logo ০১ মে ২০২৫
কর্মবীর খন্দকার মোশাররফ হোসেন
বিশেষ প্রতিনিধি, ঢাকাটাইমস
২৮ জুন, ২০১৪ ১২:০১:০১
image


সম্প্রতি একান্ত আলোচনায় বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের একজন প্রতিমন্ত্রীর মুখে বর্তমান সরকারের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রীর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা শুনে রীতিমতো বিস্মিত হই। বিস্ময়ের ঘোর কাটান একদা প্রভাবশালী ওই প্রতিমন্ত্রীই। বলেন, ‘মন্ত্রী হিসেবে নিজ মন্ত্রণালয়ে আমাকে কার্যত অকার্যকর করে রেখেছিল জনশক্তি প্রেরণকারীদের সংগঠন বায়রার সভাপতিসহ ওই খাতের কয়েকজন ব্যবসায়ী। বকলমে তারাই চালাতো মন্ত্রণালয়। আমি অসহায়ের মতো তাদের ইচ্ছেয় সায় দিতাম। কারণ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নির্বাহীর অকুণ্ঠ সমর্থন ছিল ওই ব্যবসায়ীদের প্রতি।’ বিএনপি শাসনামলের ওই প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, নির্বাহী ক্ষমতা অনেক ক্ষেত্রেই  স্বেচ্ছায় প্রয়োগ করতে পারিনি। এই যন্ত্রণা কিছুটা লাঘব হয় যখন দেখি বর্তমান প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী জনশক্তি প্রেরণ খাতের বিশৃঙ্খলা অনেকাংশেই দূর করতে পেরেছেন। বায়রা সদস্যদের ব্যবসায়িক স্বার্থের পরিবর্তে জনকল্যাণে একের পর এক সিদ্ধান্ত নিয়ে তা কার্যকর করছেন। অকপটে নিজের ব্যর্থতাকে একান্তে স্বীকার করে নিয়ে ওই প্রতিমন্ত্রী বলেন, ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। দেখিয়ে দিয়েছেন কীভাবে চাপের কাছে নতি স্বীকার করতে না হয়, কীভাবে নিজের ক্ষমতাকে জনগণের কল্যাণে কাজে লাগাতে হয়।

বিএনপি আমলের ওই প্রতিমন্ত্রীর এই মূল্যায়নের বিষয়টিকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বর্তমান সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্যদের কাজের বিচার করতে বললে প্রথিতযশা প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক রাঘঢাক না করে ঢাকাটাইমসকে বলেন, ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেনের মতো অন্তত ডজনখানেক শক্ত, দক্ষ মন্ত্রী থাকলে প্রধানমন্ত্রী সার্বিকভাবে অনেক ভালো করতে পারতেন। তিনি বলেন, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান খাতে যে চরম বিশৃঙ্খলা ছিল তার রাশ টেনে ধরে যেভাবে শৃঙ্খলা ফিরিয়েছেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী তা সত্যিই বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দুঃসাধ্য। এমন দুঃসাধ্য সাধন করতে পারা নেতৃত্বই চাই। প্রবীণ এই আইনজীবী বলেন, বাংলাদেশে ক্ষমতার রাজনীতি এমনই যে, মন্ত্রীদের সততা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রশ্নবিদ্ধ। কিন্তু এখানেও ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন অনন্য। তাঁর সততা, নিষ্ঠা অনুকরণীয় এটা আমি সর্বত্রই বলি।

দুই. বিএনপি শাসনামলের শেষ দিকের কথা। মালয়েশিয়ায় জনশক্তি পাঠানোর বিষয়ে দুই দেশের মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ প্রতিমন্ত্রীকে কীভাবে বায়রার সভাপতি হেয়প্রতিপন্ন করে নিজের কর্তৃত্ব প্রদর্শন করেন তার উদাহরণ টানেন সম্প্রতি অবসরে যাওয়া সরকারের গুরুত্বপূর্ণ এক সচিব। বলেন, ওই বৈঠকে মালয়েশিয়ার সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বায়রার তৎকালীন সভাপতি বলেন, বাংলাদেশের মন্ত্রী নয় এখানে তার কথাই হবে শেষ কথা। মাথা নিচু করে কার্যত এই বক্তব্যকেই যেন সমর্থন জানান তৎকালীন প্রবাসী কল্যাণ প্রতিমন্ত্রী। এই ঘটনায় রীতিমতো মালয়েশিয়ার প্রতিনিধি দলও হতভম্ব হয়ে যান বলে ওই সময়ের প্রত্যক্ষদর্শী প্রভাবশালী একজন সাবেক সরকারি কর্মকর্তা আলাপকালে জানান। অবসরপ্রাপ্ত উচ্চ পদস্থ এই কর্মকর্তা বলেন, মন্ত্রী হিসেবে মন্ত্রণালয়ের বিগত দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীর সঙ্গে কাজের ও ব্যক্তিত্বের পার্থক্যটা ঠিক এখানেই চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন খন্দকার মোশাররফ হোসেন। মালয়েশিয়ায় জনশক্তি পাঠানোর বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দেশটির সঙ্গে যতবার বৈঠক হয়েছে ওই বৈঠকগুলোতে কার্যত বাংলাদেশের মন্ত্রীর বক্তব্যই প্রাধান্য পেয়েছে। কারণ কীভাবে কূটনৈতিক বক্তব্য রাখতে হয়, কীভাবে দেশের ও মানুষের স্বার্থ সংরক্ষণের বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরতে হয় তা খুব ভালোভাবেই জানা আছে বর্তমান প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রীর। আর এ কারণে আন্তর্জাতিক ফোরামে তিনি যখন দেশের প্রতিনিধিত্ব করেন তখন সরকারের পদস্থ কর্মকর্তারা নির্ভর থাকেন।  

