ঢাকা: ছাত্রলীগ নেতাদের নেতৃত্বের বয়সসীমা বেঁধে দেওয়া আছে ২৯, থাকতে হবে ছাত্রত্ব আর অবিবাহিত। কিন্তু সংগঠনটির সভাপতি বদিউজ্জামান সোহাগ এবং সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলমের বয়স এরই মধ্যে বেঁধে দেওয়া সীমা পেরিয়ে গেছে। কিন্তু তারা এখনো আছেন নেতৃত্বে। এরা যখন নেতৃত্বে এসেছিলেন তখন তাদের বয়স ছিল সীমার মধ্যেই। কিন্তু সময়মতো সম্মেলন না হওয়ায় তাদের সেই বয়সসীমা পার হয়ে গেছে।
ছাত্রদলের অবস্থা আরও খারাপ। ছাত্রত্বের মেয়াদ শেষ বহু আগেই, বিয়ে করেছেন কেউ, কারও সন্তান স্কুলে যায়, তবু তারা ছাত্রদলের নেতৃত্বে। ছাত্রদলের সভাপতি আব্দুল কাদের ভুঁইয়া জুয়েল ১৯৮৭ সালে এসএসসি পাস করেন। তার বয়স এখন পঁয়তাল্লিশ পেরিয়েছে। তারই বন্ধু সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রশিদ হাবিব। তিনি দুই সন্তানের জনক। ছাত্রত্বের মেয়াদ শেষ হয়েছে ১০ বছর আগে।
ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে প্রায় এক বছর আগে। কিন্তু নতুন সম্মেলনের কোনো খোঁজ নেই। ছাত্রদলের কমিটি নিয়ে সংগঠনের মধ্যে আছে নানা ক্ষোভ। আর বিএনপির আন্দোলনে নেতা-কর্মীরা সক্রিয় না হওয়ায় খালেদা জিয়াও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন নেতাদের বিরুদ্ধে।
ছাত্রলীগের সম্মেলন কবে?
ছাত্রলীগের কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০১৩ সালের জুলাইয়ে। কিন্তু গত এক বছরেও সম্মেলনের কোনো উদ্যোগ নেয়নি সংগঠনটি। আপাতত নতুন কমিটি দেওয়ার কোনো পরিকল্পনাও নেই ক্ষমতাসীন দলের ভ্রাতৃপ্রতিম এ ছাত্র সংগঠনের। অভিযোগ রয়েছে, ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা পদ-পদবিকে কুক্ষিগত করে তদবির বাণিজ্য, ঠিকাদারি, চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন। সময়মতো সম্মেলন না হওয়ায় হতাশ হয়ে পড়ছেন সৎ, যোগ্য ও ত্যাগী নেতারা।
ছাত্রলীগের একাধিক নেতা জানান, পদ পাওয়ার পর রাতারাতি কোটিপতি বনে গেছেন অনেকে। ভেঙে পড়েছে শৃঙ্খলা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ডুয়েটসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও জেলা শাখার নেতা-কর্মীরা একের পর এক কোন্দলে জড়িয়ে পড়ছেন। আধিপত্য বিস্তার নিয়ে নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। সময়মতো সম্মেলন না হওয়ায় অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ও জেলা শাখা কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।
২০১১ সালের ১০ ও ১১ জুলাই কাউন্সিলের মাধ্যমে দায়িত্ব পায় বর্তমান কমিটি। সে সময় বদিউজ্জামান সোহাগ সভাপতি এবং সিদ্দিকী নাজমুল আলম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্রের ১১ (খ) ধারায় কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের কার্যকাল ২ বছর। উপরোক্ত সময়ের মধ্যে সম্মেলন আয়োজন করতে হবে। অন্যথায় নির্বাহী সংসদের কার্যকারিতা লোপ পাবে।
ছাত্রলীগের একটি সূত্র জানায়, এর আগের কমিটিও গঠনতন্ত্রের এ ধারাটি মানেনি। তখন থেকেই এ নিয়মটি চালু হয়। নির্ধারিত সময়ে কমিটি না হওয়ায় বয়স নির্ধারণের বেলায় সমস্যার সৃষ্টি হয়। তবে আওয়ামী লীগের হস্তক্ষেপের কারণে সময় নিয়ে শেষ পর্যন্ত আগের নিয়মটিই বহাল থাকে। আগের কমিটির মতো বর্তমান কমিটিও একই পথে হাঁটছে।
ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্রের ১১ (গ) ধারা অনুযায়ী বিশেষ বা জরুরি অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় কমিটির বর্ধিত সভায় অনুমোদন সাপেক্ষে কমিটির কার্যকাল তিন মাস বাড়ানো যাবে। ওই সভায় প্রতিটি সাংগঠনিক জেলার সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় সদস্যবৃন্দ যোগ দেবেন। গঠনতন্ত্রে এমন নিয়ম থাকলেও তা মানা হয়নি।
