logo ০১ মে ২০২৫
নিষিদ্ধ কোচিং বাণিজ্য চলছেই
মহিউদ্দন মাহী, ঢাকাটাইমস
১৬ জুলাই, ২০১৪ ০০:০৭:৫৭
image


ঢাকা: সানজিদা হক তৃষা। রাজধানীর উদয়ন স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। সে তার স্কুলের শিক্ষককের কাছেই গণিত এবং ইংরেজি কোচিং করেন। ক্লাসের বাইরে তাকে কোচিং করতে হচ্ছে। তাকে কোচিং করতে বাধ্য করা হচ্ছে কি না জানতে চাইলে ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তৃষা বলেন, ‘ক্লাসে যা পড়ায় তাতে হয় না। কোচিং তো করতেই হয়। তার কথায় বোঝা গেল সে নিজ থেকেই কোচিংকে প্রাধান্য দিচ্ছে। তার মনোভাব এমন- ক্লাশ যেন ঐচ্ছিক কোন বিষয়। কোচিংই মূখ্য।তৃষার অভিভাবকের মুখেও একই কথা। সিতারা পাারভিন নামে তৃষার অভিভাবক জানান, ‘মেয়াটাকে ভাল রেজাল্ট করতে হলে কোচিং করাতেই হবে। ক্লাশে যে পড়া হয় তাতে ভাল রেজাল্ট করা যায় না।’ কোচিংয়ের পক্ষে এভাবেই যেন শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের মনোজগত নিবিষ্ঠ।

নিজ স্কুলের শিক্ষার্থীদের তো কোচিং পড়ানো নিষেধ এমন প্রশ্নের জবাবে ঐ অভিভাবক বলেন, ‘সরকার তো নিয়ম করতে পারবে। আমার সন্তানের কি ভাল রেজাল্ট দিতে পারবে? ক্লাশে ছেলে-মেয়ারা পড়া ভাল করে বুঝে না। তাই কোচিং করাতে হয়। এটা বন্ধ করলেও লাভ নাই। ছেলে-মেয়ে আমাদের। চিন্তা আমাদের। সরকারের তো কোনো মাথাব্যাথা নেই।

এভাবেই কোচিংয়ের পক্ষে সাফাই গাইছেন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। শিক্ষকরা তো এর সাথে জড়িত আছেনই। তবে তাদের ভাষ্য হচ্ছে- আমরা পড়াতে না চাইলেও শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা চাপ দেন। তাই অনেক সময় পড়াতে বাধ্যই হন তারা।

ঐ স্কুলেরই নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইংরেজি বিভাগের এক শিক্ষক ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘কোচিং নিয়ে সরকার যে নীতিমালা প্রকাশ করেছে সেটা মানা কঠিন। কারণ নীতিমালায় বলা হয়েছে, নিজ স্কুলের শিক্ষার্থীদের পড়ানো যাবে না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে নিজ স্কুলের শিক্ষার্থীদের না পড়িয়ে পারছি না। অনেক সময় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের চাপে পড়াতে বাধ্য হতে হয়। নিজ স্কুলের শিক্ষক ছাড়া অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কাছে শিক্ষার্থীরা পড়তে চায় না।

২০১২ সালের ২০ জুন মাসে কোচিং বাণিজ্য বন্ধের নীতিমালার প্রজ্ঞাপন জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এরপর ওই বছরের ২৫ জুন নীতিমালায় একটি সংশোধনী আনা হয়। এতে সব বিষয়ের জন্য স্কুলভিত্তিক কোচিং ফি সর্বোচ্চ ১ হাজার ২০০ টাকা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়।

নীতিমালায় বলা আছে, সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা নিজ প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের কোচিং বা প্রাইভেট পড়াতে পারবেন না। তবে তারা নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-প্রধানের অনুমতিসাপেক্ষে অন্য স্কুল, কলেজ ও সমমানের প্রতিষ্ঠানে দিনে সর্বোচ্চ ১০ জন শিক্ষার্থীকে নিজ বাসায় পড়াতে পারবেন। কোনো কোচিং সেন্টারের নামে বাসা ভাড়া নিয়েও কোচিং বাণিজ্য পরিচালনা করা যাবে না।

তবে নীতিমালা বাস্তবায়ন নিয়ে শিক্ষা প্রশাসনের বিরুদ্ধে ব্যর্থতার অভিযোগও রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোচিং বন্ধে নীতিমালা ঘোষণা করলেও তা বাস্তয়নে যেভাবে পদক্ষেপ নেয়ার কথা ছিল তা নিতে পারেনি শিক্ষা প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘কোচিং বাণিজ্য বন্ধে নীতিমালা করা হয়েছে। অনেক শিক্ষকের এমপিও বন্ধ হয়ে গেছে। আগে যেসব শিক্ষক অধিক হারে কোচিং করাতেন তারা কোচিং করানো অনেকটা বন্ধ করেছেন। সবকিছুই একদিনে সম্ভব নয়। তবে কোচিং নিয়ে মন্ত্রণালয় একটা নাড়া দিয়ে এই পর্যায়ে এনেছে। কোচিং বন্ধে অভিভাবকদেরও ভূমিকা থাকতে হবে। শিক্ষার ধারা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কোচিং বাণিজ্য আর থাকবে না। সেই আধুনিক ধারা তৈরি করা হয়েছে।

মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক অধ্যাপক ফাহিমা খাতুন ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘কোচিং বাণিজ্য বন্ধে শিক্ষা প্রশাসন অত্যন্ত আন্তরিক। এ লক্ষ্যে কাজ চলছে। তবে একসাথে তো সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে না। এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া।’  

তবে শিক্ষাবিদরা বলছেন, কোচিং বন্ধে সরকারের যেমন কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। তেমনি শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মনোজগতে পরিবর্তন আনতে হবে। আর শিক্ষকদের হতে হবে দায়িত্বশীল। শিক্ষকরা যদি শ্রেণি কক্ষে নিজেদের উজার করে দিয়ে শিক্ষার্থীদের পড়ান তাহলে তাদের তো আর কোচিং এর জন্য অপেক্ষায় থাকতে হয় না। সেই বিষয়টির দিকে শিক্ষকদের মনোনিবেশ করতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘কোচিং বাণিজ্য রোধে শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবকসহ সব মহলকেই সচেতন হবে হবে। আইন করে এটা রোধ করা যাবে না। কোচিং ্এর নেতিবাচক দিকগুলো জনসম্মুখে তুলে ধরতে হবে। তাহলে অনেকেই সচেতন হবে বলে মনে করি।  ’

একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘কোচিং বাণিজ্য আইন করে বন্ধ করা যাবে না। এটাকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। শিক্ষকদের নৈতিক দিক থেকে আর বেশি শক্তিশালি হওয়া দরকার। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মানসিকতায় পরিবর্তন আনতে হবে। অন্যথায় এই সমস্যা থেকে উত্তোরণের উপায় নেই।’

শিক্ষা প্রশাসনের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে কোচিং বাণিজ্য বন্ধে যথাযথ পদক্ষেপ না নেওয়া। কোচিং বাণিজ্য ঠেকাতে নীতিমালা প্রণয়নের দীর্ঘদিন পার হলেও শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা নীতিমালা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়েছেন। বরং নীতিমালার নামে কাগজে-কলমে কিছু সুপারিশের মাধ্যমে শিক্ষকদের কোচিং ব্যবসা আরও বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কোচিংবাজদের দমনে গঠন করা হয়নি বিশেষ কোনো মনিটরিং কমিটি। ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভেতরে ও বাইরে কোচিং বাণিজ্য শুধু বাড়েনি বরং বেড়ছে কোচিং ফিও।

কোচিং ব্যবসায়ী শিক্ষকদের তালিকা তৈরি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে কারণ দর্শানোর নোটিস দেওয়া হলেও তা আমলে নিচ্ছে না সংশ্লিষ্টরা। অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শ্রেণি কক্ষে ভাল পড়া-লেখা হয় না। তাই কোচিং সেন্টার কিংবা শ্রেণিশিক্ষকদের বাড়িতে ছেলে-মেয়েদের প্রাইভেট পড়াতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। শিক্ষা প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সন্তানরাও নিয়মিত যাচ্ছে কোচিং সেন্টারে। বাড়তি যতেœর দোহাই দিয়ে কর্মকর্তাদের সন্তানদেরও কোচিং সেন্টারে সাইনবোর্ড হিসেবে ব্যবহার করছে সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে, কোচিং বাণিজ্য বন্ধের নীতিমালা নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে শুরু হয়েছে পরস্পরকে ঘায়েল করার তৎপরতা। অনেক শিক্ষক নিজে কোচিং বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত থেকেও অন্য শিক্ষকদের কোচিংবাজ আখ্যায়িত করে তাদের বিরুদ্ধে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরে (মাউশি) লিখিত অভিযোগ করেছেন বলে জানা গেছে। শিক্ষা প্রশাসনও এসব অভিযোগ খতিয়ে না দেখে অভিযোগকারী শিক্ষককের কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে ঢালাওভাবে অভিযুক্ত শিক্ষকদের কারণ দর্শানোর নোটিস পাঠাচ্ছে।

মাউশি সূত্রে জানা গেছে, মন্ত্রণালয় এবং মাউশির কিছু অসাধু শিক্ষক এই ধরনের কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত। কোচিং ব্যবসায় জড়িত এমন অনেক শিক্ষকদের বিভিন্নভাবে ‘ফাপ্পর’ দিয়ে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। আমার অনেক ভাল শিক্ষককে ফাঁসিয়ে দিচ্ছে।  

(ঢাকাটাইমস/১৫ জুলাই /এমএম/ এআর/ ঘ.)