ঢাকা: ৫ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মৌলভীবাজার-২ আসন থেকে জিতেছেন আবদুল মতিন। আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হয়েও দলের মনোনয়ন পাননি তিনি। পরে দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে দাঁড়ান স্বতন্ত্র হিসেবে। বিএনপি-জামায়াত জোটের ভোট বর্জনের মুখে এই নির্বাচনে ছিলেন জাতীয় পার্টির একজন প্রার্থীও। এই ত্রিমুখী লড়াইয়ে জিতেছেন আবদুল মতিন।
তিন জনের মধ্যে লড়াই, জড়ো করতে হয়েছে কর্মী-সমর্থকদের, চালাতে হয়েছে জোর প্রচার-প্রচারণা, ছাপাতে হয়েছে পোস্টার, লিফলেট। ভোটের দিনও কেন্দ্রে কেন্দ্রে দিতে হয়েছে এজেন্ট। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার পর থেকেই খরচের শুরু। কিন্তু আবদুল মতিনের খরচের হিসাব দেখলে এর কিছুই বোঝার উপায় নেই। নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া নথিপত্র অনুযায়ী এই নির্বাচনে তার খরচ হয়েছে ১ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। আর ব্যক্তিগত খরচ ছিল ২৫ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা।
নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রার্থীদের জমা দেওয়া যেসব হিসাব আছে এর মধ্যে সবচেয়ে কম খরচ দেখিয়েছেন আবদুল মতিন। মৌলভীবাজার-২ (কুলাউড়া-কমলগঞ্জের একাংশ) আসনে আনারস প্রতীক নিয়ে ৩০ হাজার ৮৭১ ভোট পেয়ে জিতেছেন তিনি। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন জাতীয় পার্টির মহিবুল কাদের চৌধুরী। লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে তিনি পেয়েছিলেন ২৫ হাজার ২৪১ ভোট।
ইসির ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী দেখা গেছে, আবদুল মতিন ২১ দিনের প্রচারে খরচ করেছেন ৩০ হাজার টাকা। এছাড়া পরিবহনে ১০ হাজার, বিভিন্ন জনসভায় ৪০ হাজার, নির্বাচনী ক্যাম্প বাবদ ২০ হাজার, এজেন্ট এবং অন্যান্য স্টাফ বাবদ খরচ হয়েছে ৩৫ হাজার টাকা।
এই হিসাব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের মধ্যেই। সংসদ নির্বাচনে একজন প্রার্থী আইনত ব্যয় করতে পারেন ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত। তবে ব্যয় কাগজে-কলমের মধ্যে থাকলেও আসল খরচ হয় আরও বেশি। এই বাস্তবতায় ১ লাখ ৬০ হাজার টাকার মধ্যে নির্বাচন করা আদৌ সম্ভব কি না সে বিষয়ে সংশয় আছে কমিশনে।
তবে ঢাকাটাইমসের সঙ্গে আলাপকালে সংসদ সদস্য আবদুল মতিন বলেছেন, তিনি যে হিসাব দিয়েছেন নির্বাচনী খরচ এটাই। তিনি বলেন, ‘আমি গরিব মানুষ। নির্বাচনে টাকা খরচ করার মতো সামর্থ্য আমার নেই। আমি কাউকে এক গ্লাস পানি পর্যন্ত খাওয়াইনি। অতিরিক্ত খরচ কোথাও করিনি। তাই আমার খরচ কম হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘আমি এখন পর্যন্ত পাঁচবার ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ও দুই বার উপজেলা চেয়ারম্যান হয়েছি। জনগণ বরাবর আমাকে ভালোবেসে ভোট দিয়েছে।’
নির্বাচনের পর জয়-পরাজিত সব প্রার্থীরই আয়-ব্যয়ের হিসাব জমা দিতে হয়। অন্যথায় কারাদ- এবং জরিমানার বিধানও আছে। ব্যক্তিগত আয়-ব্যয়ের পাশাপাশি দলকেও জমা দিতে হয় হিসাব। কিন্তু অতীতের কোনো নির্বাচনেই এই ব্যয়ের হিসাব খতিয়ে দেখেনি নির্বাচন কমিশন। এবারও দেখেনি তারা।
জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘প্রার্থীরা ব্যয়ের যে হিসাব দেখিয়েছে তা দিয়ে এখনকার সময়ে ভোট করা রীতিমত অসম্ভব।’ তিনি বলেন, ‘অবশ্যই প্রার্থীরা ভুল তথ্য দিয়েছে। প্রার্থীরা নির্বাচনে ব্যয় করবে এটাই স্বাভাবিক। তবে এত কম টাকা ব্যয় অস্বাভাবিকই মনে হয়। কমিশনের উচিত এ বিষয়ে তদন্ত করে ভুল তথ্য দেওয়া প্রার্থীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।’
