ঢাকা: ঘটনার পর পেরিয়ে গেছে প্রায় চার মাস, এরই মধ্যে জানা গেছে অনেক তথ্য। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছে বেশ কজন। তাহলে প্রতিবেদন দেওয়া হচ্ছে না কেন, বিচার শুরু হতে আর কত দেরি, সে প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে স্বজনহারাদের মনে। অতীতের নানা ঘটনায় তাদের মনে নানা সংশয়। পার পেয়ে যাবে না তো আবার খুনিরা?
২৭ এপ্রিল প্রকাশ্য রাজপথ থেকে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজনকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর থেকেই ঘটনার জন্য আরেক কাউন্সিলর নূর হোসেন এবং র্যাবকে দায়ী করে আসছে ভুক্তভোগীদের পরিবার। প্রাথমিক তদন্ত শেষে নারায়ণগঞ্জ র্যাবের সে সময়ের অধিনায়ক তারেক সাঈদ মোহাম্মদ ও দুই কর্মকর্তা এম এম রানা এবং আরিফ হোসেনকে চাকরিচ্যুত করা হয়। দফায় দফায় রিমান্ড শেষে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দেন তিনজন। এক মাসেরও বেশি সময় পলাতক থাকার পর কলকাতায় আটক হয়েছেন নূর হোসেনও। অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগে সেখানে বিচার চলছে তার।
ঘটনার তদন্ত করছে একাধিক সংস্থা। পুলিশি তদন্তের পাশাপাশি হাইকোর্টের নির্দেশে তদন্ত করছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একটি কমিটিও। কিন্তু নূর হোসেনের জবানবন্দি না পাওয়া পর্যন্ত প্রতিবেদন দেওয়া যাবে কি না তা নিয়ে তৈরি হয়েছে সংশয়। যদিও পুলিশ বলছে, নূর হোসেনের বক্তব্য ছাড়াও অভিযোগপত্র দিতে নেই আইনি কোনো বাধা।
নূর হোসেনকে দেশে ফিরিয়ে আনতে ভারতের সঙ্গে এরই মধ্যে যোগাযোগ করেছে সরকার। কিন্তু আইনি জটিলতার কারণে সহসাই তাকে দেশে ফেরানো যাবে এমনটি মনে করছে না পুলিশ প্রশাসন। এই বিষয়টিই ভাবিয়ে তুলছে নজরুল ইসলামের স্ত্রী ও মামলার বাদী সেলিনা ইসলাম বিউটিকে।
ঢাকাটাইমসকে বিউটি বলেন, ‘এখনো নূর হোসেনকে দেশে ফিরিয়ে না আনায় আমাদের মধ্যে হতাশা কাজ করছে। আমরা সরকারের কাছে বার বার অনুরোধ করেছি। কিন্তু সরকার এখনো আনতে পারেনি।’ তিনি বলেন, ‘আমার বিশ্বাস সরকার শক্ত পদক্ষেপ নিলে নূর হোসেনকে দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
পুলিশের তদন্তের গতি নিয়েও সন্তুষ্ট নয় স্বজনহারারা। সেলিনা ইসলাম বিউটি বলেন, ‘ঘটনার সঙ্গে কারা জড়িত সেটিও মোটামুটি নিশ্চিত। এ সম্পর্কে র্যাবের তিন কর্মকর্তার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও আছে। কিন্তু তারপরও তদন্ত শেষ হচ্ছে না কেন?’
