ঢাকা : মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। আপিল বিভাগে শুনানি শেষ হয়েছে ফাঁসির দ-প্রাপ্ত আরেক নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর। ট্রাইব্যুনালে ফাঁসির রায় হয়েছে আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ এবং মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের। ট্রাইব্যুনালে শুনানি শেষে রায়ের অপেক্ষায় আছে দলের আমির মতিউর রহমান নিজামীর মামলা। দলের শীর্ষস্থানীয় দুই নেতা মীর কাসেম আলী এবং এ টি এম আজহারুল ইসলামের বিচারও চলছে।
মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর পর শুরু হওয়া যুদ্ধাপরাধের বিচার থেমে যায় ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান সরকারের আমলে যুদ্ধাপরাধীরা সরকার এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় উঠে আসে, এমনকি প্রধানমন্ত্রিত্বও পান স্বাধীনতার পর কারাবন্দি শাহ আজিজুর রহমান। মন্ত্রিত্ব পান মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আজীবন কারাদ- পাওয়া আবদুল আলীমসহ অন্যরা। রাজনীতি করার সুযোগ পায় মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দোসর জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম পার্টি, জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম, খেলাফত আন্দোলনের মতো দল।
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টির শাসনামলেও রাষ্ট্র পরিচালনার সুযোগ পায় স্বাধীনতাবিরোধী বেশ কয়েকজন নেতা। তার পতনের পর খালেদা জিয়ার শাসনামলে রাষ্ট্রপতি করা হয় আরেক স্বাধীনতাবিরোধী আবদুর রহমান বিশ্বাসকে। তবে ২০০১ সালে স্বাধীনতাবিরোধী দল জামায়াতের সঙ্গে জোট করে ক্ষমতায় এসে দলটিকে সরকারের অংশীদার করার পর তৈরি হওয়া জনক্ষোভের প্রভাব পড়ে ২০০৮ সালের নির্বাচনে। এই নির্বাচনের আগে যুদ্ধাপরাধের বিচারের অঙ্গীকার করায় আওয়ামী লীগের জয়ের পথ সুগম হয় বলেই ধারণা করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
নানা চড়াই উৎরাই শেষে কাদের মোল্লার রায় কার্যকরের পরও রয়ে গেছে সন্দেহ-অবিশ্বাস। দল হিসেবে জামায়াতের বিচার নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সাম্প্রতিক বক্তব্যের পর তৈরি হয়েছে ক্ষোভ।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামায়াতের বিচার শুরু হওয়ার কথা ছিল আগেই। ২০১৩ সালে ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধন করার পর সংগঠন হিসেবে জামায়াতের অপরাধের বিচারের উদ্যোগও নেওয়া হয়। জামায়াতের অপরাধের তদন্ত করে তার প্রতিবেদনও জমা পড়ে ট্রাইব্যুনালে।
কিন্তু সম্প্রতি আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানিয়েছেন, বিদ্যমান আইনে ট্রাইব্যুনালে জামায়াতের বিচার করা সম্ভব নয়। জাপান সফর শেষে ফিরে সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বলেন, জামায়াতের বিচার নিয়ে এত তাড়াহুড়া করার কিছু নেই, সময় মতোই হবে সব।
সরকারের হঠাৎ এই অবস্থান নিয়ে তৈরি হয়েছে বিতর্ক। জামায়াতের বিচার শুরু করার দাবিতে কর্মসূচিও পালন করেছে গণজাগরণ মঞ্চ। জামায়াতে ইসলামী সরকারের সঙ্গে কোনো ধরনের সমঝোতায় পৌঁছেছে কি না সে কথাও ছড়াচ্ছে।
তবে সরকারের নানা সূত্র বলছে, স্বাধীনতাবিরোধী দলটির বিচার সুবিধামতো শুরু করতে চায় সরকার। এতে তুরুপের তাস হিসেবে রেখে দিতে চায় সরকার। বিএনপি-জামায়াত জোটকে মোকাবিলায় সময় মতো এই অস্ত্র ব্যবহারের চিন্তা আছে।
নির্বাচনের সময় নির্দলীয় সরকারের দাবিতে বিএনপি-জামায়াত জোটের আন্দোলন মোকাবিলায় মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকে সামনে এনে কৌশলে সফল হয়েছিল সরকার। বিএনপি-জামায়াত আসলে যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করতে চায়Ñসরকারের এমন প্রচার দেশ-বিদেশে সফল হয় বলেই ধারণা করা হয়। আওয়ামী লীগের সূত্রগুলো জানিয়েছে, বিএনপি-জামায়াত জোট আবার আন্দোলনে নামলে অস্ত্র হিসেবে জামায়াতের বিচারকে ব্যবহারের চিন্তা আছে সরকারের।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেল হক ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘সরকারের কী চিন্তা বলতে পারব না, তবে আমি মনে করি জামায়াতের বিচার এখনই করা সম্ভব এবং তা করা উচিত।’
তবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে আন্দোলন করে আসা বিশিষ্টজনেরা সরকারের এই কৌশলকে ভালো চোখে দেখছেন না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, সরকার বলেনি যে তারা জামায়াতের বিচার করবে না। তারা বিচার করবে তবে সরকারের সময়মতো। তিনি আরো বলেন, জামায়াতের বিচার নিয়ে সরকার যে যুক্তি দিচ্ছে এটা কোনো যুক্তি নয়। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী রাজাকার আল-বদরদের অনেক সহ্য করা হয়েছে, আর নয়। আমরা চাই তাদের বিচার যেন দ্রুতই করা হয়।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ঢাকাটাইমসকে বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে যা-ই থাক না কেন তাদের নিষিদ্ধ করার জন্য বিদ্যমান সন্ত্রাসবিরোধী আইনই যথেষ্ট। তিনি বলেন, ‘সরকারের যদি আন্তরিকতা ও সদিচ্ছা থাকে তাহলে ট্রাইব্যুনাল আইনে যা-ই থাকুক না কেন সন্ত্রাসবিরোধী আইনে তাদের নিষিদ্ধ করা যায়।’
আইনমন্ত্রীর বক্তব্যের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘তিনি (আইনমন্ত্রী) যে বক্তব্য দিয়েছেন তাতে বোঝা যায় আইনটি তিনি ভালোভাবে পড়ে দেখেননি। আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনের ২০ ধারায় স্পষ্ট বলা আছে, যুদ্ধাপরাধের দায়ে সংগঠনের বিচার করা যাবে। যদি জামায়াতের বিচার সম্ভব না হতো তাহলে সরকারের আগের আইনমন্ত্রী (শফিক আহমেদ) কীভাবে বলেছিলেন বিচার সম্ভব?’
ট্রাইব্যুনালের রায়ে জামায়াতের যুদ্ধাপরাধের প্রসঙ্গ
জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের সব কটি মামলায় মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের ভূমিকার প্রসঙ্গ টেনেছেন বিচারক। জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের রায় ঘোষণার সময় ট্রাইব্যুনাল তার পর্যবেক্ষণে বলেছিল, জামায়াতে ইসলামী একটি ‘ক্রিমিনাল সংগঠন’। এখনো বাংলাদেশে জামায়াতের নেতৃত্ব দিচ্ছেন স্বাধীনতাবিরোধীরা। দলটি তাদের স্বাধীনতাবিরোধিতার অবস্থান থেকে সরে আসতে পারেনি। এখনো তারা বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী কর্মকা-ে লিপ্ত।
ট্রাইব্যুনাল আরও বলে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াত নেতারা ছিল নৃশংস ও বীভৎস। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জামায়াত পাকিস্তানি সেনাদের সহায়ক বাহিনী হিসেবে ভূমিকা পালন করে। জামায়াতের সদস্যরাই রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস, আল-মুজাহিদবাহিনী ও শান্তি কমিটির মতো সশস্ত্র আধা-সামরিক বাহিনী গঠন করে স্বাধীনতাকামী জনগণের ওপর উন্মত্তভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
এমন একটি সংগঠনের বিচার কেন করা যাবে নাÑজানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘এই বিষয়ে আমি একদম কোনো কথাই বলতে চাই না।’
জামায়াতের বাংলাদেশবিরোধী অবস্থান
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বাঙালি নিধনে উন্মত্তের মতো ঝাঁপিয়ে পড়া পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দোসর ছিল জামায়াত। নিজ দেশবাসী আক্রান্ত, অথচ জামায়াতের নেতা-কর্মীরা সর্বশক্তি দিয়ে নেমে যায় আক্রমণকারীদের সহযোগিতায়। দলীয় সিদ্ধান্ত নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করার আহ্বান জানিয়ে রেডিওতে ভাষণ দেন জামায়াতের সে সময়ের পূর্ব পাকিস্তান শাখার আমির গোলাম আযম। এরপর সমমনা দলগুলো ও জামায়াতকে নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী একের পর এক বৈঠক করে বাঙালি নিধনের পরিকল্পনা করে। মুক্তিবাহিনীকে দমনে গঠন করে রাজাকার, আল-বদরবাহিনী। মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে এসে বুদ্ধিজীবী হত্যায় মেতে উঠে জামায়াতের সে সময়ের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘ। মানবতাবিরোধী অপরাধে যাদের বিচার হচ্ছে তাদের বেশির ভাগই ছিলেন এই আল-বদরবাহিনীর সদস্য।
