ঢাকা: ফেনীর একসময়ের আতঙ্ক জয়নাল হাজারী এখন ঢুকতে পারেন না নিজ এলাকায়। যার প্রতাপে একসময় ভয়ে অস্থির থাকতে হতো ফেনীবাসীকে, তার এই দশা হলো কেন? প্রশাসন না, পুলিশ না, একসময়ের শিষ্য হিসেবে পরিচিত নিজাম হাজারীর দাপটের যেন কিছুই না জয়নাল হাজারী।
ফেনী-২ আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন হাজারীর কথাই এখন ফেনীতে সব। স্থানীয় লোকজন বলছে, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, অস্ত্র ব্যবসা, ঠিকাদারি বাণিজ্য, মাদক ব্যবসা, চোরাচালান, দখলবাজি, খুন-খারাবিতে গুরু জয়নাল হাজারীকেও ছাড়িয়ে গেছেন তিনি। তাকে এখন ফেনীর নতুন ‘গডফাদার’ বলে ডাকা হয়।
কথা বলার জন্য সংসদ সদস্য নিজাম হাজারীর মুঠোফোনে একাধিকবার চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। পরে মুঠোফোনে খুদেবার্তা পাঠানো হলেও তিনি কোনো সাড়া দেননি।
তবে গত ২০ মে ফেনীর একাডেমি এলাকায় বিলাসী সিনেমা হলের পাশের রাস্তায় গুলি করে এবং পরে পুড়িয়ে ফুলগাজী উপজেলার চেয়ারম্যান একরামুল হক একরামকে হত্যার পর বেকায়দায় পড়েছেন নিজাম হাজারী। জনসমাগম থেকে দূরে রাখছেন নিজেকে। এড়িয়ে চলছেন গণমাধ্যমকেও। এই খুনের ঘটনায় এখন পর্যন্ত যারা গ্রেপ্তার হয়েছে তারা সবাই নিজাম হাজারীর বাহিনীর সদস্য বলে পরিচিত।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় আওয়ামী লীগের এক নেতা ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘একরামকে খুনের পর থেকেই বিষয়টি স্পষ্ট যে, এর সঙ্গে নিজাম হাজারী জড়িত। কিন্তু মানুষের চোখে ধুলা দিতে খুনিরাই যখন খুনের বিচার দাবি করে তখন আর কিছু বলার থাকে না।’
একরামকে খুনের মধ্য দিয়ে ফেনীতে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণের চিন্তা শুরু হয়েছে। ফেনীতে আবার জয়নাল হাজারী ফিরে আসেন কি না, কথা হচ্ছে তা নিয়ে। নিজামের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা জনমতকে কাজে লাগানোর এখনই মোক্ষম সময় বলে মনে করছে জয়নালের সমর্থকরা।
জানতে চাইলে সাবেক সংসদ সদস্য জয়নাল হাজারী ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘কোনো সুযোগের সন্ধানে আমি নেই। নেত্রীর (শেখ হাসিনা) কথায় রাজনীতি থেকে দূরে আছি। নেত্রী বললে আবার ফিরে যাব।’ তিনি বলেন, ‘যা করেছি সব দলের জন্য করেছি। দলের ভিত্তিকে শক্ত করার জন্য ওটা ছিল আমার লড়াই। এখন আর এটার প্রয়োজন হবে না।’
তবে নিজাম সমর্থক একটি অংশ মনে করে, জয়নাল হাজারী যত চেষ্টাই করুক, ফেনীর রাজনীতিতে তার ফেরার সুযোগ নেই।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনের কিছু কর্তাব্যক্তি নিজাম হাজারীর আজ্ঞাবহ। নানা অপকর্ম দেখেও না দেখার ভান করেছেন তারা।
অস্ত্র আইনে করা মামলায় ১০ বছরের কারাদ- হয়েছিল নিজাম হাজারীর। কিন্তু সেখানেও বড় ধরনের জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন এই আওয়ামী লীগ নেতা। দুই বছর ১০ মাস কম সাজা খেটে বেরিয়ে গেছেন তিনি। এই প্রতারণা ধামাচাপা দিতে জালিয়াতির অভিযোগ উঠেছে নিজামের বিরুদ্ধে। কারাগার থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর নিজেকে কারাগারে দেখিয়ে ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে উচ্চ আদালতে সাজা কমানোর জন্য আপিল করেছেন। অথচ এর আগে এ মামলায় রায় নিয়ে হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেন। উচ্চ আদালত তার সাজা বহাল রাখেন। সর্বশেষ তিনি রিভিউ আবেদন করলে আদালত তা খারিজ করে দেন।
ঠিকাদারি ব্যবসায় একচ্ছত্র আধিপত্য
ফেনীর সড়ক ও জনপথ, এলজিইডি, গণপূর্ত বিভাগ, পানি উন্নয়ন বোর্ড, জেলা পরিষদ, জনস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানসহ সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ঠিকাদারি পুরোপুরি নিজাম হাজারী ও তার ঘনিষ্ঠদের নিয়ন্ত্রণে। তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে কোনো ঠিকাদারই কাজ পান না। কোনো কিছুর ঠিকাদারি বের হলেই সংশ্লিষ্ট অফিস থেকে নিজাম বাহিনীর লোকজন তিনটি শিডিউল কিনে নেয়। নিজেরা কিছু কাজ রেখে কমিশনের বিনিময়ে বাকিগুলো অন্যদের কাছে বিক্রি করে দেয়। গত পাঁচ বছরের তাদের বাইরে কেউ ঠিকাদারি শিডিউল কিনতে পারেননি।
প্রতিটি বিভাগের ঠিকাদারির জন্য কমিশনের হারও প্রায় নির্ধারিত। সড়ক ও জনপথ বিভাগের যেকোনো ঠিকাদারি কাজ পাওয়ার জন্য ২০ শতাংশ কমিশন দিতে হয় নিজাম হাজারীকে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের জন্যও ২০ শতাংশ। জেলা পরিষদের জন্য ১০ শতাংশ হারে কমিশন আদায় করা হয়।
আওয়ামী লীগের এক নেতা ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘সরকারের গত সময়ে সোনাগাজীতে ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতায় বাঁকা নদী সোজাকরণ প্রকল্পের কাজ পাওয়ার জন্য বর্তমান পূর্তমন্ত্রী মোশাররফ হোসেনের প্রতিষ্ঠান প্রতিযোগিতা করতে চেয়েছিল। কিন্তু নিজাম হাজারীর লোকজন মোশাররফ হোসেনের লোকজনকে আটকে রাখে। ওই কাজের নেতৃত্বে ছিলেন একরামুল হক একরাম। পরে নিজাম হাজারী কাজটি পান।’ এরই মধ্যে বড় অঙ্কের একটি বিল তোলা হয়েছে।