পুলিশের সূত্রগুলো বলছে, তদন্ত অনেকদূর এগোলেও নূর হোসেনের বক্তব্য ছাড়া প্রতিবেদন দেওয়ার সম্ভাবনা কম। এই আসামিকে দেশে ফিরিয়ে আনা অথবা ভারতে গিয়ে তার বক্তব্য পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষার বিষয়ে ভাবছেন এ বাহিনীর কর্মকর্তারা।
জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার খন্দকার মহিদ উদ্দিন ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘সাত খুনের মামলার তদন্তে এ পর্যন্ত যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। অগ্রগতির সবটুকু মামলা তদন্তের স্বার্থে এ মুহূর্তে গণমাধ্যমে প্রকাশ করা যাবে না। প্রধান আসামি নূর হোসেনকে দেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া চলছে। এটি একটি স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ মামলা। তাই ব্যাপক তদন্ত প্রয়োজন।’
নূর হোসেনের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘নূর হোসেনকে ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা চলছে। আমরা বেশ আশাবাদী। এ বিষয়ে সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে।’
আদালতে জবানবন্দি
সাত খুনের মামলার দায় স্বীকার করে এরই মধ্যে নারায়ণগঞ্জ আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন র্যাবের সাবেক তিন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তারেক সাঈদ মোহাম্মাদ, আরিফ হোসেন এবং এম এম রানা। সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দিয়েছেন আরও ৯ জন। তবে আরও তদন্তের প্রয়োজন বলে দাবি করছে পুলিশ।
ঘটনায় র্যাবের সম্পৃক্ততা খুঁজে বের করতে কাজ করছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের আরেকটি তদন্ত কমিটিও। কমিটি এরই মধ্যে ঘটনাস্থল পরিদর্শন, প্রত্যক্ষদর্শী, স্বজনহারাসহ অনেকের সঙ্গে কথা বলেছে। গণশুনানিও করেছে তারা। নারায়ণগঞ্জের সংসদ সদস্য শামীম ওসমান, সিটি মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী, র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসানসহ এ বাহিনীর ঊর্ধ্বতন বেশ কজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছেন।
তদন্ত কর্মকর্তা ও জেলা গোয়েন্দা শাখার পরিদর্শক মামুনুর রশিদ বলেন, এ মামলার অভিযোগপত্র দেওয়ার মতো যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ তাদের হাতে এসেছে। বিশেষ করে র্যাব-১১ সাবেক দুই কর্মকর্তা আরিফ হোসেন ও এম এম রানার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি ধরে তদন্ত চালিয়ে খুনের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছেন তারা। তবে অভিযোগপত্র দেওয়ার ক্ষেত্রে নূর হোসেনের জন্য অপেক্ষা করবেন তারা। তবে এই তদন্তের বিষয়ে গণমাধ্যমের কাছে মুখ খুলতে নারাজ তদন্ত কমিটির প্রধান শাহজাহান আলী মোল্লা।
সন্দেহের তালিকায় র্যাবের আরও ২৩ জন
পুলিশ এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির সূত্র জানিয়েছে, সাত খুনের ঘটনায় জড়িত বা ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন র্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তা ছাড়াও নাম এসেছে আরও ২৩ জনের। এরা সবাই র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নÑর্যাব-১১ সদস্য। এদের সবাইকেই জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। এদের ১৮ জনকে আসামি করা হতে পারে। অন্যরা এ মামলার সাক্ষী হতে পারেন।
এই ২৩ র্যাব সদস্য হলেনÑ নারায়ণগঞ্জ র্যাবে কর্মরত পুলিশ পরিদর্শক (ডিএডি) আবদুস ছালাম শিকদার, নৌবাহিনীর এলএস আবদুস সামাদ, এসআই পলাশ গোলদার, নায়েক নাজিম উদ্দিন, নায়েক আবদুর রাজ্জাক, সিপাই আজম আলী, কনস্টেবল মিজানুর রহমান, এসআই পূর্ণেন্দু বালাম, নায়েক দেলোয়ার হোসেন, নায়েক নাজিম উদ্দিন, ল্যান্স নায়েক হিরা মিয়া, হাবিলদার ইমদাদুল হক, সিপাই আবু তৈয়ব আলী, কনস্টেবল শিহাব উদ্দিন, সৈনিক আবদুল আলিম, ল্যান্স নায়েক বেলাল, সৈনিক মহিউদ্দিন মুন্সি, ডিএডি সালাম শিকদার, করপোরাল মোহাম্মাদ মোখলেস, ল্যান্স করপোরাল রুহুল আমিন, এলএস আবদুস সামাদ, সিপাই আজম আলী ও কনস্টেবল মিজানুর রহমান।
