logo ০১ মে ২০২৫
ওয়াসা কর্মীদের ঘুষ বাণিজ্য
তানিম আহমেদ, ঢাকাটাইমস
৩০ মে, ২০১৪ ১৯:৩০:৪৩
image


ঢাকা: মোহাম্মদপুরের মোহাম্মদিয়া হাউজিং লিমিটেডের এক নম্বর সড়কে পানির সংকট তিন মাস ধরে। মাঝেমধ্যে পানি এলেও গত পনের দিন ধরে একটি বাড়িতে পানি আসছে না এক ফোঁটাও। প্রতিদিন এক গাড়ি করে পানি কিনে কোনো মতে টিকে আছে ওই বাড়ির লোকজন।

ওয়াসার পাইপ লাইনে সরবরাহ করা পানির দাম কম হলেও গাড়িতে করে সরবরাহ করা পানির দাম কিন্তু কম নয়। ওয়াসার ছোট এক গাড়ি পানি বিক্রি করার কথা তিনশ টাকা। বড় গাড়ির দাম যথাক্রমে পাঁচশ এবং ছয়শ টাকা। কিন্তু এই টাকায় পানি পাওয়া যায় না, কখনো কখনো  বেশি দিতে হয় দুই বা তিনশ টাকা, কখনো বা আরও বেশি।

বৃষ্টির সময় পানির চাহিদা কম হলে সংকট কিছুটা কমে আর তখন গাড়িতে করে পানি বিক্রির পরিমাণও কমে। তখন এই বখশিশের নামে ঘুষের হারও থাকে কম। কিন্তু টানা রোদ হলে পানির চাহিদা বাড়লে বেড়ে যায় এই ঘুষের হার।

মোহাম্মদপুরের একটি বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘১৫ দিন ধরে প্রতিদিন এক গাড়ি করে পানি আনছি আমরা। প্রতি গাড়ির দাম পাঁচশ টাকা হলেও দিতে হয়েছে আটশ টাকা।’

এই হিসাবে কেবল একটি বাড়ি থেকে ওয়াসার কর্মীরা ১৫ দিনে ঘুষ নিয়েছে সাড়ে চার হাজার টাকা। ঢাকায় এ রকম বাড়ি আছে শ শ। ত্যক্ত-বিরক্ত নগরবাসী এভাবে জিম্মি হয়ে পড়েছে ওয়াসার কর্মীদের বখশিশের নামে ঘুষের বাণিজ্যের কাছে। বাড়তি টাকা না দিলে নানা অজুহাতে পানি দেয় না ওয়াসার কর্মীরা। তাই এই নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য না করে এ টাকা দিয়ে দেয় ভুক্তভোগীরা।

এই সমস্যার কথা অস্বীকার করেননি ওয়াসার কর্মকর্তারাও। সংস্থাটির উচ্চপদস্থ একজন কর্মকর্তা বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, ‘বখশিশ দিতে হয় এটা সত্য। কিন্তু আমাদের কাছে কেউ আনুষ্ঠানিক অভিযোগ করে না। করলে ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হতো আমাদের পক্ষে।’

অভিযোগ করেন না কেন জানতে চাইলে মোহাম্মদপুরের ওই বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক বলেন, ‘আমাদের তো পানি না হলে চলে না। অভিযোগ করলে হয়ত কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু পরে আর পানি দেবে না।’

ইস্কাটন গার্ডেনে একটি বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক আবদুর রহিম বলেন, ‘প্রতি গাড়ির সঙ্গে অন্তত তিন থেকে চারশ টাকা বখশিশ দিতে হয়। বখশিশ যদি কম হয় তারা পরে আসতে চায় না।’

রহিম বলেন, ‘কোনো উপায় ছিল না। কারণ পানি না থাকায় ঠিকমতো  কোনো কাজই করতে পারছিলাম না। তাই বাধ্য হয়েই বেশি টাকা দিয়ে হলেও পানি তো পেয়েছি’।