অভিযোগ আছে, ফেনীর ফতেহপুরে লেভেলক্রসিং এলাকায় ফ্লাইওভার নির্মাণের ৩০ কোটি টাকার কাজ থেকে ২০ শতাংশ কমিশন আদায় করেছেন বর্তমান নিজাম হাজারী। যুবলীগের একজন নেতা এই টাকা লেনদেন করেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, ‘ঠিকাদারি ব্যবসার কমিশন-বাণিজ্যের একটি অংশ ফেনীর প্রভাবশালী এক আওয়ামী লীগ নেতাকেও দেওয়া হয়। ওই নেতা বেশির ভাগ সময় ঢাকাতেই থাকেন। তার নেকনজরের কারণে নিজাম হাজারী আজ এই পর্যায়ে এসেছেন।’
জানতে চাইলে জেলার পরিষদ প্রশাসক ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি আজিজ আহমেদ চৌধুরী কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
বালুমহালের নিয়ন্ত্রণ, রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার
ফেনী সদর ও আশপাশের এলাকার বালুমহালে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ নিজাম হাজারীর। এসব বালুমহাল থেকে কোটি কোটি টাকা আদায় করছেন তিনি। আর গত সাত বছরে কোনো ধরনের ইজারা না হওয়ায় সরকার হারাচ্ছে রাজস্ব। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ফেনীর পরশুরাম, ফুলগাজী, ছাগলনাইয়া, ফেনী সদর, লেমুয়া ধুনঘাট এলাকায় অনেকগুলো বালুমহাল আছে। প্রতিবছর সরকার এটি নির্দিষ্ট টাকার বিনিময়ে ইজারা দেওয়ার কথা থাকলেও গত সাত বছর কোনো ইজারা হচ্ছে না।
সব বালুমহাল তত্ত্বাবধায়নের মূল দায়িত্ব সদর উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান ফোরকান চৌধুরীর। পরশুরাম ও ফুলগাজী এলাকার বালুমহাল দেখাশোনা করেন পরশুরাম পৌরসভার মেয়র সাজেল চৌধুরী, উপজেলা চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন মজুমদার।
আওয়ামী লীগের নেতারা জানান, পরশুরাম-সুবার বাজার বালুমহাল নিয়ে নিহত একরামের সঙ্গে দ্বন্দ্ব ছিল নিজাম হাজারীর। এ ছাড়া ছাগলনাইয়া এলাকার দায়িত্ব উপজেলা চেয়ারম্যান সোহেল চৌধুরী, ফেনী অঞ্চল ও সবচেয়ে বড় লেমুয়ার ধুনঘাট দেখাশোনার দায়িত্ব ফোরকান চৌধুরীর।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে লেমুয়া ব্রিজের পশ্চিম পাশে গিয়ে বিশাল এলাকাজুড়ে বালুর স্তূপ দেখা যায়। এখানে কথা হয় স্থানীয় একজনের সঙ্গে। তিনি জানান, এটি ফোরকান চৌধুরীর বালুমহাল। বালুগুলো পাহাড়ি নদী থেকে তোলা হয়। এসব বালুমহালে বছরে কোটি কোটি টাকার বালু বিক্রি হয়। এসব বিক্রির ৫০ শতাংশ পান নিজাম হাজারী। বাকিটা অন্যরা পান।
লাগামহীন চাঁদাবাজি
ফেনীর বিভিন্ন জায়গায় চাঁদাবাজির শক্ত জাল বুনেছেন নিজাম হাজারী। দু-একদিনে নয়, ২০০৫ সালের ডিসেম্বরে কারাভোগ করে বের হয়ে আসার পর থেকেই চলছে তার এসব তৎপরতা। এরই মধ্যে বিশাল একটি বাহিনীও গড়েছেন চাঁদা আদায় এবং ব্যবস্থাপনার জন্য। ফেনীর পথে-প্রান্তরে এই সময়-এর সরেজমিন অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এসব তথ্য।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ফেনীর মহিপাল এলাকায় আন্তজেলা বাস টার্মিনাল থেকে দিনে পাঁচ লাখ টাকা টোল বা চাঁদা আদায় করা হয়। রসিদের মাধ্যমে এসব চাঁদা তোলার দায়িত্বে আছেন স্বপন মিয়াজী ও মামুন চৌধুরী। স্থানীয়দের কাছে যারা নিজাম বাহিনীর সদস্য বলে সুপরিচিত। এ ছাড়া ফেনীর পাঁচটি উপজেলায় বাস, ট্রাক ও সিএনজিচালিত অটোরিকশা ঢুকতে হলে ২০ টাকা করে চাঁদা দিতে হয়। এগুলো তত্ত্বাবধায়নের দায়িত্ব শ্রমিক নেতা মানিক ভূঁইয়ার। কিন্তু এক মাস আগে এই মানিক ভূঁইয়ার সঙ্গে লেনদেন নিয়ে নিজাম হাজারীর ঝামেলা হওয়ায় তাকে থানায় দেওয়া হয়। এখন তিনি হাজতে আছেন।
এ ছাড়া ফেনীর প্রতিটি বাসস্ট্যান্ড থেকে নিয়মিত রসিদের মাধ্যমে চাঁদা তোলা হয়। ২০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হয় গাড়িগুলোকে। কমিশনার আমির হোসেন বাহার এসবের সমন্বয়কের ভূমিকায় আছেন। বিভিন্ন দোকানপাট থেকেও নানাভাবে চাঁদা আদায় করে নিজামের ছত্রচ্ছায়ায় থাকা লোকজন।
অস্ত্র ব্যবসাতেও আধিপত্য
কলেজে পড়ার সময় চট্টগ্রামে ছিলেন নিজাম হাজারী। চট্টগ্রামে থাকা অবস্থায় নানা ধরনের অপকর্মে জড়িয়ে যান তিনি। ছিনতাইকারী ও অস্ত্র ব্যবসায়ীদের সঙ্গেও তার সখ্য ছিল বলে কানাঘুষা আছে। ছাত্রজীবনেই অবৈধ অস্ত্র বেচাকেনার সঙ্গে জড়িয়ে যান নিজাম হাজারী। অস্ত্রসহ ধরা খেয়ে কারাভোগও করেছেন।
