ঢাকা: ‘ও ডাক্তার, ও ডাক্তার/ তুমি কতশত পাস করে এসেছ বিলেত ঘুরে মানুষের যন্ত্রণা ভোলাতে.../ডাক্তার মানে সে তো মানুষ নয়/ আমাদের চোখে সে তো ভগবান। কসাই আর ডাক্তার একই তো নয়/ কিন্তু দুটোই আজ প্রফেশন/ কসাই জবাই করে প্রকাশ্য দিবালোকে/ তোমার আছে ক্লিনিক আর চেম্বার/ ও ডাক্তার, ও ডাক্তার।’
কলকাতার শিল্পী নচিকেতার গান। এর কতটা সত্য, আর কতটা পর্যবেক্ষণ সেটা যাচাই করা কঠিন। তবে ইদানিং বাংলাদেশে চিকিৎসকদের সঙ্গে রোগী এবং তাদের স্বজনদের মধ্যে প্রায়ই বাধছে বিরোধ, যে কারণে চিকিৎসকদের ভাবমূর্তির ক্ষতি হচ্ছে নিঃসন্দেহে। ভুল চিকিৎসা, দুর্ব্যবহার, যথাযথ চিকিৎসা না দেওয়ার অভিযোগে একাধিক স্থানে চিকিৎসকদের ওপর হামলা করেছে রোগীর স্বজনরা। আবার কোথাও কোথাও সংবাদ সংগ্রহ করতে যাওয়া সাংবাদিকদের ওপর হামলাও করেছে চিকিৎসকরা। এসবের জেরে আবার হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা বন্ধ করে দেওয়া নিয়ে সমালোচনায় পড়েছে চিকিৎসকরা।
ভুল চিকিৎসা বা চিকিৎসকদের অন্যায্য আচরণের প্রতিকারের জন্য বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলÑবিএমডিসিতে আলাদা একটি শাখা আছে। কিন্তু চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ সেখানে জমা পড়ে না বললেই চলে আর অভিযোগ দেওয়া হলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার নজির নেই। এসব ঘটনায় ডাক্তার এবং রোগীদের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হচ্ছে বলে মনে করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এ এস এম আতিকুর রহমান। তিনি বলেন, ‘চিকিৎসক ও রোগীদের মধ্যে সম্পর্ক মানস্তাত্বিক। রোগ থেকে আরোগ্য লাভে ওষুধের চেয়ে বেশি কাজ করে চিকিৎসকের ব্যবহার। এজন্য অনেক সময় বলতে শোনা যায় অমুক চিকিৎসকের হাত-যশ ভাল। এটা আসলে ওই চিকিৎসকের প্রতি রোগীর আস্থাকে বোঝায়।’ তিনি বলেন, ‘রোগীদের সঙ্গে চিকিৎসকের সম্পর্ক হওয়া উচিত হৃদতাপূর্ণ এবং মসৃণ। কিন্তু বর্তমানে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে তাকে রোগীরা চিকিৎসকের কাছে যাওয়া বন্ধ করতে না পারলেও অজানা আতঙ্কে ভুগতে পারেন। এব্যাপারে চিকিৎসকদের আরও যতœবান হওয়ার সুযোগ আছে বলে মনে করি।’
চিকিৎসক নেতারা অবশ্য বলছেন সবাইকে ঢালাও দোষারোপ করা ঠিক নয়। আর সব ঘটনায়ই যে চিকিৎসকরা দায়ী ছিলেন, বিষয়টিও ঠিক নয়।
তবে মফস্বল এবং উপজেলা পর্যায়ে চিকিৎসকদের অনুপস্থিতিসহ নানা কারণে বারবার সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে অসন্তোষ জানানো হয়েছে, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে হাসপাতালে অনুপস্থিত থাকলে চাকরিচ্যুতির হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন। এরপরও অবস্থার খুব বেশি উন্নতি হয়নি।