তবে ওয়াসার আরেক কর্মকর্তা দায় স্বীকার না করে বাড়ির মালিকদের দায় দিলেন। তিনি বলেন, ‘কোনো কোনো বাড়ির মালিক যদি আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বলেন, ‘ভাই আমাকে এক গাড়ি পানি দাও, আমি তোমাকে কিছু টাকা বেশি দেব। এখানেই সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। তারা গরিব মানুষ একশ দুইশ টাকা বেশি দিলে তো তারা নেবে।’

ওয়াসার কর্মকর্তার এই দাবি মানতে নারাজ টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, সাধারণ জনগণ স্বেচ্ছায় বেশি টাকা দিতে চায় এ কথা বিশ্বাস করার কোনো মানে নেই। ওয়াসার কর্মকর্তারা যে জনগণের সমস্যা নিয়ে সচেতন নন, এই কথাই তার প্রমাণ।

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, মানুষকে জিম্মি করে ওয়াসার কর্মীরা পানি বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েছে। আমাদের কাছে এমনো অভিযোগ আছে যে, ঘুষ আদায়ের জন্য অনেক এলাকায় ওয়াসার কর্মচারীরা পানির কৃত্রিম সংকট তৈরি করে।

ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে পানি সরবরাহে ওয়াসার আছে ৬৭০টি গভীর নলকূপ। এগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে আছে ১১টি মড্স জোন। পাইপ লাইনে পানি না এলে এসব মড্স জোনে গিয়ে বা টেলিফোনে অর্ডার দিতে হয়। কিন্তু এবার পানি সংকট এতই তীব্র হয়েছে যে, দিন-রাত পানি সরবরাহ করে কুলিয়ে উঠতে পারছে না ওয়াসা।

রাজধানীর উত্তরায় ওয়াসার মডস জোন-৯-এর উপসহকারী প্রকৌশলী গোলাম মোস্তফা ঢাকাটাইমসকে জানান, গরম পড়ার পর থেকেই গাড়িতে করে বিভিন্ন বাড়িতে পানি সরবরাহ বেড়েছে তাদের। মানুষ যে পরিমাণে পানি চায়, তা সরবরাহের ক্ষমতা তাদের নেই।

ওয়াসার এই কর্মকর্তা বলেন, দৈনিক তাদের কাছে চাহিদা হয় ৩০ থেকে ৫০ গাড়ি পানির। গাড়ি ঠিক থাকলে তারা দিনে দিতে পারেন ৩০ গাড়ি পানি। গাড়ির কারণে তারা কখনো কখনো আবার ১০ গাড়ি পানি সরবরাহ করতে পারেন না।

ওয়াসা সূত্রে জানা গেছে, শীতকালে গড়ে পানির চাহিদা থাকে ৫০ থেকে ৬০ গাড়ি। আর গ্রীষ্মকালে এই চাহিদা বাড়ে দশ গুণেরও বেশি।

সেই হিসাবে একটি গাড়ি থেকে যদি তিনশ টাকা করে নেওয়া হয় তাহলে ওই দিনই অতিরিক্ত ষাট হাজার টাকা ঘুষ নেয় ওয়াসার কর্মীরা। এই হিসাবে মাসে ঘুষের পরিমাণ হয় ১৮ লাখ টাকা। কর্মচারী সূত্রে জানা গেছে, এই টাকার ভাগ পায় অনেক কর্মকর্তাও।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওয়াসার পানির গাড়ির এক চালক এই সময়কে বলেন, ‘মানুষের উপকার করি যদি কিছু বখশিশ না দেয় আমরা চলব কি করে। আর আমাদের আবার এই বখশিশের ভাগ স্যারদেরও দিতে হয়।’

তবে ওই চালকের অভিযোগ মানতে নারাজ ওয়াসার কর্মকর্তারা। ঘুষের অভিযোগ অস্বীকার করে ওয়াসার সহকারী ব্যবস্থাপনা পরিচালক কামরুল আলম চৌধুরী ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমাদের কোনো কর্মী এ ধরনের কাজ করে থাকলে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ থাকতে হবে। কারো বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাকে বরখাস্ত করা হবে’। এই কর্মকর্তা জানান, মড্স জোন-৩-এ একটি অভিযোগ আসার পর দায়ী কর্মীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছেন তারা।

