logo ০১ মে ২০২৫
নির্বাচনী বিরোধের মামলায় এবারও দীর্ঘসূত্রতা
বিলকিছ ইরানী, ঢাকাটাইমস
০২ জুন, ২০১৪ ২২:২২:১৭
image


ঢাকা: নবম সংসদ নির্বাচনের ফলাফল চ্যালেঞ্জ করে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের করা ১০টি মামলার মধ্যে সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে নিষ্পত্তি হয়েছে কেবল তিনটির। বাকি সাতটি মামলা নিয়েই শেষ করেছেন সংসদের মেয়াদ। চারজন আবার হয়েছেন পুনঃনির্বাচিত।

৫ জানুয়ারি দশম সংসদ নির্বাচনের পরও এ মামলাগুলো পড়ে গেছে দীর্ঘসূত্রতায়। প্রায় ছয় মাস হয়ে গেলেও এর মধ্যে কেবল দুটি মামলা খারিজ হয়েছে। বাকিগুলো কোন পর্যায়ে আছে তা জানাতে পারেনি নির্বাচন কমিশন। এসব নির্বাচনী বিরোধ নিয়ে করা মামলাগুলো নিষ্পত্তিতে কমিশনের কোনো ভূমিকা থাকে না। মামলায় কমিশনকে বিবাদী করা হলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা মামলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত নেয়, কোনোটাতে নেয় না।

জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার মো. আবু হাফিজ ঢাকাটাইমসকে বলেন, মামলার বিষয়টি দেখছে হাইকোর্ট। কখনো সময় চান বিবাদী, কখনো বাদী। হাইকোর্ট তার নিয়ম অনুযায়ী তাদের সময় দেয়, এভাবে একটা মামলা শেষ করতে অনেক সময় লেগে যায়। হাইকোর্ট যেভাবে বলবে সেভাবেই হবে। এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের কোনো এখতিয়ার নেই।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার ঢাকাটাইমসকে বলেন, নির্বাচনী বিরোধ নিয়ে মামলা সময় মতো শেষ না হওয়া একটা রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনটা চলতে থাকলে নির্বাচনে কারচুপি ঠেকানো যাবে না। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের উদ্যোগী হতে হবে।

স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত নির্বাচনের ফলাফলের বিরুদ্ধে মামলা করে সংসদে বসেছেন দুইজন। একজন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এবং অপরজন মাহমুদুল হাসান। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের বর্তমান নেতা ও তখন ন্যাপ (মোজাফফর) নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ১৯৭৩ সালে প্রথম সংসদ নির্বাচনের ফল চ্যালেঞ্জ করে মামলাটি করেন। দ্বিতীয়বার এই ঘটনা ঘটতে লেগে যায় প্রায় চার দশক। নবম সংসদ নির্বাচনের ফলাফলে বিএনপি নেতা মাহমুদুল হাসান হারার পর মামলা করে তিনি ওই সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। গত মেয়াদে আরও একটি মামলার ফয়সালা হয়, ভোলা-৩ আসনের ফলাফলের বিরুদ্ধে মামলা করে জিতেন বিএনপি নেতা হাফিজউদ্দিন আহমেদ। তবে তিনি সংসদে বসতে পারেননি। আবার নির্বাচন হওয়ার পর হেরে যান তিনি।

বিএনপি-জামায়াতের বর্জনের মুখে দশম সংসদ নির্বাচনেও অনিয়মের অভিযোগ ওঠে বেশ কয়েকটি নির্বাচনী এলাকায়। এর মধ্যে একটি পাবনা-১ (সাঁথিয়া-বেড়া) আসন। এই আসন থেকে লড়াই করেন সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু এবং সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক আবু সাইয়িদ। শামসুল হক টুকু মনোনয়ন পান আওয়ামী লীগ থেকে আর আবু সাইয়িদ দাঁড়ান স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে।

