logo ০১ মে ২০২৫
দল গোছাতে নতুন সংকটে বিএনপি

মহিউদ্দিন মাহী,ঢাকাটাইমস
১১ মে, ২০১৪ ১১:০৪:২১
image


ঢাকা: বৃহত্তর ময়মনসিংহে আওয়ামী লীগের শক্তিশালী অবস্থানের বিষয়টি নতুন করে বলার কিছু নেই। এই অঞ্চলের জেলা নেত্রকোনায়ও দলটির কর্মী-  সমর্থক আছে অগুনতি। কিন্তু গত বছর নির্বাচনের সময় নির্দলীয় সরকারের দাবিতে সরকারি দলের কর্মীদের বাধা উপেক্ষা করে এই জেলায় বিএনপি  নেতা-কর্মীরা তাদের কর্মসূচি পালনে ছিল বেশ তৎপর।

আন্দোলন করতে গিয়ে পুলিশের হামলা-মামলারও শিকার হয়েছে বিএনপি নেতা-কর্মীরা। অথচ আন্দোলনে ব্যর্থতার অভিযোগে এই জেলার কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়েছে। জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক আবু তাহের তালুকদারকে প্রধান করে আহ্বায়ক কমিটি করা হয়েছে। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ নেতা-কর্মীরা। তবে আহ্বায়ক আবু তাহের খুশি। ঢাকাটাইমসকে তিনি বলেন, ‘বিএনপি চেয়ারপারসন যখন যে দায়িত্ব দেবেন তা পালনে আমি সচেষ্ট থাকব। আশা করি দল আমাকে পরবর্তী সময়ে মূল্যায়ন করবে।’

পুনর্গঠনের অংশ হিসেবে এখন পর্যন্ত ১৫টিরও বেশি জেলায় কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়েছে। তবে দলটির এই কর্মকা- নিয়ে তৈরি হয়েছে ক্ষোভ। নেতা-কর্মীরা বলছেন, আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল ঢাকার বাইরের নেতা-কর্মীদের। আর ঢাকায় লোক জড়ো করতে না পারার কারণেই সরকারকে টলানো যায়নি। তাই ব্যবস্থা নিতে হলে আগে কেন্দ্রীয় ও ঢাকার নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। তা না করে জেলা পর্যায়ে ব্যবস্থা নেওয়া কতটা যৌক্তিক সে প্রশ্নও তুলছেন নেতা-কর্মীরা।

তবে দলের শীর্ষ নেতাদের রোষানলে পড়ার ভয়ে প্রকাশ্যে কেউ এ ব্যাপারে মুখ খুলছেন না। নওগাঁর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নেতা ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘বিগত দিনগুলোতে সরকারবিরোধী আন্দোলনে মাঠে ছিল সারা দেশে দলের তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা। আর সেই তৃণমূলের কমিটিই ভেঙে দেওয়া হচ্ছে। অথচ ঢাকা মহানগরী ও কেন্দ্রীয় নেতারা আন্দোলনে কোনো ভূমিকাই রাখেননি। সে কমিটি এখনও ভাঙা হয়নি।  জেলা কমিটি পুনর্গঠন করা বেশি জরুরি নয় বলে দাবি করেন বিএনপির ওই নেতা।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদ ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘কোনো কমিটি আসলে ভেঙে দেওয়া হচ্ছে না, পুনর্গঠন করা হচ্ছে মাত্র। এটি আন্দোলনেরই অংশ। আমরা প্রতিটি জেলা কমিটির মতামত নিয়েই বিষয়টি করছি। প্রাথমিকভাবে কেউ ক্ষুব্ধ হতে পারেন, কিন্তু তাদেরকে বুঝতে হবে যে, দলের স্বার্থেই কাজটি করা হচ্ছে আর সবাইকেই এক সিদ্ধান্তে খুশি করা যায় না।’

বিএনপি নেতারা জানান, কেবল জেলা কমিটি নয়, জেলায় যে আহ্বায়ক কমিটি করা হয়েছে তাদের উপজেলা, পৌরসভা এবং ইউনিয়ন কমিটিও পুনর্গঠনের দায়িত্ব দেওয়া হবে। সম্মেলন করে ভোটের মাধ্যমে নেতৃত্ব নির্বাচনের নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে।

