logo ০১ মে ২০২৫
চেয়ারপারসনের জেলা ফেনীতেই কূলহারা বিএনপি
হাবিবুল্লাহ ফাহাদ, ফেনী থেকে ফিরে
১৫ জুন, ২০১৪ ২২:২৪:৪০
image

ঢাকা: ‘শুধু চেয়ারপারসনের (খালেদা জিয়া) জেলা বলে কোনো গ্রুপিং করি না। নেত্রীর সম্মানের কথা চিন্তা করি। কিন্তু গ্রুপিং করলে ফেনীতে বিএনপি আরও শক্তিশালী হতো। জেলার ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সাংগঠনিক দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন আছে? এত অথর্ব-অদক্ষদের দিয়ে কি আর দল চলে?’ বলছিলেন ফেনী জেলা বিএনপির একজন নেতা। তবে জেলার সাধারণ সম্পাদক জিয়াউদ্দিন মিস্টারের দাবি, ফেনী বিএনপি অধ্যুষিত একটি জেলা। এখানে দলের মধ্যে কোনো বিভাজন নেই। যা আছে তাকে নেতৃত্বের লড়াই বলে মন্তব্য করেন তিনি।


বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নিজ জেলা ফেনীতে বিএনপির রাজনীতি চলছে ধুঁকে ধুঁকে। ওই অর্থে রাজনৈতিক কোনো তৎপরতা নেই। কেন্দ্র থেকে কোনো কর্মসূচি ঘোষণা হলে কেবল তাই বাস্তবায়ন করা হয়। তাও দায়সারাভাবে। এ নিয়ে জেলা কমিটির অন্য পদের নেতা এবং তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ বাসা বেঁধেছে। জেলার বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।


বিএনপির স্থানীয় সূত্র জানায়, জেলা কমিটির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকের ওপর খুশি নন দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা। তাদের অভিযোগ, জেলার শীর্ষ এই নেতারা জেলা আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে অলিখিত আপস করে রাজনীতি করছেন। যারা আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে আপসে রাজি নন তাদের বিররুদ্ধে মামলা-হামলা করে হয়রানি করা হচ্ছে। অথচ এখন পর্যন্ত কোনো ঘটনায় জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে একটি মামলাও হয়নি, অন্য নেতাদের বিরুদ্ধে ২০টির বেশি মামলা হয়েছে। এসব কারণে জেলা বিএনপিতে দেখা দিয়েছে বিভক্তি।


২০০৯ সালের নভেম্বরে ফেনী জেলা বিএনপির কমিটি গঠন করা হয়। নিয়ম অনুযায়ী তিন বছর পর সম্মেলন হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। যে কারণে মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও পুরনো কমিটি দিয়ে চলছে সংগঠনটি। নতুন নেতৃত্ব আসার সুযোগ তৈরি হচ্ছে না। বিএনপির টালমাটাল রাজনীতির পেছনে এটিও একটি কারণ বলে দাবি করছেন তৃণমূলের নেতারা। তারা এখন তাকিয়ে আছেন নতুন কমিটির দিকে। নতুন কমিটিতে দলের জন্য যারা ত্যাগ স্বীকার করেছেন তাদের ঠাঁই হবে- এমনটা আশা করছেন তারা। বিএনপির কেন্দ্রীয় সূত্র জানায়, সংগঠনকে চাঙ্গা করতে যে কয়েকটি জেলায় শিগগির আহ্বায়ক কমিটি করার চিন্তা করা হচ্ছে ফেনী এর মধ্যে অন্যতম।


জানতে চাইলে জেলা বিএনপির প্রচার সম্পাদক গাজী হাবীবুল্লাহ মানিক ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকম  বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি আমি। আমার ওপর হামলা-মামলা বেশি হয়েছে। এ পর্যন্ত আমার বিরুদ্ধে দুই ডজনের বেশি মামলা হয়েছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আমাদের মিছিলে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা হামলা করেছে। আবার উল্টো আমাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। তাতে আমাকে প্রধান আসামি করা হয়েছে। কিন্তু আসামিদের তালিকায় জেলা বিএনপির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক কেউ নেই।’


তবে জেলা বিএনপির সভাপতি আবু তাহের ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘ফেনী বিএনপিতে কোনো দ্বন্দ্ব নেই। যারা এসব কথা বলে তারা বিএনপির কেউ না। আমরা সবাই মিলে মিশেই রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করছি।’  


জানতে চাইলে সাধারণ সম্পাদক জিয়াউদ্দিন মিস্টার বলেন, ‘আমি সন্ত্রাসী কায়দায় রাজনীতি করতে পছন্দ করি না। আমি শান্তিপ্রিয় মানুষ। কারো ওপর হামলা-মামলায় আমি নেই। তাই হয়ত আমাকে কোথাও জড়ানোর সুযোগ পায়নি।’