ভোটের দিন কারচুপির অভিযোগ ওঠে টুকুর সমর্থকদের বিরুদ্ধে। ভোট কেন্দ্র দখল করে সিল মারা, আবু সাইয়িদের সমর্থকদের ভোট কেন্দ্রে যেতে বাধা দেওয়াসহ নানা অভিযোগ ওঠে। ফলাফল প্রকাশের পর দেখা যায়, আবু সাইয়িদের তুলনায় বেশি ভোট পেয়েছেন টুকু। কিন্তু এই ফল মানতে পারেননি আবু সাইয়িদ। নির্বাচনের ফলাফলের বিরুদ্ধে মামলা করেন তিনি। নির্বাচন কমিশন এই মামলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

মামলাটি এখন কোন পর্যায় আছে জানতে চাইলে আবু সাইয়িদ ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘তিনি (টুকু) মামলাটি বারবার বিলম্বিত করার চেষ্টা করছেন। তিন বার তারিখ নিয়েছেন।’ এ বিষয়ে শামসুল হক টুকুর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি তাকে।

দশম সংসদ নির্বাচনের ফলাফলের বিরুদ্ধে করা আরও ১৪টি মামলার মধ্যে দুটি খারিজের তথ্য পাওয়া গেছে। বাকিগুলোর বিষয়ে নির্বাচন কমিশনে কোনো তথ্যও নেই।

অন্য যে সব মামলা

কুড়িগ্রাম-৪ আসন থেকে আওয়ামী লীগের পরাজিত প্রার্থী জাকির হোসেন মামলা করেন বিজয়ী প্রার্থী জাতীয় পার্টির (জেপি) রুহুল আমিনের বিরুদ্ধে।

নির্বাচন কমিশনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী এ আসনের দুটি কেন্দ্র্রে ১৬ জানুয়ারি আবার ভোট নেয় নির্বাচন কমিশন। এই পুনঃভোটের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করেন জাকির হোসেন। তার আবেদনের পর সিদ্ধান্ত চার সপ্তাহের জন্য স্থগিত করে হাইকোর্ট। পরে নির্বাচন কমিশন আপিল করলে স্থগিতাদেশের আদেশ স্থগিত করে আপিল বিভাগ। পরে হয়  পুনঃভোট।

ব্রাক্ষণবাড়িয়া-২ আসনে বিজয়ী জাতীয় পার্টির জিয়াউল হক মৃধার বিরুদ্ধে মামলা করেন পরাজিত স্বতন্ত্র প্রার্থী নায়ার কবির । নায়ার কবির মামলায় নির্বাচন বাতিলের দাবি করেন। এই মামলাটির কোনো অগ্রগতি নেই।

মাগুরা-১ আসনে আওয়ামী লীগের বিজয়ী প্রার্থী সিরাজুল আকবরের বিরুদ্ধে মামলা করেন স্বতন্ত্র প্রার্থী কুতুবুল্লাহ হোসেন মিয়া। নির্বাচন বাতিল করে এই আসনে পুনঃনির্বাচনের দাবি করেছেন কুতুবুল্লাহ হোসেন।

সাতক্ষীরা-১ আসনে বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির বিজয়ী প্রার্থী মুস্তফা লুৎফুল্লার নির্বাচন বাতিল ও নিজেকে সংসদ সদস্য ঘোষণার দাবি করে মামলা করেন পরাজিত স্বতন্ত্র প্রার্থী এস এম মুজিবুর রহমান।

নরসিংদী-২ আসনে নির্বাচন বাতিল চেয়ে বিজয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থী কামরুল আশরাফ খানের বিরুদ্ধে মামলা করেন জাসদের পরাজিত প্রার্থী জায়েদুল কবির।

লক্ষ্মীপুর-৪ আসনে বিজয়ী আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবদুল্লাহর বিরুদ্ধে মামলা করেন পরাজিত স্বতন্ত্র প্রার্থী আজাদ উদ্দিন চৌধুরী। মামলায় নির্বাচন বাতিল চেয়ে পুনঃনির্বাচনের দাবি করেছেন আজাদ চৌধুরী।

