ঢাকা: আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ও ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি একেএম এনামুল হক শামীম হত্যা চেষ্টা মামলায় স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান হান্নান ফিরোজ রিমান্ড শেষে এখন কারাগারে রয়েছেন। এ ঘটনায় এ পর্যন্ত পাঁচ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। তারা আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছেন। কিন্তু রহস্য উন্মোচন হচ্ছে না।
তবে পুলিশের একটি সূত্র বলছে, স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে হানান ফিরোজের সাথে দ্বন্দ¦কে কেন্দ্র করে শামীমের উপর হামলা হয়েছে। সেই জন্যই হান্নান ফিরোজকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। অন্যদিকে শামীম বলেছে, ‘আমি তো হান্নান ফিরোজের নামে মামলা করিনি। তাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। এটি পুলিশের বিষয়।’
একইভাবে হান্নান ফিরোজের বড় মেয়ে ও ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ফারাহ নাজ ফিরোজ ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকানা নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব নেই। শামীম “কাকার” সাথে আমাদের পরিবারিক সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। সুতরাং তার উপর হামলার প্রশ্নই আসে না।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের সন্দেহ হচ্ছে তৃতীয় পক্ষ আমার বাবাকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করছে। তারা বাবাকে ফাঁসাতে চাইছে। ১২ আগস্ট আমার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। বাবা বিয়ে নিয়েই বেশি ব্যস্ত ছিলেন। সেখানে কি করে বাবা একজন মানুষকে হত্যার ষড়যন্ত্র করতে পারে। এখন বাবা জেলে। আমার বিয়েটাও অনিশ্চিত হয়ে গেল।’
ফারাহ নাজ বলেন, ‘বাবা একজন শিক্ষাবিদ। তিনি একেবারেই সাধারণ একজন মানুষ। তার কোনো শত্রু নেই। কেন তাকে এভাবে জেলে যেতে হল বিষয়টি বোধগম্য নয়।’ তবে এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে তৃতীয় কোনো পক্ষ হান্নান ফিরোজকে ষড়যন্ত্র করে ফাঁসাতে পারে এমনটিই তাদের বদ্ধমূল ধারণা।
আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ও ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি একেএম এনামুল হক শামীম ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘আমি আসলে বেশি কিছু বলতে পারবো না। আমি তো আর হান্নান ফিরোজের নাম বলিনি। এটা পুলিশের বিষয় তারা বিষয়টি দেখতেছে।’
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ পরিদর্শক শামসুদ্দিন সালেহ আহমেদ চৌধুরী ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘মামলায় তদন্ত কাজ চলছে। এখন পর্যন্ত পাঁচজন আসামি ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে।’ এর বেশি কিছু তিনি জানেন না বলে জানান তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সূত্র জানায়, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য সংখ্যা ১৩। এর মধ্যে হান্নান ফিরোজ, স্ত্রী ও কন্যাসহ এ বোর্ডে রয়েছে ৯ জন সদস্য। আর এনামুল হক শামীম, তার স্ত্রী ও বোনসহ তার পরিবারের রয়েছে ৪ জন সদস্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে দু’টি ক্যাম্পাস। একটি ধানমন্ডিতে। অপরটি সিদ্ধেশ্বরীতে। আর রয়েছে একাধিক শাখা ক্যাম্পাস। প্রতিষ্ঠানটিতে রয়েছে প্রায় সাড়ে ১১ হাজার শিক্ষার্থী।
বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠাতা ড. হান্নান ফিরোজ পুলিশের কাছে স্বীকার করেছেন ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যরা প্রতি মাসে আড়াই লাখ টাকা করে বেতন নেন। অথচ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী ট্রাস্টি সদস্যরা কোন অর্থনৈতিক সুবিধা নিতে পারবেন না। তবে সভা সেমিনারে অংশ নিলে তারা নির্ধারিত একটা সুবিধা নিতে পারবেন। ইউজিসি সূত্র জানায় প্রতি সভায় অংশ নেয়ার জন্য ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা পেতে পারেন।
ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. একে আজাদ চৌধুরী বলেন, ‘ট্রাস্টি সদস্যরা কোন অর্থনৈতিক সুবিধা নিতে পারবেন না। তিনি বলেন, প্রতি মাসে আড়াই লাখ টাকা নেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। এটা হয়ে থাকলে নিশ্চয়ই অনিয়ম।’