কর্মক্ষেত্রের সব জায়গাতেই অসামান্য কাজের দৃষ্টান্ত রেখেছেন প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী। স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) প্রতিষ্ঠায় তাঁর অবদান সর্বজন স্বীকৃত। জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) চিফ টেকনিক্যাল কনসালট্যান্ট পদে চাকরি নিয়ে তিনি ১৯৮০ সালে সিয়েরা লিওনে যান। সেখানে কাজের মাধ্যমে এতটাই স্থানীয়দের মন জয় করেন যে, এতে দেশটির সরকার খুশি হয়ে তাঁকে সম্মানজনক নাগরিকত্ব দেন। পরে উগান্ডাতেও সাফল্যের সঙ্গে একই দায়িত্ব পালন করেন খন্দকার মোশাররফ হোসেন।

প্রকৌশলী হিসেবে শতভাগ সাফল্য পাওয়ার পর আচমকাই প্রকাশ্য রাজনীতিতে আসেন তিনি। ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে নানাভাবে জড়িয়ে থাকা, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি সব সময় নিষ্ঠাবান থাকলেও সরকারি চাকরির কারণে তখন প্রত্যক্ষ রাজনীতি করা সম্ভব ছিল না। রাজনীতিতে কতটা ভালো করা যাবে? নতুন কিছু করা সম্ভব হবে তো? নিজেই নিজেকে বিভিন্ন সময় প্রশ্ন করতেন খন্দকার মোশাররফ হোসেন। ২০০৮ সালে ফরিদপুর-৩ (সদর) আসন থেকে বিপুল ভোটে সাংসদ নির্বাচিত হওয়ার পর প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব পান। সংশ্লিষ্টরা জানান, শুরু থেকেই তাঁর মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে কীভাবে বিশৃঙ্খল এই খাতটিকে শৃঙ্খলার মধ্যে আনবেন। একদিকে মালয়েশিয়ার বন্ধ শ্রমবাজার খোলা, আরেকদিকে সেখানে অবৈধভাবে থাকা ২ লাখের বেশি শ্রমিককে বৈধ করা, সৌদি আরবে অবৈধ কয়েক লাখ বাংলাদেশির আকামার পাকাপোক্ত বন্দোবস্ত তো সাফল্যের সঙ্গে তিনি করেছেনই। পাশাপাশি বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার পরিস্থিতিতেও বিএনপি শাসনামলের তুলনায় দ্বিগুণ বিদেশে কর্মী যাচ্ছে। কর্মী যাওয়ার সংখ্যাও বিএনপি সরকারের চেয়ে অন্তত দুই গুণ। মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ হয়েছিল ভুয়া চাহিদাপত্রে লাখ লাখ কর্মী পাঠানো, উচ্চহারে অভিবাসন ব্যয়সহ আরও কিছু কারণে। বিএনপি শাসনামলের শেষ সময়ে শুরু হওয়া ওই প্রক্রিয়া পুরোমাত্রায় চালু ছিল বিগত সেনাশাসিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। এখন মালয়েশিয়ায় সরকারিভাবে কর্মী যাচ্ছে মাত্র ৩৩ হাজার টাকায়। মালয়েশিয়ায় কর্মী যাওয়া সংখ্যায় কিছুটা কম বলে বেসরকারি খাতের জনশক্তি ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন সময় এর সমালোচনা করেন বটে। কিন্তু সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে খোঁজ খবর নিয়ে জানা গেছে, এক্ষেত্রে বাংলাদেশের সরকারের কোনো দায় নেই। মালয়েশিয়া সরকার যে চাহিদাপত্র পাঠাচ্ছে তার ওপর ভিত্তি করেই কর্মী পাঠানো হচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন আলাপকালে ঢাকাটাইমসকে বলেন, আমরা লক্ষ্য করেছি অতীতে সবসময় জনশক্তি প্রেরণকারী খাতের প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা এই মন্ত্রণালয়ের ওপর খবরদারি করতেন। এর ফলে দালাল ও মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ ছিলেন বিদেশে যেতে ইচ্ছুক কর্মীরা। কিন্তু দালাল আর মধ্যস্বত্বভোগীদের রাশ মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন টেনে ধরতে পেরেছেন বলেই আমাদের কাছে প্রতীয়মান হচ্ছে। নানা অব্যবস্থাপনা দূর করে অনেকটা শৃঙ্খলা ফিরেছে জনশক্তি রপ্তানি খাতে। আমি মনে করি, সংশ্লিষ্ট অন্য মন্ত্রণালয়ের পুরোপুরি সহযোগিতা পাওয়া গেলে বিদেশে জনশক্তি প্রেরণ খাতে  সরকারের সাফল্যের পথ আরও দীর্ঘ হতো।

মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি নিজ নির্বাচনী এলাকার প্রতিও সমানভাবে নজর রেখেছেন খন্দকার মোশাররফ হোসেন। তিনি যে একজন দক্ষ, যোগ্য প্রশাসক সেটির প্রশংসা করেন ফরিদপুরে তাঁর রাজনৈতিক বিরোধীরাও। ফরিদপুরে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রীর কর্মকা- প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জেলা বিএনপির সভাপতি জহিরুল হক শাহাজাদা মিয়া বলেন, খন্দকার মোশাররফ হোসেন তাঁর কাজ দিয়ে মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন। সন্ত্রাস আর মাদকের আখড়া বলে পরিচিত এককালের ফরিদপুরকে সন্ত্রাস ও মাদকমুক্ত করে ছেড়েছেন। আওয়ামী লীগের গত মেয়াদে ফরিদপুরে তিনি যে উন্নয়ন কর্মকা-ের নেতৃত্ব দিয়েছেন তার জুড়ি মেলা ভার। বিরোধী রাজনীতি করি বলে কেবল সমালোচনাই করতে হবে তা কেন? বরং আমাদের সময়ে ফরিদপুরের ক্ষমতাসীনরা সন্ত্রাস দমন করতে ব্যর্থ হয়েছে। মাদক ব্যবসায়ীরা প্রকারান্তরে প্রশ্রয় পেয়েছে। উন্নয়ন বঞ্চিত থেকেছে এলাকাবাসী। এই সত্য অস্বীকার করব কীভাবে?

একথা সর্বত্রই আলোচিত হয় যে, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের গত মেয়াদের যেসব অসামান্য সাফল্য আছে, তার মধ্যে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান খাত অন্যতম। এই খাত থেকে যে রেমিটেন্স আসে তা আমাদের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ১৩ শতাংশের বেশি অবদান রাখছে। জিডিপিতে এটি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খাত। আলোচনায় সংশ্লিষ্টরা সব সময়ই এটি বলেন, প্রবাসী কল্যাণ খাতে সরকারের যে সাফল্য তা সম্ভব হয়েছে মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেনের বলিষ্ঠ ও নির্লোভ নেতৃত্বের কারণেই।

তাঁর দূরদৃষ্টির কারণেই মাত্র ৩৩ হাজার টাকায় সরকারিভাবে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন কর্মীরা। দেশের ইতিহাসে অতীতে এ ধরনের নজির নেই। এছাড়া ৫৩ হাজার টাকায় কোরিয়া এবং ১০ হাজার টাকায় জর্ডানে নারী পোশাক শ্রমিক পাঠাচ্ছে সরকার। বিনা টাকাতেও গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে জর্ডান গেছেন নারীরা। নারী কর্মী যাচ্ছে হংকংয়েও।

অতীত পর্যালোচনা করে দেখা যায়, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে যারা এসেছেন তাঁরা নিয়ন্ত্রিত হয়েছেন এই খাতের ব্যবসায়ীদের দ্বারা। এতে ব্যক্তি হিসেবে দু-একজন লাভবান হলেও ক্ষতি হয়েছে বিপুল সংখ্যক মানুষের। যারা বিদেশে চাকরি নিয়ে পাড়ি জমাতে চেয়েছিলেন। মধ্যস্বত্বভোগীদের মাধ্যমে যারা বিদেশ যাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন তাদের গুনতে হয়েছে মূল অভিবাসন ব্যয়ের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি টাকা। আবার এক কাজের কথা বলে অন্য কাজে দেওয়ার প্রতারণা তো ছিলই। অনিয়মের মাত্রা এমন পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে, এই খাতকে কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছিল না। দালালের প্রতারণার কারণে অনেক দেশে বাংলাদেশের শ্রমবাজার বন্ধ হতে বসেছিল।