ব্রাক্ষণবাড়িয়া-৩ আসনে বিজয়ী আওয়ামী লীগের র আ ম উবায়দুল মোক্তাদির চৌধুরীর নির্বাচন বাতিল করার আবেদন জানিয়ে মামলা করেন পরাজিত জাতীয় পার্টির (জেপি) প্রার্থী ফরিদ আহমেদ।

নাটোর-১ আসনে এবার জিতেছেন আবুল কালাম। নির্বাচন বাতিলের দাবি জানিয়ে মামলা করেছেন পরাজিত প্রার্থী আবু তালহা। এই মামলায় নির্বাচন কমিশনকে বিবাদী করা হলেও কমিশন প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

গাইবান্ধা-৪ আসনে জিতেছেন আওয়ামী লীগের মনোয়ার হোসেন চৌধুরী। এই ফলাফল মেনে নিতে পারেননি প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী আবুল কালাম আজাদ। নির্বাচন বাতিল চেয়ে মামলা করেছেন তিনি।

লক্ষ্মীপুর-১ আসনের নির্বাচন বাতিল চেয়ে মামলা করেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী শফিকুল ইসলাম। এই আসনে জিতেছেন বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের প্রার্থী এম এ আউয়াল।

বগুড়া-৫ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছেন হাবিবর রহমান। তার নির্বাচিত হওয়া বাতিল চেয়ে ওই ভোট দেওয়ার দাবিতে মামলা করেছেন প্রার্থিতা বাতিল হওয়া জাতীয় পার্টির নেতা তাজ মোহাম্মদ শেখ।

দুই মামলা খারিজ

নির্বাচনী বিরোধ নিয়ে করা মামলাগুলোর মধ্যে দুটি খারিজ হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। এর একটি ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ এবং অন্যটি ময়মনসিংহ-৯ আসন।

ব্রাক্ষণবাড়িয়া-৪ আসন থেকে এবার আনিসুল হক জিতেছেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। তার নির্বাচিত হওয়াকে অবৈধ দাবি করে মামলা করেন খন্দকার হেবজুর রহমান নামে একজন।

জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ঢাকাটাইমসকে বলেন, গত ১৭ মে মামলাটি খারিজ করে দিয়েছে হাইকোর্ট।

ময়মনসিংহ-৯ আসন থেকে এবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছিলেন সাবেক সংসদ সদস্য আবদুস সালাম। ঋণ খেলাপির অভিযোগে তার মনোনয়নপত্র বাতিল করেন রিটার্নিং কর্মকর্তা। আর ওই আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন আনোয়ারুল আবেদীন খান তুহিন। এই ফলাফল বাতিল চেয়ে মামলা করেন আবদুস সালাম।

কমিশনের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করায় কমিশন মামলাটি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত নেন। গত ২৪ এপ্রিল মামলাটি খারিজ হয়ে যায়।

উপজেলা নির্বাচনের মামলার তথ্য জানে না নির্বাচন কমিশন

সদ্য সমাপ্ত উপজেলা নির্বাচনে ৫০টিরও বেশি উপজেলায় কারচুপির অভিযোগ উঠেছে। এসব অভিযোগে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর মতো ঘটনাও ঘটেছে। বেশ কিছু ক্ষেত্রে নির্বাচনী কর্মকর্তাদের কাছে লিখিত অভিযোগও করা হয়েছে। কিন্তু তাৎক্ষণিক কোনো ব্যবস্থা নেননি নির্বাচনী কর্মকর্তারা।

এত অনিয়মের অভিযোগ থাকলে নির্বাচনের ফলাফলের বিরুদ্ধে বেশ কিছু এলাকায় মামলা হওয়া স্বাভাবিক বলে মনে করছেন নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা। তবে কোথায় কোথায় মামলা হয়েছে তার কোনো তথ্য নেই কমিশনে। জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনের একজন কর্মকর্তা ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘কোথাও ফলাফলের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে কি না তা জানতে জেলার রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে চিঠি দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। কিন্তু এখনো জবাব আসেনি।’

(ঢাকাটাইমস/ ০২ জুন/ ইরা/ এআর/ ঘ.)