‘অস্বাভাবিক’ কম খরচ
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ আসনের সংসদ সদস্য ছায়েদুল হক এবার নির্বাচনে প্রচারণা বাবদ ব্যয় দেখিয়েছেন ১ লাখ ৮০ হাজার ৮৪০ টাকা। তিনি কোনো ব্যক্তিগত খরচ দেখাননি। কুড়িগ্রাম-৪ আসনের জাতীয় পার্টি-জেপির প্রার্থী রুহুল আমিন দেখিয়েছেন ২ লাখ টাকা।এত কম টাকায় নির্বাচন করা সম্ভব কি না জানতে চাইলে এই দুই সংসদ সদস্যের ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তারা ধরেননি।
নির্বাচনী ব্যয়ের এই হিসাব নির্বাচন কমিশন যাচাই বাছাই করবে কি না জানতে চাইলে কমিশনের উপসচিব মিহির সারোয়ার মোর্শেদ ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমরা আয়-ব্যয়ের সব হিসাবই যাচাই বাছাই করে দেখব, যদি কোনো ভুল বা তথ্য গোপনের প্রমাণ পাওয়া যায় তাহলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সর্বোচ্চ ব্যয় করে বিপাকে সুবিদ আলী ভূঁইয়া
কুমিল্লা-১ আসনের আওয়ামী লীগের প্রার্থী সুবিদ আলী ভূঁইয়া এবার সর্বোচ্চ ব্যয় দেখিয়েছেন। নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে দেখা গেছে তিনি দশম সংসদ নির্বাচনে ব্যয় করেছেন ২৪ লাখ ৯৯ হাজার ৯১৫ টাকা। তবে তা এই নির্বাচনী এলাকায় অনুমিত ব্যয়ের চেয়ে বেশি। একজন প্রার্থী সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যয় করতে পারলেও হিসাবটা এত সরল নয়। ভোটারপ্রতি সর্বোচ্চ ৮ টাকা করে খরচ করতে পারেন প্রার্থীরা। সে হিসাবে কোনো নির্বাচনী এলাকায় ৩ লাখ ১২ হাজার ৫০০ জন ভোটার থাকলেই কেবল এই ২৫ লাখ টাকা খরচ করা যায়। কিন্তু কুমিল্লা-১ আসনে ভোটার ছিল ৩ লাখ ৮ হাজারের মতো। এই হিসাবে এই আসনে কোনো প্রার্থীর সর্বোচ্চ ব্যয়ের সীমা ২৪ লাখ ৬৪ হাজার টাকা। কিন্তু সুবিদ আলী তার চেয়ে বেশি খরচ করেছেন ৩৫ হাজার ৯১৫ টাকা।
সুবিদ আলীর দেওয়া হিসাবে দেখা গেছে, তিনি প্রচারে ৯ লাখ ১১ হাজার ২২০ টাকা, পরিবহনে ৩ লাখ ২৯ হাজার টাকা, জনসভায় ৫ লাখ ৮১ হাজার টাকা, নির্বাচনী ক্যাম্পে ৩ লাখ ২৮ হাজার টাকা, এজেন্ট ও অন্যান্য স্টাফদের পেছনে ২ লাখ ৮ হাজার ২৩৫ টাকা এবং আবাসন ও প্রশাসনিক কাজে খরচ করেছেন ১ লাখ ৩৪ হাজার টাকা। ব্যক্তিগত কোনো খরচ দেখাননি এই সংসদ সদস্য।
সুবিদ আলী ভূঁইয়ার বিষয়ে নির্বাচন কমিশন কী ব্যবস্থা নেবে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনের উপসচিব মিহির সারোয়ার মোর্শেদ বলেন, প্রার্থী তার এলাকার ভোটার সংখ্যার আটগুণ খরচ করতে পারবে। এছাড়া ব্যক্তিগত খরচও এখানে যোগ করা হবে। যদি ব্যক্তিগত খরচ বাদে বেশি টাকা খরচ করে তবে তার বিরুদ্ধে মামলা করা যায়।
হিসাব জমা দেননি সবাই
গত ৫ জানুয়ারির দশম সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। বাকি ১৪৭ আসনে নির্বাচন হয়। এদের মধ্যে অনেকেই সময় মতো তাদের ব্যয়ের হিসাব জমা দেননি। এদেরকে নোটিশ দিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
নির্দিষ্ট সময়ে লালমনিরহাট-১ আসনের নির্বাচনী ব্যয়ের হিসাব জমা না দেওয়ায় জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করার নির্দেশ দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। ইতিমধ্যে কুমিল্লা-৫ আসনের জাতীয় পার্টি শফিকুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।