বৈদেশিক কর্মসংস্থান খাতের সঙ্গে জড়িত একজন ব্যবসায়ী ঢাকাটাইমসকে বলেন, জনশক্তি রপ্তানি খাতে দালাল চক্রের দৌরাত্ম্য কমিয়ে আনতে প্রকাশ্য চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিলেন ফরিদপুর-৩ (সদর) আসন থেকে দুইবার নির্বাচিত সংসদ সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন। এজন্য অনেক বৈরী অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে তাকে। বিদেশে জনশক্তি প্রেরণকারীদের সংগঠন বায়রা শুরু থেকেই মন্ত্রীর কার্যক্রমের বিরোধিতা করেছে। নিজেদের হাতের মুঠো থেকে এত বড় একটি লাভজনক খাত ছুটে যাওয়ার কথা চিন্তা করে সরকারকে বিভিন্ন সময় অসহযোগিতার মনোভাব দেখিয়েছে সংগঠনটি। এত প্রতিকূলতার মধ্যেও সাধারণ মানুষের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আপস করেননি খন্দকার মোশাররফ হোসেন। নিজের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে জনশক্তি প্রেরণ খাতকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছেন। দালালের কবলে পড়ে মানুষের হয়রানি বন্ধে ‘বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসন আইন-২০১৩’ প্রণয়নে বলিষ্ঠ ভূমিকা ছিল তাঁর। এই আইন করতে গিয়েও নিজ দলের লোকদের থেকেও কখনো কখনো অসহযোগী আচরণ পেয়েছেন। কিন্তু থেমে থাকেননি তিনি। কঠোর প্রচেষ্টার মাধ্যমে সংসদে এই আইন পাস করিয়েছেন।

পর্যবেক্ষকদের মতে, লিবিয়া সংকটের সময়ও ধৈর্য ও বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীর তৎক্ষণিক দিক-নির্দেশনা ও মন্ত্রীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ৩৬ হাজার ৬৫৬ বাংলাদেশি কর্মীকে সফলভাবে দেশে ফেরত আনা গেছে। শুধু তাই নয়, এই কর্মীদের সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিজনকে ৫০ হাজার টাকা নগদ দেওয়া হয়েছে।   

বৈদেশিক কর্মসংস্থান বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অতীতে কখনও বৈদেশিক কর্মসংস্থান খাতে কোনো সরকারের এত সাফল্য নেই। এই খাতটি ছিল এক কথায় বিশৃঙ্খল ও ফড়িয়াদের নিয়ন্ত্রণে। এদের নেটওয়ার্ক ছিল খুবই শক্তিশালী। গ্রাম থেকে একশ্রেণির দালালের মাধ্যমে লোক সংগ্রহ করে কমিশনের বিনিময়ে তাদের তুলে দেওয়া হতো শহরের দালালদের হাতে। পদে পদে হয়রানি হতেন গ্রামের খেটে খাওয়া সহজ-সরল মানুষ। কিন্তু এত ভোগান্তির পর বিদেশের মুখ দেখতেন খুব কমসংখ্যক কর্মী। যে কারণে বিদেশ যাওয়াকে ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিয়েছিলেন মানুষ।

কিন্তু স্বপ্ন ও বাস্তবের মধ্যে ব্যবধান যে সামান্যই এই আস্থা এখন সাধারণ মানুষের হয়েছে, যারা কাজ নিয়ে বিদেশে যেতে চান।

খুলেছে নতুন শ্রমবাজার, বেড়েছে প্রবাসী

জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক বেশ কয়েকটি সংস্থার সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা ও বিদেশে উচ্চ শিক্ষাগ্রহণের সুবাদে কূটনৈতিক পর্যায়ে সম্পর্ক উন্নয়নে দারুণ বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী। সূত্র জানায়, মূলত তাঁর নেতৃত্বে ধারাবাহিক কূটনৈতিক যোগাযোগের ফল হিসেবে নতুন করে ৬০টি দেশে বাংলাদেশি কর্মীদের শ্রমবাজার সৃষ্টি হয়েছে। এখন বিশ্বের ১৫৯টি দেশে কর্মী পাঠানো হচ্ছে। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ৯৭টি দেশে বাংলাদেশ থেকে কর্মী যেত।

গত পাঁচ বছরে বিদেশে বাংলাদেশি কর্মীদের কর্মসংস্থান বেড়েছে ৮২ শতাংশ। ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৩ সালের ২২ অক্টোবর পর্যন্ত বিদেশে কর্মী গিয়েছে ২৩ লাখ ৭৮ হাজার ১৩৬ জন। যেখানে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট সরকারের সময়ে পাঁচ বছরে ১৩ লাখ সাত হাজার ৮৮ জন কর্মী বিদেশ গিয়েছিল। সরকারি হিসাবে, বর্তমানে কমপক্ষে ৮৭ লাখ ১৭ হাজার প্রবাসী বাংলাদেশি বিদেশে কর্মরত আছেন।

