logo ০১ মে ২০২৫
প্রখর তাপ উপেক্ষা করে এমপির সংবর্ধনায় আসতে হলো ওদের
মহিউদ্দিন মাহী, ঢাকাটাইমস
২০ মে, ২০১৪ ২২:৫৮:১৩
image


ঢাকা: গ্রীষ্মের এই রোদ এড়িয়ে চলতে চায় না কে? প্রখর খরতাপ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে কতই না চেষ্টা চলে মানুষের। কিন্তু এর মধ্যে যদি কাউকে বাধ্য করা হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা রোদে দাঁড়িয়ে থাকতে?

৭ মে তীব্র গরমে এভাবেই দীর্ঘক্ষণ রোদে দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য  হয়েছিল পিরোজপুর সদর উপজেলার করিমুন্নেছা বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রীরা। সেদিন স্কুলে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণীর অনুষ্ঠান ছিল। প্রধান অতিথি ছিলেন স্থানীয় সংসদ সদস্য এ কে এম এ আউয়াল। সংসদ সদস্য আসবেন, তাই সকাল ৮টা থেকে সড়কে দাঁড়িয়ে থাকে ছাত্রীরা।

ঘুম থেকে উঠে নানা প্রস্তুতি সেরে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়িতে করে সংসদ সদস্য স্কুলে আসেন বেলা সাড়ে এগারোটায়। ততক্ষণে রোদে আর পানির তেষ্টায় প্রাণ ওষ্ঠাগত ছাত্রীদের। এর মধ্যে শুরু হয় আনুষ্ঠানিকতা। স্কুলের মাঠে আবার এক হয়ে জড়ো হয়ে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার পালা। কিন্তু জাতীয় সঙ্গীত চলছে, অথচ সম্মান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার বদলে একে একে বসে পড়তে থাকে ছাত্রীরা। পরে তারা অজ্ঞান হয়ে ঢলে পড়ে মাটিতে। সংখ্যাটা যখন ৫০-এর অধিক ছাড়ায় তখন পুরস্কার বিতরণের আনন্দময় আয়োজন পরিণত হয় বিষাদে।

উৎকণ্ঠিত অভিভাবক আর স্কুলের কর্মীদের মনোযোগের কেন্দ্রে তখন আর নেই সংসদ সদস্য। তাকে ফেলে ছাত্রীদের নিয়ে ছোটাছুটি শুরু হয় হাসপাতালে। সেখানে তখন মর্মান্তিক পরিবেশ। কান্নায় ভেঙে পড়ে অসুস্থ শিক্ষার্থীদের সহপাঠীরা। হাসপাতালে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের সারিয়ে তুলতে চিকিৎসকদেরও আপ্রাণ চেষ্টা। তবে বিকালের মধ্যেই সুস্থ হয়ে ওঠে শিক্ষার্থীরা। ফিরে যায় তাদের বাড়িতে।

কিন্তু এই ঘটনায় ক্ষোভ ছড়ায় এলাকায়। কেন একজন জনপ্রতিনিধিকে সংবর্ধনা দিতে এভাবে শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করা হবেÑ সে প্রশ্ন উঠে অভিভাবকদের মধ্যে। এক ছাত্রীর বাবা ঢাকাটাইমসকে জানান, সকাল থেকে রোদে দাঁড়িয়ে ক্লান্ত অবস্থায় একটু পানি চেয়েছিল তার মেয়ে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ পানির ব্যবস্থা রাখেনি। এরপর লাইনে দাঁড়ানোর পর তার বুকে প্রচ- ব্যথা অনুভূত হয়। পরে সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে।

এভাবে সংবর্ধনা কেন নিতে হবেÑ জানতে চাইলে সংসদ সদস্য এ কে এম এ আউয়াল ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘ওই দিন শিক্ষার্থীদের দাঁড় করানো হয়নি। আমি স্কুলে গিয়েছিলাম ১১টায়। মাত্র ১০ মিনিট ছিলাম। জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার সময় কিছু শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আমি ডাক্তারদের  সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। তারা বলেছে একটি রোগের কথা। যে রোগটি একজনের হলে অন্যদেরও হয়।’

ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক আবদুল হালিম বলেন, আসলে ওই দিন ছাত্রীদের দাঁড় করানো হয়নি। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান ছিল। তাঁবুর মধ্যেই ছাত্রীরা ছিল। জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার সময় বাইরে এলে ছাত্রীরা অসুস্থ হয়ে পড়ে। আসলে রোদের তাপ বেশি থাকায় এমনটি হয়েছে।

জনপ্রতিনিধিদের সংবর্ধনা দিতে গিয়ে ছাত্রছাত্রীদের দুর্ভোগে ফেলার এ রকম ঘটনা কেবল একটি নয়। বাংলাদেশে এটি একটি সাধারণ প্রবণতা দেশটির জন্মের পর থেকেই। কিন্তু এ নিয়ে সমালোচনাও আছে শুরু থেকেই। আদালতও হস্তক্ষেপ করেছে, কেন জনপ্রতিনিধিদের সংবর্ধনায় শিক্ষার্থীদের ব্যবহার অবৈধ ঘোষণা করা হবে নাÑ তা জানতে চেয়ে সরকারকে রুলও দিয়েছে হাইকোর্ট।

চারদিক থেকে সমালোচনার ঢেউ উঠার পর গত ২৭ জানুয়ারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করে জনপ্রতিনিধিদের সংবর্ধনা দেওয়া যাবে না বলে পরিপত্র জারি করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এই নির্দেশ না মানলে সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও ওই আদেশে জানিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।

এই নির্দেশনা জারি হওয়ায় ভোগান্তির অবসান হয়েছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের। কিন্তু মাধ্যমিকের কিশোর-কিশোরীদের কী হবে?