গত ১৯ জুন ধানমন্ডির নিজ বাসা থেকে বের হওয়ার সময় ইবনে সিনা হাসপাতালের গলিতে দুর্বৃত্তের হামলার শিকার হন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য একে এম এনামুল হক শামীম। মোটর সাইকেল আরোহী দুর্বৃত্তদের গুলি তার হাতে লাগে। শামীম গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরদিন তার চাচা নাসির উদ্দিন বাদী হয়ে ধানমন্ডি থানায় একটি মামলা করেন। তাতে হান্নান ফিরোজ বা কারও নাম ছিল না। ঘটনার পর থেকেই র্যাব-পুলিশ তদন্তে নামে। শামীমকে গুলি করার অভিযোগে গত ৭ই জুলাই র্যাব বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে হারুন, মেহেদী, মনির ও জুয়েল নামের চারজনকে গ্রেপ্তার করে।
এদের মধ্যে হারুন ও মেহেদী মোটরসাইকেল আরোহী তিন দুর্বৃত্তের দু’জন। দু’দিন পর ৯ জুলাই মোটরসাইকেল আরোহী অপর একজন রানা হাওলাদার, নাজিমুল হক মিঠু ও নূরে আলম সিদ্দিকী নামে আরও দু’জনকে গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশ। কয়েক দফা রিমান্ড শেষে ১৫ই জুলাই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয় রানা। ওই স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে রানা বলে, শামীমকে হত্যাচেষ্টার মূল পরিকল্পনাকারী স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান হান্নান ফিরোজ। শামীমকে হত্যার জন্য তিনি মিঠুকে দায়িত্ব দেন। এ জন্য ৬ লাখ টাকাও দেন। মিঠু তার সঙ্গে যোগাযোগ করলে সে মোটরসাইকেল কেনাসহ পেশাদার কিলার ভাড়া করে। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে রানা বলেছে, হান্নান ফিরোজের পরিকল্পনা ও মিঠুর কথামতো তারা এ কাজ করেছে।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, নাজিমুল হক মিঠু হলো হান্নান ফিরোজের মালিকানাধীন ‘বাংলাদেশ সময়’-এর প্রশাসনিক কর্মকর্তা। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, রানার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি ও অন্য কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদে হান্নান ফিরোজের নাম আসে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১৬ই জুলাই হান্নান ফিরোজকে ভোরে তার ধানমন্ডির ৯/এ’র বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
একেএম এনামুল হক শামীম একটি ব্যাংকের পরিচালক থাকাকালে ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য হন। বর্তমানে শামীম ছাড়াও তার স্ত্রী তাহমিনা খাতুন, বোন শামীম আরা হক কাকলী ও শামীমের আত্মীয় জাকির হোসেন ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য। শামীম ইউনিভার্সিটিতে নিয়মিত অফিস করলেও অন্যরা একেবারেই অনিয়মিত। কিন্তু প্রতি মাসে তারা নিয়ে নেন কাগজে-কলমে আড়াই লাখ টাকা। এর বাইরে তো আছেই। এছাড়া শামীম ডিসিপ্লিন বোর্ডের সভাপতি। হান্নান ফিরোজের পর শামীমের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। অন্যদিকে হান্নান ফিরোজ ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান।
এর বাইরে তার স্ত্রী ফাতিনাজ ফিরোজ, ছোট ভাই মাহবুব আলম জাকির, বড় মেয়ে ফারাহ নাজ ফিরোজ, ছোট মেয়ে জারাহ নাজ ফিরোজ, শ্যালক তালাল রহমান, ছোট ভাই মনিরুজ্জামান মনির, চাচা সেলিম হোসেন চৌধুরী ও ছোট বোন রুমানা হক রিতা ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় আসায় শামীমের আধিপত্য বাড়তে থাকে ক্যাম্পাসে। তিনি রাজনীতি করলেও ক্যাম্পাসে যাতায়াত ছিল নিয়মিত।
মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার (ডিসি-দক্ষিণ) কৃষ্ণপদ রায় বলেন, গ্রেপ্তারকৃত একজনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে হান্নান ফিরোজের নাম আসায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আমরা ঘটনার রহস্য উদঘাটনের চেষ্টা করছি। ইউনিভার্সিটির ব্যবস্থাপনা নিয়ে তাদের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ¦ ছিল। তদন্ত শেষ হলেই সব কিছু বলা যাবে।
ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এম.এ হান্নান ফিরোজের স্ত্রী ও ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ফাতিনাজ ফিরোজ ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, শামীমের সঙ্গে আমাদের পারিবারিক কোন দ্বন্দ্ব নেই। তিনিই শামীমকে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে এসেছেন। কথিত অভিযোগের ভিত্তিতে শামীমের হত্যাচেষ্টার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে বয়স্ক একজন মানুষকে বারবার রিমান্ডে নেয়ার বিষয়টি দুঃখজনক। আমি আমার স্বামীর নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করছি।’
(ঢাকাটাইমস/২৯ জুলাই/এমএম/ এআর/ ঘ.)