ঢাকা: ‘স্ত্রী ও ছেলে থাকেন আমেরিকায়। তিনিও এক পা বাড়িয়ে রেখেছেন। প্রায়ই ঘনিষ্ঠদের বলেন, রাজনৈতিক পরিস্থিতি প্রতিকূলে গেলে স্ত্রী-ছেলের কাছে চলে যাবেন।’ ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খানের ব্যাপারে বলছিলেন ওয়াসারই একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তিনি আরো বলেন, ‘গত বছরের ২৪ অক্টোবর মহাজোট সরকারের মেয়াদ শেষে কঠিন আন্দোলনের হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিল বিএনপি। বিষয়টিকে হালকাভাবে নেননি ওয়াসার এমডি। তিনি ভেবেছিলেন দেশে কিছু একটা হতে যাচ্ছে। এই আশঙ্কায় ২৪ অক্টোবর আমেরিকায় পাড়ি জমিয়েছিলেন তাকসিম এ খান। পরিস্থিতি অনুকূলে থাকায় ২০-২২ দিন পর দেশে ফিরেছিলেন তিনি।’
২০০৯ সালের ১৩ অক্টোবর ওয়াসার এমডি হিসেবে প্রথম নিয়োগ পান তাকসিম এ খান। ওই সময়ই অভিযোগ উঠেছিল, শর্ত ভেঙে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তাকে। কারণ পত্রিকায় প্রকাশিত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে লেখা ছিল, আবেদনকারীর অবশ্যই পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন কাজে পর্যাপ্ত জ্ঞান এবং একই ধরনের সংস্থায় তৃতীয় গ্রেডে চাকরি করার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। এ ছাড়া এ খাতে অন্তত ২০ বছরের কাজ করার অভিজ্ঞতাও চাওয়া হয়েছিল। প্রশাসন ব্যবস্থাপনায় ২০ বছরের অভিজ্ঞতা থাকা বাধ্যতামূলক ছিল। কিন্তু এসবের কোনোটাই ছিল না তাকসিম এ খানের। তিনি তখন ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল ইউকে ২০০১ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের পরামর্শক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। অথচ নিয়োগ পরীক্ষায় তিনিই প্রথম হয়েছিলেন ওয়াসা বোর্ডের বিচারে। শর্ত অনুযায়ী কোনো অভিজ্ঞতা না থাকায় পরবর্তী নিয়োগের ক্ষেত্রে ওয়াসার এমডিকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের এক চিঠিতে সতর্কও করা হয়েছিল।
নিয়োগ পাওয়ার পর থেকেই তাকসিমের বিরুদ্ধে উঠতে থাকে স্বেচ্ছাচারী আচরণের নানা অভিযোগ। একপর্যায়ে চেয়ারম্যান মো. রহমতুল্লাহর সঙ্গেও তৈরি হয় দ্বন্দ্ব। এর অংশ হিসেবে চার মাস ধরে চেয়ারম্যানের মাসিক সম্মানী এবং গাড়ি সুবিধাও বন্ধ করে দেন। বিষয়টি নিয়ে নগরীতে পানি সরবরাহের দায়িত্বে থাকা সরকারি সংস্থাটির কর্মীরা বিস্মিত।
অনিয়মের অভিযোগও উঠেছে সংস্থাটির বিরুদ্ধে। বিদেশি অর্থায়নে নানা প্রকল্প বাস্তবায়নে আছে ব্যর্থতার অভিযোগও। লাভজনক প্রতিষ্ঠান ওয়াসাকে পড়তে হয়েছে দায়-দেনার মুখে। আর এই পরিস্থিতির জন্য তাকসিমকেই দায়ী করছেন ওয়াসার বোর্ডের সদস্যসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওয়াসার এক কর্মকর্তা বলেন, ‘এমডি আসার আগে ওয়াসা লাভজনক ছিল। কিন্তু এখন দিন দিন অনেক টাকা দেনা হয়ে যাচ্ছে। বিদেশি ঋণ ও অনুদান নিয়ে যেসব প্রকল্প করা হয়েছে তার প্রায় সবই ব্যর্থ হতে বসেছে। এমডি ওয়াসার বিভিন্ন প্রকল্প থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা বেহাত করেছেন।’
তবে এসব অনিয়মের বিষয়ে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খানের বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। কারণ তিনি এখন ডেনমার্কে আছেন।
ক্ষুব্ধ ওয়াসার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা
এমডির আচরণে ওয়াসার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি বড় অংশে তৈরি হয়েছে ক্ষোভ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মচারী বলেন, ‘এমডি সাহেব আছেন নিজের চিন্তায়। তিনি মেয়াদ শেষ হলে আবার কীভাবে নিয়োগের মেয়াদ বাড়ানো যায়, সেই চেষ্টায় ব্যস্ত থাকেন। কয়েক দিন পর পর ওয়াসার টাকায় বিদেশে ঘুরতে যান। দীর্ঘদিন ধরে ওয়াসায় জনবল সংকট থাকলেও এসবের দিকে কোনো নজর নেই তার। যে কারণে একজন কর্মচারীকে তিনজনের কাজ করতে হয়।’
বোর্ডের সিদ্ধান্তকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তৃতীয় দফা নিয়োগ
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ওয়াসার এমডির প্রথম দফা তিন বছরের জন্য নিয়োগের মেয়াদ শেষ হয় ২০১২ সালের ১৩ অক্টোবর। ওয়াসা আইন অনুযায়ী পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে নিয়োগ পরীক্ষার মাধ্যমে সংস্থাটির সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ ওয়াসা বোর্ড এমডি নিয়োগ দেওয়ার কথা। কিন্তু তাকসিম এ খান দ্বিতীয়বারের মতো নিয়োগ পেতে মরিয়া হয়ে উঠলে ওই আইন আর মানতে পারেনি বোর্ড। সরকারি দলের একজন প্রভাবশালী সংসদ সদস্যের ফুপা পরিচয়ে তিন বছরের জন্য আবারও নিয়োগ পেতে জোর তদবির শুরু করেন তিনি। পরে অবশ্য তিন বছরের পরিবর্তে এক বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয় তাকে। গত ১৩ অক্টোবর দ্বিতীয় দফা চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়। কিন্তু আবারও এমডি পদে নিয়োগ পাওয়ার চেষ্টা করছেন তাকসিম এ খান।
সূত্র জানায়, গতবারের মতো এবারও কোনো ধরনের বিজ্ঞপ্তি ছাড়া এমডি নিয়োগ না করতে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ওয়াসা বোর্ডের চাপ ছিল। কিন্তু তাকসিম এ খান তৃতীয়বারের মতো জোর করে নিয়োগ পেতে চাইলে ওয়াসা বোর্ডের সভায় এমডি নিয়োগের সিদ্ধান্ত স্থগিত করা হয় গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর। কিন্তু এর তিন দিন আগে ২৮ আগস্ট স্থানীয় সরকার বিভাগের তৎকালীন সচিব আবু আলম শহীদ খান ওয়াসার এমডি নিয়োগের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি সারসংক্ষেপ পাঠান। এতে বলা হয়, ‘ঢাকা ওয়াসার দৈনন্দিন কাজ পরিচালনার ও উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ আইনের বিধান অনুসারে প্রকৌশলী তাকসিম এ খানকে স্বীয় পদে বোর্ডের সুপারিশ অনুযায়ী অবশিষ্ট দুই বছরের জন্য নিয়োগ করা যায়। বর্ণিত প্রেক্ষাপটে, ঢাকা ওয়াসা পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে প্রকৌশলী তাকসিম এ খানকে ১৫ অক্টোবর, ২০১৩ থেকে ১৪ অক্টোবর ২০১৫ সাল পর্যন্ত দুই বছরের নিয়োগের জন্য প্রস্তাব মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সদয় বিবেচনা ও অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হলো।’
সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো ওই প্রস্তাবে ২১০তম বোর্ড সভার স্থগিত সিদ্ধান্তকে পাশ কাটানো হয়। বরং এক বছর আগের ১৯৮তম তামাদি বোর্ড সভার কথা বলে প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রস্তাব পাঠানো হয়। এর তিন দিন পর প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ অনুমোদন দিয়ে প্রস্তাবে সই করেন। ঠিক ওই দিনই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকেও এ-সংক্রান্ত চিঠি ইস্যু করা হয়। নিয়ম অনুযায়ী, বোর্ডের নির্দেশনা ছাড়া সচিব কোনো চুক্তি করতে পারেন না। কিন্তু ওয়াসার এমডি নিয়োগের চুক্তি সই করেছেন বোর্ডের সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিন।