নিজাম হাজারীর সঙ্গে সখ্য


স্থানীয় সূত্র জানায়, ফেনী বিএনপির শীর্ষ নেতাদের কয়েকজন স্থানীয় আওয়ামী লীগের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখেন। এটি রাজনৈতিক কারণে নয়, বরং গা বাঁচানোর কৌশল হিসেবে। এখানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাংসদ নিজাম উদ্দিন হাজারীর সঙ্গে জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের অলিখিত সমঝোতা চুক্তি আছে। যে কারণে বিগত সময়ে সরকারবিরোধী আন্দোলনে ফেনী বিএনপির তেমন কোনো কর্মসূচি দেখা যায়নি। নামকাওয়াস্তে মিছিল-সমাবেশ হয়েছে। তবে ১৯ দলের শরিক দু-একটি দল আলাদাভাবে কর্মসূচি পালনের চেষ্টা করেছে।


সূত্র জানায়, নিজাম হাজারীর সঙ্গে জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জিয়াউদ্দিন মিস্টারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। নিজাম হাজারীর সঙ্গে পরামর্শ না করে মিস্টার কোনো কর্মসূচিই পালন করেন না। তবে জিয়াউদ্দিন দাবি করেন, তার সঙ্গে নিজাম হাজারীর কোনো ধরনের আঁতাত নেই। তিনি ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘নিজাম হাজারীর সঙ্গে আপসের প্রশ্নই আসে না। তিনি যে রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী আমি তার উল্টো। তবে নিজাম হাজারীর বাবার সঙ্গে আমার বাবার ঘনিষ্ঠতা ছিল। তারা একসঙ্গে ওঠাবসা করতেন। সেই হিসেবে দুই পরিবারের মধ্যে প্রায় ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে সুসম্পর্ক আছে। এর বেশি কিছু নয়।’


বিএনপির একটি সূত্র জানায়, নিজের জেলা ফেনীতে বিএনপির এই দুরাবস্থার কথা খালেদা জিয়া পুরোপুরি জানেন। তিনি এনিয়ে একাধিকবার জেলার শীর্ষ নেতাদের শাসিয়েছেন। এ ছাড়া দলের ফোরামেও একাধিকবার আলোচনা হয়েছে।


উপজেলা নির্বাচনে ফলাফল শূন্য


সম্প্রতি শেষ হওয়া উপজেলা নির্বাচনেও দুমড়ে-মুচড়ে গেছে বিএনপি। ফেনীর ছয়টি উপজেলার একটিতে জিততে পারেননি বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা। উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী ছিলেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এমন একজন নেতা ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘নির্বাচনের সময় স্থানীয় নেতাদের কাউকেই পাশে পাওয়া যায়নি। আমাদের চোখের সামনে আওয়ামী লীগের লোকজন ভোট জালিয়াতি, কেন্দ্র দখল করেছে। অথচ দলের নেতা-কর্মীরা এক হয়ে কাজ না করায় প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায়নি।’


স্থানীয় বিএনপি নেতারা বলেন, উপজেলা নির্বাচনে দলীয় সমর্থন পাওয়া নিয়েও বাণিজ্য হয়েছে। কেন্দ্রের সুবিধাভোগী নেতাদের হাত করে অনেকে জোর করে কেন্দ্রের সমর্থন নিয়েছেন। অথচ তাদের পেছনে তৃণমূলের কোনো সমর্থন ছিল না। তৃণমূলের মত ছিল যাদের পক্ষে তাদের মনোনয়ন না দেওয়ায় অনেকের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। সেই কারণেই নির্বাচনী মাঠে পাওয়া যায়নি কাউকে।


তবে জেলার সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘নির্বাচনের আগের দিন রাতে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা ব্যালট পেপারে সিল মেরেছে। ভোটের দিন কেন্দ্র দখলে নিয়েছে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে লোকজনদের শাসিয়েছে। বিএনপি নেতা-কর্মীদের বাসায় হামলা করে এলাকা ছাড়া করেছে। তাদের সঙ্গে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতা ছিল বলে প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায়নি।’


 নতুন কমিটিতে পদ পেতে দৌড়ঝাঁপ


নিয়ম অনুযায়ী এক বছরেরও বেশি সময় আগে শেষ হয়েছে ফেনী জেলা বিএনপির কমিটির মেয়াদ। কিন্তু এখনো নতুন কমিটির মুখ দেখছে না দলটি। এ নিয়ে নেতৃত্ব পেতে ইচ্ছুক নেতাদের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব দিন দিন জোরালো হচ্ছে। তবে শিগগির কমিটি করে দেয়া হবে কেন্দ্রের এমন আশ্বাসে পদ পেতে ভেতরে ভেতরে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মী। তৃণমূলের সঙ্গে সম্পর্ক করে সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করছেন তারা। আবার কেন্দ্রের নীতিনির্ধারণী মহলেও যোগাযোগ রাখছেন নিয়মিত।