আর মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালি হত্যায় সহযোগিতার দায়ে স্বাধীন বাংলাদেশেও নিষিদ্ধ করা হয় দলটিকে। বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পর জিয়াউর রহমানের সরকার আবার জামায়াতকে রাজনীতিতে ফেরার সুযোগ করে দেয়। সেই সুযোগে গোলাম আযম ১৯৭৯ সালে দেশে ফিরে দলের আমিরের দায়িত্ব নেন। সামরিক শাসক এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে জামায়াত ১৮টি আসন পায় এবং সরকার গঠনে বিএনপিকে সমর্থন দেয়। এরপর ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আসন কমে তিনটি হলেও ২০০১ সালের নির্বাচনে জামায়াত পায় ১৭টি আসন। চারদলীয় জোট সরকারের মন্ত্রিসভায়ও জায়গা পান জামায়াতের শীর্ষ দুই নেতা। সর্বশেষ ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে দুটি আসন পায় জামায়াতে ইসলামী।
২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার রায়কে কেন্দ্র করে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের যাত্রা শুরু হয়। গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের মুখে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি সংবিধান সংশোধন করে ট্রাইব্যুনাল আইনে সংশোধনী আনে সরকার। এ সময় ব্যক্তির পাশাপাশি সংগঠন বা দলের বিচারের বিধান জুড়ে দেওয়া হয়। এর আগে যে বিধান ছিল সে অনুযায়ী সংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বিচার করার সুযোগ ছিল না।
গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম সংগঠক বাপ্পাদিত্য বসু ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘জামায়াতের বিচার নিয়ে আইনের যে দুর্বলতা আছে এটা এতদিন কেন সরকারের মাথায় আসেনি। আইনের সংশোধন যদি করা দরকার হয় তাহলেই চলতি সংসদ অধিবেশনে তা সংশোধন করে তাদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে।’
বাপ্পাদিত্য বসু বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালের আইনের কোথাও নেই সংগঠনের বিচার করা। কিন্তু তারপরও সেখানে বিচারকরা নাৎসী বাহিনীকে নিষিদ্ধ করেছিল।’
গত বছরের ১ আগস্ট রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধনকে অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্ট। ফলে দলীয় প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগও বাতিল করে দেয় নির্বাচন কমিশন। আপিল বিভাগে এখন চলছে সে মামলা।
বাংলাদেশে জামায়াতের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ কেবল ১৯৭১ সালে নয়, নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবিতে ১৮ দলীয় জোটের আন্দোলনের সময় দেশের বিভিন্ন এলাকায় যে নজিরবিহীন সন্ত্রাস হয়েছে, ভোট ঠেকাতে যাত্রীবোঝাই যানবাহনে আগুন, সরকারি সম্পত্তিতে হামলা, পুলিশের ওপর আক্রমণ, ভোটকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত স্কুল এবং স্বাস্থ্য কেন্দ্রে হামলার ঘটনায় দেশ-বিদেশে নিন্দনীয় হয়েছে বিএনপি-জামায়াত জোট। এসব হামলার ঘটনায় জামায়াতকে দায়ী করেছেন বিএনপির শীর্ষস্থানীয় একাধিক নেতা। আর এসব সহিংসতার জন্য বিএনপিকে জামায়াত ছাড়ার পরামর্শ দিয়েছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা এবং দাতা দেশগুলো।
আর আন্দোলনের নামে সন্ত্রাসের দায় অস্বীকার করেনি জামায়াত ও তার ছাত্র সংগঠন ছাত্রশিবির। বরং দেশের ৫৯০টি জায়গায় সহিংসতার কথা জানায় ছাত্রশিবির। আন্দোলন চলাকালে ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকু-ে একের পর এক গাড়িতে আগুন দেওয়ার দায় স্বীকার করেছেন জামায়াত নেতা সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ১৮ দলীয় জোটের সমাবেশে তিনি বলেন, সীতাকু-ের ঘটনা নমুনা মাত্র। তাদের দাবি না মানলে তাদের এই আগুন সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া হবে।
দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানিতে যেমন নাৎসী বাহিনীকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে তাদের অপরাধের জন্য তেমনিভাবে জামায়াতকেও নিষিদ্ধ করা হোক।
(ঢাকাটাইমস/ ০৭ জুন/ টিএম/ এআর/ ঘ.)