রেমিটেন্স বেড়েছে, সঙ্গে নারী কর্মীও

বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যেও বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স। সরকারের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত পাঁচ বছরে মোট রেমিটেন্স এসেছে ৫৮.৩৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে যা ছিল মাত্র ১৮.৩৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই রেমিটেন্স বেড়েছে ২১৮ শতাংশ। অর্থাৎ ৪০.০৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি। পুরুষের পাশাপাশি নারী অভিবাসীর সংখ্যা বেড়েছে। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে বিদেশে নারী কর্মী ছিল ৪৩ হাজার ৮৩৮ জন। বর্তমানে এই সংখ্যা গিয়ে দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৬১ হাজার ৯ শ ২১ জনে। অর্থাৎ এক লাখ ১৮ হাজার ৮৩ জন বেশি নারী বিদেশে কাজের সুযোগ পেয়েছে। এখানে বৃদ্ধির হার ২শ ৬৯ ভাগ।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের ধারা অব্যাহত না থাকলে বিশ্ব মন্দার মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হতো। গত বছর পুরোটাই দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভালো ছিল না। এসব সংকটের মধ্যেও প্রবাসীদের কষ্টার্জিত টাকা দেশের অর্থনীতিকে বাঁচিয়েছে। তাই এই ধারা অব্যাহত রাখতে হবে।’

মানবপাচার রোধে টাস্কফোর্স

অভিবাসন ব্যয় কমানোর জন্য বৈধ পথের বাইরেও অবৈধভাবে বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি বিদেশ যেত। তবে অবৈধভাবে বিদেশ গেলে চরম ভোগান্তিতে পড়তো অনেক লোকই। অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটাতে হতো। অনেক সময় কারাগারে দিনের পর দিন পড়ে থাকতেন তারা। অন্যদিনে দেশে তাঁর স্বজনদের দিন কাটতে দুশ্চিন্তায়। তার ওপর অবৈধভাবে মালয়েশিয়া, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে ঢুুকে পড়ায় সেসব দেশের শ্রমবাজারে বাংলাদেশি কর্মীদের সুনামের পরিবর্তে দুর্নাম বাড়ছিল। এ রকম এক পরিস্থিতিতে মালয়েশিয়া বাংলাদেশিদের কাজের ভিসা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। এসব বিষয় মাথায় রেখে অবৈধ, অনিয়মিত অভিবাসন ও মানবপাচার ঠেকাতে স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, র‌্যাব ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি স্থায়ী ভিজিলেন্স টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই টাস্কফোর্স মানবপাচার রোধে বিশ্বের বিভিন্ন মহলে বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছে। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দক্ষ নেতৃত্বের কারণে এটি সম্ভব হয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।



স্বীকৃতি মিলেছে প্রবাসীদের, প্রযুক্তি নির্ভর সেবা

প্রবাসীদের অবদানকে স্বীকৃতি জানাতে অতীতে কোনো সরকারই সেই অর্থে উদ্যোগী হয়নি। প্রবাসীদের অর্জন সব সময়ই ছিল আড়ালে। কিন্তু প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রীর সদিচ্ছায় গত পাঁচ বছরে প্রবাসীদের গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য স্বীকৃতি ও সম্মাননা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ২০২১ সালের মধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার যে ঘোষণা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিয়েছিলেন সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নের পথকে আরও একধাপ এগিয়ে রাখতে কাজ করছে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অতীতে বিএমইটিতে কেবলমাত্র বিদেশে কাজ নিয়ে যেতে ইচ্ছুক কর্মীদের একটি তথ্যভা-ার ছিল। কিন্তু বর্তমান সরকারের গত মেয়াদে অভিবাসন কার্যক্রমকে পুরোপুরি ডিজিটালাইজড করা হয়েছে। অনলাইনে নিবন্ধন, বিদেশগামী কর্মীদের ছবিসহ আঙুলের ছাপের প্রিন্ট নেওয়া, আয়কর ও কল্যাণ ফি সংগ্রহ করা, অনলাইনে ভিসা চেকিং, অভিযোগ জমা দেওয়ার পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। এছাড়া সারাদেশে ইউনিয়ন ও তথ্যসেবা কেন্দ্র থেকে বিদেশে যেতে ইচ্ছুক কর্মীদের নিবন্ধিত করা হয়েছে। এর মাধ্যমে বিদেশে কাজ নিয়ে যেতে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমিয়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয়েছে।

