logo ০১ মে ২০২৫
নতুন ট্যাক্সিক্যাবে সন্তুষ্ট নগরবাসী, ভাড়া নিয়ে অতৃপ্তি
তানিম আহমেদ, ঢাকাটাইমস
২৫ জুন, ২০১৪ ১৪:৪৯:৫৫
image

ঢাকা: মাহবুবুল আলম রবিন পড়াশোনা করেন ঢাকা কলেজে, থাকেন কল্যাণপুরের ইস্টার্ন হাউজিং আবাসিক এলাকায়। এক বন্ধুকে বিদায় জানাতে গিয়েছেন বিমানবন্দরে। ফেরার পথে সবাই মিলে নিলেন একটি বিলাসবহুল ট্যাক্সিক্যাব।


এই সময়কে রবিন বলেন, ট্যাক্সিক্যাব নিয়ে অনেক আলোচনা- সমালোচনা শুনেছি। বিমানবন্দর থেকে কল্যাণপুর পর্যন্ত সাড়ে ১৬ কিলোমিটারের ভাড়া উঠেছে ৬৬২ টাকা। টাকা বেশি হলেও গাড়িটি আরামদায়ক। ভাড়া আরেকটু কম হলে আমাদের সবার জন্য সুবিধা হতো।


নব্বই দশকের শেষ দিকে ঢাকায় ট্যাক্সিক্যাব চালু হলেও যাত্রীসেবার মান নিয়ে ছিল বড় ধরনের প্রশ্ন। মিটারে না চলা, যাত্রীদের ই”ছামতো গন্তব্যে যেতে না চাওয়া আর লক্কড় ঝক্কড় গাড়ির জন্য যাত্রীদের বিরক্তির কারণ ছিল বাহনগুলো। এসব সমস্যা সমাধানে গত ২৩ এপ্রিল থেকে নামানো হয়েছে নতুন ট্যাক্সিক্যাব। বিলাসবহুল এই ক্যাবগুলো যাত্রীসেবায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে, এমন আশ্বাস দিয়েছে সরকার।  


নতুন গাড়িগুলো যাত্রীসেবায় কী পরিবর্তন এনেছে? বেলা সাড়ে এগারোটার দিকে সেগুনবাগিচায় দুর্নীতি দমন কমিশনের কার্যালয়ের সামনে ক্যাব নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন চালক আনোয়ার হোসেন। তার প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে ঢাকাটাইমসকে তিনি বলেন, ‘আমি নয় বছর ধরে ঢাকার রাস্তায় গাড়ি চালাই। যাত্রীদের অনেক হয়রানি হতে দেখেছি। অনেক সময় যাত্রীরা গাড়ির  জন্য অপেক্ষা করেও গাড়ি পেত না। কিন্তু এখন আপনি ঢাকা শহরের যেখান থেকে ফোন করবেন সেখানেই আমরা পৌঁছে যাব। আবার ভাড়া নিয়েও নেই ঝামেলা, মিটারের নির্ধারিত ভাড়াই। আমাদের দেশে এটা নতুন একটি ধারণা।’


বিআরটিএ জানায়, তমা কনস্ট্রাকশন এবং সেনা কল্যাণ ট্রাস্টকে প্রাথমিক পর্যায়ে ঢাকা মহানগরে ২৫০টি করে ৫০০টি ট্যাক্সিক্যাব নামানোর অনুমতি দেওয়া হয়। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত টয়োটা প্রিমিও, এলিয়ন ও এক্সিও গাড়িগুলো হবে সর্বনিম্ন ১৫শ সিসির। নির্ধারিত ভাড়া এবং যাত্রীদের ইচ্ছামতো গন্তব্যে যাবে গাড়িগুলো।


আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নতুন ট্যাক্সিক্যাবে (শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত) যাত্রীদেরকে প্রতি কিলোমিটারের জন্য ভাড়া দিতে হবে ৩৪ টাকা করে। তবে আর প্রথম দুই কিলোমিটার বা এর কম দূরত্বের জন্য দিতে হবে ৮৫ টাকা। এছাড়া রাস্তায় আটকে থাকলে প্রতি মিনিটের জন্য দিতে হবে ৮ টাকা করে।


এই ভাড়ায় যাত্রী পাওয়া যায় কি না জানতে চাইলে তমা কনস্ট্রাকশনের ট্যাক্সিক্যাব প্রকল্পের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোস্তফা কামাল ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমারা যাত্রীদের সাড়া পাচ্ছি অনেক। আমাদের কোনো গাড়িই বসে নেই। যাত্রীরা আমাদের ফোন করলে গাড়ি ঢাকার যেকোনো জায়গায় চলে যায়। আর ভাড়া নিয়ে যাত্রীদের কোনো অভিযোগ আমরা পাইনি। ভাড়া বেশি হলেও আমরা তাদের মানসম্মত সেবা দিচ্ছি।’