এদের মধ্যে পরিদর্শক ছালাম শিকদার ও আবদুস সামাদ ছাড়া অন্য সবাইকে এ ঘটনার পর র্যাব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে এই র্যাব সদস্যদের সবাইকে আসামি করা হবে না। কারণ তাদের বেশির ভাগই নিজ বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নির্দেশ অনুসরণ করেছেন। ইতোমধ্যে চারজনের জবানবন্দিও নেওয়া হয়েছে।
পুলিশ জানিয়েছে, তিন র্যাব কর্মকর্তার স্বীকারোক্তি, প্রত্যক্ষদর্শী, নূর হোসেনের দেহরক্ষী ও ঘনিষ্ঠজনদের স্বীকারোক্তিতে এখন পর্যন্ত ২৬ র্যাব সদস্যসহ ৩৮ জনের নাম এসেছে। এই তালিকায় বিভিন্ন দলের নেতা-কর্মী, নারায়ণগঞ্জের পুলিশ-প্রশাসনের কর্মকর্তা ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য আছেন। এই তালিকা যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।
তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্র আরও জানায়, নূর হোসেনের সাত সহযোগীর মধ্যে আলী মোহাম্মদ ও মোহাম্মদ চার্চিল নামের দুইজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। নূর হোসেনের সঙ্গে তার প্রধান সহযোগী সেলিম কলকাতায় ধরা পড়েছেন। অন্যরা গা-ঢাকা দিয়েছেন।
জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, আলোচিত এই হত্যার ঘটনায় এখন পর্যন্ত পুলিশ ১৫ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। এদের মধ্যে র্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তা ছাড়াও নূর হোসেনের সহযোগী চার্চিল ও আলী মোহাম্মদ ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। আর অপহরণ ও খুনের প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী হিসেবে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন ৯ জন। এরা হলেনÑ পথচারী শহীদুল, তার মেয়ে রাবেয়া আক্তার, শাহীনুল ইসলাম, র্যাব সদস্য আবদুস সামাদ, আবদুস সালাম, আবদুর রাজ্জাক, আলী আজম, এএসপি শাহরিয়ার আলম ও নায়েক নাজিমউদ্দিন।
যেভাবে খুন
র্যাব-১১ সাবেক তিন কর্মকর্তার জবানবন্দি পর্যালোচনা করে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে, নারায়ণগঞ্জ থেকে নজরুল ইসলাম, আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজনকে অপহরণের পর সারা দিন তাদের গাড়িতে রাখেন ওই কর্মকর্তারা। আরিফ প্রথমে এদের সবাইকে নরসিংদী ক্যাম্পে নিয়ে আটক রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেখানকার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এদের রাখতে অপারগতা জানিয়েছিলেন। এরপর নরসিংদীর শিববাড়ি এলাকায় রাস্তার পাশে একটি নির্জন স্থানে তাদের রাখা হয়। অপহরণকারীরা রাস্তার পাশে বসে দুপুরের খাবারও খান। রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত তারা এদিক-সেদিক ঘোরাফেরা করেন। এরপর সাতজনকে নিয়ে আসেন কাঁচপুর সেতুর নিচে বিআইডব্লিউটিএর একটি ঘাটের কাছে। ওই ঘাটটি নূর হোসেন নিয়ন্ত্রণ করতেন। রাত ১২টার দিকে ওই ঘাট থেকে সবাইকে নৌকায় তোলা হয়।
পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে এক সেনাসদস্য তদন্তকারী কর্মকর্তাকে বলেন, আরিফ হোসেন অপহরণের পর থেকে নূর হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলেন। কাঁচপুর সেতুর নিচে আগে থেকে একটি নৌকাসহ তার লোকজন অপেক্ষা করছিলেন। এর আগে নারায়ণগঞ্জের ১ নম্বর ঘাট থেকে র্যাবের নৌকাটি সেখানে আনা হয়। এরপর দুটি নৌকায় সাতজনের মৃতদেহ তোলা হয়।
তদন্ত কর্মকর্তা বলেছেন, শুধু জবানবন্দিকেই প্রমাণ হিসেবে না ধরে ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর প্রমাণ নিশ্চিত করা হয়েছে, যেন আদালতে আসামিরা জবানবন্দি অস্বীকার করলে বিচারকের কাছে তথ্য-প্রমাণ হাজির করা যায়। এ কারণে তারা র্যাব কর্মকর্তাদের বক্তব্যের ভিডিও ধারণ করেছেন।
ওই ঘটনার পর নিহত নজরুলের শ্বশুর শহিদুল ইসলাম এ ঘটনার জন্য ৬ কোটি টাকা ঘুষ নেওয়ার যে দাবি করেছেন, এর কোনো প্রমাণ পাননি তদন্ত কর্মকর্তারা। শহিদুল ইসলাম এ নিয়ে এখন আর কোনো কথা বলতে চান না।
(ঢাকাটাইমস/ ২৩আগস্ট/ এমএম/ জেডএ.)