নিজাম হাজারীর একসময়ের ঘনিষ্ঠ একাধিক কর্মী জানান, এই আওয়ামী লীগ নেতার অস্ত্রভা-ার দেখাশোনার দায়িত্বে আছেন পৌর যুবলীগ নেতা জিয়াউল আলম মিস্টার। তিনি একরাম হত্যা মামলার আসামি। ৫ নম্বর ওয়ার্ড কমিশনার ও একরাম হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া আব্দুল্লাহ হিল মাহমুদ শিবলুও অস্ত্র ব্যবসার অন্যতম সহযোগী। তিনি চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির কাশেম চেয়ারম্যান নামে এক ব্যক্তির কাছ থেকে অস্ত্র এনে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় সরবরাহ করেন। সদর আওয়ামী লীগের সভাপতি রেংসু করিমও আছেন নিজাম বাহিনীর অস্ত্র তত্ত্বাবধায়নে। এ ছাড়া ফেনী পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর কৌহিনুর আলম মামুন, সোহেল, শহিদান ও জনি নামে দুই ব্যক্তিও আছেন এই কাজের সঙ্গে।
সূত্র জানায়, জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবীর আদেল নিজাম হাজারী ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সহপাঠীও ছিলেন তারা। শহরের রাজঝির দিঘির সঙ্গে সড়ক ও জনপথ বিভাগের বাংলোতে বসে আদেল আগে নানা ধরনের সালিসি বৈঠক করতেন। কিন্তু একরাম হত্যা মামলায় আসামি হওয়ার পর থেকে আর দেখা যাচ্ছে না তাকে।
২০০০ সালে জামায়াতের ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের গুলিতে ছাত্রলীগের ছয় নেতা-কর্মীসহ আটজনকে হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার নিক্সন ও সরোয়ার জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করে যে, একটি একে ফোরটি সেভেন রাইফেল তারা নিয়েছিল নিজাম হাজারীর কাছ থেকে। কলকাতায় গ্রেপ্তার হওয়া দুই আসামি সাজ্জাদ ও নাসিরও জিজ্ঞাসাবাদে জানায় যে, হত্যাকা-ে ব্যবহৃত অস্ত্রগুলো নিজাম হাজারীর লোকদের কাছ থেকে পেয়েছিল তারা।
মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মাসোহারা
ফেনী শহরে অবাধে বিক্রি হয় মাদক। শহরের জেল রোডে সন্ধ্যার পর থেকেই একশ্রেণির মাদক ব্যবসায়ীদের আনাগোনা শুরু হয়। স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনকে হাত করে একটি সংঘবদ্ধ চক্র এই ব্যবসা করে যাচ্ছে। নিজাম হাজারীর লোকজনকেও এসব মাদক ব্যবসায়ী নিয়মিত মাসোহারা দিয়ে থাকে বলে জানা গেছে।
জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক এক নেতা ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘যুবলীগ নেতা জিয়াউল আলম মিস্টারের তত্ত্বাবধানে মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নিয়মিত মাসোহারা তোলা হয়। এ ছাড়া ফেনী রেলস্টেশন এলাকায় মাদক ব্যবসায়ী খায়েরের দুই ছেলে মাসুদ ও সুমন রেলের মাধ্যমে ফেনী থেকে অন্য জেলায় ফেনসিডিল, ইয়াবা ইত্যাদি মাদক চালান করেন। এই দুজন প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে ঘোরাফেরা করেন। এ ছাড়া রেলস্টেশন এলাকায় দোকান থেকে চাঁদাও তোলেন তারা।’
সূত্রে জানা গেছে, সীমান্ত দিয়ে মাদক, অস্ত্র, ভারতীয় পণ্য এবং মোটরসাইকেল চোরাচালানের সঙ্গে নিজাম বাহিনীর লোকজন জড়িত। তারা নিয়মিত নিজাম হাজারীকে কমিশন দেয়। ধর্মপুর, কাজীরবাগ, পরশুরাম সীমান্ত দিয়ে এসব চোরকারবার চলে। পরে ফেনীর হয়ে এসব মাদক, অস্ত্র চলে যায় রাজধানী, নোয়াখালী, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন অঞ্চলে।
পৌর এলাকায় নানা অনিয়ম
পৌর এলাকায় সরকারি গাছ বিক্রি, সরকারি জায়গায় পানি নিষ্কাশনের নালার ওপর দোকান তুলে টাকা আদায়ের বিস্তর অভিযোগ আছে নিজাম হাজারীর বিরুদ্ধে। তবে এ নিয়ে নাম প্রকাশ করে কেউ কিছু বলতে সাহস পায় না। জেল রোড এলাকার এক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘ভাই চুপচাপ ব্যবসা করি নিজেরটা খাই। কে কী করল এসব নিয়ে কথা বলে নিজের জানটা হারানোর ইচ্ছা আমার নেই।’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ফেনী শহরের দাউদপুর ব্রিজ থেকে ডিসির ভবন পর্যন্ত শত বছরের পুরোনো গাছ কেটে দুই মাস আগে বিক্রি করে দিয়েছেন ফেনী যুবলীগের সদস্য জানে আলম ভূঁইয়া। তিনি নিজাম হাজারীর ঘনিষ্ঠজন বলে পরিচিত। এ ছাড়া পৌরসভার মার্কেট, মজিদ মিয়ার বাজার, সুলতান মাহমুদ হকার্স মার্কেটে সরকারি জায়গায় ছোট ছোট দোকানঘর তুলে বিক্রি করেছেন সাংসদ। এ থেকেও কোটি কোটি টাকা তিনি আয় করেছেন বলে অভিযোগ আছে।
শহরের জেল রোড এলাকায় জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয়, প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ একাডেমি এবং জেলা কারাগারের সামনে সুয়্যারেজ ড্রেনের ওপর প্রায় ৫০টির মতো দোকান তৈরি করা হয়েছে। ড্রেনের ওপর স্লাপ বসিয়ে এসব ঘর করা হয়েছে। স্থানীয় সূত্র জানায়, নিজাম হাজারী পৌর মেয়র থাকাকালে এসব দোকান করেছেন। প্রতিটি দোকানের বিপরীতে নিয়েছেন পাঁচ লাখ টাকা।
অভিযোগ আছে, ফেনী শহরের দাউদপুর এলাকায় খাল ভরাট করে পৌর মার্কেট করেছেন নিজাম হাজারী। প্রায় ১০০টির মতো দোকান থেকে ২০ লাখ টাকা করে নিয়েছেন। অথচ পৌরসভার খাতা-কলমে দেখানো হয়েছে পাঁচ লাখ টাকা।
এ ছাড়া মেয়র থাকাকালে ফেনী পৌর এলাকায় বহুতল ভবন নির্মাণে আগের তুলনায় ছয় গুণেরও বেশি করারোপ করেছিলেন নিজাম হাজারী। আগে যেখানে তিন লাখ টাকা কর দিতে হতো পরে সেখানে আদায় করা হতো ১৮ থেকে ১৯ লাখ টাকা। টাকা না দিলে ভবন নির্মাণ বন্ধ করে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