বিএনপির সূত্র জানায়, জেলা বিএনপির সভাপতি পদে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুল আউয়াল মিন্টু, মোশাররফ হোসেন ও অধ্যাপক জয়নাল আবেদিনের নাম জোরেশোরে উঠে আসছে। ব্যক্তিগতভাবে এই নেতারা স্থানীয় পর্যায়ে তৃণমূলের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করছেন। অন্যদিকে সাধারণ সম্পাদক পদে জেলার প্রচার সম্পাদক গাজী হাবীবুল্লাহ মানিক, সহ-সভাপতি এবং ফেনী সদর বিএনপির সভাপতি সৈয়দ মিজানুর রহমান, যুগ্ম সম্পাদক মনোয়ার হোসেন দুলাল এবং সাংগঠনিক সম্পাদক মেসবাহ উদ্দিনের নাম উঠে আসছে। পদ পেতে এরই মধ্যে দৌড়ঝাঁপও শুরু করেছেন তারা। তবে জেলার বর্তমান সাধারণ সম্পাদক জিয়াউদ্দিন মিস্টার ফের সাধারণ সম্পাদক হতে ইচ্ছুক নন বলে ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে  জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমার আর সাধারণ সম্পাদক হওয়ার ইচ্ছা নেই। এত দিন দলের দুর্দিন ছিল, আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, আমি পালন করেছি। আগামী দিন বিগত সময়ের মতো কঠিন হবে না। তাই জেলা কমিটিতে একটি সদস্য পদ পেলেই আমি খুশি।’


জানতে চাইলে গাজী হাবীবুল্লাহ মানিক বলেন, ‘বিগত সময়ে সরকারবিরোধী আন্দোলনে আমার অগ্রণী ভূমিকার কথা বিএনপির তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের জিজ্ঞেস করলেই শুনবেন। জেলার শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ওই অর্থে ভালো নয়। কারণ তাদের অভিযোগ, আমি তৃণমূলের মতামতের ভিত্তিতে রাজনীতি করি, তাদের কথা শুনি না। তবে বিএনপি করার কারণে আমি গত পাঁচ বছরে যেভাবে হয়রানির শিকার হয়েছি অতীতে কারো বেলায় এমনটি হয়েছে কি না জানা নেই। নেত্রী আমার বিষয়টি মূল্যায়ন করবেন বলে আমি আশাবাদী।’


দলে বিভেদ যেখানে...


ফেনী জেলা বিএনপির মধ্যে বিভেদের বিষয়টি অনেক আগে থেকেই চলে আসছে। এখানে একটি অংশ জেলার সাবেক সভাপতি ও খালেদা জিয়ার ভাই প্রয়াত সাঈদ এস্কান্দারের সমর্থক। যাদের ধরে রেখেছেন সাবেক সংসদ সদস্য রেহানা আক্তার রানু। জেলা বিএনপির বিভিন্ন কার্যক্রমে এই অংশের প্রভাব-প্রতিপত্তি বেশি। চেয়ারপারসনের ঘনিষ্ঠ পরিচয়ে রানু এলাকায় নিজের অবস্থান ধরে রেখেছেন কৌশলে।


নাম প্রকাশ অনিচ্ছুক জেলার এক নেতা বলেন, ‘বিগত সংসদ নির্বাচনের আগে খালেদা জিয়া ফেনীতে এসেছিলেন। তাঁর আগমন উপলক্ষে একটি সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছিল। নেত্রী আসার আগে সমাবেশ মঞ্চে রানু ওঠার পর বিএনপির নেতা-কর্মী-সমর্থকদের একটি অংশ তাকে লক্ষ্য করে জুতা ছুড়েছিল। রানু ফেনী বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থানকে শক্তিশালী করতে কোনো ভূমিকা রাখেননি। বরং চেয়ারপারসনের ঘনিষ্ঠ পরিচয় দিয়ে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছেন।’


বিএনপির অপর অংশটি সাবেক জেলা সভাপতি মোশাররফ হোসেন ও জয়নাল আবেদিনের (ভিপি জয়নাল) নেতৃত্বাধীন। জেলা-উপজেলা কমিটিতে এ অংশের কেউ না থাকায় তারা সক্রিয় হতে পারছেন না।


গতি নেই সহযোগী অঙ্গসংগঠনগুলোরও


চার বছর আগে জেলা ছাত্রদলের কমিটি গঠনের পর থেকে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এখানে তাঁরা দুজন এক হয়ে কর্মসূচি পালন করেছেন খুবই কম। সর্বশেষ আওয়ামী লীগ নেতা একরাম হত্যার পর এক সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রদলের সভাপতি আমানউদ্দিন কায়সার সাব্বির এবং সাধারণ সম্পাদক নঈমুদ্দিন চৌধুরীকে একসঙ্গে দেখা গেছে বলে মন্তব্য করেছেন ছাত্রদলের নেতারা। 


সূত্র জানায়, আমানউদ্দিন কায়সার সাব্বির সভাপতি হওয়ার পর থেকে নঈমুদ্দিন চৌধুরীর যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। সংবাদ সম্মেলন করে তিনি বলেন, নঈমুদ্দিনসহ আরও কয়েকজনকে কমিটি থেকে বাদ দিতে হবে। না হলে তিনিই কমিটি থেকে পদত্যাগ করবেন। এ ঘটনার পর থেকেই ফেনীতে ছাত্রদল সক্রিয় হতে পারেনি। একই অবস্থা যুবদলসহ অন্য অঙ্গসংগঠনগুলোরও।


(ঢাকাটাইমস/১৫জুন/ এএসএ)