logo ০১ মে ২০২৫
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসাইন্স এন্ড হসপিটাল
ঝকঝকে তকতকে অনন্য এক হাসপাতাল
মহিউদ্দিন মাহী ও আশিক আহমেদ
০২ জুলাই, ২০১৪ ২০:৫৬:৪৯
image


ঢাকা: ‘বাংলাদেশে সরকারি কোনো হাসপাতালে যে এরকম পরিবেশে চিকিৎসা হয় তা কখনও ভাবিনি। মনে হচ্ছে বিদেশি কোনো হাসপাতালে ঢুকেছি, চিকিৎসা সেবা নিচ্ছি।’ কথাগুলো বলছিলেন শিলা পারভীন নামে রোগীর এক স্বজন। তিনি এসেছেন ফরিদপুরের বোয়ালমারী থেকে। তার পিতার মাথায় সমস্যা নিয়ে। গত সপ্তাহে ঢাকায় এনেছেন চিকিৎসার জন্য। ভর্তি করেছেন জাতীয় নিউরোসাইন্স ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে।

গত রবিবার তাঁর বাবার অপারেশন হয়েছে। চিকিৎসক আর নার্সদের নিবির পরিচর্যায় তার বাবা ধীরে ধীরে ভালো হয়ে উঠছেন। হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা এবং পরিবেশ দেখে তিনি মুগ্ধ । তিনি বললেন, ‘এমন জানলে আমি আরও আগেই বাবাকে এই হাসপাতালে নিয়ে আসতাম। সরকারি হাসপাতাল যে এতো পরিচ্ছন্ন ও আধুনিক সেবা দিতে পারে। তা কখনও কল্পনাও করিনি।’ 



নিউরোসাইন্স ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল নিয়ে নাসিমা আক্তার রূবীর অভিমতও একই। তিনি এসেছেন রাজধানীর মোহাম্মদপুর থেকে। তার স্বামী নিউরো রোগী। তিনি বলেন, ‘এখানকার পরিবেশ অনেক চমৎকার। এখানে রোগীরা আসলে পরিবেশ দেখেই অনেকটা ভাল হয়ে যায়। এছাড়া চিকিৎসকদের আন্তরিকতাও যথেষ্ট।’



আমাদের দেশে সরকারি হাসপাতালগুলো সম্পর্কে সেবাগ্রহণকারীদের অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। গড়পরতায় সবার অভিজ্ঞতাই তিক্ত। সরকারি হাসপাতাল বলতে বুঝায় গাদা-গাদা রোগী আর অপরিচ্ছন্নতা। বিধগুটে গন্ধ। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। রোগীদের দেখার কেউ নেই। চিকিৎসক-কর্মকর্তা-নার্সদের দেখা পাওয়া যেখানে খুব কঠিন। এমনসব নেতিবাচক ধারণাই সর্বত্র আলোচিত।

কিন্তু এসবের মধ্যে বাংলাদেশে জাতীয় নিউরো সাইন্স ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল এক নতুন অধ্যায় সৃষ্টি করেছে। সরকারি হাসপাতালের ধারণাই পাল্টে দিয়েছে। আধুনিক সেবা এবং স্বাস্থ্যকর পরিবেশে নিশ্চিত করাই যেখানে সবার ব্রত।

এ নিয়ে কথা হয় হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. কাজী দীন মোহাম্মদের সঙ্গে । তিনি ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ নিউরোসাইন্স ৩০০ বেডের বিশেষায়িত হাসপাতাল। এই হসপিটাল দেশের স্বাস্থ্যখাতে একটি বড় মাইলফলক বলে আমি মনে করি। এখানকার চিকিৎসক-কর্মকর্তাসহ সকলের আন্তরিক কর্মনিষ্ঠার কারণে উন্নত সেবা এবং আধুনিক পরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে।’

এক প্রশ্নের জবাবে খ্যাতিমান এই চিকিৎসক বলেন, ‘জনবল দিয়ে কাজ করানো এবং এর উপর দৃষ্টি রাখাটা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এই দুইটার মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে পারলে সবকিছুই সম্ভব। নিজের মনে করে কাজ করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দেশের কল্যাণে কাজ করতে হয়। মানুষের উপকার করার চেষ্টা থাকলে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। এই হাসপাতালে কাজ এবং সেবা এই দুইটার উপর আলাদা গুরুত্ব দেয়া হয়। ফলে সকলেই যার যার কাজ সুচারু রূপে সম্পন্ন করে। এজন্যই আমাদের পরিবেশ এবং সেবার মান ধরে রাখতে সক্ষম হচ্ছি। ’

রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে অবস্থিত প্রতিষ্ঠানটি স্নায়ুরোগের চিকিৎসার জন্য দেশের একমাত্র ও এশিয়ার অন্যতম বৃহত্তম হাসপাতাল। ২০১২ সালের ১২ সেপ্টেম্বর উদ্বোধনের পর ১৯২ শয্যা নিয়ে চিকিৎসাসেবা দেয়া শুরু করে এই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এখন শয্যা সংখ্যা ৩০০ টি। যদিও ক্রমান্বয়ে ৫০০ শয্যার হাসপাতাল করার কথা রয়েছে। ৯তলা বিশিষ্ট এই হাসপাতালটির অষ্টম এবং নবম তলায় শয্যা তৈরির কাজ কিছুদিন আগে সম্পূর্ণ হয়েছে।  