কৃষক লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক রুহুল আমিন ভুঁইয়া মানিক ফেনীতে একটি ভবন করতে চেয়েছিলেন। পরে করসংক্রান্ত জটিলতায় তার ভবন নির্মাণকাজ থেমে যায়। পরে ঝামেলা কিছুটা মিটে গেলেও এখনো ভবনটি নির্মাণ করতে পারেননি তারা। জানতে চাইলে রুহুল আমিন ভুঁইয়া মানিক ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘নিজাম সাহেব মেয়র থাকাকালে ভবন নির্মাণে পৌর কর তিন লাখ থেকে ১৯ লাখ টাকা করা হয়েছিল। এ ব্যাপারে মেয়রের সঙ্গে যোগাযোগ করার পর তিনি জানিয়েছিলেন পৌরসভার প্রকৌশলীদের পরামর্শে তিনি কর বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন। পরে বর্ধিত কর জমা দিয়েছিলাম। পরে জমির উত্তরাধিকার জটিলতা দেখা দেয়। বিষয়টি এখন সমাধান হয়েছে। কিন্তু ভবন নির্মাণ আর শুরু করা যায়নি।’
জায়গা দখল করে সাততলা দালান
শহরের মাস্টারপাড়া এলাকায় নিজাম হাজারীর বাড়ি। এই বাড়িতেই থাকেন তিনি। সরেজমিনে দেখা যায়, সুরম্য বাড়িটির একটি অংশ দোতলা। মূল ফটকটি দৃষ্টিনন্দন। দেখেই বোঝা যাচ্ছে খুব বেশি দিন হয় লাগানো হয়নি। এই বাড়িতে যাওয়ার আগে রাস্তার পাশে চোখে পড়ে সাততলা একটি দালান। এখনো নির্মাণকাজ পুরোপুরি শেষ হয়নি। অভিযোগ আছে, এ জমিটির প্রকৃত মালিক ফেনী পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মোশাররফ হোসেন মিয়া হাজারী। যাকে সবাই মিয়া হাজারী নামেই বেশি চেনে।
জোর করে এই জমি দখল করে ভবন তুলছেন ফেনী-২ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য। এ ছাড়া বাড়িটির পাশে মার্বেল পাথরে বাঁধাই করা পুকুর ঘাঁট ও পুকুরের জায়গার মালিক মিয়া হাজারী, রফিক হাজারী ও ননু হাজারী। নিজাম হাজারী এটি দখলে নিয়ে পৌরসভার অর্থায়নে এটির উন্নয়নকাজ করেছেন বলে অভিযোগ আছে।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ পুকুর ঘাট ছিল নিজাম হাজারীর বৈঠকখানা। এখানে বসে ছোটখাটো বৈঠকগুলো সারতেন তিনি। তবে একরাম হত্যার পর এখানে আর বসতে দেখা যায়নি তাকে।
জানতে চাইলে মোশাররফ হোসেন মিয়া হাজারী ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমি এসব ব্যাপারে কোনো কথা বলতে পারব না। আমি খুবই অসুস্থ। দয়া করে আমাকে কোনো প্রশ্ন করবেন না।’
অনিয়ম করে সমবায় ব্যাংকের চেয়ারম্যান
ক্ষমতার দাপটে ফেনীর কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাংকের চেয়ারম্যান হওয়ার অভিযোগ আছে সাংসদ নিজাম হাজারীর বিরুদ্ধে। আওয়ামী লীগের এক নেতা ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘নিয়ম হচ্ছে সমবায় সমিতি ব্যবসা আছে এমন ব্যক্তি সমবায় ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদের জন্য লড়তে পারবেন। কিন্তু নিজাম হাজারী সাহেবের কোনো দৃশ্যমান সমিতি আগে থেকে ছিল না। পরে তিনি চেয়ারম্যান হওয়ার জন্য ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে ওই পদের বিপরীতে লড়েছেন।’
এর আগের মেয়াদে গিয়াসউদ্দিন বুলবুল ফেনীর সমবায় ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন। এবারও তিনি একই পদে লড়তে চেয়েছিলেন। কিন্তু অভিযোগ আছে, নিজাম হাজারী বুলবুলকে বলে দিয়েছেন, নির্বাচন করতে চাইলে বউ, ছেলেমেয়েসহ জ্বালিয়ে দেবেন। পরে ভয়ে তিনি আর চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করেননি। বুলবুল ছাগলনাইয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক।
ফেনীর পাঁচগাছিয়া সমবায় সুপার মার্কেটটি চারতলা। এটিকে ১৫ তলা করার জন্য কাজ দেওয়া হয়েছে সালেহ বাবুল নামে একজন ঠিকাদারকে। অভিযোগ আছে, এই ঠিকাদারি প্রক্রিয়ায় অচ্ছতা আছে। কোনো ধরনের ঠিকাদারি বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই দুই কোটি টাকার বিনিময়ে নিজাম হাজারী কাজটি বাবুলকে দিয়েছেন।
অর্পিত সম্পত্তি জবর-দখল
অর্পিত সম্পত্তি জবর দখল করে বিক্রি করার অভিযোগ আছে নিজাম হাজারীর বিরুদ্ধে। অনুসন্ধানে এমন একটি ঘটনার খোঁজ পাওয়া গেছে। ফেনী সদরের দেবীপুরে মৃত দয়া রাম দাসের ছেলে তপন চন্দ্র দাস নামে এক ব্যক্তি পরিবার নিয়ে বসবাস করত। তার ওখানে এক হাজার ২০০ শতাংশ জায়গা ছিল। ওই জায়গাটি কেনার জন্য বায়না করেছিলেন ফেনী জেলার বর্তমান সভাপতি আব্দুর রহমান বিকম। বায়না হিসেবে ২৩ লাখ টাকাও দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু অভিযোগ আছে, রাতের আঁধারে লোকজন দিয়ে ওই হিন্দু পরিবারকে তাদের জায়গা থেকে উচ্ছেদ করেন নিজাম হাজারী। পরে বিভিন্ন জনের কাছে ওই জায়গাটি বিক্রি করেন তিনি। তবে আব্দুর রহমান জায়গাটি আর কিনতে পারেননি।
জানতে চাইলে তিনি ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘জায়গাটি আমি কেনার জন্য বায়না করেছিলাম। কিন্তু যখন অন্যদের চোখ সেদিকে গেল তখন আমার আর কেনা হয়নি।’ বায়নার টাকা ফেরত পেয়েছেন কি না জানতে চাইলে আব্দুর রহমান বলেন, ‘টাকা এমপি সাহেবের (নিজাম হাজারী) মাধ্যমে ফেরত পেয়েছি।’ ওই ঘটনার পর থেকে হিন্দু পরিবারটির আর খোঁজ পাওয়া যায়নি।
