logo ০১ মে ২০২৫
সাত খুনের মামলা
তদন্ত সহজ করে দিল তিনজনের স্বীকারোক্তি
মহিউদ্দিন মাহী,ঢাকাটাইমস
২১ জুন, ২০১৪ ১২:৪১:২৬
image


নারায়ণগঞ্জ: নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের মামলায় দায় স্বীকার করে র‌্যাবের সাবেক দুই কর্মকর্তা এম এম রানা ও আরিফ হোসেনের পর এবার দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিলেন র‌্যাব-১১-এর সাবেক অধিনায়ক তারেক সাঈদও। এই স্বীকারোক্তির পর সাত খুনের মামলার রহস্য উন্মোচনের পথে অনেকটাই এগিয়ে গেল তদন্ত সংস্থা। ভারতের কলকাতায় আটক নূর হোসেনকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারলেই প্রতিবেদন দেওয়া সহজ হয়ে যাবে বলে মনে করছেন তারা।

নূর হোসেনকে কোনো কারণে দেশে আনতে দেরি হলে ভারতে গিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের সুপারিশ করেছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার খন্দকার মহিদ উদ্দিনও বলেছেন, প্রয়োজনে নূর হোসেনকে জিজ্ঞাসাবাদে তারা ভারতে লোক পাঠাবেন।

গত ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ থেকে অপহৃত হন সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজন। এর তিন দিন পর ৩০ এপ্রিল ছয়জনের ও পরদিন আরেকজনের লাশ পাওয়া যায় শীতলক্ষ্যা নদীতে।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের মামলা তদন্তের বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে এখন পর্যন্ত ৩২ জনের নাম এসেছে। তবে এদের সবাই অপহরণ-খুনের সঙ্গে যুক্ত নন। নূর হোসেনের কাছ থেকে নিয়মিত টাকা নিতেন এমন ৮ রাজনীতিবিদ, পুলিশ, প্রশাসনের কর্মকর্তার নামও রয়েছে এই তালিকায়। র‌্যাবের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নামও আলোচনায় এসেছে।

সাত খুনের মামলার তিন আসামি র‌্যাব-১১-এর সাবেক অধিনায়ক তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, আরিফ হোসেন ও এম এম রানার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে দেওয়া তথ্য এবং আটক নূর হোসেনের ঘনিষ্ঠজনদের জিজ্ঞাসাবাদ করে এসব নাম পেয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।

তদন্তকারীরা বলছেন, সরাসরি অপহরণ ও খুনের সঙ্গে জড়িত র‌্যাবের ১৮ জন। একজন কর্মকর্তা বলেছেন, তারা শুধু খুনের সঙ্গে যুক্তদের ব্যাপারে তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করছেন। নূর হোসেন যাদের টাকা দিতেন বা যারা নূর হোসেনের কাছ থেকে সুবিধা নিতেন, তাদের ব্যাপারে পুলিশ ও সরকারের উচ্চপর্যায়কে অবহিত করা হয়েছে। এ রকম ১০-১২ জনের সঙ্গে খুনের মামলার সম্পর্ক নেই। এরা নূর হোসেনের অবৈধ টাকার ভাগ পেতেন।

সাতজনকে অপহরণের পর পরই নজরুলের স্ত্রী সেলিনা হোসেন অভিযোগ তুলেছিলেন নূর হোসেনের বিরুদ্ধে। আর শুরু থেকেই অভিযোগের তীর ছোড়া হয় র‌্যাবের বিরুদ্ধেও। কারণ সাতজনকে তুলে নেওয়া সাধারণ কোনো সন্ত্রাসীদের পক্ষে সম্ভব কি না তা নিয়ে কথা উঠে শুরুতেই।

এই খুনের শুরু থেকেই র‌্যাবের বিরুদ্ধে উঠে অভিযোগ। এ বাহিনীর সূত্র নিশ্চিত করেছে যে, নারায়ণগঞ্জে র‌্যাব-১১-এর কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ সম্পর্কে শুরুতেই জানতে পারে সদর দপ্তর। আর অভিযোগ পেয়েই র‌্যাব-১১-এর অধিনায়ক তারেক সাঈদ, দুই কর্মকর্তা আরিফ হোসেন এবং এম এম রানাকে বরখাস্ত করা হয়। এরপর গ্রেপ্তারও হন তারা। কয়েক দফা রিমান্ড শেষে নিজেদের দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দিও দেন তারা।