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঠেকাতে ব্যর্থ হওয়ার পর বিএনপির সাংগঠনিক শক্তি নিয়ে প্রশ্ন উঠে। এরই অংশ হিসেবে চলতি মাসের শুরুর দিকে খালেদা জিয়া তৃণমূল নেতাদের গুলশান অফিসে ডেকে এনে কথা বলে ৮ জেলার কমিটি ভেঙে দেন। সেই সঙ্গে নতুন আহ্বায়ক কমিটি গঠন করে ভবিষ্যতে আন্দোলনে কীভাবে সফল হওয়া যাবে সে ব্যাপারে মতামত নিয়েছেন এবং যখন কেন্দ্র থেকে নির্দেশ দেওয়া হবে সঙ্গে সঙ্গে রাজপথে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।



আহ্বায়ক কমিটি নিয়েও বিরোধ

যে প্রক্রিয়ায় জেলা কমিটিগুলো ভেঙে দেওয়া হচ্ছে তা হিতে বিপরীত হয়ে যেতে পারে বলে দলের মধ্যেই একটি অংশের আশঙ্কা। তারা বলছেন, সরকারবিরোধী আন্দোলনে যারা ঢাকাকে সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছিলেন, বিএনপির সেই তৃণমূল নেতা-কর্মীদের ওপরই আগে খড়গ নেমে এসেছে। এর ফলে অনেক জেলায়ই আগের কমিটির ত্যাগী নেতা-কর্মীরা পদপদবী হারাচ্ছেন।

নওগাঁয় আহ্বায়ক কমিটির প্রধান করা হয়েছে সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আবু বকর সিদ্দিক নান্নুকে। কিন্তু তাকে মানতে চান না দলের একাংশ। বিলুপ্ত কমিটির এক নেতা ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘এক যুগ্ম মহাসচিব ও সাংগঠনিক সম্পাদকের ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে নওগাঁ জেলা কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এসব নেতা এবং তাদের সহযোগীরা আন্দোলনের সময় ছিলেন ঢাকায়। আর আমরা যারা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছি   সেই কমিটি ভেঙে দিয়ে গুরুত্বহীন করে দল অবমূল্যায়ন করেছে।’

বিলুপ্ত কমিটির সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম ধলু বলেন, ‘কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্তের অংশ হিসেবেই নওগাঁ জেলা কমিটি ভেঙে নতুন আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে। ৪৫ দিনের মধেই কাউন্সিলের মাধ্যমে নতুন কমিটি গঠন করা হবে বলে জানান তিনি।

সিলেটে আহ্বায়ক করা হয়েছে আগের কমিটির সহ-সভাপতি নুরুল হককে। ওই কমিটির সভাপতি ইলিয়াস আলী নিখোঁজ রয়েছেন। সাধারণ সম্পাদক আবদুল গফফারকে সদস্য পদে রাখা হয়েছে। এ কমিটি ইলিয়াস আলীর প্রতিপক্ষ বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরীর সমর্থক বলে জানা গেছে। অথচ উপজেলা নির্বাচনে শমসের মবিন চৌধুরী যাকে সমর্থন দিয়েছেন তিনি পরাজিত হয়েছেন।

সিলেট সদর বিএনপির এক শীর্ষ নেতা বলেন, ‘ভাই আর রাজনীতি করব না। রাজনীতি করে কী লাভ। যারা ত্যাগী নেতা-কর্মীদের মূল্যায়ন করতে জানেন না, তাদের সঙ্গে কিসের রাজনীতি।’

পঞ্চগড় জেলা বিএনপির কমিটিতে সহ-সভাপতি এ হাসান প্রধানকে আহ্বায়ক করা হয়েছে। তিনি ছিলেন আগের কমিটির সহ-সভাপতি। কিন্তু তাকে নিয়েও দলে আছে অসন্তোষ।