এ ছাড়া অর্পিত সম্পত্তি অবমুক্তের নামে ফেনী বাজারের ভেতরের হিন্দু জমির মালিকদের কাছ থেকে কোটি টাকা চাঁদা আদায়ের অভিযোগ আছে বর্তমান সাংসদের লোকজনের বিরুদ্ধে।
হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে টাকা পাচার
নিজাম হাজারীর বিরুদ্ধে অর্থপাচারের অভিযোগ এনেছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের এক নেতা। তিনি ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘নিজাম হাজারীর কোটি কোটি টাকা হুন্ডির মাধ্যমে লন্ডনে ভাই ও ঘনিষ্ঠজনের কাছে পাঠিয়েছেন। তার ছোট ভাই আব্বাস একসময় লন্ডনে থাকতেন। তিনি এখন ইতালি থাকেন। ওই ভাইয়ের কাছে হুন্ডির মাধ্যমে নিজাম অনেক টাকা পাঠিয়েছেন। এ ছাড়া তার বন্ধু কুতুব হাজারীও লন্ডনে আছেন। তার কাছেও নিজাম হাজারীর টাকা আছে।’
দিঘি ভরাট করে মার্কেট
ফেনীর দাগনভূঞা উপজেলার কোরাইশ মুন্সি বাজারে বিশাল আয়তনের একটি দিঘি ভরাট করে সেখানে মার্কেট তৈরি করা হচ্ছে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, বিশাল এলাকাজুড়ে ওই দিঘিটি মুন্সি বাড়ির দিঘি নামে পরিচিত। এখন দিঘির কোনো অস্তিত্ব নেই। প্রায় পুরোটাই ভরাট করে গড়ে তোলা হয়েছে মার্কেট। বহুতল মার্কেট নির্মাণের কাজও চলছে। নির্মাণ শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান দাগনভূঞা উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান জয়নাল আবদিন মামুন এই দিঘি ভরাট করে এই মার্কেট বানাচ্ছেন। তবে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জবর দখল করে দিঘি ভরাট করে স্থাপনা তৈরি করছেন মামুন। মূলত এই দিঘির প্রকৃত মালিক মুন্সি বাড়ির লোকজন। স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল লতিফ ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘মামুন চেয়ারম্যান রাতের আঁধারে দিঘি ভরাট শুরু করেন। কেউ জিজ্ঞাসা করলে তার লোকজন বলে এই জায়গা মামুন মিয়া কিনে নিয়েছেন। অথচ মুন্সি বাড়ির লোকজন বলছে তারা এই জায়গা বিক্রি করেননি। সময় হলে তারা এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেবেন।’ তিনি জানান, এই দিঘি থেকে পানি নিয়ে শত শত মানুষ কাজ করত।
এই উপজেলার চেয়ারম্যান দিদারুল কবির রতন ও জয়নাল আবদিন মামুন দুজনই নিজাম হাজারীর খুবই ঘনিষ্ঠজন। এই দিঘি ভরাট করে মার্কেট করার পেছনেও আছে নিজাম হাজারীর হাত। মূলত তার মাধ্যমেই প্রশাসনকে হাত করে এসব জবর দখলের কাজ করে যাচ্ছেন মামুন। এর সঙ্গে নিজাম হাজারীর ব্যবসায়িক সম্পর্ক আছে বলেও একটি সূত্রে জানা গেছে।
উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদিন মামুন ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আট-দশ বছর আগে দিঘি কিনেছি। এটা সরকারি কোনো জায়গা না। এত দিন কিছু করিনি এখন ভরাট করে মার্কেট করছি।’ এই মার্কেট নির্মাণের সঙ্গে সাংসদ নিজাম হাজারীর কোনো সম্পর্ক আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ফেনী থেকে দাগনভূঞা অনেক দূর। আমি ছোট মানুষ, তিনি অনেক বড় মাপের মানুষ। তার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।’ সরেজমিনে কোরাইশ মুন্সি বাজারে টাঙানো একটি ব্যানারে নিজাম হাজারীর সঙ্গে মামুনের ছবি দেখা গেছে। স্থানীয়রাও বলছে, মামুন নিজামের খুবই আস্থাভাজন। প্রায়ই তিনি ওই এলাকায় যান।
বন বিভাগের গাছ কেটে উজাড়
দাগনভূঞার কোরাইশ মুন্সি বাজার থেকে বেরুলী সড়কের দুই পাশে শত শত কাটা গাছের গোড়া পড়ে আছে। যেসব গাছ কাটা হয়নি সেগুলোতেও লাল কালিতে নম্বর বসানো হয়েছে। স্থানীয়দের কাছে জানতে চাইলে তারা জানায়, বন বিভাগের এই গাছগুলো কাটার কাজ চলছে। যেগুলো নম্বর বসানো হয়েছে সেগুলোও কাটা হবে। উপজেলা চেয়ারম্যান দিদারুল কবির রতন ও ভাইস চেয়ারম্যান জয়নাল আবদিন মামুনের তত্ত্বাবধায়নে এসব কাটা হচ্ছে। কারণ কী জানতে চাইলে এক অটোরিকশাচালক ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমরাও এক মেম্বারকে জিজ্ঞাস করেছিলাম, তিনি বলছেন ঝড়ে গাছ ভেঙে রাস্তার ওপর পড়তে পারে এই জন্য কেটে ফেলা হচ্ছে।’
তবে ঘটনা অনুসন্ধানে জানা গেছে, স্থানীয় প্রশাসনকে হাত করে রতন ও মামুন মিলে বন বিভাগের এই গাছগুলো কাটছেন। এর সঙ্গে আছেন নিজাম হাজারীও। বন বিভাগের এসব গাছ বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ এনেছেন স্থানীয়রা।
জানতে চাইলে উপজেলা চেয়ারম্যান দিদারুল কবির রতন ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘বন বিভাগের গাছ টেন্ডারের মাধ্যমে কাটা হচ্ছে। এ ব্যাপারে আমি কিছু জানি না। বন বিভাগের কর্মকর্তারা এটা বলতে পারবেন। গাছ কাটার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।’
মামলায় সাজা খাটা নিয়ে জালিয়াতি