রোগীদের জিম্মি করার প্রবণতায় ক্ষোভ
দুই বছর আগের কথা। হবিগঞ্জে অফিস চলাকালে ক্লিনিকে রোগী দেখার সময় হাতেনাতে ধরা পড়ার পর তাকে কারাগারে পাঠায় ভ্রাম্যমাণ আদালত। এর প্রতিবাদে জেলার সব সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা বন্ধ করে দেয় ডাক্তাররা। তিনদিন রোগীদের দুর্দশা দেখে ওই চিকিৎসকের জামিনের ব্যবস্থা করে সরকার।
ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যুর ঘটনায় করা মামলায় এক চিকিৎসকের জামিন বাতিল করে কারাগারে পাঠানোর পর ২৭ মার্চ থেকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা বন্ধ করে দেয় চিকিৎসকরা। চিকিৎসা না পেয়ে দুর্দশাগ্রস্ত রোগীদের সহায়তায় ছিল না কেউ। বিনা চিকিৎসায় রোগী মৃত্যুর অভিযোগও উঠে। এই অবস্থায় আবারও চিকিৎসকদের কাছে নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়। আবার জামিন পান ওই চিকিৎসক।
রোগীদের দুর্দশা দেখে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম জানান, চিকিৎসকদের ধর্মঘটের বিরুদ্ধে আইন করবে সরকার। এ জন্য প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। এই বক্তব্যের দুদিন পরই ৬ এপ্রিল ধর্মঘটে যায় রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিক্ষানবিশ চিকিৎসকরা। স্থানীয়দের সঙ্গে বিরোধের জেরে শিক্ষানবিশদের হোস্টেলে হামলার ঘটনায় রোগীরা কেন ভুগবে সে প্রশ্নের জবাব দিতে না পারলেও দুই দিন চিকিৎসা সেবা বন্ধ করে রোগীদের ভোগান্তির কারণ হয় চিকিৎসকরা।
১৩ এপ্রিল রাজধানীর বারডেম হাসপাতালে রোগীর স্বজনদের সঙ্গে বিরোধের জেরে টানা দুই দিন চিকিৎসা বন্ধ রাখে ডাক্তাররা। এতে হাজার হাজার রোগীকে ভোগান্তি পোহাতে হয়।
হাসপাতালের বাইরে এক চিকিৎসকের ওপর হামলার ঘটনায় ১১ মে জরুরি বিভাগ এবং বহির্বিভাগে সেবা বন্ধ করে দেয় শিক্ষানবিশ চিকিৎসকরা। দূর-দূরান্ত থেকে রোগীরা এসে চিকিৎসা না নিয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হয়।
রোগীদের এভাবে জিম্মি করার প্রবণতায় সারা দেশে ছড়াচ্ছে ক্ষোভ। সমালোচনা করছেন খোদ চিকিৎসক নেতাদের কেউ কেউ। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘কোনো কারণে স্বার্থে ব্যাঘাত ঘটলেই হলো, ব্যস। ধর্মঘটের নামে রোগীদের কষ্ট দেওয়া শুরু। জরুরি বিভাগে মুমূর্ষু রোগী মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতর হলেও চিকিৎসকরা ফিরে তাকাবেন না। তাঁরা আন্দোলন করছেন। পত্রিকার পাতায় এসব ছবি দেখে মনে হয় এই কী মানবতা? মানবতার সেবায় এই শপথ নিয়েছিলেন চিকিৎসকরা?’
