ঢাকা: ভাই আমাদের মাথায় হাত। ব্যবসা নেই। ১৩ দিন পর দোকান খুললাম। কোনো ক্রেতা নেই। ফরমালিন আতঙ্কে ভুগছে মানুষ। ভয়ে কেউ ফল কিনতে চায় না। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে কথাগুলো বললেন রাজধানীর হাতিরপুল বাজারের ফল বিক্রেতা বিল্লাল হোসেন।
তিনি বলেন, আমরা খুচরা বিক্রেতা। আমাদের পরিবার এই ব্যবসার ওপরই নির্ভর করছে। অথচ ফরমালিন আতঙ্কে ব্যবসার যে নাজুক অবস্থা তাতে এখন আমাদের জীবন বাঁচানোই কঠিন হয়ে গেছে।
আরেক ফল ব্যবসায়ী আশিকুর রহমান অপু ঢাকাটাইমসকে জানান, আমরা খুচরা বিক্রেতা। পাইকারি বিক্রেতাদের কাছ থেকে আমরা ফলের ফরমালিন পরীক্ষা করেই ক্রয় করি। তারপরও যদি আমাদের ওপর এমন আচরণ করা হয় তাহলে আমরা কোথায় যাব।
মৌসুমি ফল পচে যাওয়ার হাত থেকে ফরমালিন মেশানো হয়Ñএমন ধারণা ছড়িয়েছে মানুষের মধ্যে। আর ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ সম্প্রতি ঢাকার প্রবেশপথে তল্লাশি চৌকি বসিয়ে ফরমালিন দেয়ার অভিযোগে বিপুলসংখ্যক আম, লিচু, জাম ধ্বংস করেছে। তবে পরে দেখা গেছে পুলিশ যে যন্ত্র দিয়ে ফরমালিন পরীক্ষা করেছে সেটা ত্রুটিপূর্ণ। আর ফলে স্বাভাবিকভাবেই ফরমাল ডিহাইড নামে একটি রাসায়নিক যৌগ উৎপন্ন হয় যা এই যন্ত্রে ধরা পড়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনো বস্তুতে ফরমালিন দেয়া হয়েছে কি না, সেটা পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। তাৎক্ষণিক পরীক্ষার জন্য কোনো যন্ত্র এখনও আবিষ্কৃত হয়নি। এই সমালোচনা ওঠার পর পুলিশের অভিযান কিছুটা পাল্টেছে। এখন ফল পরীক্ষার বদলে ফরমালিন মজুদকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে তারা। সরকারও খাদ্যপণ্যে ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহারে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রেখে একটি আইনের খসড়া পাস করেছে। এতে ফরমালিন বিক্রিতে লাইসেন্স নেয়ার বিধান রাখা হয়েছে। এছাড়া রাসায়নিকটি কার কাছে কী পরিমাণ বিক্রি করা হয়েছে তার হিসাব দেয়ার বিধানও রাখা হয়েছে।
পুলিশের অভিযান পাল্টালেও খাদ্যপণ্যে ফরমালিন ব্যবহার নিয়ে আতঙ্ক কমেনি। বরং সবজি এবং মাছের বাজারেও ছড়িয়েছে এই আতঙ্ক। রাজধানীর পলাশী বাজারের মাছ বিক্রেতা কফিল উদ্দিন বলেন, আমাদের ব্যবসাও এখন ভালো যাচ্ছে না। কারণ মাছে ফরমালিন আছে এমন প্রচারণায় ক্রেতারা এখন কম আসছেন।
একই বাজারের সবজি বিক্রেতা সোবহান মিয়া বলেন, সবজিতে নাকি ফরমালিন। এই জন্য ক্রেতা অর্ধেকে নেমে গেছে। বেচাকেনা খুব কম।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফলে ফরমালিন নিয়ে আতঙ্ক অনুমানভিত্তিক। এ নিয়ে কিছু করার আগে বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা দরকার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল ফার্মেসি বিভাগের অধ্যাপক মুনীরউদ্দিন আহমদ ঢাকাটাইমসকে বলেন, ফলে ফরমালিন নিয়ে আমাদের দেশে অনুমাননির্ভর আতঙ্ক ছড়ানো হচ্ছে। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো বৈজ্ঞানিক গবেষণা হয়নি। পত্রপত্রিকায় যেসব আতঙ্কের খবর আসছে সেগুলো শুধু অনুমাননির্ভর বক্তব্য।