হাকিম আদালতে দেওয়া এই জবানবন্দি গোপনই ছিল। তবে ফাঁস হয়ে গেছে কিছু কিছু বিষয়। নারায়ণগঞ্জ আইনজীবী সমিতির সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন নিশ্চিত করেছেন তিন সাবেক র‌্যাব কর্মকর্তার স্বীকারোক্তির প্রসঙ্গটি।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং আদালতের সূত্র জানায়, তিন সাবেক র‌্যাব কর্মকর্তা সাত খুনের ঘটনায় নিজেদের সম্পৃক্ততার পাশাপাশি এ বাহিনীর এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নাম বলেছেন। তবে ওই কর্মকর্তা কে তা জানাতে রাজি হননি কেউ। এ নিয়ে গণমাধ্যমে অবশ্য এসেছে নানা প্রতিবেদন। এর পর র‌্যাবের সদর দপ্তর থেকে একটি বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। যাতে বলা হয়েছে, অনুমানভিত্তিক নানা প্রতিবেদনে তাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হচ্ছে।  

বিশিষ্ট আইনজীবী রফিকুল ইসলাম ঢাকাটাইমসকে বলেন, যেকোন মামলায় কেউ ১৬৪ ধারায় দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দিলে সেটা আইনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এবং এটা একটা মামলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশও বটে। দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দিলে সেই মামলার ৯০ শতাংশ কাজ হয়ে যায়। নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনায় র‌্যাব-১১ এর সাবেক তিন কর্মকর্তা দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন তাতে মামলার অধিকাংশ কাজই হয়ে গেছে। এখন শুধু সাপোর্টিং কিছু বিষয় নিয়ে এগুলেই হয়।

কী বলেছেন তারেক সাঈদ

সাবেক দুই র‌্যাব কর্মকর্তা এম এম রানা ও আরিফ হোসেন এই মামলায় তাদের দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন দুই দফা রিমান্ড শেষেই। তবে তাদের অধিনায়ক তারেক সাঈদ জবানবন্দি দিয়েছেন পাঁচ দফায় ৩২ দিনের টানা রিমান্ড শেষে।

আদালত সূত্র জানায়, জবানবন্দিতে তারেক সাঈদ স্বীকার করেছেন সাতজনকে অপহরণের বিষয়টি তিনি জানতেন। যখন ওই সাতজনকে তুলে আনা হয় তখন অধিনায়ক নিজের অফিসেই ছিলেন। তার সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ রক্ষা করছিলেন আরিফ ও রানা। সাতজনকে অপহরণের পর তাদের বহন করা মাইক্রোবাসটি নরসিংদী নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই তাদের হত্যার পরিকল্পনা করা হলেও  আরিফ হোসেন অপহৃতদের নারায়ণগঞ্জে এনে হত্যা করার পক্ষে ছিলেন। রাতে সাতজনের মরদেহ কাঁচপুর ব্রিজের জনশূন্যে নিয়ে এলে এতগুলো মরদেহ দেখে আঁতকে ওঠেন তারেক সাঈদ। তখন তিনি সাতজনকেই হত্যা করায় আরিফ ও রানাকে বকাঝকা করেন। পরে সাতজনের লাশ শীতলক্ষ্যার বন্দর উপজেলার মদনগঞ্জের চর ধলেশ্বরী এলাকায় ডোবানোর মিশনে অংশ নেন তারেক সাঈদই।

১৮ জুন নারায়ণগঞ্জ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কে এম মহিউদ্দিনের খাস কামরায় সাত খুনের ঘটনায় দায়ের করা দুটি মামলায় জবানবন্দি গ্রহণ করা হয়।