খোদ চিকিৎসক নেতারাই বলছেন, কথায় কথায় কর্মবিরতি কিংবা ধর্মঘটে যাওয়া চিকিৎসকদের মানায় না। কারণ আর সব পেশার চেয়ে চিকিৎসা পেশা সম্পূর্ণ আলাদা। এখানে মানবতার সেবাই চির ধর্ম। এই শপথ বুকে নিয়েই চিকিৎসক হিসেবে নাম লিখিয়েছেন তারা। হাসপাতালের অসহায় গরিব রোগীকে জিম্মি করে কোনো ধরনের আন্দোলনে যাওয়া চিকিৎসকদের জন্য শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
কথায় কথায় কর্মবিরতিতে না যেতে চিকিৎসকদের প্রতি একাধিকবার আহ্বান জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। এজন্য একটি আইন করার কথাও বলেছিলেন তিনি। কিন্তু বলা পর্যন্তই। এর পর এ ব্যাপারে কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি চোখে পড়েনি।
জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক দীন মোহাম্মদ নূরুল হক ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘চিকিৎসকদের ঘন ঘন ধর্মঘটের বিষয়টি নিয়ে আমরা একাধিবার সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি। যেখানে সমস্যা হচ্ছে সেখানেই আমরা দ্রুত ব্যবস্থা নিচ্ছি। যদি কারোর অবহেলায় রোগী মারা যায় তবে অবশ্যই তাদের শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে।’
বিএমএ’র মহাসচিব এম ইকবাল আর্সলানের দাবি, শুধু হুমকি-ধামকি বা আইন করে এই পরিস্থিতি থেকে উঠে আসা সম্ভব নয়। এ জন্য ঘটনার পেছনের ঘটনা জানতে হবে। আসলেই এর পেছনে কোনো মহলের ষড়যন্ত্র বা উস্কানি আছে কি না তাও খতিয়ে দেখার দাবি জানান এই চিকিৎসক নেতা। তবে তিনি এও বলেন, ‘হাসপাতালে জরুরি সেবা বন্ধ করে দিয়ে কর্মসূচি পালন করা ঠিক নয়। এসব অপকর্ম যারা করছেন তাদের দায়ভার চিকিৎসক সমাজ কোনো অবস্থাতেই নেবে না।’
সাংবাদিকদের ওপর হামলা এবং চিকিৎসা দিতে অনীহা
২০ এপ্রিল রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রোগীর স্বজনদের সঙ্গে চিকিৎসকদের বিরোধের খবর শুনে সংবাদ সংগ্রহ করতে গেলে সাংবাদিকদের ওপর লাঠিসোটা নিয়ে হামলা করে চিকিৎসকরা। এরপর আবার নিজেরাই চিকিৎসা সেবা বন্ধ করে দিয়ে দুর্দশার কারণ তৈরি করে তারা।
এই ঘটনার জেরে ফটোসাংবাদিক গুলবাহার আলী জুয়েলকে ৭ মে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পায়ের অপারেশন করতে অস্বীকার জানায় চিকিৎসকরা। পরে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসা হয় তার।
এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হলে আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে ওই শিক্ষানবিশ চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন। রুলে বিচারক বলেন, ‘বিভিন্ন জায়গায় শিক্ষানবিশ চিকিৎসকরা সীমা অতিক্রম করেছে। সম্প্রতি তারা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সংঘাতে জড়িয়েছে।’ চিকিৎসকদের উদ্দেশে আদালত বলেন, ‘চিকিৎসা দিতে চাইলে হাসপাতালে থাকবেন, আর মাস্তানি করতে চাইলে রাস্তায় যান।’
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের পরিচালক জাফরুল্লাহ চৌধুরী মনে করেন, ‘শিক্ষানবিশ চিকিৎসকের কারণে গোটা চিকিৎসক সমাজকে আজ প্রশ্নের মুখে দাঁড়াতে হচ্ছে। এর একটি স্থায়ী সমাধান হওয়া উচিত।’