গত ৭ ফেব্রুয়ারি ছিল প্রার্থীদের ব্যয়ের রিটার্ন জমা দেওয়ার শেষ দিন। নির্বাচনী আইন অনুযায়ী গেজেট প্রকাশের ৩০ দিনের মধ্যে হিসাব না দিলে কমিশন তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারবে। জয়ী-পরাজিত সবাইকেই গেজেট প্রকাশের ৩০ দিনের মধ্যে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে এই হিসাব জমা দিতে হয়। সেই সঙ্গে এর অনুলিপি ইসি সচিবালয়ে ডাকযোগেও পাঠাতে হবে। হিসাব জমা না দিলে দুই থেকে সাত বছরের কারাদ- ও আর্থিক জরিমানার বিধান রয়েছে।
যারা হিসাব জমা দেননি
জাতীয় পার্টির লালমনিরহাট-১ আসনের হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, লক্ষ্মীপুর-১ আসনের জাপা প্রার্থী মোহাম্মদ মাহমুদুর রহমান মাহমুদ, লক্ষ্মীপুর-৪ আসনের জাপা প্রার্থী বেলাল হোসেন ও একই আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী এ কে এম শরিফউদ্দীন। কুমিল্লা-৫ আসনের জাপা প্রার্থী শফিকুর রহমান, বরিশাল-৪ আসনের জাতীয় পার্টির (জেপি) শেখ মো. জয়নাল আবেদীন, শেরপুর-৩ আসনের জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) এস এম আবদুর রাজ্জাক ও একই আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী হেদায়েতুল ইসলাম, সুনামগঞ্জ-৫ আসনের বিএনএফের মোহাম্মদ আশরাফ হোসেন এবং টাঙ্গাইল-৮ আসনের আওয়ামী লীগের শওকত মোমেন শাহজাহান ব্যয়ের হিসাব জমা দেননি। এর মধ্যে শওকত মোমেন শাহজাহান মারা গেছেন। বাকিদের বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতি চলছে।
নির্বাচন কমিশনার আবু হাফিজ জানিয়েছেন, ‘যারা আয় ব্যয়ের হিসাব দেবেন না, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। রিটার্নিং কর্মকর্তাদের আমরা বলে দিয়েছে মামলা করতে।’
তবে লালমনিরহাটের রিটার্নিং কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান বলেন, ‘জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান লালমনিরহাট-১ আসনের ব্যয়ের হিসাব জমা দেননি। কেন তিনি সময়মতো হিসাব জমা দেননি তার যৌক্তিক ব্যাখ্যা না পেলে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
কেবল ব্যক্তি নয়, ব্যয়ের হিসাব জমা না দেওয়ায় দলের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন। এরই মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ ১২টি দলকে সতর্ক করে চিঠি দিয়েছে কমিশন। অন্য দলগুলো হলোÑ জাতীয় পার্টি, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, তরীকত ফেডারেশন, বিএনএফ, জাতীয় পার্টি (জেপি), গণতন্ত্রী পার্টি, ন্যাপ, গণফ্রন্ট, খেলাফত মজলিস এবং বাংলাদেশ ইসলামিক ফ্রন্ট। ৪ মে দেওয়া এক চিঠিতে দলগুলোকে তাদের আয়- ব্যয়ের হিসাব জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
আইন অনুযায়ী ৫০ জন প্রার্থী থাকলে কোনো দল সর্বোচ্চ ৭৫ লাখ, ১০০ প্রার্থীর জন্য দেড় কোটি, ২০০ প্রার্থীর জন্য তিন কোটি এবং ৩০০ প্রার্থীর জন্য সাড়ে চার কোটি টাকা ব্যয় করতে পারবে। নির্বাচন কমিশনের উপসচিব মিহির সারোয়ার মোর্শেদ জানিয়েছেন, দলগুলোর হিসাব দেওয়ার সময় এখনও আছে। তবে ১০ হাজার টাকা জরিমানা দিয়ে ১৫ দিন সময় নিতে পারবে। এরপরও তারা হিসাব জমা না দিলে নিবন্ধন বাতিল হওয়ার সুযোগ আছে।
প্রার্থীরা ব্যয়ের যে হিসাব দেখিয়েছে তা দিয়ে এখনকার সময়ে ভোট করা রীতিমত অসম্ভব। অবশ্যই প্রার্থীরা ভুল তথ্য দিয়েছে। প্রার্থীরা নির্বাচনে ব্যয় করবে এটাই স্বাভাবিক। তবে এত কম টাকা ব্যয় অস্বাভাবিকই মনে হয়। কমিশনের উচিত এ বিষয়ে তদন্ত করে ভুল তথ্য দেওয়া প্রার্থীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।
(ঢাকাটাইমস/ ১১ মে / ইরা/ এআর)