রানা ও আরিফ স্বীকার করেছেন আগেই

আরিফ হোসেন ৪ জুন এবং পরদিন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন এম এম রানা। আরিফ ও রানার দেওয়া তথ্য মতে, এই অপহরণ ও হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর নূর হোসেন। আরিফ দাবি করেন, কেবল তারা নিজেরা সিদ্ধান্ত নিয়ে এ ঘটনা ঘটাননি। র‌্যাবের সদর দপ্তরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও বিষয়টি জানতেন। তার নির্দেশেই মূলত তারা নূর হোসেনের কাছ থেকে টাকা নিয়ে এই সাতজনকে হত্যা করেন।

সাত খুনের মামলায় এ পর্যন্ত র‌্যাবের সাবেক মেজর আরিফ হোসেন, লে. কমান্ডার এম এম রানা, নূর হোসেনের দেহরক্ষী গোলাম মোহাম্মদ চার্চিল স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এছাড়া আরও দুই সাক্ষী জবানবন্দি দিয়েছেন। মামলায় এজাহারভুক্ত আসামিদের মধ্যে এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। তবে এ ঘটনায় সবমিলিয়ে মোট ১৪ জনকে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

নারায়ণগঞ্জ পুলিশ সুপার ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘মামলার উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। এ পর্যন্ত সাক্ষীসহ ছয়জন ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। মামলার প্রধান আসামি নূর  হোসেন কলকাতায় গ্রেপ্তার হয়েছে। তাকে আনার প্রক্রিয়া চলছে। কীভাবে নূর হোসেনকে ফিরিয়ে আনা যায়, সে ব্যাপারে সর্বাত্মক উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা এ পর্যন্ত মোট ১৪ জনকে আটক করেছি। মামলার এজাহারে নাম থাকা প্রধান আসামি নূর  হোসেন কলকাতায় গ্রেপ্তার হয়েছে। আর যারা আছে তাদের মধ্যে মামলার তদন্তে যাদের নাম আসবে তাদের আমরা গ্রেপ্তার করব। তদন্ত এখনো চলছে। এটা বিশাল মামলা। তাই এ বিষয়টি আমরা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে করছি।’

আলোচিত এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা জেলা গোয়েন্দা শাখার পরিদর্শক মামুনুর রশিদ ম-ল এই সময়কে বলেন, ‘মামলার যথেষ্ট অগ্রগতি আছে। তবে অভিযোগপত্র দিতে সময় লাগবে।’

তথ্য চেয়েছে ভারত

স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানান, ভারত নূর হোসেনের বিষয়ে বেশকিছু তথ্য জানতে চেয়েছে। কী কী বিষয়ে জানতে চেয়েছে তা না জানালেও প্রতিমন্ত্রী জানান, এ সব তথ্য তারা সংগ্রহ করছেন এবং ভারতকে তা দেওয়া হবে।  

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, নূর হোসেনকে কলকাতা থেকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনতে এরই মধ্যে দিল্লির সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে।

কলকাতায় নূর হোসেনকে জিজ্ঞাসাবাদ

সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, প্রথম পর্যায়ে নূর হোসেনরা কীভাবে ও কোন সীমান্ত পার হয়ে পশ্চিমবঙ্গে ঢুকেছেন, ইন্দ্রপ্রস্থ আবাসনে আসার আগে তারা কোথায় ছিলেন, কারা এখানে থাকতে সাহায্য করেছেন, কলকাতায় কাদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ রয়েছে ইত্যাদি বিষয়ে জেরা করা হচ্ছে। বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের বিষয়টিও তারা জেনে নিচ্ছেন জেরার মাধ্যমে। তাদের কাছে মোবাইল ফোনের যেসব সিম পাওয়া গেছে, সেসব সিম কীভাবে কেনা হয়েছে বা ওই সিমের মাধ্যমে কোথায় কোথায় কথা বলা হয়েছে, তাও তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।

কলকাতা পুলিশ জানিয়েছে, নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছে নূর হোসেন। নূর হোসেন রিমান্ডে কলকাতার পুলিশকে জানিয়েছে, রাজনৈতিক কারণে নূর হোসেনকে নারায়ণগঞ্জের সাত হত্যাকা-ে জড়ানো হয়েছে।

(ঢাকাটাইমস/ ২১ জুন / এমএম/ এআর/ ঘ.)