অধ্যাপক মুনীরউদ্দিন বলেন, ফলে কখনও ফরমালিন দেয়া হয় না। এগুলো দিয়ে ফল প্রিজারভেশন করা যায় না। ফরমালিন দেয়া হয় প্রাণিজ জিনিসে। যেমন মাছ, মানুষের মরদেহসহ অন্যান্যে। ফলে দেওয়া হয় কীটনাশক। সেটা অবশ্য মানবদেহের জন্য ক্ষতিকরও বটে। কিš‘ এ নিয়ে কোনো বৈজ্ঞানিক গবেষণা হয়নি। আমাদের দেশে ফল বা পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণের জন্য একটা কর্তৃপক্ষ আছেÑবিএসটিআই। তারা টাকার বিনিময় ফিটনেস সনদ দেয়। ফলে সেটার প্রতি এখন আর মানুষের আস্থা নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক ঢাকাটাইমসকে ফরমালিন নিয়ে বিস্তারিত বক্তব্য তুলে ধরেন। তা পাঠকের জন্য তুলে ধরা হল:
ফল নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা করার আগে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের পথে বসানো ঠিক হবে না। ফলে বিষাক্ত পদার্থের বিরুদ্ধে যে অভিযান অব্যাহত রয়েছে, সেটা ভালো। কিন্তু এটা যদি আরও পরিকল্পনামাফিক করা হয় সেটাতে কিন্তু সব মহলেরই লাভ। ফল যখন গাছে থাকে তখনও কিন্তু রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়। সেটাকে মনিটরিং-এর আওতায় আনতে হবে। সব কিছুকে যদি পরিকল্পনা অনুযায়ী মনিটরিং-এর মধ্যে আনা যায় তাহলে বিষাক্ত খাবার থেকে মানুষ রক্ষা পেতে পারে।
ফল সংরক্ষণে উন্নত প্রসেসিং অ্যান্ড প্যাকেজিং প্লান্ট স্থাপনের পরামর্শও দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। সে ক্ষেত্রে ফল আরও বেশি সময় রাখা যাবে। আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি দিয়ে আম জীবাণুমুক্ত করে প্যাকেটজাত করার পরামর্শও দিয়েছেন তারা। মুকুল আসার আগে ছত্রাক প্রতিরোধে একবার রাসায়নিক ব্যবহার, মুকুল পড়া বন্ধে এবং আম পরিপুষ্ট করতে ভিটামিন জাতীয় ওষুধ ব্যবহার এবং পোকা দমন করতে সীমিত কীটনাশক ব্যবহারের পরামর্শও দিয়েছেন তারা। এ জন্য প্রতিটি বাগানে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি তৈরির ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
অধ্যাপক মুনীরউদ্দিন বলেন, টমেটো, আম, কলা, পেঁপে ও আনারসের মতো উপাদেয় বিভিন্ন ফল ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান দিয়ে কৃত্রিম উপায়ে পাকানো হয়। কৃত্রিম উপায়ে ফল পাকানোর কাজে ব্যবহৃত এমন একটি ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্যের নাম ক্যালসিয়াম কার্বাইড। ইথ্রেল (ethrel)) বা ইথেফোন (ethephon) ব্যবহার করেও কৃত্রিম উপায়ে ফল পাকানো যায়। তবে ইথ্রেল বা ইথেফোন ক্যালসিয়াম কার্বাইডের মতো ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিক উপাদান নয়। কারণ ক্যালসিয়াম কার্বাইডের সঙ্গে স্বাস্থ্য ও জীবনের জন্য বিপজ্জনক আর্সেনিক ও ফসফরাসÑ এ দুটি বিষাক্ত উপাদানের কিছু পরিমাণ মিশ্রণ থাকে। অসাবধানতার কারণে এবং ভুল পদ্ধতিতে উচ্চমাত্রায় ক্যালসিয়াম কার্বাইড ব্যবহার করে কৃত্রিম উপায়ে ফল পাকানো হলে এই ফল আর্সেনিক ও ফসফরাস দ্বারা দূষিত হয়ে পড়তে পারে এবং বিষাক্ত উপাদান দুটি আমাদের শরীরে প্রবেশ করলে সাস্থ্যহানি ছাড়াও জীবন বিপন্ন হতে পারে। আর্সেনিক ও ফসফরাস দূষণের ফলে আমাদের শরীরে বিভিন্ন ধরনের উপসর্গ দেখা দেয়।