২০০০ সালের ১৬ আগস্ট অস্ত্র আইনের ১৯(ক) ধারায় ১০ বছর এবং ১৯ (চ) ধারায় সাত বছরের কারাদ- হয় নিজাম হাজারীর। চট্টগ্রাম নগরের ডবলমুরিং থানায় হওয়া মামলায় চট্টগ্রামের চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত ও বিশেষ ট্রাইব্যুনাল তাকে এই সাজা দিয়েছিলেন। উভয় দ- একসঙ্গে চলবে বলে রায়ে বলা হয়। অর্থাৎ ১০ বছর সাজা ভোগ করবেন নিজাম হাজারী। কিন্তু কারাগারের হিসাব বলছে, নিজাম হাজারী দুই বছর ১০ মাস এক দিন কম কারাভোগ করে বেরিয়ে গেছেন। ২০০৫ সালের ১ ডিসেম্বর তিনি কারাগার থেকে বের হন। এই প্রতারণা ঢাকতে আরও জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন নিজাম হাজারী। আইনজীবীরা বলছেন, এটি প্রমাণ হলে তার বিরুদ্ধে নতুন করে মামলা হতে পারে। আবার কারাগারেও ফিরতে হতে পারে তাকে।
আদালত সূত্র জানায়, তিনি নিজেকে জেলে দেখিয়ে সাজা কমানোর জন্য ২০০৬ সালের ১৩ এপ্রিল হাইকোর্টের আপিল বিভাগে একটি আপিল করেন। ফৌজদারি আপিল নম্বর-১৪০৯/২০০৬। অথচ এর আগে ওই মামলায় চট্টগ্রামের চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত ও বিশেষ ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেছিলেন। ২০০১ সালের ১৮ এপ্রিল বিচারপতি এ কে বদরুল হক ও বিচারপতি এ এফ এম মেছবাউদ্দিনের বেঞ্চে নিজাম হাজারীর আপিল শুনানি শুরু হয় (ফৌজদারি আপিল ২৩৬৯/২০০০)। একই বছরের ২ মে তারা ট্রাইব্যুনালের দেওয়া সাজা বহাল রেখে রায় দেন। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে নিজাম হাজারী সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেন (নম্বর ১০৭/২০০১)। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মাহমুদুল আমীন চৌধুরীর নেতৃত্বে বিচারপতি মো. রুহুল আমিন ও বিচারপতি এফ এম হাসান আপিল নাকচ করে হাইকোর্টের রায় বহাল রাখেন। পরে নিজাম হাজারী সুপ্রিম কোর্টে রায় বিবেচনার জন্য রিভিউ আবেদন করেন (নম্বর ১৮/২০০২)।
তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ জে আর মোদাচ্ছের হোসেনের নেতৃত্বে বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিম ও বিচারপতি আমীরুল কবির চৌধুরী আবেদন খারিজ করে দেন। ফলে নিজাম হাজারীর ১০ বছরের দ- বহাল থাকে।
জানতে চাইলে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান বিচারপতি আমীরুল কবির চৌধুরী ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আদালতের সঙ্গে জালিয়াতি প্রমাণ হলে অবশ্যই শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। এ থেকে বাঁচার সুযোগ নেই।’
নিজাম হাজারী ২০১১ সালের ১৮ জানুয়ারি ফেনী পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হন। নির্বাচনের আগে জমা দেওয়া হলফনামায় তিনি এই সাজার তথ্য গোপন করেন। আবার পৌর মেয়র পদ থেকে ইস্তফা না দিয়ে গত ৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হন নিজাম হাজারী। এবার হলফনামায় তিনি মামলা-মোকদ্দমার ঘরে লেখেন ‘মামলা নিষ্পত্তি ও মুক্তি’।
হু হু করে বেড়েছে সম্পদ
তিন বছরের ব্যবধানে সাংসদ নিজাম উদ্দিন হাজারীর শুধু টাকা বেড়েছে ৩২ গুণ। একই সঙ্গে বেড়েছে তার স্ত্রীর সম্পত্তিও। এ সময়কালে তার স্ত্রী পাঁচটি ফ্ল্যাট ও রামগড়ে ১৫ একর জমির মালিক হয়েছেন। নির্বাচন কমিশনে নিজাম হাজারীর জমা দেওয়া হলফনামা বিশ্লেষণ করে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
তবে স্থানীয়দের দাবি, গত তিন বছরে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন নিজাম হাজারী। যার বেশির ভাগই হলফনামায় উল্লেখ করেননি তিনি। দুদক এ ব্যাপারে অনুসন্ধান শুরু করলে আরও তথ্য বেরিয়ে আসবে।
২০১১ সালের ১৮ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ফেনী পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হন নিজাম হাজারী। এর তিন বছরের মাথায় তিনি আওয়ামী লীগ থেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পৌর নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হলফনামায় নিজাম হাজারী নিজের এবং স্ত্রীর নামে থাকা স¤পদের বিবরণ দেন। তাতে দেখা যায়, ওই সময়ে নিজাম হাজারীর নামে ব্যাংকে জমা টাকার পরিমাণ ১০ লাখ আর স্ত্রীর নামে সঞ্চয়পত্র বা স্থায়ী আমানত ছিল এক কোটি টাকা। তখন তার কাছে নগদ টাকা ছিল ৫০ হাজার, স্ত্রীর কাছে ছিল ৫০ হাজার টাকা।
হলফনামা অনুযায়ী, ২০১১ সাল পর্যন্ত নিজাম হাজারী ৫০ শতাংশ কৃষিজমি ও ৫০ শতাংশ অকৃষি জমির মালিক। তখন স্ত্রীর নামে কোনো জমি বা ফ্ল্যাট ছিল না। নিজামের একটি মোটর কার থাকার কথা বলা হলেও দাম উল্লেখ করা হয়নি। স্ত্রীর নামে তখন কোনো গাড়ি ছিল না। তবে স্ত্রীর ১০০ তোলা স্বর্ণালংকার ছিল। গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে গত ডিসেম্বরে নির্বাচন কমিশনে আবার হলফনামা দেন নিজাম হাজারী। তাতে দেখা যায়, তার আয় বৃদ্ধির তুলনায় স¤পদ অনেক বেশি বেড়েছে। ২০১১ সালে তিনি বার্ষিক আয় দেখান এক লাখ ৮০ হাজার। ২০১৩ সালে দেখান দুই লাখ ৪১ হাজার ৪৬৮ টাকা। অর্থাৎ তিন বছরের ব্যবধানে সাংসদ নিজাম হাজারীর বার্ষিক আয় বেড়েছে ৬১ হাজার ৪৬৮ টাকা।