তমা কনস্ট্রাকশনের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের গাড়ি গ্যাসে নয় অকটেনে চলে। এছাড়াও আমাদের গাড়িতে জিপিএস সিস্টেম চালু আছে। যাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য আমাদের প্রতিটি গাড়িতে সিসি ক্যামেরা আছে। কোথাও যদি কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে তাহলে আমরা গাড়ি সেখানে বন্ধ করে দিতে পারব। এতে কারো পক্ষে গাড়ি চালু করা সম্ভব হবে না।


এছাড়াও যাত্রীদের সুবিধার জন্য আমরা সার্বক্ষণিক কাস্টমার সার্ভিস সেন্টার চালু করেছি। এতে প্রায় ৪০টি মোবাইল ফোন চালু রেখেছি। এখানে যাত্রীরা অভিযোগও করতে পারবে। যাত্রীদের অভিযোগের ভিত্তিতে আমরা একজন চালকে বরখাস্তও করেছি।’


নন-এসি ট্যাক্সিক্যাবের জন্য প্রথম দুই কিলোমিটারের ভাড়া ৫০ টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে।  পরের প্রতি কিলোমিটারের ভাড়া ২০ টাকা। প্রতি দুই মিনিট যাত্রাবিরতির জন্য দিতে হবে ৫ টাকা।


সিএনজিচালিত অটোরিকশার দৌরাত্ম্যে বিরক্ত যাত্রীদের জন্য এই ক্যাবগুলো ভালো বিকল্প হতে পারত, তবে গাড়িগুলো এখনো নামেনি। কবে নামবে তাও জানাতে পারেনি তমা কনস্ট্রাকশনের কর্মকর্তারা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়িগুলো নিয়ে ভাবছি। এই প্রকল্প সফল হলে আমরা নন-এসি নিয়ে চিন্তা করব।’


চুক্তি অনুযায়ী তমা কনস্ট্রাকশন নামাবে মোট ২৫০টি গাড়ি। এগুলো চলবে ঢাকা ও এর আশপাশে। আর সেনা কল্যাণ ট্রাস্ট নামাবে ৪০০টি। এর মধ্যে ঢাকা ও আশপাশে আড়াইশটি এবং চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে চলবে ১৫০টি।


তমা কনস্ট্রাকশন সূত্রে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত ৭৭টি গাড়ি ঢাকার রাস্তায় চলছে। ১০টি গাড়ি রাস্তায় নামার অপেক্ষায় আছে। যেকোনো সময় নামবে গাড়িগুলো। এছাড়া ২৪টি গাড়ি বন্দরে আছে। জুনের মধ্যেই ঢাকায় পৌঁছবে এগুলো।


তমা কনস্ট্রাকশনের ট্যাক্সিক্যাব প্রকল্পের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোস্তফা কামাল ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমরা ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত সময় নিয়েছি। এর মধ্যেই আমাদের বাকি ১৩৯টি গাড়ি ঢাকায় পৌঁছবে।’


তমা কনস্ট্রাকশন কর্মকর্তারা অভিযোগ করে বলেন, বিআরটিএ, সিটি করপোরেশন এবং ডিএমপির কাছে বারবার যোগাযোগ করা সত্ত্বেও এখনো পার্কিং-এর জন্য নির্ধারিত স্থান পাওয়া যায়নি। এ কারণে অনেক ঝামেলায় পড়তে হচ্ছে। অনেক সময় পুলিশ গাড়ি রেকার করে নিয়ে যায়। এতে অসুবিধায় পড়তে হয়।


এক কর্মকর্তা বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আমাদের গাড়ি কম, এর পর যদি পুলিশ গাড়ি নিয়ে যায় তাহলে যাত্রীদের হয়রানিতে পড়তে হয়।’


এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ডিএমপি (ট্রাফিক) অতিরিক্ত কমিশনার মিলি বিশ্বাস ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘তমা কনস্ট্রাকশন আমাদের কাছে দরখাস্ত দিয়েছে। তবে আমরা তো একক সিদ্ধান্তে তাদেরকে পার্কিং-এর জায়গা দিতে পারি না। এটা সিটি করপোরেশনের ব্যাপার। সিটি করপোরেশনের সঙ্গে বসে এ ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত নেব।’


