ঢাকা: কুমিল্লার বাতাকান্দির বাসিন্দা শরিফুল ইসলাম ব্যাংক হিসাব খুলবেন। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তাকে জানালো জাতীয় পরিচয়পত্র ছাড়া হিসাব খোলা যাবে না। কিন্তু দীর্ঘদিন দেশের বাইরে থাকার কারণে তার পরিচয়পত্র করা হয়নি। হারিয়ে ফেলেছেন পাসপোর্টও। এখন কী হবে।
এই সময়ে শরিফুলের সঙ্গে কথা হলো এক অপরিচিত ব্যক্তির। ওই ব্যক্তি বললেন, এত চিন্তা না করে মাত্র ২৫ থেকে ৩০ টাকা খরচ করলেই বানিয়ে নেওয়া যায় একটি ভুয়া পরিচয়পত্র। সময় লাগবে কেবল এক ঘণ্টা। কিন্তু অবৈধ কাজ করতে মন সায় দেয়নি শরিফুলের। তাই তিনি যাননি ওপথে।
সবার নৈতিকতা শরিফুলের মতো নয়। প্রয়োজন আইন মানে না, এই প্রচলিত কথা বিশ্বাস করে নকল পরিচয়পত্র বানিয়ে দিব্যি কাজ চালিয়ে যাচ্ছে তারা। ঢাকার বেশ কয়েকটি এলাকায় বানানো হয় এগুলো। তবে এই নকল করার প্রবণতা ঠেকাতে উদ্যোগী হয়েছে নির্বাচন কমিশন।
স্মার্টকার্ড নামে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে তারা, যার কাজ শুরু হবে এ বছরের অক্টোবরে। আইডিয়া নামক প্রকল্পের (আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম ফর অ্যানহ্যান্সিং অ্যাক্সেস টু সার্ভিসেস) আওতায় এটি করা হবে। এ প্রকল্পে বাংলাদেশ সরকার ২০১১ সালের ২১ জুলাই বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ১ হাজার ৩৭৯ কোটি টাকার একটি ঋণ চুক্তি স্বাক্ষর করে।
এ বিষয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন অণুবিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সুলতানুজ্জামান ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘জাতীয় পরিচয়পত্র নকল কিনা তা জানতে আমাদের ভেরিফিকেশন সার্ভিস চালু আছে। নকল সন্দেহ হলেই আমাদের জানালে আমরা ভেরিফিকেশন করে দেব। এছাড়া নকল রোধে স্মার্টকার্ড তৈরির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এই স্মার্টকার্ডে ব্যক্তির সব তথ্য দেওয়া থাকবে। এ বছরেই স্মার্টকার্ড দেওয়ার পরিকল্পনা আছে। প্রথমবার বিনামূল্যে স্মার্টকার্ড দেওয়া হবে। পরবর্তী সময়ে হারালে বা নষ্ট হল নির্ধারিত ফি দিয়ে নতুন কার্ড সংগ্রহ করতে পারবে।’
নকল করা সহজ
মোবাইল ফোনের সিমকার্ড কেনা থেকে শুরু করে অনেক কাজেই ইদানীং জাতীয় পরিচয়পত্র অপরিহার্য হয়ে পড়ায় এ সুযোগে নকল জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরির ব্যবসা করছে কয়েকটি চক্র। ভুয়া নাম-ঠিকানা ও ছবি ব্যবহার করে তৈরি করা এসব পরিচয়পত্র দেখে বোঝার উপায় নেই এগুলো নকল।
তবে মূলত মোবাইল ফোনের সিমকার্ডের খুচরা বিক্রেতারাই এর প্রধান গ্রাহক। সিম বিক্রেতারা অনেক সময় নিবন্ধন ছাড়াই কার্ড বিক্রি করেন। পরে এর বিপরীতে ভুয়া নিবন্ধন দেখিয়ে এসব পরিচয়পত্র ও ছবি ব্যবহার করা হয়।
সাধারণত যারা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত তারাই এসব ভুয়া নিবন্ধনের সিমকার্ড সংগ্রহ করে ব্যবহার করে। চাঁদাবাজি, হুমকি, রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকা- চালানো হয় এসব সিমকার্ড ব্যবহার করে। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের পরও অপরাধী শনাক্ত করতে গিয়ে পুলিশকে বিপাকে পড়তে হয়। যাদের নাম-পরিচয় ও ছবি ব্যবহার করা হচ্ছে, তারাও বিপদে পড়ে যান।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে ধরাও পড়ছে অনেকে। গত ১৮ এপ্রিল ঢাকা এবং গাজীপুরে অভিযান চালিয়ে পুলিশ ৫৩ হাজারেরও বেশি নকল পরিচয়পত্রসহ আটক করে তৌফিক ও সহযোগী আমিনুল ইসলাম নামে দুই জনকে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম জানান, কদমতলী থানা পুলিশ ১৭৫/এ, পূর্ব ধোলাইরপাড় থেকে চার হাজার ৬৫০টি ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্রসহ আমিনুল ইসলামকে আটক করা হয়। তার দেওয়া তথ্যে অভিযান চালানো হয় গাজীপুরের টঙ্গীর আরিচপুর বাজার এলাকার শেরেবাংলা রোডে। সেখানে তৌফিক ইসলাম নামে একজনের বাসা থেকে আরও ৪৮ হাজার ৪৫০টি ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র এবং বিভিন্ন ব্যক্তির ৩১ হাজার ৬৫০টি ছবি উদ্ধার করা হয়। এছাড়া তার বাসা থেকে একটি কম্পিউটার, দুটি প্রিন্টার, ২৩টি সিমকার্ড, প্রিন্টারে ব্যবহৃত ২০ বোতল বিভিন্ন রঙের কালি উদ্ধার করা হয়।