সর্বশেষ হলফনামা অনুযায়ী, তিন বছরে নিজামের স্ত্রী পাঁচটি ফ্ল্যাট, ৮ শতাংশ অকৃষি জমি, রামগড়ে ১৫ একর জমি ও ২৭ লাখ টাকার একটি মোটর কারের মালিক হয়েছেন। অবশ্য এ ধাপে স্ত্রীর নামে স্থায়ী আমানত ৫০ লাখ টাকা দেখানো হয়, যা আগে ছিল এক কোটি টাকা। এ ছাড়া সর্বশেষ হলফনামায় নিজাম হাজারী নিজের ৩০ তোলা এবং স্ত্রীর ১০০ তোলা স্বর্ণ থাকার কথা উল্লেখ করেন।
যেভাবে উঠে এলেন নিজাম হাজারী
আশির দশকে ফেনী কমার্স কলেজে পড়ার সময় চট্টগ্রামের এমইএইচ এলাকায় সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িয়ে যান নিজাম হাজারী। সেখান থেকে ধীরে ধীরে অস্ত্র ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতিম-লীর সদস্য প্রয়াত আখতারুজ্জামান বাবুর ছত্রচ্ছায়ায় ছিলেন তিনি। নিজাম হাজারীর দুঃসম্পর্কের আত্মীয় নিজাম হাজারী লমী হাজারী বাড়ির ছেলে। আর জয়নাল হাজারী গণি হাজারী বাড়ির ছেলে।
নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় জয়নাল হাজারীর হাত ধরেই ফেনীতে আসেন নিজাম। ছিলেন জয়নাল হাজারীর দেহরক্ষী। একসময় নানার বাড়ি ফুলগাজী উপজেলায় আধিপত্য বাড়তে থাকে নিজামের। ১৯৯২ সালের ২২ মার্চ চট্টগ্রামের ডবলমুরিং থানা পুলিশ অস্ত্রসহ তাকে গ্রেপ্তার করে। পরে ওই বছরের ২৮ জুলাই তিনি জামিনে বের হন। ২০০০ সালের ১৬ আগস্ট তার ১৭ বছরের কারাদ- হয়। কিন্তু ২০০৫ সালের ১ ডিসেম্বর কারাগার থেকে বের হন তিনি। ২০০১ সালে জয়নাল হাজারী ভারতে পালিয়ে গেলে ফেনী আওয়ামী লীগে নয়া মেরুকরণ শুরু হয়।
২০০৫ সালে নিজামকে সংবর্ধনা দেওয়া হয় ফেনীতে। নিজাম বুঝতে পারেন, এখানে আওয়ামী লীগে অবস্থান তৈরি করতে হলে প্রয়োজন একরামকে এবং সুর মেলাতে হবে জয়নাল হাজারীর সুরে। ফেনীতে তিনি জয়নাল হাজারীর পক্ষে অবস্থান নিয়ে মিটিং-মিছিল করতে থাকেন। জয়নাল হাজারীর অনুপস্থিতিতে একজোট হন নিজাম হাজারী, একরাম ও উপজেলা চেয়ারম্যান দিদার।
সময়ের ব্যবধানে গুরু জয়নাল হাজারীকে ফেলে একরামের আরও ঘনিষ্ঠ হন নিজাম হাজারী। ২০০৯ সালে জয়নাল হাজারী দেশে ফেরেন। কিন্তু কেন্দ্রের নির্দেশে তিনি আর ফেনীর রাজনীতিতে সক্রিয় হতে পারেননি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে একরাম ফুলগাজীর চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। আর ২০১১ সালে ফেনী পৌরসভার মেয়র হন নিজাম উদ্দিন হাজারী।
২০১২ সালের সম্মেলনে নিজাম উদ্দিন হাজারী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন। এরপর পৌরসভার মেয়র পদ থেকে ইস্তফা না দিয়ে গত ৫ জানুয়ারি নিজাম হাজারী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
জামায়াতের সঙ্গে সখ্য
জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে বেশ সুসম্পর্ক আছে ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম হাজারীর। জামায়াতের কর্মসূচিতে বাধা দূরে থাক, প্রয়োজনে কর্মসূচি বাস্তবায়নে সার্বিক সহায়তা করেন তিনি। এ আলোচনা ফেনীর রাজনৈতিক অঙ্গনে শোনা যায়। স্থানীয় একজন আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, নিজাম হাজারী ব্যক্তিস্বার্থে জামায়াতের সঙ্গে অলিখিত সমঝোতা চুক্তি করে চলেন। ফেনী জেলা জামায়াতে ইসলামীর একাধিক মিছিল-মিটিংয়েও প্রকাশ্যে গুণগান গেয়েছেন জামায়াত নেতারা। গত কয়েক মাস আগে একটি মিছিলে এই রকম স্লোগানও দেওয়া হয় যে, ‘নিজাম হাজারী নাজেম ওসমানী (জামায়াতের জেলা আমির) ভাই ভাই, আর কারো রক্ষা নেই।’
অপর একটি সূত্র জানায়, ফেনী শহরের জামায়াতের তত্ত্বাবধায়নে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠান বলে পরিচিত শাহীন একাডেমিতে ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি ভবন করে দিয়েছেন নিজাম হাজারী। ওই ভবন উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বলা হয়, ‘নিজাম হাজারী গডফাদার নন, তিনি একজন গুডফাদার।’ গত বছরের ৫ মে হেফাজতে ইসলামের ঢাকা অভিমুখে লংমার্চ কর্মসূচিতে যাওয়ার জন্য ফেনী থেকে ৩৩টি বাস ঠিক করে দিয়েছিলেন নিজাম হাজারী।
দলে ভিড়াতে দলীয় নেতা-কর্র্মীদের ওপর হামলা-মামলা
জয়নাল হাজারী ফেনী আওয়ামী লীগের রাজনীতি থেকে সরে যাওয়ার পর পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ নিতে মরিয়া হয়ে ওঠেন নিজাম হাজারী। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে ছিলেন জয়নাল হাজারী। ওই পদটি এখন নিজাম হাজারীর কব্জায়। অথচ এর আগে কেন্দ্রীয় যুবলীগের একটি সদস্য পদ ছাড়া আওয়ামী লীগের রাজনীতির কোথাও দেখা যায়নি তাকে। এখানে প্রভাব-প্রতিপত্তি খাটানোর অভিযোগ তুলেছেন জেলার প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতারা। তারা বলেন, নিজাম হাজারী এককভাবে জেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছেন। জেলা, উপজেলা, থানা, ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে তিনি তার আস্থাভাজনদের বসিয়েছেন। এ ছাড়া জয়নাল হাজারীর সময়ে যারা ফেনী আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ছিলেন তাদের মধ্যে যারা নিজাম হাজারীর সঙ্গে যাননি তাদের ওপর একের পর এক অত্যাচার নির্যাতন চালানো হয়েছে।