স্মার্ট কার্ড পাচ্ছেন প্রবাসীরা, অনলাইনে ভিসা যাচাই

অতীতে বিদেশ যাওয়া ও কর্মীদের প্রবাস জীবনে বিভিন্ন ধরনের বিড়ম্বনার মুখোমুখি হতে হতো। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা জানান, বিদেশ যেতে ঝামেলা দূর করতে এবং নিরাপদ প্রবাস জীবন নিশ্চিতে কর্মীদের অত্যাধুনিক স্মার্ট কার্ড দেওয়া হয়েছে। ৩২ কেবি মেমোরির কম্পিউটার চিপস্ আছে এই কার্ডে। এতে কর্মীর ছবি, ফিঙ্গার প্রিন্ট, ব্যক্তিগত তথ্য এবং নিয়োগকর্তার তথ্য আছে। এতে একজনের নামের ভিসায় অন্যজনের বিদেশ যাওয়া বন্ধ হয়েছে। আবার জরুরি ক্ষেত্রে তথ্য পেতেও কোনো সমস্যা হচ্ছে না।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আগে ভিসা নিয়েও প্রতারণার শিকার হতেন কর্মীরা। দেশে বসে কাগজে প্রিন্ট করা যে ভিসা পেতেন তা অনলাইনে যাচাইয়ের ব্যবস্থা ছিল না। এতে অনেক সময় দেখা যেত, ভিসায় যে তথ্য দেওয়া আছে তা পুরোপুরি ঠিক নয়। কাজের ধরন কিংবা বেতন যা লেখা থাকতো বাস্তবে তার চিত্র ছিল ভিন্ন। এতে বিদেশে গিয়ে কর্মী প্রতারণার শিকার হতেন। কিন্তু অভিবাসন খরচ ওঠানোর কথা চিন্তা করে যেকোনো কাজই করতে হতো তাদের। এখন দেশে বসে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সিঙ্গাপুর, কাতার ও বাহরাইনের ভিসা অনলাইনে যাচাই করার সুযোগ তৈরি হওয়ায় এই ধরনের প্রতারণার ফাঁদ বন্ধ হয়েছে।

সূত্রগুলো আরও জানায়, আগে প্রবাস জীবনে বাংলাদেশি কর্মীদের সুবিধা-অসুবিধা শোনার জন্য দূতাবাস বা হাইকমিশনের বিকল্প ছিল না। তাও আবার দিনের পর দিন ধরনা দিয়ে একদিন হাইকমিশনের কর্মকর্তার দেখা পেতেন শ্রমিকরা। তাদের কাছে কোনো বিষয়ে অভিযোগ করে সুফল মিলতো, তাও নয়। কিন্তু এখন কর্মীরা যখন তখন অনলাইনে বসে প্রবাস জীবনের নানা সমস্যা নিয়ে অভিযোগ করতে পারেন। সর্বশেষ তথ্য মতে, এখন পর্যন্ত অনলাইনে ৫শ ১৫টি অভিযোগপত্র পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ৩শ ৫টির বেশি অভিযোগ নিষ্পত্তি করা হয়েছে। বাকিগুলো তদন্তাধীন আছে।

প্রবাসীদের কল্যাণে ব্যাংক

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অর্থের অভাবে অনেক সময় কর্মীরা চাকরি পাওয়ার পরও বিদেশে যেতে পারতেন না। আবার অনেকে শেষ সম্বল ভিটেমাটি বিক্রি করে বিদেশে যেতেন। বিদেশে যেতে ইচ্ছুক কর্মীদের অর্থের চিন্তা এখন অনেক কমে গেছে। কারণ, জাতীয় সংসদে পাস করা প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক আইনের আওতায় ব্যাংক চালু করা হয়েছে। কেউ বিদেশে চাকরি পেয়ে ঋণের আবেদন করলে চাকরির বিপরীতে সহজ শর্তে ঋণ নিতে পারেন। এছাড়া দেশে ফিরে কর্মসংস্থানের জন্য প্রবাসীদের স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়া হয়। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংক এ পর্যন্ত কমপক্ষে দুই হাজার ৫১০ জন বিদেশগামী কর্মীকে অভিবাসন ঋণ বাবদ প্রায় ২৫ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। জনসাধারণকে বেশি সেবা দেওয়ার জন্য সচিবালয়ের বাইরে মন্ত্রণালয়কে নিয়ে আসার পাশাপাশি এর অধীনে সব প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাকে একই ভবনে নিয়ে আসা হয়েছে। যাতে সাধারণ মানুষ সহজেই সেবা পান।