তবে কেবল শিক্ষানবিশরাই যে এসব ঘটনায় জড়িত তা নয়, ১৩ মে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি শিশির মোড়লকে হাসপাতালে ডেকে নিয়ে পেটান শিকদার উইমেন্স মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কার্ডিয়াক বিভাগের প্রধান সফিউল আজম।
সফিউল আজমের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চাকরি করেও পূর্ণাঙ্গ চাকরি নিয়েছেন শিকদার মেডিকেলে। এ বিষয়ে টেলিফোনে বক্তব্য জানতে চাইলে ওই চিকিৎসক শিশির মোড়লকে তার হাসপাতালে যেতে বলেন। এরপর প্রশ্ন শুনেই শিশির মোড়লকে কিল-ঘুষি মারতে থাকেন ওই চিকিৎসক। পরে হামলায় যোগ দেন সফিউল আজমের সহকর্মীরা। মারধরের পর একটি কক্ষে শিশির মোড়লকে বন্দি করে রাখে চিকিৎসকরা। পরে হাজারীবাগ থানায় ফোন করলে উপপরিদর্শক সুখেন চন্দ্র সরকার তাকে উদ্ধার করেন।
কর্মস্থলে থাকে না অর্ধেক চিকিৎসক
চাকরি গ্রামে হলেও ঢাকায় থাকার অভিযোগ আছে চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে। এক জরিপে দেখা গেছে, শতকরা ৪৭ ভাগ চিকিৎসক জেলা এবং উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অনুপস্থিত থাকেন। বিশেষ করে শহর থেকে দূরের গ্রামগুলোতে একেবারেই যান না চিকিৎসকরা। এ নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ হচ্ছে বিভিন্ন গণমাধ্যমে। বারবার সরকার জানিয়েছে অসন্তোষ।
গত ২ এপ্রিল সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চিকিৎসকদের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, ‘কর্মস্থলে না থাকলে সরকারি চিকিৎসক এবং শিক্ষকদের বরখাস্ত করা হবে। যারা চাকরি নিয়ে কর্মস্থলে না থাকে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যারা চাকরি পেয়ে কর্মস্থলে থাকবে না, তাদের বিদায় দিয়ে নতুনদের নিয়োগের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমাদের অনেকের প্রবণতা আছে, কর্মস্থল থেকে অনেকেই রাজধানীতে চলে আসে। তাদের তো চাকরি করার দরকার নেই।’ কিন্তু সরকারপ্রধানের এই হুঁশিয়ারি গায়ে মাখছেন না ‘ফাঁকিবাজ’ চিকিৎসকরা। মাসের শেষে কাজে যোগ দিয়ে বেতন নিয়েই চলে আসেন তারা।
মহাজোট সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হকের পর বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমও চিকিৎসকদের হুঁশিয়ার করে আসছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত গ্রামে না থাকার দায়ে কোনো চিকিৎসক চাকরি হারিয়েছেন বলে শোনা যায়নি। বরং চিকিৎসকদের শহরমুখী প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাইফুল আলম ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘এ পর্যন্ত সরকার চিকিৎসকদের গ্রামে পাঠাতে যতই হাঁকডাক ছেড়েছে এর কোনোটাই কাজে আসেনি। যে কারণে চিকিৎসকরাও এসবে কর্ণপাত করেন না। এতে বরাবরই ভোগান্তি পোহাচ্ছেন সাধারণ মানুষÑ যারা অর্থাভাবে বেসরকারি ক্লিনিকে চিকিৎসার জন্য যেতে পারেন না, আবার সরকারি হাসপাতালে গিয়েও সেবা পান না।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক দীন মোহাম্মদ নূরুল ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘কোনো চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেলে অবশ্যই আমরা ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। এ ব্যাপারে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’
