন্ম তারা কেন এর বিলোপ চাইছেন জানতে চাইলে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘র‌্যাবের বিলোপ আমরা চাইছি না। আমরা চাইছি বাহিনীকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রেখে সংস্কার করা হোক। আইনের মধ্য থেকে এরা কাজ করুক।’  

বিএনপি চেয়ারপারসন তো বলছেন র‌্যাব বিলুপ্ত করতে হবেÑ এমন প্রশ্নের জবাবে মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘ম্যাডাম তো বিষয়টি নিয়ে ব্যাখা দিয়েছেন। তিনি বলেননি র‌্যাব একেবারে বিলুপ্ত করতে হবে।’

ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ অবশ্য স্পষ্টই জানিয়ে দিয়েছে, এ বাহিনী বিলুপ্তির পক্ষে নয় তারা। তবে সংস্কার করে বাহিনীটিকে আরও বেশি জনবান্ধব করা হবে।

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য নূহ-উল আলম লেলিন ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমরা বরাবরই বলে আসছি র‌্যাবকে বিলুপ্ত নয়, এটাকে সংস্কার করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা চাইছি র‌্যাব আইনের মধ্যে থেকে তাদের দায়িত্ব পালন করবে। তাদের জবাবদিহিতা আরও বেশি নিশ্চিত কীভাবে করা যায় সে বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া হবে।’

জমির বরাদ্দ বাতিলে হতাশা

নৌ-পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান ২৬ মে জানান, র‌্যাব-১০’র একটি কার্যালয়ের জন্য সাত একর জমির বরাদ্দ বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সরকার বলেছে, ঢাকার পাশে বুড়িগঙ্গা নদীর পুরনো বা আদি চ্যানেলের জায়গা উদ্ধারের অংশ হিসেবে ওই জমির বরাদ্দ বাতিলের সিদ্ধান্ত এসেছে। আগামী জুনের মধ্যে এই উদ্ধার প্রক্রিয়া দৃশ্যমান করতে সরকার একটি কমিটিও গঠন করেছে।

ঢাকার কামরাঙ্গীরচর এলাকায় ৭ একর জায়গা প্রায় এক কোটি টাকায় র‌্যাবকে বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছিল ২০০৭ সালে। সেখানে র‌্যাব-১০’র স্থায়ী কার্যালয় নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু জায়গাটি পড়েছে বুড়িগঙ্গা নদীর আদি চ্যানেলের ভেতরে। পাঁচ মন্ত্রী গত ২৫ মে ওই আদি চ্যানেলের পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখেছেন। নদী রক্ষায় গঠিত টাস্কফোর্সে ওই মন্ত্রীরা রয়েছেন। ২৬ মে টাস্কফোর্সের বৈঠকে সরেজমিনে পরিদর্শনের ভিত্তিতে বুড়িগঙ্গা নদীর আদি চ্যানেলে র‌্যাবের জায়গার বরাদ্দ বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়।

নৌ-পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান জানিয়েছেন, বুড়িগঙ্গা নদীর পুরনো চ্যানেল উদ্ধারের অংশ হিসেবেই তারা এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

সরকারের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে হতাশ র‌্যাবের কর্মকর্তারা। তবে এ নিয়ে নাম প্রকাশ করে কিছু বলতে চান না তারা। একজন কর্মকর্তা ঢাকাটাইমসকে বলেন, নদী রক্ষার জন্য এই বরাদ্দ বাতিল হয়েছে বলে মনে করেন না তারা। কিন্তু এখন যে পরিস্থিতি তাতে এ নিয়ে কিছু বলার সুযোগ নেই।

(ঢাকাটাইমস/ ১০ জুন /এমএম/এএ/ এআর/ ঘ.)