জেলা যুবলীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক আইনজীবী এম শাহজাহান সাজুর ওপরও অত্যাচার ও নির্যাতন চালিয়েছে নিজাম হাজারীর লোকজন। দিনেদুপুরে সবার চোখের সামনে আগুন দেওয়া হয়েছে তার বাড়িতে। তালা ঝোলানো ও ভাঙচুর করা হয়েছে ফেনী শহরের লাভ মার্কেটে শাহজাহান সাজুর চেম্বারে। তার বাবা-মাকেও মারধর করা হয়। দাগনভূঞা উপজেলা নির্বাচনে নিজাম হাজারীর পছন্দের প্রার্থী দিদারুল কবিরের পক্ষে কাজ না করায় তার ওপর এই অত্যাচারের খড়গ নেমে আসে।
জয়নাল হাজারীর সমর্থক বলে পরিচিত আওয়ামী লীগের একটি অংশের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে এবং হামলা চালিয়ে নানাভাবে হয়রানি করেছেন নিজাম হাজারীর লোকজন। এর মধ্যে ফেনী জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ইমদাদুল হক মাসুদের ওপর ২০১০ সালে মার্চের ১০-১১ তারিখে ধারালো অস্ত্র নিয়ে হামলা চালায় মামুন, মাসুদ ও ফরমান। ধারালো অস্ত্রের আঘাতে মাসুদের মাথা ও হাতে মারাত্মক জখম হয়। পরে এ ঘটনায় উল্টো মামলা করে হামলাকারীরা। কিন্তু ইমদাদুল হকের পরিবার হামলাকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করতে গেলে তৎকালীন ফেনী সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আমিনুল ইসলাম তাদের ফিরিয়ে দেন। পরে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের দিয়ে চাপ প্রয়োগ করার পর ওসি মামলা নেন। ফেনীতে মামুন, মাসুদ ও ফরমান নিজাম হাজারীর ক্যাডার বাহিনীর সদস্য বলে পরিচিত। ওই ঘটনার পর ইমদাদুল হককে ব্যক্তিগতভাবে ডাকিয়ে নেন নিজাম হাজারীর। তিনি দলে তার সঙ্গে মিলে রাজনীতি করতে বলেন। কিন্তু ইমদাদুল হক নিজাম হাজারীর প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় পরে আরও একাধিক মামলায় আসামি করা হয় তাঁকে। এভাবে একের পর আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের নিজের আনুগত্য স্বীকার করাতে নানাভাবে হয়রানি করেছেন নিজাম হাজারী।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলা যুবলীগের সাবেক এক নেতা ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে আগের মতো সক্রিয় হওয়ার স্বপ্ন আর দেখি না। দলের জন্য করে কী লাভ বলেন? দল দল করতে গিয়ে আজ হামলা-মামলার শিকার হচ্ছি। এর চেয়ে রাজনীতি থেকে নীরবে দূরে সরে থাকাই ভালো।’
গত বছরের ২৬ অক্টোবর ঢাকার ফকিরাপুলে হোটেল আসরের সামনে থেকে নিখোঁজ হন সারোয়ার জাহান বাবুল। তার পর থেকে আর খোঁজ মেলেনি তার। বাবুলের পরিবারের অভিযোগ, বাবুল জয়নাল হাজারীর সঙ্গে রাজনীতি করত। এই অপরাধে জয়নাল হাজারীর প্রতিপক্ষরা তাকে গুম করিয়েছে।
গডফাদারের ভিড়ে একজন ‘গডমাদার’
একরামুল হক একরাম হত্যার ঘটনায় আবিদ গ্রেপ্তারের পর আলোচনায় আসেন তার মা মহিলা আওয়ামী লীগের জেলা সাধারণ সম্পাদক লায়লা জেসমিন বড়মনি। এত গডফাদারের ভিড়ে একজন গডমাদার তিনি। ২০১২ সালের সম্মেলনের আগে তিনি মহিলা আওয়ামী লীগের কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন না। তাকে হঠাৎ দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন করায় অনেকেই অসন্তুষ্ট। নিজাম হাজারীর মামি হওয়ায় সবাই তাকে সমীহ করে চলেন।
একদিকে ফুফাতো ভাই নিজাম হাজারী অন্যদিকে মা বড়মনির আশ্রয়-প্রশ্রয়ে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন আবিদ। দলীয় সূত্র জানায়, বড়মনির আচার-আচরণে দলীয় লোকজন বিরক্ত ও ক্ষোভেপুঁ ফুসলেও নিজাম হাজারীর ভয়ে কেউ এত দিন মুখ খোলেননি। জানা গেছে, বড়মণির বাবা আনসার বাহিনীতে চাকরির সুবাদে ফেনীর বাসিন্দা ছিলেন। তাদের আদি নিবাস সন্দ্বীপে। দীর্ঘদিন ফেনীতে চাকরির সুবাদে স্টেডিয়াম এলাকায় নিজের বাড়ি হয় মণির বাবার। ২০০২ সালের দিকে অসুস্থ হয়ে পড়েন স্বামী বাবর। দীর্ঘ ১০ বছর অসুস্থ থেকে বছরখানেক আগে মারা যান বাবর।
দলে পদ লাভের আগে থেকেই অর্থ আর ক্ষমতার লোভ পেয়ে বসে বড়মনি কে। এই পথে এগিয়ে যাওয়ার সিঁড়ি হিসেবে নিজের ছেলেদেরই ব্যবহার করতে শুরু করেন তিনি। তাদের তিনি ছেড়ে দেন সন্ত্রাস আর মাদক ব্যবসার অন্ধকার জগতে। একপর্যায়ে ফেনীতে ইয়াবা ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ চলে আসে মণির ছেলে আবিদের হাতে। স্টেডিয়াম পাড়ায় মা-ছেলেদের দাপটে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েন অনেক বড় বড় ব্যবসায়ী। ধীরে ধীরে আবিদের কুখ্যাতিও ছড়াতে থাকে। ছেলের এই বদনামকে বরং পুঁজি করে নেন মা। নিজেকে রাজনীতির মাঠে আরো শক্তিশালী করতে ছেলেকে ব্যবহার করতে থাকেন।
(ঢাকাটাইমস/ ৩১ মে/ এইচএফ/ জেডএ.)