কমিশন বাণিজ্য
চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতির ফলে রোগ নির্ণয় এখন অনেক সহজ হয়ে গেছে। নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে কম সময়ে জানা যায় রোগী কী ধরনের সমস্যা ভুগছেন। অথচ এই রোগ নির্ণয় নিয়ে বাণিজ্যে জড়িয়ে গেছেন একশ্রেণির চিকিৎসক। রোগ নির্ণয়ের মাধ্যমে কমিশন পেতে রোগীকে নিজের পছন্দের ডায়াগনস্টিক সেন্টার বা ক্লিনিকে পাঠান চিকিৎসক নিজেই। আবার কেউ চিকিৎসকের পরামর্শ না শুনলে পরীক্ষার প্রতিবেদন ভালো আসেনি বলে আবারও নিজের পছন্দের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পাঠান। বেসরকারি একটি ক্লিনিকের ব্যবস্থাপক ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘চিকিৎসকদের কারণেই অনেক নাম সর্বস্ব প্রতিষ্ঠান টিকে আছে। যেসব জায়গায় রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রতিবেদন পুরোপুরি সঠিক আসে না, দেখা যায় চিকিৎসকরা মোটা অঙ্কের কমিশন পেতে রোগীকে সেই প্রতিষ্ঠানে যাওয়ার পরামর্শ দেন। চিকিৎসকের মন রাখতে রোগীরা তাঁর কথা অমান্য করার সাহসও পান না।’
তবে চিকিৎসকদের জাতীয় সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাংগঠনিক সম্পাদক উত্তম কুমার বড়–য়া বলেন, ‘হাতের পাঁচ আঙুল তো আর সমান নয়। খারাপ-ভালো মিলিয়েই মানুষ। সব চিকিৎসক যদি অনৈতিক ও বাণিজ্যিক মনোভাবাপন্ন হতো তবে দেশের গরিব মানুষ চিকিৎসা পেত না। তার মানে কিছু মুষ্টিমেয় চিকিৎসক চিকিৎসা পেশাকে কলুষিত করছে।’
ওষুধ কোম্পানির উপহারে ঘর সাজে চিকিৎসকের
পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে কমিশন বাণিজ্যই নয়, বেসরকারি ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকেও মোটা অঙ্কের কমিশন, উপঢৌকন বা সুবিধা পেয়ে থাকেন চিকিৎসকরা। বিনিময়ে নির্দিষ্ট কোম্পানির ওষুধ চিকিৎসা ব্যবস্থাপত্রে লেখাই তাঁর কাজ। এমনও নি¤œমানের প্রতিষ্ঠান আছে যারা নিজেদের ওষুধের বিক্রি বাড়াতে চিকিৎসকদের ঘরের সামগ্রী এমনকি গাড়ি পর্যন্ত উপহার দেয়। সম্প্রতি আর্থিক লেনদেনের অভিযোগও উঠেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি ওষুধ কোম্পানির এক কর্মকর্তা ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমাদের কাছে তিন ধরনের তালিকা আছে। প্রথম তালিকায় আছেন অধ্যাপকরা। তারা যা চাইবেন তার সবই দেওয়ার নির্দেশ আছে। দ্বিতীয় তালিকায় আছেন সহযোগী এবং সহকারী অধ্যাপকরা। তারা যা চাইবেন কিছুটা দেন-দরবার করে তা দেওয়ার নির্দেশনা আছে। এর পরে আছে মেডিকেল অফিসাররা। তারা যা চাইবেন তার অর্ধেক দেওয়ার নির্দেশনা আছে।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘একশ্রেণির চিকিৎসকের অনৈতিক ও বাণিজ্যিক মনোভাবের কারণে গোটা চিকিৎসক সমাজের প্রতি মানুষের আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। চিকিৎসা মানেই এখন অনেক টাকার খেলা মানুষের মধ্যে এই ধারণা জন্মেছে। সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় চিকিৎসা সেবা পৌঁছে দিতে রাষ্ট্রের সব চেষ্টা ব্যর্থ হচ্ছে একশ্রেণির অসাধু চিকিৎসকের কারণে। এটি তো দীর্ঘদিন চলতে পারে না।’