এর মধ্যে রয়েছে বমি হওয়া, ডায়রিয়া, পেট ও বুকে জ্বালাপোড়া করা, তৃষ্ণা পাওয়া, সাধারণ দুর্বলতা, কথা বলতে বা কিছু গিলতে অসুবিধা হওয়া। এ ছাড়া হাত-পা অবশ হওয়া, শরীরের ত্বক ঠাণ্ডা ও ভিজে যাওয়া এবং রক্তচাপ কমে যাওয়ার মতো উপসর্গগুলোও দেখা দিতে পারে। ক্যালসিয়াম কার্বাইড অত্যন্ত ক্রিয়াশীল দ্রব্য বলে ভিজা হাতে ধরলে হাতে ফোসকা পড়ে যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আর্সেনিক ও ফসফরাস বিষক্রিয়ার উপসর্গগুলো আগেভাগে দৃশ্যমান হয় বলে সময়মতো চিকিৎসা নেয়া সম্ভব হয়। সময়মতো চিকিৎসা না নিলে আর্সেনিক ও ফসফরাস বিষক্রিয়ার কারণে জীবন বিপন্ন হতে পারে।
দামে অতি সস্তা বলে ব্যবসায়ীরা ফল পাকানোর কাজে ক্যালসিয়াম কার্বাইডের যথেচ্ছ অপব্যবহার করে থাকে। এক কিলোগ্রাম ক্যালসিয়াম কার্বাইডের দাম ৭০ থেকে ৯০ টাকা মাত্র। এক কিলোগ্রাম ক্যালসিয়াম কার্বাইড দিয়ে ১০ টন ফল পাকানো যায়। তবে ব্যবসায়ীরা সাধারণত ৫০ কিলোগ্রাম ফলের জন্য ১০০ গ্রাম ক্যালসিয়াম কার্বাইড ব্যবহার করে থাকে।
প্রাকৃতিক উপায়ে ফল পাকার পেছনে যে রাসায়নিক উপাদানটি মূল ভূমিকা পালন করে থাকে তার নাম ইথাইলিন। ইথাইলিন গাছ বা ফলে উৎপাদিত ছোট আকৃতির একটি রাসায়নিক যৌগ। ফল যখন পরিপক্ব হয় তখন ফলে ইথাইলিন উৎপাদনের পরিমাণ থাকে সর্বোচ্চ মাত্রায়। ইথাইলিন ফলের বিভিন্ন জিনকে উদ্দীপিত করার ফলে তৈরি হয় নানা ধরনের প্রয়োজনীয়সংখ্যক এনজাইম। এমাইলেজ ও পেকটিনেজ এ ধরনের দুই রকম গুরুত্বপূর্ণ এনজাইম।
কাঁচা ফলের ভেতর থাকে স্বাদবিহীন দীর্ঘ আকৃতির শর্করা যাকে আমরা বলি স্টার্চ। এমাইলেজ স্টার্চকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে সুক্রোজ ফ্রুকটোজের মতো ছোট আকৃতির যৌগে রূপান্তরিত করে দেয়। এ বিক্রিয়া ফলের আটাতুল্য গুণাবলীকে কমিয়ে ফলকে মিষ্টি ও রসালো করে তোলে। অন্যদিকে পেকটিনেজ ফলের শক্ত খোসা বা আবরণ পেকটিনকে ভেঙে দিয়ে তাকে নরম করে ফেলে। অন্য আরেক ধরনের এনজাইম ফলের সবুজ ক্লোরোফিলকে রাসায়নিক রূপান্তরের মাধ্যমে কেরোটিনয়েডের মতো রঙিন উপাদান সৃষ্টি করে বলে পাকা ফল লাল বা হলুদ বর্ণ ধারণ করে। বিভিন্ন এনজাইমের রাসায়নিক কর্মকাণ্ডের ফলে বিভিন্ন রঞ্জক পদার্থের সৃষ্টি হয় বলে পাকা ফল বিভিন্ন রঙ ধারণ করে। অন্য একটি এনজাইম ফলে বিদ্যমান এসিডকে ভেঙে দিয়ে অম্লত্বকে নিরপেক্ষ করে দেয় বলে কাঁচা টক ফল পাকলে আর টক থাকে না। ফলের বৃহদাকৃতির যৌগগুলো ভেঙে ছোট ছোট উদ্বায়ী যৌগে রূপান্তরিত হয় বলে আমরা ফলের নানা সুগন্ধ পাই।
ফলে ফরমালিন নিয়ে আমাদের দেশে অনুমাননির্ভর আতঙ্ক ছড়ানো হচ্ছে। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো বৈজ্ঞানিক গবেষণা হয়নি। পত্রপত্রিকায় যেসব আতঙ্কের খবর আসছে সেগুলো শুধু অনুমাননির্ভর বক্তব্য। ফলে কখনো ফরমালিন দেওয়া হয় না। এগুলো দিয়ে ফল প্রিজারভেশন করা যায় না। ফরমালিন দেয়া হয় প্রাণিজ জিনিসে।
যেমন মাছ, মানুষের মরদেহসহ অন্যান্যে। ফলে দেওয়া হয় কীটনাশক। সেটা অবশ্য মানবদেহের জন্য ক্ষতিকরও বটে। কিš‘ এ নিয়ে কোনো বৈজ্ঞানিক গবেষণা হয়নি। আমাদের দেশে ফল বা পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণের জন্য একটা কর্তৃপক্ষ আছে বিএসটিআই। তারা টাকার বিনিময় ফিটনেস সনদ দেয়। ফলে সেটার প্রতি এখন আর মানুষের আস্থা নেই।
(ঢাকাটাইমস/৪জুলাই/এমএম/এএসএ)