বেড়েছে ক্ষতিপূরণ

সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রবাসে কোনো কর্মী মারা গেলে তার মরদেহ আনা থেকে শুরু করে দাফন করা পর্যন্ত পরিবারের লোকজনদের নানা জটিলতায় পড়তে হয়। কিন্তু প্রবাসী কল্যাণের অংশ হিসেবে এই খাতেও বেড়েছে অনুদান ও ক্ষতিপূরণ। সূত্র জানায়, প্রবাসে কর্মরত অবস্থায় কোনো কর্মী মারা গেলে তাঁর মরদেহ নিয়ে আসা ও দাফন খরচ বাবদ ইতিপূর্বে ২০ হাজার টাকা অনুদান সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হতো। এখন এর পরিমাণ বাড়িয়ে ৩৫ হাজার টাকা করা হয়েছে। এছাড়া মরদেহ বহনের জন্য বিমানবন্দর থেকে মৃতের উত্তরাধিকারীদের কাছে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য সব আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস চালুর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। আবার যেসব কর্মী বিদেশে স্বাভাবিকভাবে মারা যান তাদের সংশ্লিষ্ট দেশের শ্রম আইন অনুযায়ী কোনো আর্থিক ক্ষতিপূরণ পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। সেক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের অভিবাসীবান্ধব নীতির ওপর ভর করে কল্যাণ তহবিল থেকে আগের নিয়মে এক লাখ টাকার পরিবর্তে বর্তমানে তিন লাখ টাকা আর্থিক সাহায্য দেওয়া হচ্ছে।

সর্বশেষ সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ২০০৯ সাল থেকে ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিদেশে মারা যাওয়া কর্মীদের পরিবারকে আর্থিক অনুদান হিসেবে ৬৭ কোটি ৯৫ লাখ ৭৪ হাজার ১৪১ টাকা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া প্রবাসে মারা যাওয়া কর্মীদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ বা বকেয়া বেতন হিসেবে একই সময়ে ১২০ কোটি ৬৪ লাখ ৫৮ হাজার ৪৩০ টাকা দিয়েছে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়।

কর্মীদের দক্ষতা বাড়াতে তৎপর সরকার

আলাপকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন বলেন, অদক্ষ কর্মীর চেয়ে দক্ষ কর্মী দেশের অর্থনীতিতে বেশি অবদান রাখতে পারে। কারণ তুলনামূলকভাবে দক্ষ কর্মীর আয় অদক্ষ কর্মীর আয়ের চেয়ে বেশি।

বিষয়টিকে মাথায় রেখে তাই সরকার কর্মী নয়, দক্ষ কর্মী রপ্তানিতে বেশ নজর দিচ্ছে বলে বিএমইটির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন।

সূত্র জানায়, বর্তমান সরকারের গত মেয়াদেই দক্ষ কর্মী গড়ে তোলার জন্য ১৪০ কোটি টাকার একটি তহবিল করা হয়েছে। যা থেকে প্রতিবছর প্রায় ১৪ কোটি টাকা লাভ পাওয়া যায়। এই টাকা বিদেশে যেতে ইচ্ছুক কর্মীদের দক্ষতা বাড়ানোর কাজে ব্যয় করা হচ্ছে। সরকারি তথ্যমতে, বিএমইটির অধীনে ৩৮টি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের মাধ্যমে ৪৮টি কর্মসংস্থান উপযোগী ট্রেডে বিদেশে যেতে ইচ্ছুক কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এরই মধ্যে আড়াই লাখের বেশি কর্মী প্রশিক্ষণ নিয়ে দক্ষ হয়ে উঠেছে। এছাড়া ৩৫টি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের কাজ এ বছরের মধ্যে শেষ হবে। আগামী বছর থেকে দেড় লাখ কর্মীকে এসব কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ দেওয়া সম্ভব হবে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে দেশের প্রতিটি উপজেলায় একটি করে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই কেন্দ্রগুলোর কাজ শেষ হলে বছরে প্রায় ছয় লাখ কর্মীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া যাবে। অথচ বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় পাঁচ বছরে মাত্র ৮০ হাজারের কাছাকাছি কর্মীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। আগে নারীদের বিদেশ যেতে কোনো প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো না। এখন বিদেশে যেতে চান এমন নারীদেরও হাউজকিপিংয়ের ওপর ২১ দিনের প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এতে বিদেশে গিয়ে নারী শ্রমিকরা অত্যাধুনিক যন্ত্রাংশের ব্যবহার ও রক্ষণাবেক্ষণে অবদান রাখতে পারছেন। এছাড়া বিদেশের শ্রমবাজারে দক্ষ নারী কর্মীদের চাহিদাও বাড়ছে। বিদেশে কাজ নিয়ে যাওয়ার আগে সব কর্মীকেই তিনদিনের এবং মালয়েশিয়াগামীদের ১০ দিনের ওরিয়েন্টেশন প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