এ সমস্যার সমাধান কি হবে জানতে চাইলে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘সমস্যা অস্বীকার না করে ওয়াসার উচিত হবে তাদের পর্যবেক্ষণ দলকে আরও শক্তিশালী করা এবং যে এলাকায় অভিযোগ পাওয়া যাবে সেখানেই দ্রুত এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। এ কাজ করলে মানুষের সমস্যার যেমন সমাধান হবে, তেমনি ওয়াসার ভাবমূর্তিও বাড়বে।

পানি সংকট

এবার গরম পড়ার পর থেকেই রাজধানীতে চলছে পানির সংকট।  কোনো কোনো এলাকায় পান আসে না, কোথাও এলেও একেবারেই কম, কোথাও লাইনের শেষ দিকের বাড়িগুলোতে পানি পাওয়া যায় না।

গরম বেড়ে যাওয়ায় সঙ্গে সঙ্গে রাজধানীর মিরপুর, কাজীপাড়া,  শেওড়াপাড়া, দক্ষিণ মনিপুর, কাফরুল, কল্যাণপুরেও পানির সমস্যা  বেড়েছে বলে জানিয়েছেন এসব এলাকার বাসিন্দারা। সংশ্লিষ্ট এলাকার বাসিন্দারা জানান, কোথাও পানি নেই, কোথাও পানিতে ময়লা ও দুর্গন্ধ। মিরপুর ২ নম্বর সেকশন সংলগ্ন কাজীপাড়ায় তিন মাস ধরে পানি সংকট চলছে। মিরপুর-১৪ নম্বর এলাকা সংলগ্ন বৌবাজার এলাকায় পানির কল খুললে ময়লার সঙ্গে কেঁচোও আসছে। মাঝেমধ্যে পানি আসছে না।

এছাড়ও ইস্কাটন গার্ডেন, গোপীবাগ, পেয়াদাপাড়া, মোহাম্মদপুরের  মোহাম্মদীয়া হাউজিং সোসাইটির এক নম্বর সড়ক, নবোদয় হাউজিং, উত্তরা ও গুলশানের কিছু অংশে পানির সমস্যার কথা জানিয়েছেন এলাকাবাসী। পেয়াদাপাড়া, ওয়ারী ও বনগ্রাম এলাকায় ওয়াসার পানিতে ঝাঁঝালো গ্যাসের দুর্গন্ধ আসছে। এই পানি দিয়ে হাত, মুখ ও গোসল করলে চোখ জ্বালাপোড়া করে। লাইনে পানি সরবরাহ কম থাকায় বাসাবাড়িতে পানির অভাবে গোসল-খাওয়া পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গেছে।

পানি সংকটে রাজধানীবাসী নাজেহাল হলেও ওয়াসার দাবি, সংকট নেই। সহকারী ব্যবস্থাপনা পরিচালক কামরুল আলম চৌধুরী বলেছেন, তাদের তথ্যমতে পানির সমস্যা হচ্ছে দুটি এলাকায়। এর একটি মোহাম্মদপুরের মনসুরাবাদ এবং অপরটি গেন্ডারিয়ার ফরিদাবাদ। এই দুই এলাকায় গভীর নলকূপ নষ্ট হয়ে গেছে। এগুলো মেরামত চলছে।

তবে এই কর্মকর্তা এমন কথা বললেও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা ঢাকার পানি সংকটের কথা স্বীকার করে এও বলেছেন যে, এই সমস্যার আশু কোনো সমাধান তারা দেখছেন না। একজন কর্মকর্তা বলেন, প্রতিদিন ঢাকায় আসছে মানুষ, বাড়ছে চাহিদা। কিন্তু ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নামছে নিয়মিত। আগের মতো পানি উঠতে চায় না পাম্পগুলোতে। এই অবস্থায় আগামী বছর পানির সংকট আরও বাড়বে।

বিকল্প তাহলে কীÑজানতে চাইলে একজন কর্মকর্তা বলেন, পদ্মা এবং মেঘনা থেকে পানি আনার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, সেগুলো শেষ করতে সময় লাগবে চার থেকে ছয় বছর।

(ঢাকাটাইমস/ ৩০ মে / টিএ/ এআর/ ঘ.)