তবে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) এবং হাই ডিপেনডেন্সি ইউনিট (এইচডিইউ) এখনও চালু হয়নি। তবে জরুরি বিভাগে সীমিত আকারে ও বহির্বিভাগে পুরোপুরি চিকিৎসা সেবা দেয়া হচ্ছে প্রতিদিনই।



সরেজমিনে হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, পূর্বমুখী হাসপাতালের প্রবেশপথেই সিসি ক্যামেরা বসানো। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পরিবেশ। দেখে বোঝার উপায় নেই যে, এটি বাংলাদেশের কোনো হাসপাতাল।

হাসপাতালের ওয়ার্ড বয় অপূর্ব জানান, ‘হাসপাতালের পরিচালনায় যারা রয়েছেন তাদের সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণের কারণে হাসপাতালটির পরিবেশ অনেক সুন্দর। দুই ঘণ্টা পর পর হাসপাতালের পরিচ্ছন্নতার কাজ করা হয়। যার জন্য এর পরিবেশ ঝকঝকে। ’

আবিদা নামে এক পরিচ্ছন্ন কর্মী জানান, ‘সকাল সাতটায় হাসপাতালে আসি। আর রাত ১০টায় বাসায় যাই। এরমধ্যে অনেকবার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করা হয়। যারফলে ময়লা হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আর আমাদের পরিচালক স্যার খুবই কড়া, কাজে ফাঁকি দেয়া যায় না।’



হাসপাতালের রিসিপশন সেন্টারের কর্মকর্তারাও বেশ আন্তরিক বলে জানিয়েছেন রোগীর স্বজনরা। ময়মনসিংহের ভালুকা থেকে আগত স্বদেশ সরকার ঢাকাটাইমসকে জানান, ‘ভাই অনেক দূর থেকে এসেছি। এটাই প্রথম আগমন। ভেবেছিলাম ডাক্তার দেখাতে পারবো কি না। কিন্তু এসে দিকে এলাহী কাল্ড। এমন সরকারি হাসপাতাল আমার জীবনে দেখি নাই। এখানে প্রবেশ করেই রিসিপশনে জানতে চাইলাম। পরে সব কিছু তারা বলে দিলেন কি করতে হবে, কার কাছে যেতে হবে, ইত্যাদি। এই সেবাটাই অন্যান্য হাসপাতালে পাওয়া যায় না।’

এ হাসপাতালের আরেকটি বিশেষ দিক রয়েছে আর তা হচ্ছে বহির্বিভাগ এবং এই বিভাগ থেকে রোগীদেরকে বিনামূল্যে ওষুধ দেয়া হয়। অন্যান্য হাসপাতালে ওষুধ চুরির অভিযোগ থাকলেও এই হাসপাতালের নার্স, আয়া, বয় ও সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ওষুধ চুরির কোনো অভিযোগ নেই।



হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আজিমপুর থেকে আসা মিনা জানান, ‘দুইবার এ হাসপাতালে এসেছি। দুই দিনে হাসপাতাল থেকে যেসব ওষুধ দেয়া হয়েছে সেগুলো এখানকার বহির্বিভাগ থেকেই পেয়েছি।’

ময়মনসিংহ থেকে আসা আরেক রোগীর ভাই ইমরান বলেন, ‘এ হাসপাতাল অনেক পরিচ্ছন্ন এবং চিকিৎসাসেবার মান দেশের যে কোনো সরকারি হাসপাতালের চেয়ে ভালো। পরিবেশ দেখে মনে হয়, কোনো বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছি। তবে ভর্তি হতে একটু সময় বেশি লাগে। এই সমস্যাটা ছাড়া এ হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা অনন্য।’

হাসপাতালে দ্রুত আইসিইউ চালুর দাবি জানিয়ে চিকিৎসাধীন এক রোগীর ছেলে শাহীন টিপু বলেন, ‘তার বাবা স্ট্রোক করার পর আইসিইউতে ভর্তি অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছিল। কিন্তু এখানে আইসিইউ সুবিধা না থাকায় তার বাবাকে একটি বেসরকারি হাসপাতালে আইসিইউ সুবিধা দেয়া হয়েছে। এতে প্রতিদিন প্রায় ১৫ হাজার টাকা করে খরচ হয়েছে। কিন্তু এই হাসপাতালে আইসিইউ ব্যবস্থা থাকলে প্রতিদিন গড়ে তিন থেকে চার হাজার টাকা লাগত।’