ওয়াসার এমডি পদে নিয়োগ পেতে আগ্রহী ছিলেন প্রকৌশলী ড. মো. আরিফুর রহমান মিয়া। জানতে চাইলে তিনি ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘ওয়াসা আইন অনুযায়ী নিয়োগ প্রক্রিয়া না মেনে এমডি নিয়োগ করায় আমি বঞ্চিত হয়েছি। তাই এই নিয়োগকে চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে গত ১৯ জানুয়ারি একটি রিট করি। রিটটি হাইকোর্ট খারিজ করে দিলে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আবেদন করেছি। এটি এখন বিচারধীন আছে।
আরিফুর রহমান জানান, তিনি স্পেনের অর্থায়নে ওয়াসার একটি প্রকল্পের কোয়ালিটি ম্যানেজার ছিলেন। কিন্তু কোনো নিয়ম না মেনে তাঁকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। এনিয়েও তিনি ওয়াসা কর্তৃপক্ষকে একটি উকিল নোটিশ পাঠিয়েছেন।
পদত্যাগ করেছেন চেয়ারম্যান
গত ২০১২ সালের ৮ মে ঢাকা ওয়াসার চেয়ারম্যান পদে যোগ দেন মো. রহমতুল্লাহ। এর আগে তিনি ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলী ছিলেন। ওই বিশ্ববিদ্যালয়েই তিনি পড়েছেন এবং ওখানে ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতিও ছিলেন তিনি। একসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিপি হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর আস্থাভাজন ওই নেতা।
সূত্র জানায়, যোগদানের পর থেকেই ওয়াসার বিভিন্ন পর্যায়ে নানা অনিয়ম ও এমডির একচ্ছত্র আধিপত্যের বিষয়টি নজরে আসতে থাকে তাঁর। এ নিয়ে এমডির সঙ্গে মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বও জোরালো হয় ধীরে ধীরে। একপর্যায়ে এমডির রোষানলে চেয়ারম্যানের হাত-পা বাঁধা পড়ে। স্বাভাবিকভাবে দায়িত্ব পালনের পথে বাধা সৃষ্টি হয়। পরে গত ১৯ জুন মো. রহমতুল্লাহ নিজের পদ থেকে অব্যাহতি চেয়ে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বরাবর পদত্যাগপত্র জমা দেন। এতে তিনি লেখেন, ‘ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদে পুনর্নিয়োগে বোর্ডের সিদ্ধান্ত মানা হয়নি। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আমাকে অব্যাহতি দেওয়া হোক।’
জানতে চাইলে প্রকৌশলী মো. রহমতুল্লাহ ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘স্থানীয় সরকার মন্ত্রীর এপিএস সেলিম খানের কাছে দুটি পদত্যাগপত্র দিয়েছি। একটিতে এমডির পুনর্নিয়োগ নিয়ে সৃষ্ট পরিস্থিতির বিষয় এবং অন্যটিতে ব্যক্তিগত কারণের কথা বলেছি।’
জানা যায়, নিয়ম অনুযায়ী প্রতি মাসে একটি করে ওয়াসার বোর্ড সভা হওয়ার কথা। কিন্তু গত চার মাস ধরে এমডির প্রভাবের কারণে বোর্ড সভা হচ্ছে না। এ ব্যাপারে মো. রহমতুল্লাহ বলেন, ‘বোর্ড সভা নিয়মিত করার জন্য আমি স্থানীয় সরকার সচিব বরাবর চিঠিও দিয়েছি। অনেক চেষ্টা করেও যেহেতু নিয়ম অনুযায়ী সংস্থাটিতে কাজ করা যাচ্ছে না তাই আমি নিজেই সরে এসেছি।’
চেয়ারম্যানের সম্মানী-গাড়ি বন্ধ করে দেন এমডি!
সূত্র ঢাকাটাইমসকে জানায়, নিজের মতের পক্ষে সায় না দেওয়ায় বরাবরই চেয়ারম্যানের ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন ওয়াসার এমডি। তাই যে করেই হোক চেয়ারম্যানকে শায়েস্তা করার চেষ্টা চালিয়ে যান তাকসিম এ খান। এর অংশ হিসেবে নিয়মের বাইরে গিয়ে গত চার মাস ধরে চেয়ারম্যান মো. রহমতুল্লাহর মাসিক সম্মানী বন্ধ করে দেন তিনি। সেই সঙ্গে চেয়ারম্যানের ব্যবহারের জন্য গাড়িটিও সরবরাহ না করতে নির্দেশ দেন। এমনকি ওয়াসায় গেলে তাকে হেনস্তা করার হুমকিও দেন তাকসিম এ খান। যে কারণে গত চার মাস ধরে ওয়াসার স্বাভাবিক কার্যক্রমে চরম ব্যাঘাত ঘটছে।
(ঢাকাটাইমস/ ২৯জুন/ এইচএফ/ জেডএ.)