পিরোজপুরে সংসদ সদস্য আউয়ালের সংবর্ধনায় গিয়ে ৫০ কিশোরীর অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার পর কেবল প্রাথমিক নয়, এ ধরনের আয়োজনে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের ব্যবহার নিষিদ্ধের দাবি উঠেছে। অবশ্য এমন দাবি উঠেছে এর আগেও। সম্প্রতি নাটোরে একটি অনুষ্ঠানেও মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষার্থীদের দীর্ঘক্ষণ রোদে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়।

এর আগে চলতি বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি শেরপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য আতিউর রহমান আতিককে বরণ করে নেওয়ার জন্যও শিক্ষার্থীদের রাস্তায় লাইনে দাঁড় করানো হয়েছে। এ সময় তারাকান্দি, ভাতশালা, কানাশাকুলা, নবীনগর, থানামোড়সহ শহরে প্রবেশের রাস্তার দুই পাশে নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদেরও দাঁড় করানো হয়। এসব এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্লাস বন্ধ রেখে শিক্ষকরাও রাস্তায় দাঁড়িয়েছিলেন হুইপকে সংবর্ধনা জানাতে।

সম্প্রতি খুলনায় এক প্রতিমন্ত্রীকে সংবর্ধনা দিতে ২০৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ রেখে শিক্ষার্থীদের হাজির করা হয়। আবার সিরাজগঞ্জে এক সংসদ সদস্যকে সংবর্ধনা দেওয়ার জন্য স্কুলের শিক্ষার্থীদের প্রখর রোদে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। এতে ১৩ ছাত্রী অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়।

কেবল ছোটরা নয়, বাদ যাচ্ছে না বড়রাও। গত ৩০ জানুয়ারি শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমুকে সংবর্ধনা জানাতে রাস্তায় দাঁড় করানো হয়েছে ব্রজমোহন কলেজের (স্নাতক-স্নাতকোত্তর পর্যায়) শিক্ষার্থীদের। এদিন সকাল সাড়ে ৯টা থেকে শিক্ষার্থীরা তিন ঘণ্টা মন্ত্রীর জন্য দাঁড়িয়ে থাকেন। মহানগর আওয়ামী লীগ সংবর্ধনার আয়োজন করে।

এ ব্যাপারে ব্রজমোহন কলেজ ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক নাহিদ সেরনিয়াবাত জানান, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় জনপ্রতিনিধিদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষার্থীদের দাঁড় করানো যাবে না বলে পরিপত্র জারি করেছে। তাই তারা এবার সংবর্ধনার জন্য স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে গেছেন। তারা সবাই স্বেচ্ছায় গিয়েছেন বলে তিনি দাবি করেন।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী মনে করেন, ‘এ ধরনের সংবর্ধনার কোনো মানেই হয় না।’ ঢাকাটাইমসকে তিনি বলেন, ‘আমার কাছে বিষয়টা সর্বতোভাবে অগ্রহণযোগ্য। কেন মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞা মানা হচ্ছে না। সরকারই বা কেন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। শিক্ষার্থীরা ক্লাসরুমে পড়ালেখা করবে। অবসর সময়ে খেলাধুলা করবে। কাউকে সংবর্ধনা দেওয়া তাদের কাজ নয়। জনপ্রতিনিধিদের কাজ হবে শিক্ষার্থীবান্ধব। সেটা না করে তারা বাড়াবাড়ি করছেন। তাদের কাছে আমরা ভালো কিছু আশা করি।’

ইতিহাসের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘এই ধরনের সংস্কৃতি ছিল ঔপনিবেশিক আমলে। ব্রিটিশ কোনো কর্তা যখন স্কুলে আসত তখন শিক্ষার্থীদের দাঁড় করানো হতো। আমরা কি এখনও ঔপনিবেশিক আমলে আছি? আমি আশা করব সরকার যেন এ বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা নেয়।’

জানতে চাইলে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘কেবলমাত্র রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর সংবর্ধনায় শিক্ষার্থীদের দাঁড় করানো যাবে। তবে অন্য কোনো জনপ্রতিনিধি কিংবা বিশিষ্ট ব্যক্তিকে সংবর্ধনা জানানোর নামে শিক্ষার্থীদের রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখা যাবে না।’  

শিক্ষামন্ত্রী আরও বলেন, ‘আগে এই ঘটনা অহরহ ঘটলেও গত ৫ বছরে শিক্ষার্থীদের রাস্তায় রোদে-বৃষ্টিতে দাঁড়ানোর সংস্কৃতি বন্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর অতি উৎসাহী কিছু জনপ্রতিনিধি সংবর্ধনার নামে আবারও শিক্ষার্থীদের রাস্তায় দাঁড় করিয়েছেন। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। এই ঘটনা চলতে দেওয়া হবে না, এটা পুরোপুরি বন্ধ করা হবে।’

এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘শুধু ক্ষুদে নয়, কোনো পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনার নামে রাস্তায় দাঁড় করানো যাবে না। এর কারণ হচ্ছে, শিক্ষার্থীরা রোদ-বৃষ্টি-শীতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট পায়। তাদের কষ্ট না দেওয়ার জন্যই এই সংস্কৃতি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এটা আর হবে না।’

রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর আগমনকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীদের রাস্তায় দাঁড়ানোর বিষয়ে তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি কিংবা প্রধানমন্ত্রীর বিষয়টি আলাদা। তারা কোথাও সফরে গেলে তাদের দেখাও একটা ভাগ্যের ব্যাপার।’

(ঢাকাটাইমস/ ২১ মে /এমএম/ ঘ.)