চক্রটি জাতীয় পরিচয়পত্র প্রস্তুতকারী কর্তৃপক্ষের স্বাক্ষর জাল করে এবং বিভিন্ন স্টুডিও থেকে পাসপোর্ট আকারের ছবি কিনে ভুয়া পরিচয়পত্র তৈরি করে। গত দেড় মাসে তারা এমন কয়েক হাজার পরিচয়পত্র বিক্রি করেছে বলে জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে জানিয়েছে। এছাড়া চাকরির বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রার্থীদের এবং কিছু অসাধু ডিও ম্যানেজারের কাছ থেকে ছবি সংগ্রহ করে। মূল জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর মিলিয়ে তারা ভুয়া পরিচয়পত্র তৈরি করে থাকে।
এ মামলা তদন্তের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) পাঠানো হয়েছে। দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা প্রণব ভট্টাচার্য ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এখনো তদন্ত কার্যক্রম শুরু হয়নি। শিগগির তদন্ত শুরু করা হবে এবং দোষীদের উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া হবে।
নকল পরিচয়পত্র তৈরি করে রোহিঙ্গারা বিদেশ চলে যাচ্ছে বলেও প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গারা টেকনাফে কিছু দিন অবস্থান করার পর দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায়। পরে সব জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট তৈরি করে মধ্যপ্রাচ্য এবং মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি পরিচয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে এরা। সিলেট এবং চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে গত এক মাসে বেশ কজন ধরাও পড়েছে এভাবে বিদেশ যাওয়ার সময়।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী কক্সবাজার শহরে বিভিন্ন কম্পিউটারের দোকানে তৈরি করা হয় এসব নকল পরিচয়পত্র। মাঝেমধ্যে পুলিশ অভিযান চালিয়ে এদের আটক করলেও এই অবৈধ ব্যবসা থামানো যায় না।
নকল রোধে নির্বাচন কমিশনের উদ্যোগ
এদিকে খুব সহজে জাতীয় পরিচয়পত্র নকল করা যায় বলে একটি বিশেষ অত্যাধুনিক উন্নতমানের জাতীয় পরিচয়পত্র বা স্মার্টকার্ড তৈরির কথা ভাবছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। বর্তমানে যে জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়া হয়েছে তা সাধারণ কাগজে কোনো মনোগ্রাম ছাড়া শুধু লেমিনেটিং করা। যা খুব সহজেই নকল করা হচ্ছে। কিন্তু স্মার্টকার্ড হবে যন্ত্রে পাঠযোগ্য। এতে বিশেষ কোড থাকবে, যাতে নাগরিকের ব্যক্তিগতের সুরক্ষা নিশ্চিত করা হবে।
ইসির জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন অণুবিভাগ থেকে বলা হয়, জাতীয় পরিচয়পত্রের জালিয়াতি রোধে নাগরিকদের দেওয়া হবে যন্ত্রে পাঠযোগ্য জাতীয় পরিচয়পত্র তথা স্মার্টকার্ড। দেশে তৈরি দীর্ঘমেয়াদি এ কার্ডের প্রাথমিক ব্যয় হচ্ছে প্রায় দুইশ টাকা। টেকসই ও সুন্দর অবয়বে এ কার্ড নানা কাজে ব্যবহার করা যাবে। বর্তমানে এক পৃষ্ঠায় নাম, পিতা ও মাতার নাম, জন্ম তারিখ ও আইডি নম্বর এবং অপর পৃষ্ঠায় ঠিকানা-সংবলিত লেমিনেটিং করা কার্ড পাচ্ছেন ভোটাররা। স্মার্টকার্ডে নাগরিকের সব তথ্য থাকবে। তবে ভোটারদের সবাইকে পর্যায়ক্রমে স্মার্টকার্ড দিতে চায় কমিশন।