রোগীর গোপনীয়তা নষ্ট হচ্ছে চিকিৎসকের কারণে
আইন অনুযায়ী রোগীর গোপনীয়তা রক্ষা করা চিকিৎসকের দায়িত্ব। এমনকি চিকিৎসক রোগীকে যে ব্যবস্থাপত্র দেবেন তাও অন্যকে দেখানোর নিয়ম নেই। কিন্তু চিকিৎসকের অতি বাণিজ্যিক মনোভাবের কারণে প্রতিটি হাসপাতাল ও চেম্বারে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের দৌরাত্ম্য প্রতিদিনের চিত্র। রোগী চিকিৎসকের চেম্বার থেকে বের হলেই তারা হুড়মুড়িয়ে পড়েন তার ওপর। চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র নিয়ে শুরু হয় টানাহেঁচড়া। চুক্তি অনুযায়ী চিকিৎসক ঠিক ওষুধটা লিখলেন কি না তা মিলিয়ে দেখেন। আবার কেউ কেউ ছবিও তুলে রাখেন চিকিৎসা ব্যবস্থাপত্রের। এতে রোগীর গোপনীয়তা বলতে আর কিছুই থাকে না।
চিকিৎসকদের এ ধরনের লাগামহীন বাণিজ্যিক কর্মকা- ধীরে ধীরে চিকিৎসক সমাজের প্রতি সাধারণ মানুষের নেতিবাচক ধারণাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে একসময় চিকিৎসকদের নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়বে।
ফি আদায়ে ফ্রি স্টাইল
চিকিৎসকদের ফি আদায়ের উচ্চহার ট্রেডিশনে পরিণত হয়েছে। ব্যাপারটি এমন যে, যত বেশি ডিগ্রি তত বেশি ফি। আর যত বেশি ফি তত বড় চিকিৎসক। ডিগ্রির ছড়াছড়িতে অভিজ্ঞতা ম্লান হতে বসেছে। বর্তমানে একজন চিকিৎসককে প্রথম সাক্ষাতেই সর্বনিম্ন ৪০০ থেকে সর্বোচ্চ ২০০০ টাকা পর্যন্ত ফি দিতে হয়। এরপর পরবর্তী সাক্ষাতে প্রতিবারে গুনতে হয় প্রথমবারের অর্ধেক পরিমাণ টাকা। নামিদামী কোন ক্লিনিক বা হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত হতে পারলেই উচ্চশিক্ষা ছাড়াই চিকিৎসকরা রাতারাতি বিশেষজ্ঞ বনে যান। অভিজ্ঞতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন না কেউ। মাত্র ১০০ ডলারের বিনিময়ে যেকোনো ফেলোশিপ নিয়ে নামের পাশে ‘বিশেষজ্ঞ’ লেবেল লাগান। এটাকে পুঁজি করে মানবতাকে ছিকায় তুলে রেখে গলাকাটা ভিজিট আদায় করেন রোগীদের কাছ থেকে। রোগীদের এমন অভিযোগের যেন অন্ত নেই।
তবে চিকিৎসকদের এ ‘ফ্রি স্টাইল’ টাকা আদায়ে ভ্রƒক্ষেপ নেই কারো। এমনকি চিকিৎসকদের একমাত্র নিয়ামক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) এ ব্যাপারে নিষ্ক্রিয় মনোভাবের পরিচয় দিচ্ছে। ফলে কম আয়ের মানুষের জন্য উন্নত চিকিৎসা পাওয়া রীতিমতো ‘স্বপ্ন’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ বিষয়ে চিকিৎসকদের বক্তব্য হচ্ছে, ফি আদায়ে যে নীতিমালা রয়েছে তা প্রায় ৩০ বছর আগের। বর্তমান যুগের তুলনায় তা সম্পূর্ণ অসাঞ্জস্যপূর্ণ। বর্তমান সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোর সঙ্গে মিল রেখে এ আইনের সংশোধন করা প্রয়োজন বলে মনে করেন তারা।
(ঢাকাটাইমস/ ১৭ মে / এইচএফ/ এআর/ ঘ.)