বাংলাদেশে প্রথম ট্যাক্সিক্যাব নামানো হয় ১৯৯৭ সালে। সে সময় কালো রঙের নন-এসি এবং হলুদ রঙের এসি ক্যাব চালু করা হয়। একাধিক কোম্পানি ট্যাক্সিক্যাব আমদানি করে। এর মধ্যে ক্যাব- স্যালিডা, অনুদীপ এবং ক্যাব-এক্স কোম্পানির নামে আমদানি করা হয় খুবই নিম্নমানের ক্যাব। নাভানাসহ দুটি কোম্পানি উন্নতমানের ক্যাব আমদানি করে।


বিশেষ করে ২০০২ সালে ক্যাব-এক্স অস্বাভাবিক নিম্নমানের ক্যাব আমদানি করে, যেগুলো বছর ঘুরে আসার আগেই অকেজো হয়ে যায় এবং এর ফলে অসংখ্য ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী সর্বস্বান্ত হয়। এরপর নতুন করে আর ট্যাক্সিক্যাব আমদানি করা হয়নি। সে অভিজ্ঞতার আলোকেই মহাজোট সরকারের আমলে একটি বা দুটি নির্দিষ্ট কোম্পানিকে পূর্বনির্ধারিত মানের ক্যাব আমদানির অনুমতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।


বিমানবন্দরে ঢুকতে পারে না নতুন ক্যাব


যাত্রী পরিবহনের অনুমিত থাকা সত্ত্বেও বিমানবন্দর এলাকায় নতুন ট্যাক্সিক্যাব ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন চালকরা। এক চালক বলেন, ‘ভাড়ায়চালিত প্রাইভেট কারের জন্য আমরা যাত্রী নিয়ে বিমানবন্দর এলাকায় যেতে পারি না।’ তমার কর্মকর্তারা জানান, বিআরটিএ চিঠি এবং সিভিল এভিয়েশন-এর চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করা সত্ত্বেও তারা এর কোনো সমাধান পাচ্ছেন না।


নির্ধারিত ভাড়ার ক্যাব না থাকায় বিমানবন্দরে থাকা প্রাইভেট কার চালকগুলো ইচ্ছামতো ভাড়া আদায় করছে। সবাই মিলে একজোট হয়ে যাত্রীদের অতিরিক্ত ভাড়া দিতে বাধ্য করছে। মাঝেমধ্যে ছিনতাইয়ের ঘটনাও ঘটছে এসব ভাড়া করা গাড়িতে। ট্যাক্সি ক্যাবগুলো বিমানবন্দরে ঢুকতে দিলে এসব সমস্যার সমাধান হতো বলছেন এক কর্মকর্তা।


কম ভাড়ার গাড়ির অভিজ্ঞতাও ভালো নয়


২০০৮ সালে এসি ট্যাক্সিক্যাবের ভাড়া ছিল প্রথম দুই কিলোমিটারের জন্য ৪০ টাকা। পরবর্তী প্রতি কিলোমিটারের জন্য ৮ টাকা। প্রতি দুই মিনিট যাত্রাবিরতির জন্য এক টাকা। ২০১০ সালে নতুন ট্যাক্সিক্যাব নামানোর কথা বলে ভাড়া বাড়িয়ে প্রথম দুই কিলোমিটারে ভাড়া ছিল ৬০ টাকা, পরবর্তী প্রতি কিলোমিটারে ১৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়। প্রতি দুই মিনিট যাত্রাবিরতির জন্য ধরা হয় পৌনে ৪ টাকা। কিš‘ গত তিন বছরে কোনো ট্যাক্সি রাস্তায় নামেনি।


ট্যাক্সিক্যাবের জন্য নির্ধারণ করা ভাড়াকে যৌক্তিক ও বাস্তবসম্মত বলে দাবি করেছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। বিআরটিএ বলেছে, ট্যাক্সিক্যাব নীতিমালা অনুযায়ী ১৯৯৮ সালে যে ট্যাক্সিক্যাব নামানো হয়েছিল, তা অত্যন্ত নি¤œমানের এবং সর্বনিম্ন ইঞ্জিন সিসি ছিল ৮০০। ফলে ওগুলো অল্প কিছুদিনের মধ্যে নষ্ট হয়ে যায়।


ওই সময় ভাড়া নির্ধারণে ব্যয় বিশ্লেষণ করে ট্যাক্সিক্যাবের দাম ধরা হয়েছিল তিন লাখ টাকা। পরে বিভিন্ন সময় ট্যাক্সিক্যাবের মূল্য, যন্ত্রাংশ, মেরামত খরচ ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি পেলেও সেই তুলনায় ব্যয় বিশ্লেষণ করে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়নি। ২০১০ সালে ট্যাক্সিক্যাব সার্ভিস গাইডলাইন করা হলেও গাড়ি নামানো যায়নি।


(ঢাকাটাইমস/২৫জুন/টিএ/এএসএ)