এরই আলোকে জাতীয় পরিচয়পত্র বিধিমালায় কিছু সংশোধনী আনতে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে সংশোধনী প্রস্তাব আইন মন্ত্রণালয়ের পাঠিয়েছে ইসির আইন শাখা। গত ৭ মে কিছু অভিমতসহ মন্ত্রণালয় বিধিমালাটি নির্বাচন কমিশনে ফেরত পাঠায়। এতে বলা হয়েছে, স্মার্টকার্ড নবায়ন ও হারিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে যে ফিস ধার্য করা হয়েছে এর জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের সম্মতি দরকার।
এছাড়া নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব ওয়েবসাইটে নির্দিষ্ট ফরম পূরণ করে ভোটার হওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার পরিকল্পনা করছে ইসি। আর যারা ভোটার নন তারাও স্মার্টকার্ড নেওয়ার জন্য অনলাইনেই কাজ সম্পন্ন করতে পারবেন।
এদিকে বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় স্মার্টকার্ড প্রকল্পের বিধানেও কিছু পরিবর্তন আনতে চাচ্ছে নির্বাচন কমিশন। এতে প্রতিটি স্মার্টকার্ডের মূল্য দুইশ টাকা ধরে তা বিনামূল্যে দেওয়া হবে। যার মেয়াদ হবে ১০ বছর। এরপর নবায়নের জন্য সাধারণ ক্ষেত্রে ২৫০ টাকা এবং জরুরি ভিত্তিতে ৫০০ টাকা ব্যয় করতে হবে।
আবার স্মার্টকার্ড নষ্ট হয়ে গেলে বা হারিয়ে গেল প্রথম বার সাধারণ ক্ষেত্রে ৫০০ টাকা এবং জরুরি হলে ১০০০ (একহাজার) টাকা খরচ করতে হবে। এভাবে দ্বিতীয় বার হারালে সাধারণ এক হাজার টাকা এবং জরুরি ভিত্তিতে হলে দিতে হবে দুই হাজার টাকা। এরপরও কারও পরিচয়পত্র হারিয়ে গেলে সাধারণ ক্ষেত্রে দুই হাজার এবং জরুরি ক্ষেত্রে চার হাজার টাকা ফি দিতে হবে।
ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রম
১৫ মে সারা দেশে ছবিসহ ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রম শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন। নিবন্ধন ফরম ছাপানোর কাজও শেষ হয়েছে।
সারা দেশে ৩ ধাপে এ কার্যক্রম শেষ হবে ১৫ নভেম্বর। বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হওয়া প্রথম ধাপের হালনাগাদ কার্যক্রমে প্রায় ১৮ লাখ নতুন ভোটার অন্তর্ভুক্ত করা হবে। যাদের বয়স ২০১৫ সালে ১ জানুয়ারি ১৮ বছর হবে তারাই কেবল ভোটার হতে পারবেন। এরই মধ্যে নির্বাচন কমিশন গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে হালনাগাদের জন্য প্রচারণা শুরু করে দিয়েছে। মোবাইল অপারেটরের মাধ্যমেও জানানো হচ্ছে হালনাগাদের বিষয়টি।
তবে নিবন্ধন বিধিমালা সংশোধনের আগেই নতুন ফরম ছেপেছে নির্বাচন কমিশন। গত সপ্তাহে বিধিমালায় বেশ কিছু পরিবর্তন এনে আইন মন্ত্রণালয়ে একটি সংশোধনী প্রস্তাব পাঠিয়েছিল। আইনমন্ত্রী দেশের বাইরে থাকায় সেটা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। কিন্তু নির্বাচন কমিশন বিধিমালা সংশোধন হবে ধরে নিয়েই সংশোধন হওয়ার আগেই নিবন্ধন ফরম ছাপিয়েছে।
সংশোধিত এই নিবন্ধন ফরমে ভোটারদের অঙ্গীকারনামা যুক্ত করা হয়েছে। যা ২০১২ সালে হালনাগাদের সময় ছিল না। এছাড়া ভোটার এলাকা স্থানান্তরের বিধান পরিবর্তনের বিষয়েও পরিবর্তন আনা হয়েছে। এতে এলাকা পরিবর্তনের কারণ সম্পর্কে উপজেলা বা থানা কর্মকর্তাকে সন্তুষ্টি করার বিধান যুক্ত করা হয়েছে। ফলে ভোটার যেখানেই স্থান পরিবর্তন করার ইচ্ছা পোষণ করুন না কেন, তার কারণ ব্যাখ্যা করে উপজেলা কর্মকর্তাকে সন্তুষ্ট করতে হবে।
এবার সারা দেশে প্রায় ৪৬ লাখ নতুন ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্য নিয়ে মাঠে নেমেছে ইসি। এ জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৫৬ কোটি টাকা। বতর্মানে দেশে প্রায় সোয়া ৯ কোটি ভোটার রয়েছে। ২০১২ সালে হালনাগাদের সময় ৭০ লাখ ভোটার করা হয়েছিল। সে সময় খরচ হয়েছিল ৩৬ লাখ টাকা।
(ঢাকাটাইম/১৭মে/ইরা/এএসএ)