হাসপাতালের এক প্রশাসনিক কর্মকর্তা জানান, স্নায়ুরোগে আক্রাস্ত রোগীদের মস্তিষ্কে অথবা শরীরের অন্য কোথাও অস্ত্রোপচারের পর পূর্ণ নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রাখার নিয়ম থাকলেও এখানে আইসিইউ নেই। কিছুটা কম ঝুঁকির মধ্যে থাকা রোগীদের জন্য হাই ডিপেনডেন্সি ইউনিট (এইচডিইউ) চালু করার কথা থাকলে সেটাও চালু করা সম্ভব হয়নি। পরীক্ষামূলকভাবে চলছে স্বল্প পরিসরে সকাল ৭টা থেকে দুপুর ৩টা পর্যন্ত জরুরি বিভাগের কার্যক্রম। বর্তমানে সেখানে মাত্র ১২টি বেডে রোগীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। আটটি অপারেশন থিয়েটারের মধ্যে চারটিতে অস্ত্রোপচার করা হয়। তিনি জানান, ‘এ হাসপাতালে বর্তমানে ১৩০ জন চিকিৎসক, ১৩০ জন স্থায়ী ও ১৮৯ জন নার্স অস্থায়ীভাবে কাজ করেন। তবে সম্প্রতি আরো ৭২ জন তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী (টেকনিশিয়ান ও মেডিকেল টেকনোলজিস্ট) নিয়োগ দেয়া হয়।



চারটি অপারেশন থিয়েটারে প্রতিদিন গড়ে পাঁচটির মতো অপারেশন করা হয়। তবে প্রতিদিন আউটডোর ও ইনডোর মিলে গড়ে দুই থেকে তিনশ রোগী চিকিৎসাসেবা নিতে আসেন। শয্যা সংখ্যা কম থাকায় প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে রোগী এসে ফিরে যাচ্ছেন। তবে শয্যা সংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টা চলছে বলে তিনি জানান।’



এ ব্যাপারে জাতীয় নিউরো সায়েন্স ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের যুগ্ম পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. বদরুল আলম ঢাকাটাইমসকে জানান, ‘নতুন বেড সংযোজন, আইসিইউ, এইচডিইউ, জরুরি বিভাগের সব চিকিৎসাসেবা চালু করতে হলে তাদের চিকিৎসক এবং নার্সের সংখ্যা আরো বাড়াতে হবে। বর্তমান জনবল সঙ্কটের কারণে রোগীর সংখ্যা বাড়লে সেবার মান ধরে রাখা যাবে না। আরো কমপক্ষে ১০০ ডাক্তার এবং ৩০০ নার্স থাকলে তাদের চিকিৎসাসেবার পরিধি বাড়ানো সম্ভব হতো। তাদের যন্ত্রপাতির কোনো সমস্যা নেই, তবে লোকবলের কারণে হাসপাতালটি পরিপূর্ণভাবে চালু করা সম্ভব হচ্ছে না।’

তিনি আরো বলেন, ‘এখানে ভর্তি হতে সময় লাগে তার কারণ হাসপাতালে রোগীদের এমআরআই পরীক্ষার জন্য সিরিয়াল পেতে দেরি হয়। কারণ তাদের যে উন্নত মেশিন রয়েছে তা আর কোনো হাসপাতালে নেই। রোগী অনেক, তাই সিরিয়াল পেতে দেরি হয়। সিরিয়াল অনুযায়ী একটি মেশিন দিয়ে রোগীদের রোগ নির্ণয় করতে হয়। তাই সময় একটু বেশি লাগে। এ যন্ত্রের দাম প্রায় ১৫-২০ কোটি টাকা। চাইলেও এ রকম যন্ত্র বাড়ানো যাচ্ছে না। তবে আইসিইউ তৈরির কাজ প্রায় ৮০ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন।’



ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো-সাইন্স এন্ড হসপিটালের সহকারি পরিচালক শাহ আমিনুল হক চৌধুরী ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘এটি একটি বিশেষায়িত হাসপাতাল। এটির চিকিৎসা সেবা থেকে শুরু করে হাসপাতালের পরিবেশ সুন্দর রাখা সকল কিছুই শক্তভাবে মনিটরিং করা হয়। এখানে যারা কাজ করেন তারা চাকরি করার মানুষিকতা নিয়ে কাজ করেন না। সবাই সেবার ব্রত নিয়েই এখানে কাজ করেন। ফলে সকল কিছুই নিয়মতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত হয়। ’



তিনি বলেন, ‘নিউরো সাইন্স হাসপাতালের সেবার মান উন্নত রাখা এবং পরিবেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার বিষয়ে আমরা আমাদের অন্তরের কাছে দায়বদ্ধ। সেই দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে আমরা সেবা দিচ্ছি। এজন্যই এখানের পরিবেশ অনেক সুন্দর এবং চমৎকার।’



স্বপ্ন অনেক বড় উল্লেখ করে এই চিকিৎসক বলেন, ‘আমরা শুধু হাসপাতালের সেবার মান উন্নত করার জন্যই কাজ করছি না। বরং সিঙ্গাপুর এবং থাইল্যান্ডের চিকিৎসা সেবা এখানে নিশ্চিত করতে চাই। সেই জন্য এখানে সকল চিকিৎসক-কর্মকর্তা-কর্মচারি নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। ’

(ঢাকাটাইমস/০২ জুলাই/এমএম/এএ/এআর/ ঘ.)