সম্মেলনের প্রাথমিক কাজগুলোও করা হয়নি। কোনো কাউন্সিল প্রস্তুতি বা উপ-কমিটি করা হয়নি। তবে জানতে চাইলে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি বদিউজ্জামান সোহাগ ঢাকাটাইসকে বলেন, ‘নেত্রী (শেখ হাসিনা) নির্দেশ দিলেই সম্মেলনের ব্যবস্থা করব আমরা।’ তিনি বলেন, ‘জেলা পর্যায়ে সম্মেলনগুলো হচ্ছে। এগুলো শেষে কেন্দ্রীয় সম্মেলন হবে।’
বাদ পড়ার আশঙ্কায় ক্ষোভ
ঠিক সময়ে সম্মেলন না হওয়ায় ছাত্রলীগের নেতাদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সংগঠনের মধ্যে শৃঙ্খলা ভেঙে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম তরিকুল ইসলাম বলেন, ‘ছাত্রলীগ একটি বড় সংগঠন। কিছু ছোটখাটো সমস্যা থাকবে। তবে কোনো নেতা-কর্মী সংগঠন পরিপন্থী কাজ করলে সাংগঠনিকভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ভবিষ্যতে আরো কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
ছাত্রদলের নেতৃত্ব নিয়ে সংগঠনে ক্ষোভ প্রকাশ্য
বর্তমান কমিটি গঠন করা হয়েছিল ২০১২ সালের ৪ সেপ্টেম্বর। সে হিসাবে আগামী ৪ সেপ্টেম্বর কমিটি গঠনের দুই বছর পূর্ণ হবে। ২০১২ সালের ৪ সেপ্টেম্বর আব্দুল কাদের ভূঁইয়া জুয়েলকে সভাপতি ও হাবিবুর রশিদ হাবিবকে সাধারণ সম্পাদক, বজলুল করিম চৌধুরী আবেদকে সিনিয়র সহ-সভাপতি, ওবায়দুল হক নাসিরকে সিনিয়র যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ও রাজীব আহসানকে সাংগঠনিক সম্পাদক করে খালেদা জিয়া পাঁচ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করেন।
সংগঠনটির গঠনতন্ত্রেও কমিটির মেয়াদ দুই বছরের জন্য বলা আছে। এই কমিটি নিয়ে ছাত্রদলে ক্ষোভের কারণ অন্য। কমিটির অনেক নেতার বয়স বেশি। ছাত্রত্ব টিকিয়ে রেখেছে তারা কোথাও নামমাত্র ভর্তি হয়ে। তাদেরকে সংগঠনের নেতা-কর্মীরাই আদুভাই বলে ডাকে।
কে কে আদুভাই?
ছাত্রদলের নেতৃত্বে এখন যারা আছেন তাদের অধিকাংশ আদুভাই হিসেবে পরিচিত। বিশেষ করে নরসিংদীর মনোহরদীর ছেলে ছাত্রদলের বর্তমান সভাপতি আব্দুল কাদের ভুঁইয়া জুয়েল ১৯৮৭ সালে এসএসসি পাস করেন। ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি এবং পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফাইন্যান্সে ভর্তি হন। কয়েক বছর পর বিশ্ববিদালয় থেকে ঝরে পড়েন। পরে টাঙ্গাইলের একটি কলেজ থেকে ডিগ্রি পাস করেন বলে জানা গেছে। একই সেশনে পাস করেন সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রশিদ হাবিব। মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল থেকে এসএসসি, ঢাকা সিটি কলেজ থেকে এইচএসসি ও ডিগ্রি এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি মাস্টার্স পাস করেছেন বলে জানা গেছে। তিনি আমেরিকার নাগরিক। দুই কন্যা সন্তানের জনক। বড় মেয়ে এসএসসি পাস করেছে। ছোটো মেয়ে দশম শ্রেণিতে পড়ে। এই দুই নেতার বয়সই ৪৫ বছরের বেশি। তাদের ছাত্রত্ব শেষ হয়েছে একযুগ আগে। কমিটির সিনিয়র সহ-সভাপতি বজলুল করিম চৌধুরী আবেদের বয়স চল্লিশোর্ধ্ব।
বর্তমান পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে সহ-সভাপতি করা হয়েছে ৩১ জনকে। ৩১ জনের সবার বয়স চল্লিশের ওপরে এবং সবাই বিবাহিত। সবাই ’৯০ থেকে ’৯৫ সালের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। এক যুগেরও বেশি সময় আগে তাদের ছাত্রত্ব শেষ হয়েছে। এসব নেতার অনেকের ছেলেমেয়েই এখন প্রাথমিক স্কুলের গ-ি পেরিয়ে মাধ্যমিকেও পড়ছে।
যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে ২১ জনকে। এরা সবাই ’৯৬ থেকে ’৯৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন এবং কারোরই ছাত্রত্ব নেই। এঁদের সবার বয়স এখন ৩৫ থেকে ৪০-এর মধ্যে, সবাই বিবাহিত। সহ-সাধারণ সম্পাদক ৩৪ জন। এরা ’৯৭ ও ’৯৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন, বয়স ৩২ থেকে ৩৩। কেউই নিয়মিত ছাত্র নন।
সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ৩৯ জন। এ ছাড়া বিভিন্ন সম্পাদকীয় পদে যারা রয়েছেন তাদেরও বয়স ৩০-এর ওপরে। ছাত্রদলের সবচেয়ে কম বয়সী নেতার বয়স ২৮। ২৯১ সদস্যের বর্তমান কমিটির মধ্যে ১৫০ জনই বিবাহিত এবং এর মধ্যে ১০০ জনের সন্তানরা এখন স্কুলে যায়। সেই অর্থে তাঁরা ছাত্রের বাবা। এদেরকেই ছাত্রদলের তৃণমূল কর্মীরা আদুভাই বলে ডাকেন।
এই আদুভাইদের সরিয়ে দিয়ে তরুণ ও নিয়মিত ছাত্রদের দিয়ে কমিটি গঠন করার দাবি ওঠছে ছাত্রদলে। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কাছেও পৌঁছেছে এই দাবি। ইতিমধ্যে তিনি ছাত্রদলের নতুন কমিটি গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন।
সংগঠনের কমিটি ১০১ সদস্যের হওয়ার কথা থাকলেও সবাইকে সমন্বয় করতে গিয়ে বর্তমান কমিটির পরিধি হয়েছে ২৯১ জনের। কিন্তু শেষ সময়ে সরকারের দমনপীড়ন ও গ্রেপ্তার আতঙ্কে নির্দিষ্ট কজন নেতাকর্মী ছাড়া বাকি কেউ মাঠে নামেনি।
সংগঠনটির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে অনেক নেতার মোবাইল ফোনই বন্ধ পাওয়া যায়। ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক মনিরুজ্জামান রেজিন এ বিষয়ে বলেন, সব কিছুই আমাদের চেয়ারপারসনের এখতিয়ার। কিন্তু এই কমাসে রাজপথের আন্দোলনে এমন কারও নাম আমার মনে পড়ছে না, যিনি পরবর্তী সময়ে নেতা হতে পারেন।
সরকারবিরোধী আন্দোলনে দলের প্রত্যাশা পূরণ করতে না পারায় বর্তমান কমিটির প্রতি বিরক্ত খালেদা জিয়া। সংগঠনের নেতাদের ডেকে নিয়ে তিনি তার ক্ষোভের কথা বলেছেন। কিন্তু ছাত্রদলের কর্মীরা বলছেন বিবাহিত, ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের নিয়ে সংগঠন করলে এমনই হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের জাফর নামে ছাত্রদলের এক কর্মী ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘ছাত্রদলকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে শক্ত অবস্থান তৈরি করতে হলে নিয়মিত ছাত্রদের নিয়ে কমিটি গঠন করতে হবে। অন্যথায় ছাত্রদল মাঠে আন্দোলন জমাতে পারবে না। সে জন্য এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে।’
কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের রিয়াদ নামে এক ছাত্রদল কর্মী জানান, ‘সরকারবিরোধী আন্দোলন চাঙ্গা করতে হলে নিয়মতি ছাত্রদের দিয়ে ছাত্রদলের কমিটি গঠন করতে হবে। অন্যথায় ছাত্রদল ঝিমিয়েই থাকবে।’
তবে বর্তমান কমিটিতে যারা আছেন তাদের মুখে ভিন্ন কথা। তারা চান এই কমিটি মেয়াদ পূর্ণ করুক। ছাত্রদলের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক বায়েজীদ আরেফিন বলেন, ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি আব্দুল কাদের ভূঁইয়া জুয়েল, সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রশিদ হাবিবসহ নেতারা গ্রেপ্তার হওয়ার পর কোনো নেতা-কর্মীই মাঠে নামেননি। আমরা কোনো নেতা-কর্মীকে খুঁজে পাইনি, যারা দায়িত্ব নিয়ে আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেন। দেখাতে পারেননি কেউ তাক লাগানো পারফরমেন্স, যা দিয়ে নেতা হতে পারেন।’
আরেফিন আরও বলেন, ‘যেখানে মূল দল বিএনপি ও অংগ সংগঠনের বাঘা বাঘা নেতা আন্দোলনে মাঠে নামেননি, সেখানে মাত্র এক বছরের কিছু বেশি বয়সী জুয়েল-হাবিবের নেতৃত্বে ছাত্রদলের কমিটির দোষ ধরা অবশ্যই উদ্দেশ্যমূলক।’
ছাত্রদলের দ্বিতীয় যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসান বলেন, কমিটি গঠনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন আমাদের নেত্রী খালেদা জিয়া। নেত্রীর কাছে আবেদন থাকবে বর্তমান কমিটি গঠনের পর থেকে আন্দোলনে যে সব নেতা ঝুঁকি ও সাহস নিয়ে মাঠে ছিলেন, তাদের মধ্য থেকেই যেন নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন করা হয়। তা হলে ছাত্রদলের মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা উৎসাহিত হবেন এবং নতুন উদ্যমে আন্দোলন-সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়বেন।’
(ঢাকাটাইমস/ ১ জুন/ এমএম/ জেডএ.)