প্রতিকূলতার মধ্যে প্রবাসী কল্যাণে বিদেশে শ্রম উইং

গত ৫ জুন জাতীয় সংসদে বাজেট পেশকালে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত দেশের অর্থনীতিতে প্রবাসীদের অবদানের ভূয়সী প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, সরকার বৈদেশিক কর্মসংস্থান খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি, প্রবাসীদের কল্যাণ ও ভালোমন্দ দেখাশোনা করা সরকারের দায়িত্ব। সরকার তা করে যাচ্ছে। অর্থমন্ত্রী জানান, নতুন করে ১২টি দেশে শ্রম উইং খোলা হয়েছে। আরও ১১টি দেশে শ্রম উইং খোলা হবে। এই উইংগুলো প্রবাসে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের কল্যাণের বিষয়ে দেখাশোনা করবে। পাশাপাশি নতুন বাজার, কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য কাজ করবে।

গত ১৭ জুন জাতীয় সংসদের প্রশ্নোত্তর পর্বে প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী জানান, বর্তমানে যেসব দেশে কর্মী পাঠানো হচ্ছে, সেসব দেশে অধিক হারে শ্রমবাজার সম্প্রসারণে ইতোমধ্যে শ্রম উইংয়ের সংখ্যা ১৩ থেকে ২৮টিতে উন্নীত করা হয়েছে। আরও ১১টি নতুন শ্রম উইং খোলার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে। ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশে অধিক হারে বাংলাদেশের জনশক্তি পাঠানোর লক্ষ্যে নতুন নতুন শ্রম উইং সৃষ্টির পাশাপাশি বিদ্যমান শ্রম উইংগুলোর জনবল বাড়ানোর পরিকল্পনা আছে।

জনশক্তি প্রেরণকারীদের সংগঠন বায়রার সভাপতি আবুল বাশার ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘বিদেশে বাংলাদেশি দূতাবাস বা মিশনগুলোর কার্যক্রম নিয়ে প্রবাসীদের অভিযোগের শেষ নেই। দূতাবাসের কর্মকর্তারা যেভাবে প্রবাসী শ্রমিকদের কল্যাণে কাজ করার কথা, তা করছে না। তাই শ্রম উইং প্রবাসীদের কল্যাণে কাজ করতে পারলে অবশ্যই এটি বাড়ানো দরকার।’

নতুন আইন তৈরি

জনশক্তি রপ্তানি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, গত পাঁচ বছরে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সাফল্যের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূূর্ণ হলো অভিবাসন আইন সংশোধন। ‘ইমিগ্রেশন অর্ডিন্যান্স-১৯৮২’ আরও যুগোপযোগী করার জন্য ‘বৈদেশিক কর্মসংস্থান এবং অভিবাসী আইন-২০১৩’ নামে একটি নতুন আইন তৈরি করা হয়েছে। এটি বিদেশে কর্মীদের নিরাপদ কর্মসংস্থান এবং রিক্রুটিং এজেন্সির জবাবদিহিতা অনেক বেশি নিশ্চিত করেছে।

এছাড়া চারদলীয় জোট সরকার আমলে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক সনদ (১৯৯০টি) অনুস্বাক্ষর করা হয়নি। কিন্তু বর্তমান সরকার গত ২০১১ সালের ২৪ আগস্ট সনদটি অনুসমর্থন করেছে। এতে বাংলাদেশ অভিবাসী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের নিরাপদ প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসন উপযোগী পরিবেশ তৈরিতে এগিয়ে গেছে।

পাদটীকা : শেখ হাসিনা কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদারের লক্ষ্যে গত মেয়াদে আস্থা রেখেছিলেন নবিশ রাজনীতিক ডা. দীপু মনির ওপর। বিদেশ ভ্রমণে গোটা ৫ বছর কাটিয়ে দিলেও তাঁর প্রাপ্তির খাতায় অর্জন শূন্য। ভালো চিকিৎসকখ্যাত রুহুল হক মন্ত্রী হয়ে কাড়ি কাড়ি টাকা বানিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। কমিউনিস্টখ্যাত মান্নান খান প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পর সম্পদের পাহাড় গড়েছিলেন বলে দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্তে বেরিয়ে আসছে নানা তথ্য। সাম্যবাদী দীলিপ বড়–য়া মন্ত্রী হওয়ার পর আগের তুলনায় কীভাবে বিত্ত-বৈভবের দিকে নজর দিয়েছেন তা নিয়ে পত্রপত্রিকায় লেখালেখি কম হয়নি।

কিন্তু শৈশবকাল থেকে বিত্ত-বৈভবের মধ্যে যিনি বেড়ে উঠেছেন সেই খন্দকার মোশাররফ হোসেন কিন্তু ঠিকই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় গিয়ে কীভাবে নির্লোভ থেকে নিজেকে দেশের সেবায় নিয়োজিত করতে হয় তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছেন। স্বনির্ভর বাংলাদেশ গড়তে এরকম খন্দকার মোশাররফ হোসেনদেরই বড় বেশি প্রয়োজন। প্রয়োজন তাঁর থেকে শিক্ষা নিয়ে তাঁকে অনুসরণ করাও।  

(ঢাকাটাইমস/২৮ জুন/ এআর/ ঘ.)