তৃণমূলের তোপের মুখে কেন্দ্রীয় নেতারা

জেলা কমিটি পুনর্গঠনে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সিনিয়র নেতাদের দিয়ে ৫৬টি দল গঠন করে দেন। এই নেতাদের বিভিন্ন জেলা সফর করে কমিটি পুনর্গঠন করতে বলা হয়। এরই অংশ হিসেবে বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী সিলেট গিয়ে তার প্রতিপক্ষের ঝাড়ু মিছিলের মুখে পড়ে ব্যর্থ হয়ে ঢাকায় ফিরে আসেন। এর আগে একবার চট্টগ্রামে গিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এম কে আনোয়ার দুই পক্ষের প্রতিরোধের মুখে পড়েন। উত্তরবঙ্গের একটি জেলায় গিয়ে স্থায়ী কমিটির সদস্য হান্নান শাহ দুই পক্ষের তোপের মুখে পড়েন। এ পরিস্থিতিতে ৫৬টি দলের জেলা সফর কর্মসূচি স্থগিত করে দেন খালেদা জিয়া।

তবে খালেদা জিয়া এবার নিয়েছেন কঠোর অবস্থান। জেলা কমিটি পুনর্গঠন নিয়ে কেন্দ্রীয় কিংবা মাঠ নেতাদের কোনো মতামত বা ওজর-আপত্তি কানে তুলছেন না। কোনো একটি জেলার সঙ্গে মতবিনিময়ের আগেই তিনি তার নিজস্ব সূত্রে যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করছেন এবং পুরনো কমিটি ভেঙে নতুন আহ্বায়ক কমিটি করে দিচ্ছেন। এই আহ্বায়ক কমিটি তিনি নিজেই আগে ঠিক করে রাখছেন। এরপর মাঠ নেতা-কর্মীদের সামনে ঘোষণা দিচ্ছেন মাত্র।

খালেদা জিয়া এও জানিয়ে দিয়েছেন যে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করে তার সামনে হাজির করতে ব্যর্থ হলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেবেন তিনি। সেই সঙ্গে তিনি নবীন-প্রবীণের সমন্বয়ে কমিটি করার কথাও বলছেন।



সব জেলা কমিটিই মেয়াদোত্তীর্ণ

বিএনপির অবশ্য জেলা কমিটিগুলো পুনর্গঠন করা ছাড়া বিকল্প নেই। দলের গঠনতন্ত্র অনুসারে সারা দেশে বিএনপির সাংগঠনিক জেলা রয়েছে ৭৫টি। এর সব জেলা কমিটিই মেয়াদোত্তীর্ণ। তবে বিএনপির তৃণমূল নেতা-কর্মীদের আপত্তি হচ্ছে এই পুনর্গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে। যাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তারা কতটা সক্রিয় এবং দলের প্রতি কতটা আন্তরিক, সে প্রশ্ন প্রকাশ্যেই তুলছেন তারা।

তবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘সরকারের দমন-পীড়নের কারণে দলের কেন্দ্রীয় নেতারা রাস্তায় নামতে পারেননিÑ এটা যেমন সত্য, তেমনি অনেক নেতা-কর্মীর সদিচ্ছারও অভাব ছিল। তিনি বলেন, বিএনপিসহ দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কমিটি পুনর্গঠন বা পরিবর্তন ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার অংশ। ম্যাডাম চাইলে দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী যেকোনো সিদ্ধান্তই নিতে পারেন।’

বিএনপিতে শৃঙ্খলার অভাব অবশ্য নতুন কোনো খবর নয়। উপজেলা নির্বাচনের সময়ও বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের কারণে একেক উপজেলায় একাধিক প্রার্থী অংশ নেয়। আর এর দায় স্থানীয় নেতাদের ওপর চাপিয়ে কেন্দ্র থেকে সারা দেশের প্রায় ২০০ স্থানীয় নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। দলের ওই সিদ্ধান্তের ব্যাপারে তৃণমূল পর্যায়ের অনেক নেতা-কর্মীর ক্ষোভ রয়েছে।

(ঢাকাটাইমস/১১ মে / এমএম/  ঘ.)